১২

মাস চারেক কাটিয়া গেল। মীরা আমার জীবনকে আচ্ছন্ন করিয়া তুলিতেছে। আমিও কি ধীরে ধীরে প্রবেশ করিতেছি ওর জীবনে? ও আমার লেখা খোঁজে, মাস্টারির অভিনয় কবে তরুকে লইয়া—যখন বোঝে আমি টের পাইয়াছি, হঠাৎ ভারিক্কে হইয়া উঠিয়া মনিবের গুরুতর সম্বন্ধটা মেরামত করিতে লাগিয়া যায়। আকর্ষণ বিকর্ষণের মধ্য দিয়া কি হইতেছে সব সময় ঠিক ধরিতে পারি না, সন্দেহ হয়।

একদিন মিস্টার রায় বাড়িতে একটা পার্টি দিলেন। আমার সময়ে এই প্রথম পার্টি। কারণটা ঠিক মনে পড়িতেছে না, খুব সম্ভব বিশেষ কোন উপলক্ষ্য ছিল না। আমি আসিবার এই মাস চারেকের মধ্যে মীরা চার-পাঁচটি ছোট-বড় পার্টিতে যোগদান করিয়া আসিল দেখিলাম, তাহার মধ্যে তরুর সঙ্গে একটিতে আমিও ছিলাম; সেই সব নিমন্ত্রণের পাল্টা-নিমন্ত্রণ হিসাবে মীরা বোধ হয় পিতাকে রাজি করাইয়া এই বন্দোবস্তুটা করিতেছে। খুব ব্যস্ত!—সাজানর প্ল্যান, মেনুর (খাদ্য তালিকার) নির্ণয়; যন্ত্র সংগীতের জন্য ভবানীপুর হইতে অরকেস্ট্রা ঠিক করা, যাহাদের নিমন্ত্রণ করিতে হইবে তাহাদের তালিকা প্রস্তুত, কার্ড ছাপানো, বিলির বন্দোবস্ত—এই সব লইয়া কয়েকদিন তাহার যেন নিঃশ্বাস ফেলিবার ফুরসত নাই। উৎসাহের দীপ্তি, কর্মচঞ্চলতার কতকটা আলুথালু ভাব এবং তাহারই মাঝে মাঝে একটু ক্লান্তির অবসাদে তাহার এক যেন নূতন রূপ ফুটিয়াছে। মাঝে মাঝে পরামর্শ চায়। আমি এ-সমাজের অল্পই বুঝি, বিশেষ করিয়া পার্টির বিষয় তো আরও কম। বলিলে মীরা বলে, “ও-সব শুনছি না, আপনি গা-ঝাড়া দিতে চান, শৈলেনবাবু। বাবার ফুরসত কম, একবার সেই রাত্তিরে খাবার সময় দেখা হবে, মাকে তো দেখছেনই, দাঁড়ান আপনিও স’রে, আমি দাঁড়িয়ে অপমান হই…।”

মীরা কথাগুলো একটু অভিমানের সুরে বলে। এ কয়দিন থেকে সেই কতকটা দৃপ্ত-মীরা যেন লুপ্ত; মীরা কর্মের মধ্যে কতকটা যেন এলাইয়া গিয়াছে, তাহার চিরন্তনী অসহায় নারী-প্রকৃতিটা স্ফুট হইয়া উঠিয়াছে। আমি অবশ্য তাহারই সাহায্যে তাহাকে পরামর্শ দিই, সে যাহা বলে, কিংবা কোন সময় বলিয়াছে সেই সব কথাই খানিকটা ঘুরাইয়া ফিরাইয়া আমার মন্তব্য জানাই, তাহাতেই সে প্রীত। মীরা এই কয়টি দিনে কর্মব্যস্ততার মধ্যে নিজেকে তুলিয়া তাহার অজ্ঞাতসারেই আমার খুব কাছে আসিয়া পড়িয়াছে। ও বুঝিতেছে না, ফুরসত নাই ওর বুঝিবার, এমন কি পরিবর্ধমান অন্তরঙ্গতার মাঝে কখন “মাস্টারমশাই” ছাড়িয়া যে “শৈলেনবাবু” বলিতে আরম্ভ করিয়া দিয়াছে তাহারও হিসাব নাই বোধ হয় ওর; কিন্তু আমার হিসাব আছে, আমি সমস্ত অন্তর দিয়া বুঝিতেছি; এই লুকোচুরিটুকু যে কত মিষ্ট লাগিতেছে! …মীরা আমায় পাইতেছে না, কিন্তু মীরাকে আমি পাইতেছি।

বলিল, “আপনি নেমন্তন্নটা নতুন ক’রে লিখে দিন না—বাংলায় আজকাল যেমন নতুন কত ধরণে লেখে দেখতে পাই…”

লেখা হইলে মুখের পানে প্রশংসার দৃষ্টিতে চাহিয়া বলিল, “চমৎকার হয়েছে, আমি মাথা খুঁড়লেও পারতুম না। আপনাকে যে কী বকশিস দেব তাই ভাবছি।”

আজ মীরা কি সত্যই এত কাছে? —যেন বিশ্বাস হয় না। আমি আমার যতটকু সীমা ও অধিকার তাহার মধ্যেই একটা শোভন উত্তর খুঁজিতেছিলাম, মীরা হাসিয়া একটু চিন্তিতভাবে ভ্রূ-যুগল কুঁচকাইয়া থাকিয়া বলিল—“হয়েছে–ওর জন্যে কাৰ্ড পছন্দ ছাপানো সব আপনার হাতে, আমি একেবারে আর ওদিকে চাইব না।”

আমি হাসিয়া বলিলাম, “অসহযোগিতাও একটা বকশিস নাকি?”

মীরাও তর্কের উৎসাহে অভিনয় করিয়া বলিল, “বাঃ নিজের একটা সম্পূর্ণ ভার দিয়ে দেওয়া বকশিসের মধ্যে পড়ে না? ধরুন যদি…”

শেষ করিবার পূর্বেই অত্যন্ত লজ্জিত হইয়া হঠাৎ থামিয়া গেল। আমি ওর কথার সরল অথচ অনভীপ্সিত মানেটা যেন ধরিতে পারি নাই, কিংবা ওর লজ্জাটাও যেন চোখে পড়ে নাই এইভাবে প্রশ্ন করিলাম, “তা বেশ, আমার কিন্তু প্লেন কার্ড পছন্দ, মেলা ফুলকাটা-ফুলকাটা ভাল লাগে না। আপনার সঙ্গে রুচির মিল না হতে পারে তাই আগে থাকতে বলে রাখছি।”

মীরা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে একবার আমার পানে চাহিল—ভান করিতেছি, না সত্যিই কিছু বুঝি নাই? তাহার পর সহজভাবেই বলিল, “প্লেন তো নিশ্চয়ই, আমারও তাই পছন্দ।”

তাড়াতাড়ি চলিয়া গেল।

কি ভাবিল মীরা আমায়? স্থূলবুদ্ধি? অরসিক? জড়? না, বুঝিতে পারিল আমি তাহার কথাটার অন্য যাহা মানে হইতে পারে তাহা পুরাপুরিই বুঝিয়াছি, না বুঝিবার ভান করিয়া তাহার লজ্জাটা সামলাইয়া লইয়াছি মাত্র?

যাহাই ভাবুক, কাজটা কিন্তু ঠিকই করিয়াছি। মীরা লজ্জিত হইবে আর আমি ওর জ্ঞাতসারে সেই লজ্জা উপভোগ করিব সেদিন এত শীঘ্র আসে না।

পার্টিতে অনেকগুলি নূতন মানুষ দেখিলাম, মীরা সাধারণত তাহাদের সঙ্গে মেলামেশা করে, মেয়ে পুরুষ উভয় জাতিরই। মীরা প্রথম ঝোঁকটায় সকলকে অভ্যর্থনা করিতে, বসাইতে ব্যস্ত ছিল, কতকটা নিশ্চিন্ত হইলে আমায় ছাড়া ছাড়া ভাবে কয়েক জনের সঙ্গে পরিচয় করাইয়া দিল। তাহার মধ্যে একজন রেবা;—মীরার বিশেষ বন্ধু। মীরা যখন কয়টা দিন সরঞ্জামে মাতিয়া ছিল, রেবাকে তাহার সঙ্গে দেখিয়াছি। মেয়েটি মীরার চেয়ে এক-আধবছরের ছোট হইতে পারে, খুব সুন্দরী, খুব শৌখীন এবং অত্যন্ত লাজুক। এর আগেও এবং পরিচয়ের পরও রেবাকে দেখিয়া আমার এই কথাই মনে হইয়াছে যে, ও নিজের সৌন্দর্যকে এত ভালবাসে যে না সাজাইয়া গোছাইয়া যেন পারে না; অথচ এই সাজানর জন্যই ওর অপরিসীম লজ্জা। এই মেয়েটিতে এই একটা নূতন জিনিস দেখিলাম, যেহেতু সুন্দরীরা একটু লজ্জিত বেশি হয় একথা সত্য হইলেও শৌখীনদের ভাগ্যে লজ্জা একটু কমই থাকে—কেননা শখ জিনিসটাই হইতেছে পরের চক্ষে নিজেকে বিশিষ্ট করিয়া দেখা।

রেবাকে অবশ্য এ-কাহিনীর মধ্যে আর পাওয়া যাইবে না, কারণ আমি আসিবার কিছু দিন পরেই হঠাৎ বিবাহ হইয়া রেবা লাহোর চলিয়া গেল। সৌন্দর্য, শখ আর লজ্জার অদ্ভুত সমাবেশে ও আমার মনে একটা কৌতূহল জাগাইয়াছিল, বলিয়া ওর কথা একটু না তুলিয়া পারিলাম না।

আর একটি যুবতী সম্বন্ধে আমার কিছুদিন হইতে কৌতূহল জগিয়াছিল, তাহার কারণ আগন্তুকদের মধ্যে তাহাকেই সবচেয়ে বেশি দেখিয়াছি এ-বাড়িতে, আর তরুর মুখেও তাহার কিছু কিছু পরিচয় পাইয়াছি। অর্পনা দেবী আজ সাক্ষাৎভাবে পরিচয় করাইয়া দিলেন। জীবনে তাহাকে কখনও ভোলা চলিবে না। শুধু তাহাই নয়, যতদিন বাঁচিয়া থাকিব তাহার স্মৃতির পাদপীঠে অনির্বাণ শ্রদ্ধার বাতি জ্বালিয়া রাখিব।

অপর্ণা দেবী গোড়া হইতে উপস্থিত ছিলেন; কাল রাত্রি হইতে তাঁহার শরীরটা, একটু অসুস্থ হইয়া পড়িয়াছে। পার্টিটা আর পিছাইয়া দেওয়া সম্ভব হইল না; তবে তিনি একটু বিলম্ব করিয়া নামিলেন, যখন প্রথম অভ্যর্থনার বেগটা কতকটা প্রশমিত হইয়া সবাই একটু স্থির হইয়াছে। তাঁহার সেই গরদের চওড়া লালপেড়ে শাড়ি, সিঁথিতে চওড়া সিঁদুর, মুখে প্রসন্ন হাসি ঈষৎ ক্লান্তির সহিত মিশিয়া একটা অপার্থিব কারুণ্যের ভাব ফুটাইয়া তুলিয়াছে। অভ্যাগতদের জিজ্ঞাসাবাদ করিয়া ফিরিলেন একটু। উনি নামিয়াছেন পর্যন্ত আমার নজরটা বেশির ভাগ ওঁর দিকেই রহিয়াছে। আমার মন আর দৃষ্টি এঁকে বরাবরই খোঁজে, কম পায় বলিয়া আরও বেশি করিয়া খোঁজে।

এক সময় মীরা এক যুব-দম্পতির সঙ্গে ঘুরিতে ঘুরিতে আমার সামনে আসিয়া দাঁড়াইল, হাসিয়া বলিল—“শৈলেনবাবু, আপনার লেখার খোরাক, নিয়ে এলাম, পরিচয় করুন—তপেশবাবু, আর অনীতা—মিস্টার তপেশ বোস আর অনীতা চট্টোপাধ্যায়—অবশ্য এখন বোস—বুঝতেই পাচ্ছেন জ্যান্ত রোমান্স।”

আমি এঁদের নমস্কার করিয়া হাসিয়া বলিলাম, “রোমান্সের দিক থেকে এঁদের অভিনন্দিত করছি।”

তপেশ হাসিয়া কি একটা উত্তর দিতে যাইবে, এমন সময় অপর্ণা দেবী একটু যেন চঞ্চলভাবেই আসিয়া উপস্থিত হইলেন। মুখে একটা উদ্বেগের ভাব, চাপিবার প্রয়াস থাকিলেও বেশ প্রকট। প্রশ্ন করিলেন, “সরমাকে দেখছি না তো মীরা, আসেনি?”

মীরা যেন এতক্ষণ একটা দরকারী জিনিস ভুলিয়া ছিল, একটু চকিত হইয়া চারিদিকে চাহিয়া বলিল, “কই, দেখছি না তো!”

“আসেনি নিশ্চয়, কেন এল না বল তো? কার্ড পাঠাতে ভোল নি তো?”

“তাকে আমি নিজের হাতে কার্ড দিয়েছি। আসতও তো বরাবর কেমন হচ্ছে-না-হচ্ছে খোঁজ নিতে।”

“তবে!”

একটু চিন্তা করিয়া বলিলেন, “ফোনে একবার দেখ মীরা, লক্ষ্মীটি!”

মীরা পা বাড়াইবার সঙ্গে সঙ্গেই একটা মোটর আসিয়া গেটে প্রবেশ করিল। “ঐ যে সরমাদের গাড়ি” বলিয়া মীরা ত্রস্তপদে অগ্রসর হইল।

সরমাকে আমি এই বাড়িতে পূর্বে কয়েকবার দেখিয়াছি এবং এর-তার মুখে, বিশেষ করিয়া তরুর কাছে তাহার অল্প-বিস্তর পরিচয় পাইয়াছি। কিন্তু কোন প্রাসঙ্গিকতা না থাকায় তাহার সম্বন্ধে কিছু বলি নাই; দু-একটা কথা বলিতে চাই।

সরমাকে দেখিলে আমার একটা কথা মনে পড়িয়া যায়,–স্থির-বিদ্যুৎ। এ-এক আশ্চর্য সৌন্দর্য যাহার পানে একবার চাহিলে আপাদমস্তক ভাল করিয়া না-দেখিয়া চক্ষু ফিরাইবার উপায় থাকে না। আমি ঠিক এই ধরনের সৌন্দর্য জীবনে আর একবার মাত্র দেখিয়াছি—একটি অ্যাংলো-ইণ্ডিয়ান মেয়ের মধ্যে। বোটানিক্যাল গার্ডেনসে একটা লেকের ধারে সে, একজন আয়া আর একটা ছোট মেয়ে বসিয়া ছিল; বোধ হয় তাহার ভগ্নী। আমার খেয়াল হইল যখন ছোট মেয়েটা বলিল—“Look, Kate, the Babu is staring at you” (কেট্‌, দেখ, বাবুটি তোমার পানে হাঁ ক’রে চেয়ে রয়েছে)। আমি অপ্রস্তুত হইয়া গেলাম, কিন্তু লক্ষ্য করিলাম কেট্ অপ্রস্তুত বা বিস্মিত কিছুই হইল না। তাহার মানে কেট্ এতে অভ্যস্ত—লোকে তাহার দিকে একবার চাহিলে যে চাহিয়া থাকিবেই–কেটের এটা গা-সওয়া হইয়া গিয়াছে।

অবশ্য আমি নিতান্ত আত্মবিস্মৃত হইয়া সরমার দিকে চাহিয়া থাকি নাই। বাহাদুরি লইতেছি না; সৌন্দর্য যেমন আপনাকে এবং আর সবাইকে আকৃষ্ট করে, আমাকে তাহার চেয়ে কিছু কম করে না, তবে আমি সেই—‘Look Kate, the Babu is staring at you’-এর পর থেকে অতিরিক্ত সাবধানে থাকি, সৌন্দর্যকেও বিশ্বাস করি না; চক্ষুকেও নয়। তবুও আলাদা ছিলাম, অভদ্রতার ততটা ভয় ছিল না। সরমার আশ্চর্য সৌন্দর্য দেখিলাম খানিকটা।

সরমার মাথায় এলো খোঁপা, চুলটা ঈষৎ কুঞ্চিত বলিয়া চিক্‌ চিক্‌ করিতেছে, বাঁকা কি সিধা কোন সিঁথিই নাই, চুলটা শুধু টানিয়া আঁচড়ানো। মুখটা বেশ পুরন্ত। মুখের ভাবটা একটু ছেলেমানুষ- ছেলেমানুষ গোছের, রঙটা খুব গৌর এবং একটু হলদেটে—অর্থাৎ রঙে রক্তাভা থাকিলে যে একটা উগ্রতা থাকে সেটা নাই। বিদ্যুৎও স্থির হইয়া গেলে এই রঙেই দাঁড়াইবে।

সরমার পরনে খুব হালকা কমলালেবুর রঙের একটা শাড়ি, সেই রঙেরই পুরা-হাতা ব্লাউস, কানে দুইটি ঝুমকা দুল, হাতে দু-গাছি রুলি চারগাছি করিয়া আসমানি রঙের রেশমী চুড়ি।

সরমা অসামান্যা সুন্দরী, কিন্তু তাহার সৌন্দর্যের মধ্যে আরও যা অসামান্য তা তাহার শান্তি, যাহা প্রায় বিষাদের কাছাকাছি আসিয়া পড়িয়াছে। … বিদ্যুৎ শুধু স্থির নয়, তাহার দাহও হারাইয়াছে।

অপর্ণা দেবীও একটু আগাইয়া গিয়াছিলেন। মীরা হাসিতে হাসিতে সরমাকে সঙ্গে করিয়া আনিয়া বলিল, “এসেছে তোমার সরমা, মা; এই নাও।…মা হেদিয়ে উঠেছিলেন সরমাদি। ওঁর ভয় আমি তোমাকে কার্ড দিতেই ভুলে বসে আছি।”

সরমা লজ্জিতভাবে একবার অপর্ণা দেবীর পানে চাহিয়া তাঁহার চরণ স্পর্শ করিয়া অভিবাদন করিল। অপর্ণা দেবী তাহার মস্তকে হাত দিয়া হাতটা ধীরে ধীরে পিঠে নামাইয়া লইলেন, হাসিয়া বলিলেন, “আমার সরমাই তো, তোর হিংসে হয় নাকি?”

সরমা হাসিয়া অপর্ণা দেবীর মুখের পানে চাহিয়া বলিল, “এ কি রকম হ’ল কাকীমা?”

এদিকে বলছেন ‘আমার সরমাই তো’, আবার ওদিকে ধরে রেখেছেন যে কার্ড না পেলে আসতাম না। আমার জোর রইল তাহ’লে কোথায়?”

আবার তিনজনেই একসঙ্গে হাসিয়া উঠিলেন। অপর্ণা দেবী একটু অপ্রতিভ হইয়া বলিলেন, “বাঃ, কার্ড না দিলে আসবে না এ-কথা কেন বলব? বলছিলাম মীরার পদে পদে যা ভুল,তোমার কার্ড বোধ হয় পাঠানই হয়নি। তোমার গুণের কথা চাপা দিচ্ছিলাম না, ওর দোষের কথা, ওর ভুলের কথা বলছিলাম।”

মীরা গম্ভীর হইয়া গেল, প্রশ্ন করিল, “সেইটেই কি ভুল হ’ত মা?”

অপর্ণা দেবী তাহার পানে চাহিয়া বিস্মিতভাবে বলিলেন, “বা রে! কার্ড না দেওয়াটা ভুল হ’ত না? কী যে বলে মীরা!”

মীরা আরও তর্কের ভঙ্গিতে বলিল, “বা—রে, হ’ত?—যে-সরমা তোমার এত আপনার যে মীরারও হিংসে হচ্ছে বলছ, তাকে কার্ড পাঠানই কি ভুল হয়নি?”

সঙ্গে সঙ্গে গাম্ভীর্য ঠেলিয়া তাহার হাসি উছলিয়া উঠিল।

ওর গাম্ভীর্যের পিছনে এই কৌতুক লুকানো ছিল দেখিরা সরমা ও অপর্ণা দেবীও হাসিয়া উঠিলেন। অপর্ণা দেবী দুইজনের নিকটই পরাজয় স্বীকার করিয়া বলিলেন, “আচ্ছা হয়েছে, ওদিকে চল একটু! তোমরা দু-জনেই সমান।”

মীরা একটু আবদারে হুকুমের সুরে বলিল, “বল—দু-জনেই তোমার সমান আপনার অর্থাৎ সরমাদি আমার চেয়ে বেশি আপনার নয়?”

অপর্ণা দেবী হাসিয়া বলিলেন, “দু-জনেই সমান দুষ্টু, আর আপনার। … এস সরমা।”

ঘুরিতেই অল্প দূরেই আমায় দেখিলেন। আমি তখন অন্য দিকে চোখ-কান যে নাই আমার সেইটা প্রমাণ করিবার জন্য খুব মনোযোগের সহিত কেটলি হইতে চা ঢালিতেছি। অপর্ণা দেবী কাছে আসিয়া বলিলেন, “তুমি বড় একলা পড়ে গেছ তো শৈলেন। নতুন মানুষ…।”

মীরা বলিল “আমাদের সঙ্গে ঘুরে ফিরে একটু জানা-শোনা করে নিন্ না, ম।” একটু হাসিয়া বলিল, “কিন্তু যা একলষেঁড়ে মানুষ!”

অপর্ণা দেবী একটু হাসিলেন, বলিলেন, “তা বেশ তো। কিন্তু দাঁড়াও, আগে তোমাদের পরিচয়টা করিয়ে দিই। এটি আমাদের তরুর নতুন মাস্টার। এ সরমা, এ হচ্ছে…”

অপর্ণা দেবী হঠাৎ থামিয়া গেলেন; কি যেন একটা প্রবল কুণ্ঠা আসিয়া গেল মাঝখানেই। সরমাও একটু রাঙিয়া উঠিল।

অপর্ণা দেবী কথাটা ঘুরাইরা লইয়া বলিলেন, “এমন চমৎকার মেয়ে দেখা যায় না শৈলেন।”

সরমা আবার একটু রাঙিয়া উঠিল, তাহার পর আমার নমস্কার করিয়া হাসিয়া বলিল, “এমন চমৎকার কাকীমা দেখা যায় না শৈলেনবাবু, মিছিমিছি এত প্রশংসা করতে পারেন!”

আবার সবাই হাসিয়া উঠিলাম।

আমি উত্তর করিলাম, “যোগ্যের প্রশংসায় মস্ত বড় একটা আনন্দ আছে কিনা—সরমা দেবী।”

সরমা সেইভাবেই বলিল, “শুনলেন—বললাম মিছিমিছি প্রশংসা করেন।”

আমি বলিলাম, “ঐটেই তো যোগ্যতার চিহ্ন! আপনি যোগ্য বলেই তো মনে করেন আপনাকে যে প্রশংসাগুলো করা হয় সেগুলো আপনার প্রাপ্য নয়; যে অযোগ্য সে মনে করবে তার মত প্রশংসার পাত্র জগতে বিরল, অথচ লোকে তার প্রাপ্য চুকিয়ে দিলে না।…যা শূন্যগর্ভ তাই তো ভরে ওঠবার জন্যে হাহাকার করতে থাকে।”

যাহাকে ভালবাসা যায় সে কাছে থাকিলে একটা তৃতীয় নয়ন খোলে মানুষের। আমি যখন সরমার কথার উত্তর দিলাম—এই বলিয়া যে, সে প্রশংসার উপযোগী—তখন অপর্ণা দেবী, মীরা দুইজনে স্মিতহাস্য করিল; কিন্তু দেখিলাম মীরার হাসিটা যেন কতটা নিষ্প্রভ, অন্ততঃ মীরার কথা যে অল্প হইয়া গিয়াছে এটা তো বেশই স্পষ্ট। অবাধ্যভাবেই যেন চক্ষু গিয়া মীরার উপর পড়িল, সেই মুহূর্তেই আবার সরাইয়া লইলাম। মীরার বুদ্ধি অতি তীক্ষ্ণ, তাহার তৃতীয় নয়ন আমার চেয়েও শতগুণে জাগ্রত; ঐটুকুতেই সে বুঝিল সে ধরা পড়িয়া গিয়াছে, সঙ্গে সঙ্গেই সতর্ক হইয়া গেল।