১৩

শুধু সতর্ক হইল বলা ঠিক হইবে না। মীরার মূর্তিও গেল বদলাইয়া।

আমিও সতর্ক হইয়া গেলাম; কিন্তু শেষরক্ষণ যে করিতে পারি নাই সেটা এই প্রসঙ্গের উপসংহারে টের পাওয়া যাইবে।

পরিবর্তনের প্রথম তো এই দেখা গেল যে মীরা আরও সহজভাবে কথা কহিতে আরম্ভ করিল, বরং একটু বেশি করিয়াই। সরমার বা হাতটা দুই হাতে তুলিয়া ধরিয়া বলিল, “এবার চল সরমাদি একটু ওদিকে, শচী তোমায় খুঁজছিলও, মা এস।”

আমি সতর্ক ছিলামই। আমি এখানে আসিয়াছি তরুকে পড়ানর কাজ লইয়া, আর একটা কাজ প্রকৃতির খেয়ালে আমার উপরে আসিয়া পড়িয়াছে, মীরাকে পড়া। আমি এর অন্তস্থল পর্যন্ত ভালভাবে পড়িয়া ফেলিয়াছি। মীরা জেদী মেয়ে, আমার মুখে সরমার প্রশংসাটা ওর কটু লাগিয়াছে। বেশ বুঝিলাম আমায় না ডাকিবার জন্যই মীরা উহাদের দুইজনকে এত ঘটা করিয়া ডাকিতেছে। আঘাতটা কাটাইবার জন্য আমি তখনই চায়ের কেট্‌লিটা তুলিয়া নিজের কাজে লাগিয়া গেলাম। মীরা মনে মনে বোধ হয় একটা কুটিল হাস্য করিয়া থাকিবে; নিজের পরাজয়টা বুঝিয়া তখনই অস্ত্র পরিবর্তন করিল, দুই পা গিয়াই গ্রীবা বাঁকাইয়া একটু বিস্মিতভাবে বলিল, “বাঃ আপনিও আসুন শৈলেনবাবু।”

অপর্ণা দেবী বলিলেন, “ও-বেচারি চা-টা ঢালছে; খেয়ে নিয়েই না হয় আসবে; এইখানেই তো আছি আমরা।”

মীরা বলিল, “বাঃ, বাড়ির লোক উনি, নিজের চা নিয়েই ব্যস্ত থাকবেন? একটু দেখতে-শুনতে হবে না সবাইদের?”

মিস্টার রায় অন্য একটি ভদ্রলোকের সঙ্গে বেড়াইতে বেড়াইতে আসিয়া পড়িলেন, মীরার শেষ কথাটারই প্রতিধ্বনি করিয়া বলিলেন, “হ্যাঁ, একটু দেখ-শোনগে সবাই তোমরা, সার্ভিটা ঠিক হচ্ছে কিনা।”

তাহার পর সরমার মাথায় হাত দিয়া তাহার মুখটা নিজের দিকে ফিরাইয়া লইয়া বলিলেন, “তুমি আরও রোগা হ’য়ে গেছ সরমা মাঈ—You are killing yourself by inches; no…” (তুমি তিল তিল ক’রে নিজেকে হত্যা করছ। ঠিক নয়…)!”

সরমা যেন অতিমাত্র সংকুচিত হইয়া গেল। মিস্টার রায় বিশেষ করিয়া যেন তাহাকেই বলিলেন, “যাও, দেখ-শোনগে সব। এবারে এদের স্ট্রিং-কন্‌সার্টটা বেশ ভাল হয়েছে, যে ছোকরা ব্যাঞ্জো ধরেছে তার হাতটি চমৎকার নয় কি?…হ্যাল্লো!”

অভিমতের সমর্থনের অপেক্ষা না করিয়াই অন্য একজনকে উদ্দেশ্য করিয়া চলিয়া গেলেন।

মীরা আবার আমার ডাক দিল, “আসুন শৈলেনবাবু।”

অপর্ণা দেবীও বলিলেন, “এস শৈলেন, ও ছাড়বার পাত্রী নয়।”

মেয়ে-পুরুষে-শিশুতে প্রায় এক শতেরও অধিক লোক। সমস্ত বাগানটাতে, গাড়ি বারান্দার সামনে গোল ঘাস-জমিটাতে ছোট-বড় টেবিল পাতা। কোথাও দুইটা, কোথাও বা ততোধিক চেয়ার দেওয়া। সুবিধামত বসিয়া আহারের সঙ্গে সবাই গল্পগুজব করিতেছে; জিজ্ঞাসাবাদ করিয়া ঘুরিয়া বেড়াইতে লাগিলাম। অবশ্য জিজ্ঞাসাবাদ বেশির ভাগ করিল মীরাই, তাহার পর অপর্ণা দেবী, সরমা নমস্কার করিয়া প্রয়োজনমত এক-আধটা প্রশ্ন করিল বা উত্তর দিল, আমি একেবারেই রহিলাম নীরব।

একবার রাস্তার পাশের দেওয়ালের দিকটায় নজর পড়িল। দেখি গেট থেকে আরও একটু সরিয়া ইমানুল, ক্লীনার মদন এবং অন্য গাড়িরও কয়েকজন ড্রাইভার দাঁড়াইয়া আছে, তামাসা দেখিতেছে। একটু দূরে, গেটের ওদিকটায় একটা ঝাড়ুদার মেথর, তাহার ঠিক পিছন দিকে একটা ঝুড়ি, উচ্ছিষ্ট সঞ্চয়ের জন্য একটু লুব্ধ দৃষ্টিতে দাঁড়াইয়া আছে। ইমানুলকে চিনিতে একটু বেগ পাইতে হইল, সে একটা ঝলঝলে সুট পরিয়া একটু আড়াল দেখিয়া দাঁড়াইয়া আছে।

ইমানুল হঠাৎ কোটপ্যাণ্ট পরিল কেন? এই রকম একটা দিনে কি ওর বেশি করিয়া মনে পড়িয়া যায় যে ও লাট সাহেবের সমধর্মী? সেই দিকে চাহিয়া চিন্তা করিতেছি, এমন সময়—“এই যে, আপনারা এখানে? নমস্কার” —বলিয়া একটি যুবক আমাদের দলের সামনে আসিয়া দাঁড়াইল।

অপর্ণা দেবী বলিলেন, “এই যে নিশীথ, কোথায় ছিলে এতক্ষণ!”

নিশীথের পরনে নিখুঁত কায়দামাফিক ইভনিং-সুট, বাঁ-হাতে হরিণের শিঙের মুঠি লাগানো একটি চেরির ছড়ি, ডান হাতে একটা পাইপ। গায়ের রঙ শ্যামবর্ণ, বয়স সাতাশ-আঠাশ আন্দাজ হইবে।

নিশীথ পাইপে একটা টান দিল, তাহার পর বা হাতের ছড়িটার উপর একটু চাপ দিয়া সেটাকে ধনুকাকার করিয়া বলিল, “আমার আসতে একটু দেরিই হ’য়ে গেছল। প্রথমতঃ কর্নেল ব্রেটের ছেলে গ্লাসগো থেকে লাস্ট মেলে ফিরেছে খবর পেলাম, একটু সন্ধানটন্ধান নিতে গেছলাম। আমরা ক-জনে ওদিকে ঐ টেবিলটাতে বসে আছি! আপনাদের পাকড়াও ক’রে নিয়ে যাবার ভার পড়েছে, আমার ওপর। চলুন।”

বলিয়া নিজের রসিকতায় সাহেবী ধরণের হাস্য করিয়া পাইপে আর একটা টান দিল।

অপর্ণা দেবী বলিলেন, “আমার একটু ঘোরাফেরা দরকার, অন্তত যতক্ষণ পারি। তুমি এঁদের নিয়ে যাও বরং। …ইনি হচ্ছেন তরুর টিউটর, নাম শৈলেন মুখোপাধ্যায়। আর এ আমাদের নিশীথ, শৈলেন; তুমি নিশ্চয় শুনে থাকবে এর সম্বন্ধে।”

অল্প অল্প শুনিয়াছি, দু-একবার দেখিয়াছিও, পরিচয় হয় নাই। একটা আবছা উত্তর দিলাম, “ও, ইনিই?”

নমস্কার করিলাম। নিশীথ আড়চোখে একবার দেখিয়া লইয়া পাইপটা একটু কপালের কাছে তুলিয়া ধরিয়া একটা দায়েঠেকাগোছের প্রতিনমস্কার করিল, তাহার পর কালক্ষেপ না করিয়া মীরার পানে চাহিয়া বলিল, “তাহ’লে আপনারা চলুন মিস রায়, সরমা দেবী আসুন।”

আমার প্রতি ভদ্রতা প্রকাশ করিতে যে অভদ্রতাটা জাহির করিল। সেটা অন্ততঃ অপর্ণা দেবীর দৃষ্টি এড়াইল না, তিনি বলিলেন, “তুমি আমার সঙ্গে এস শৈলেন, আরও কয়েক জনের সঙ্গে তোমার পরিচয় করিয়ে দিই।”

মীরা একটু আবদারের সুরে বলিল, “না মা, ওঁকে আমাদের সঙ্গে আসতে দাও।” নিশীথ সঙ্গে সঙ্গে বলিল, “হ্যাঁ, সেই বেশ হবে, আসুন আপনিও।”

আমি একটু বিমূঢ়ভাবে অপর্ণা দেবীর পানে চাহিলাম। অপর্ণা দেবী হাসিয়া আমাকেই প্রশ্ন করিলেন, “কি করবে?”

তাহার পর সমস্যাটা আমার পক্ষে আরও জটিল করিয়া ফেলিয়াছেন দেখিয়া সেইরূপ ভাবেই আসিয়া বলিলেন, “তাহ’লে যাও ওদের সঙ্গেই, আমি এক্ষুণি ওপরে চলে গেলে তুমি আবার একলা পড়ে যাবে। …সরমাকে ছাড়বে না।”

মীরা সরমার হাতটা জড়াইয়া ধরিয়া বলিল, “না—তোমার ঐ মিসিস সেন আসছেন।”

নিশীথ অযথাই মীরাকে সমর্থন করিয়া বলিল, “বাঃ, ওঁকে কি ক’রে ছাড়ব আমরা।”

অপর্ণা দেবী একবার মুগ্ধ নয়নে সরমার পানে চাহিয়া বলিলেন, “তুমি এক্ষুণি যেন পালিও না সরমা, আর যাবার আগে নিশ্চয় একবার আমার সঙ্গে ওপরের ঘরে দেখা ক’রে যেও; নিশ্চয়। আমি বোধ হয় আর বেশিক্ষণ নীচে থাকতে পারব না।”

মীরা যাইতে যাইতে গ্রীবা ফিরাইয়া বলিল, “পালানো সম্বন্ধে তুমি নিশ্চিত থেক। নিশীথও ঘুরিয়া, দাঁতে পাইপ চাপিয়া প্রতিধ্বনি করিল, “পালানো শক্ত আমাদের কাছ থেকে, সেদিকে আপনার কোন চিন্তা নেই।”

বোধ হয় ভাবিল এ রসিকতাটুকু একেবারে চরম-গোছের হইয়াছে; ধোঁয়া ছাড়িতে ছাড়িতে সাহেবী কায়দায় মৃদু মৃদু হাসিতে লাগিল।