১০

দিন চারেক পরে মিস্টার রায় আসিলেন; আমি আসিবার ঠিক সতের দিনের দিন।

আমি আমার ঘরে বসিয়াছিলাম। ইমানুল রাজু বেয়ারার অনুপস্থিতির সুযোগ পাইয়া আমার ঘরে আসিয়া বসিয়াছে। হাতে একখানি পোস্টকার্ড, তাহাকে চিঠি লিখিয়া দিতে হইবে।—ইমানুলের পরিচয় আরও একটু পাইলাম আজ। রাঁচির দুই স্টেশন এদিকে জোনহা, সেইখানে নামিয়াই ইমানুলের বাড়ি যাইতে হয়, দুইটা পাহাড় ডিঙাইয়া। স্টেশন হইতে মাইল-দেড়েক দূরে জোন্‌হার জলপ্রপাত, ওদিককার একটা দ্রষ্টব্য বিষয়। রাঁচি হইতে মোটরে বা রেলযোগে প্রায়ই লোক দল বাঁধিয়া প্রপাত দেখিতে আসে, গাইড বা কুলি হিসাবে স্থানীয় লোকেরা এই থেকে কিছু কিছু উপার্জন করে, বিশেষ করিয়া যখন জোন্‌হা দর্শনের মরসুম, অর্থাৎ পূজার সময় হইতে শীতের খানিকটা পর্যন্ত। কতকটা এই সাময়িক উপার্জন আর কতকটা সামান্য একটু চাষ-আবাদ—এই লইয়া ইমানুলের চলিয়া যাইতেছিল। বাড়িতে বড় ভাই, ভাজ আর তাহাদের দুইটি ছোট ছোট ছেলে-মেয়ে। বড় ভাই ক্ষেত-আবাদের দিকটায় নজর রাখে।

জোন্‌হার কাছে কি উপলক্ষ্যে একটা বড় মেলা বসে, লোক হয় বিস্তর, কিছু পাদ্রীরও আমদানি হয়। একদিন রেভারেণ্ড চাইল্ড গাড়ি হইতে নামিল, সঙ্গে একজন ওদেশী সহযোগী ও একটা পুস্তকের গাঁঠরি—মেলায় বিলি করিবার জন্য। মেলায় গাঁঠরিটা পৌঁছাইয়া দিবার জন্য ইমানুলকেই কুলি নিযুক্ত করিল সাহেব। সেই দিন পাদ্রী সাহেবের বক্তৃতায় যীশুর করুণার কথা ইমানুল ভাল করিয়া শুনিল। স্টেশনে ফেরত আসিবার সময় সাহেব যীশুর কথা আরও বলিল, খ্রীষ্টধর্মের গৌরব আর সমদর্শিতার কথা বলিল এবং ইমানুলের ঝোঁক দেখিয়া তাহাকে একটা টাকা দিয়া বলিল—সে যেন শীঘ্রই একদিন তাহাদের মিশনে আসে, সমস্ত ব্যাপারটা স্বচক্ষে দেখিতে পাইবে।

মিশনে আসিয়া ইমানুল আর যা দেখিল, তা দেখিল, একটি দেখিবার মোহ তাহাকে একেবারে পাইয়া বসিল। নূতন ধর্মের চক্ষু-ঝলসানো আলোয় ইমানুলের নজর সব চেয়ে বেশি করিয়া পড়িল মিস ফ্লোরেন্স চাইল্ডের উপর। মেয়েটি রেভারেণ্ড চাইল্ডের ভ্রাতুষ্পুত্রী, বাপ-মা নাই। … ইমানুল যখন কাহিনীটা বিবৃত করিতেছিল আমার অত্যন্ত অদ্ভুত ঠেকিতেছিল,—অত উঁচুতে দৃষ্টিক্ষেপ কি করিয়া করিতে পারিল ইমানুল! মাথায় ছিট আছে একটু নিশ্চয়, তবুও একেবারে পাগল না হইলে সম্ভব হয় কি করিয়া?

কিন্তু একটু ভাবিয়া দেখিলাম অদ্ভুত হইলেও আশ্চর্য কি এমন? চোখে লাগা চোখের ব্যাপার,—তাহার সঙ্গে নিজের গায়ের রঙ আর মুখের কাঠামোর কি সম্বন্ধ? যে দৃষ্টি আকর্ষণ করে সে তেমনই করিয়া আকর্ষণ করে; নিজের পানে চাহিয়া দেখিবার কি ফুরসত দেয়? ইমানুলের বিভ্রান্ত দৃষ্টিতে তখন আবার সাম্যের মোহ—সাম্যের অর্থই তো আকাশে মাটিতে মিতালি। একদিকে থাকিবে কদর্য ওরাওঁ যুবক, আর অপর দিকে থাকিবে দেবকন্যার মত তরুণী ফ্লোরেন্স, তবেই তো সাম্যের কথা উঠিবে। আরও আছে। শুধু গায়ের চামড়া আর মুখের কাঠামোই কি সব? ভালবাসার মূল যেখানে, সেখানে তো সেই একই রাঙা রক্তের তরঙ্গ দুলিতেছে।

ভেদাভেদ-জ্ঞানের সঙ্গে দ্বিধা আশঙ্কাও গেছে,—ইমানুল কথাটা বোধ হয় স্বয়ং ফাদার চাইল্ডকে বলিত, বর্বরেরা চিন্তা আর বাক্যের মধ্যে অবসর রাখিতে জানে না! তবে ইতিমধ্যে ফাদার চাইল্ডের সহযোগী ন্যাথেনিয়াল কথাটা টের পাইল। লোকটা খুব ধূর্ত এবং অভিজ্ঞ, যাহাকে বলা যায় পাকা খেলোয়াড়। জানে যে যাহারা খ্রীষ্টান হয় তাহারা সব সময় ত্রাণকর্তা যীশুর আহ্বানে সাড়া দিয়া আসে না, বরং অধিকাংশ সময়েই নয়। অবশ্য ইমানুলের এ-ব্যাপারটা একটু বাড়াবাড়ি, একেবারে চাঁদে হাত বাড়ানো। কিন্তু সে কথাটা বাড়িতে ছিল না। খলিফা লোক, যেমন বাড়িতে দিল না, তেমনই আবার নিরুৎসাহও করিল না; বলিল, “এটা এমন কিছু বেশি কথা নয়। তুমি পাবে, তবে সময় নেবে একটু। আগে কিছু উপার্জন কর, কিছু সঞ্চয় কর; তারপর আমি যথাসময়ে ফাদার চাইণ্ডের কাছে কথাটা ভাঙব। ইতিমধ্যে আমি তার ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।”

ইমানুল দীক্ষিত হইবার কয়েকদিন পরে, চাইল্ড সাহেবকে বলিয়া কহিয়া কলিকাতায় তাঁহার এক ব্যবসাদার বন্ধুর নিকটে ইমানুলের মালীগিরির চাকরি জোগাড় করিয়া দিয়া তাড়াতাড়ি সরাইয়া দিল। বলিল, “এবার গিয়ে তুমি মাসে মাসে টাকা জোগাড় করতে থাক ইমানুল, আমি এদিকে পথ পরিষ্কার করতে থাকি। তুমি শুধু আমায় মাঝে মাঝে চিঠি দিতে থেক এবং দয়াময় যীশুর কাছে খুব প্রার্থনা করতে থেক। … পাবে বইকি মিস ফ্লোরেন্সকে, তবে সময় নেবে।”

ন্যাথেনিয়াল জানিত সভ্য জীবনকে একটু ভাল করিয়া দেখিবার সুযোগ পাইলেই এই বন্য ওরাঁওয়ের মোহ ভাঙিবে, তাহার পূর্বে নয়।

ইমানুল কলিকাতায় আসিল এবং চাকরি ও প্রার্থনা শুরু করিয়া দিল। এমনই রোজ প্রার্থনা করিত নিজের ঘরে, তাহার পর প্রথম রবিবার আসিতেই পাদ্রীর দেওয়া অতিরিক্ত বড় কোট-প্যাণ্ট পরিয়া সাহেব-পরিবারের সঙ্গে গির্জায় যাইবার জন্য তাহাদের সঙ্গ লয়। ফলে সেইদিন তাহার দুইটি জিনিস ঘুচিয়া যার—চাকরি আর সাম্যের মোহ। তাহার পর এখানে চাকরি করিতেছে। এখানেও প্রায় বছর চারেক হইল।

আমি বলিলাম, “ইমানুল, তবুও রাজা-লাটসাহেবের ধরম সম্বন্ধে তোমার মোহটা গেল না?”

ইমানুল দাঁত বাহির করিয়া হাসিল, বলিল, “সাহেব আমীর মাস্টারবাবু, ওদের কথা যেতে দিন, ত্রাণকর্তা যীশু বলেছেন, একটা ছুঁচের ছেঁদার অন্দর দিয়ে একটা উট গলে যেতে পারে, কিন্তু একজন আমীর লোক স্বর্গে যেতে পারে না। কিন্তু ফাদার-চাইল্ড অন্য রকম লোক আছেন, তিনি ত্রাণ্ কর্তা, যীশুর মতন, কাউকে নীচু দেখেন না। আপনি দিন লিখে বাবু নাথুকে। লিখুন, ‘ভাই ন্যাথেনিয়াল পুরীনকে ইমানুল রোমানের হাজার হাজার সেলাম পৌঁছে’—ইংরিজীতেই লিখবেন বাবু, নাথু ইংরিজী জানে—পরে, এর আগের সব খাত নাথু ভাইকে জানিয়েছি, কিন্তু এখনতক কোন জবাব না পাওয়ায় মর্মান্তিক দুশ্চিন্তায় আছি…”

আমি একটু বিস্ময়ের সহিত চাহিতেই ইমানুল কুণ্ঠিতভাবে হাসিয়া বলিল, “হ্যা, ‘মর্মান্তিক দুশ্চিন্তা’ লব্‌জটা নিশ্চয়ই লিখে দেবেন মাস্টার-বাবু, ইংরিজীতে—ক্লীনার মদন শিখিয়ে দিয়েছে খুব জোর আছে লব্‌জটাতে। মদন আপন ইস্তিরিকে হরেক চিঠিতে লেখে—’মর্মান্তিক দুশ্চিন্তায় আছি’—খুব জলদি জবাব এসে পড়ে। লিখে দিন—মর্মান্তিক দুশ্চিন্তায় আছি। ইংরিজীতে আরও ওজনদার হবে লব্‌জটা—হেঁ বাবু‥”

এমন সময় গেটের বাহিরে মোটরের হর্ণ বাজিয়া উঠিল। মর্মান্তিক দুশ্চিন্তা, আর পোস্টকার্ড তুলিয়া ইমানুল গেট খুলিতে ছুটিয়া গেল।

একটু পরেই মীরার সঙ্গে মিস্টার রায় গাড়ি হইতে নামিলেন।

আমি বাহির হইয়া গাড়ি-বারান্দার উপর দাঁড়াইরা ছিলাম, অভিবাদন করিতে মীরা সংক্ষেপে পরিচয় দিল—“তরুর নতুন টিউটর—শৈলেনবাবু।”

মিস্টার রায়—“দ্যাটস্ অল, আইট্‌!” ( That’s all right!) বলিয়া আমার দিকে চাহিয়া একটু শিরশ্চালন করিলেন, তাহার পর পিতা পুত্রীতে উপরে উঠিয়া গেলেন! আমার মনটা অত্যন্ত ছোট হইয়া গেল। ভীত, ক্ষুণ্নমনে হাজার রকম অশুভ কল্পনা করিতে করিতে আমি ঘরের মধ্যে গিয়া একটা চেয়ারে বসিয়া পড়িলাম।

কারণ ছিল। মিস্টার রায় যেন কল্পনার মধ্য হইতে মূর্তি লইয়া নামিয়া আসিয়াছেন,—আমার বিভীষিকার ধ্যানমূর্তি। সেই বাঁকা টিকলো নাক, সেই ঈষৎ কোটরগত তীক্ষ্ণ চক্ষু, সেই কপাল, সেই মোটাঘন ভ্রূ, বর্তুল চিবুক। মনটা আমার একটা অহেতুক অস্বাচ্ছন্দ্যে যেন নিজের মধ্যেই গুটাইয়া আসিতে লাগিল। কল্পিত চেহারার সঙ্গে এ মিলটা আমার একেবারেই ভাল লাগিল না, কেন না এ-রকম মিল কখনও হয় না। কেবলই মনে হইতে লাগিল—ইহার পিছনে একটা দৈব অভিসন্ধি আছে।

আমার জীবনে আর একবার মাত্র এইরূপ রহস্যময় মিলের অভিজ্ঞতা হইয়াছিল, তাহার স্মৃতি এখনও আমার মনটাকে চঞ্চল করিয়া তোলে। খুব ছোটবেলায় একবার আমাদের বাংলা স্কুলে থার্ড মাস্টারের পদ খালি হয়। হঠাৎ একদিন স্বপ্ন দেখিলাম নূতন থার্ড মাস্টার একজন আসিয়াছেন;—মাথায় টাক, মোটা গোঁফ, হুঁ চাল দাড়ি, সবল চেহারা। আসিয়াই প্রথমে হেডমাস্টারকে চেয়ারসুদ্ধ তুলিয়া আছাড় দিলেন—ছেলেদের না ঠেঙাইয়া চুপ করিয়া বসিয়া থাকিবার জন্য। সেকেণ্ড মাস্টার আগন্তুককে নমস্কার করিবার জন্য সহাস্য মুখে হাত তুলিতে যাইতেছিলেন, আকস্মিক বিপদ দেখিয়া ছুটিয়া ঘরের বাহির হইয়া পড়িলেন। নুতন মাস্টার তাঁহাকে তাড়া করিয়া রাস্তা পর্যন্ত দিয়া আসিলেন, তাহার পর সেই অভিভাবকহীন স্কুলে ঢুকিয়া আমাদের মার। সে যে কি মার, স্বপ্ন হইলেও এখনও গায়ে কাঁটা দিয়া ওঠে! যখন ভাঙিল স্বপ্ন, দেখি ঘামিয়া নাহিয়া গিয়াছি।

পরের দিন সত্যই থার্ড মাস্টার আসিলেন,—সেই টাক, সেই গোঁফ, সেই সূঁচাল দাড়ি, সেই চেহারা। প্রথম দিনই আমাদের ক্লাসের বলাইয়ের ঘাড়ে মার পড়িল। তেমন বিশেষ দোষ ছিল না; কিন্তু থার্ড মাস্টার বলিলেন, “আজ ভাল দিন দেখে কাজে জয়েন করেছি, বৌনিটা সেরে রাখলাম। তোমাদেরও সুবিধে হল, হেডমাস্টারের মত আমার কাছে মামার বাড়ির আবদার খাটবে না, এটা জেনে রাখলে।”

তাহার পরদিন থেকেই মার আরম্ভ হইল। সে যে কি উৎকট অমানুষিক প্রহার!—পাঁচ দিনের মধ্যে সাতটা ছেলে বিছানা লইল। অবশ্য হেডমাস্টারকে মারেন নাই—স্বপ্নে একটু বাড়াবাড়িই হয়—তবে আমাদের পড়াইয়া অর্থাৎ প্রহার করিয়া যে সময়টা বাঁচিত সেটা মাস্টারদের সঙ্গে ঝগড়া করিয়াই করিয়াই কাটাইতেন। এগারটি দিন ছিলেন, তাহার পর স্কুল কমিটির বিশেষ অধিবেশন করিয়া তাঁহাকে সরানো হইল। যাইবার দিন একটু অনুতপ্ত গোছের হইয়াছিলেন, হেডমাস্টার প্রভৃতিকে বলিলেন, “দুঃখু রইল—আমাদের পরস্পরের ভাল করে পরিচয়ই হল না : ফুরসত পেলাম কই?”

তাহার পর কল্পনা আর বাস্তবে আশ্চর্য এই মিল দেখিলাম। পূর্বেই বলিয়াছি মন বড়ই বিমর্ষ হইয়া রহিল এবং সমস্ত দিন আমি মিস্টার রায়ের দৃষ্টি এড়াইয়া কাটাইলাম। বলা বাহুল্য, এই স্নিগ্ধ পরিবারের সঙ্গে পক্ষাধিক কাল কাটাইয়া আমার যে একটা অহেতুক এবং অস্বাভাবিক ব্যারিস্টার-ভীতি ছিল সেটা অনেকটা অপসারিত হইয়া আসিয়াছিল, বুঝিতে পারিতেছিলাম একটু বড় মহলে কখনও যাতায়াত না থাকার দরুনই বড়দের সম্বন্ধে আমার একটা অপরিচয়ের আতঙ্ক থাকিয়া গিয়াছিল, এ এক ধরনের হীনমন্যতা—ব্যারিস্টারভীতি তাহারই একটা উগ্র রূপ। বেশ কাটাইয়া উঠিতেছিলাম দুর্বলতাটুকু, সব ভণ্ডুল করিয়া দিল চেহারায় কাল্পনিক আর বাস্তব ব্যারিস্টারের এই কল্পনাতীত মিল। অবশ্য ভয় আর কিছু নয়। মিস্টার রায় যে খুব একটা অভদ্র রকম কিছু করিবেন এমন নয়, তবে ব্যারিস্টারিপদ্ধতিতে খুব কড়া জেরায় ফেলিয়া আমায় ভদ্রভাবে অপদস্থ করিতে পারেন; আমার চাকরির মধ্যেই তাঁহার জেরার প্রচুর মালমশলা রহিয়াছে। এত বেশি মাহিনার টুইশ্যনি যে লইয়া বসিয়া আছি কি বিশেষ যোগ্যতা আমার? তাঁহার অনুপস্থিতির সুযোগ লইয়া এক অনভিজ্ঞা বালিকাকে কি এমন বুঝাইয়াছি যে, সে নির্বিচারে নিয়োগ করিয়া ফেলিল? গৃহকর্তা বাড়ি নাই দেখিয়াও আমি কয়েকটা দিন অপেক্ষা করিলাম না কেন?

কতকটা আড়ালে আডালেই কাটাইলাম এবং বৈকালে তরুকে লইয়া যখন বেড়াইতে গেলাম খুব সন্তর্পণে ঘুরাইয়া-ফিরাইয়া প্রশ্ন করিলাম—মিস্টার রায় আমার সম্বন্ধে কোন প্রশ্নাদি করিয়াছেন কিনা। তরু বলিল–“কিছু না”…এ উত্তরে নিশ্চিত্ত হইবার কথা, কিন্তু আমি আরও চিন্তিত হইয়া পড়িলাম। তখন মনে হইল লোকটা কিছু একটা মতলব আঁটিয়া স্থির করিয়া ফেলিয়াছে। একটা নূতন লোক বাড়িতে আসিয়াছে, তাহাকে দেখিলও অথচ তাহার সম্বন্ধে না রাম না গঙ্গা—কিছুই বলে না, এ তো ভাল লক্ষণ নয়।

আহারের সময় আবার সাক্ষাৎ লইল। রাজু বেয়ারা আসিয়া বলিল, “ওঁয়া ডাইনিং রুমে এসেছেন, সায়েব আপনাকে ডাকছেন।…… সায়েব ভয়ঙ্কর খাপ্পা হয়েছেন মাস্টার-মশা!”

প্রশ্ন করিলাম, “কেন রে?”

“গভর্ণমেণ্ট বলছে—ইম্পিরিয়াল লাইব্রেরি দিল্লীতে নিয়ে যাবে।”

আশ্বস্ত হইলাম—রাজুর সেই পাকামি! তাহার পিছনে পিছনে গিয়া ডাইনিং রুমে প্রবেশ করিলাম এবং মিস্টার রায়কে নমস্কার করিয়া নিজের চেয়ারের পিছনে দাঁড়াইলাম।

মিস্টার রায় সত্যই কি একটা লইয়া উত্তেজিতভাবে কথা কহিতেছিলেন, আমি দাঁড়াইতেই আমার পানে চাহিয়া স্মিত হাস্যের সহিত বলিলেন, “আই সী! (I see) তুমিই তরু-মার টিউটর হয়েছ? দাড়াও একটু দেখি।”

অপর্ণা দেবী বলিলেন, “বাঃ, তোমরা সবাই খেতে বসেছ, আর ও বেচারি চেয়ার কোলে করে দাঁড়িয়ে থাকবে, তুমি ব’স শৈলেন।”

মিস্টার রায় অপ্রতিভভাবে তাড়াতাড়ি বলিয়া উঠিলেন, “O, sorry, I didn’t mean that! (না, তা বলবার উদ্দেশ নয় আমার) –তোমায় দাঁড়িয়ে থাকতে বলব কেন, ব’স ব’স… মিলিয়ে দেখছিলাম মীরা-মা তোমার যেমনটি বর্ণনা করে লিখেছিল আমায়, ঠিক সেই রকমটি তুমি—exactly, মীরা লিখেছিল…”

মীরা যেন প্রসঙ্গটাকে চাপা দিবার চেষ্টায় বলিল, “বাবা, পদ্মার কথা ছেড়ে দিলে কেন? মাস্টারমশাইও নিশ্চয় শোনার জন্যে ব্যস্ত হয়ে আছেন।” যাহাতে আমি ব্যস্ত হইয়া উঠি সেজন্য আমার পানে কতকটা প্রত্যাশা ও মিনতির দৃষ্টিতে চাহিল।

বলা বাহুল্য, মীরা কি লিখিয়াছিল সেইটকু শুনিবার জন্যই আমি উৎকর্ণ হইয়া উঠিয়াছি, তবু আগ্রহের অভিনয় করিয়া প্রশ্ন করিলাম, “পদ্মার কথা হচ্ছিল নাকি? তাহ’লে তো…”

মিস্টার রায় বলিলেন, “পদ্মার কথা বলব বই কি, না বললে আমার আহার পরিপাক হবে না; She is sublime (পদ্মা মহিমময়ী)…হ্যাঁ, কি বলছিলাম? ঠিক কথা—মীরা-মা লিখেছিল—You are too grave for your age, তা সত্যিই তুমি বয়সের অনুপাতে বেশি ভারিক্কে—if I am any judge of physiognomy (আকৃতি বিজ্ঞান সম্বন্ধে যদি আমার বিন্দুমাত্র জ্ঞান থাকে)…মীরা-মাঈ, কত বয়স লিখেছিলে মাস্টারমশাইয়ের?”

অবাধ্যভাবেই আমার দৃষ্টি একবার টেবিলের চারিদিকে ঘুরিয়া গেল—সকলে যেন কাঠ মারিয়া গিয়াছে। শুধু তরু তাহার শৈশবসুলভ অনভিজ্ঞতায় কিছু কৌতুকের আভাস পাইয়া একবার এর, একবার ওর মুখের পানে চাহিয়া অল্প অল্প হাসিতেছে।

সামলাইল মীরাই, উপস্থিত বুদ্ধি তাহারই বেশি, সামলাইলও, আবার সুযোগ পাইয়া আমার গাম্ভীর্যকে ব্যঙ্গও করিল। ঈষৎ হাসিয়া বলিল, “পঞ্চাশ-পঞ্চান্ন লিখে থাকব বোধ হয়, ঠিক মনে পড়ছে না।”

মিস্টার রায় হো-হো করিয়া হাসিয়া উঠিলেন, “O no, you naughty girl! He is hardly twenty-four—বাইশ-তেইশের বেশি হতেই পারে না। Yes, let me sec… (থামো দেখি) না, তুমি আমায় বয়সের কথা লেখইনি মীরা,—না লেখনি—রয়েছে চিঠি আমার কাছে। লিখেছ, লোক ভাল, লিখেছ, সাহিত্যিক—মানে, তরুকে ওদিকে ট্রেনিং দিতে পারবেন—অর্থাৎ তোমার সিলেক্‌শ্যন যাতে আমি রদ না করে দিই সেই জন্যই বোধ হয় আর সব কথাই লিখেছ ওঁর সম্বন্ধে, কিন্তু বয়সের কথা…”

চক্ষু বিস্ফারিত করিয়া হাসিতে হাসিতে মীরার নমিত মুখের দিকে চাহিয়া তিনি মাঝপথেই থামিয়া গেলেন। অপর্ণা দেবী এই সময় মুখটা একট নীচু করিয়া ধীরকণ্ঠে বলিলেন, “লেখেনি নিশ্চয় বয়সের কথা।”

মাথা নীচু করিয়া থাকিলেও বেশ বুঝিলাম, কথাটুকু বলিবার সঙ্গে সঙ্গে স্ত্রী স্বামীর দিকে চাহিয়া ইঙ্গিত করিয়াছে। মিস্টার রায় সঙ্গে সঙ্গে চিঠির প্রসঙ্গটা একেবারে ছাড়িয়া দিয়া নির্বাকভাবে আহারে প্রবৃত্ত হইলেন। প্রায় মিনিট পাঁচেক শুধু সবার কাঁটা-চামচ-প্লেটের ঠোকাঠুকির শব্দ শোনা যাইতে লাগিল, মাঝে মাঝে শুধু এক-একবার মিস্টার রায়ের “I see ‥হু বুঝেছি।” একবার বোধ হয় উপরে উপরেই অপর্ণা দেবীর পানে চাহিয়া বলিলেন, “ঠিক বলেছ তুমি, Yes, you are right … ভুল হয়েছে…”

সামলাইতে যাইয়া যে আরও বেসামাল করিয়া ফেলিতেছেন সেদিকে হুঁশ নাই। খানিকক্ষণ পরে কথাবার্তা আবার স্বাভাবিক ধারার প্রবর্তিত হইল। কুমিল্লার কথা, আট ঘণ্টা পদ্মার উপর ষ্টিমার-যাত্রার কথা, তরুর লেখাপড়ায় কথা, মল্লিকদের বাড়িতে পার্টির কথা। মীরা আর অপর্ণা দেবী সাবধানে প্রসঙ্গটা ঠিকপথে চালিত করিয়া রাখিলেন। তবু মিস্টার রায় তরুর পড়িবার আলোচনায় শেষের দিকটায় আবার একটা বেফাঁস করিয়া ফেলিলেন, বলিলেন, “আমার আইডিয়া ছিল বেশ একজন বয়স্ক দেখে টিউটর ঠিক করা; তোমায় সে-কথা বলেছিলাম কি কখনও মীরা-মাঈ?”

মীরা আবার রাঙিয়া বলিল, “কই, না তো বাবা!”

অপর্ণা দেবী তাড়াতাড়ি বলিয়া উঠিলেন, “হয়েছে খাওয়া, এইবার তাহলে ওঠ তোমরা; তুমি আবার রাত জেগে আছ।”

উঠিয়া হাত মুছিতে মুছিতে মিস্টার রায় কতকটা চিন্তিতভাবে আপন মনেই বলিলেন, “তাহলে বলিনি। আর ভালই হয়েছে—যারা ছোট, অল্প বয়স, তাদের চোখের সামনে সর্বদা আমাদের মত বুডো একজন থাকা ভাল কি-না সে-বিষয়ে আমার সন্দেহ আছে—তাতে তারাও বুড়িয়ে যেতে পারে…”

কথা শেষ হইবার আগেই যাহাকে উদ্দেশ্য করিয়া বলা সে-ই প্রথমে পর্দা ঠেলিয়া বাহির হইয়া গেল।