» » মানুক দেওতার রহস্য সন্ধানে

বর্ণাকার

অজেয় রায়

মানুক দেওতার রহস্য সন্ধানে

আট

দুপুরে হঠাৎ গুরগুর আওয়াজ শোনা গেল, চাপা মেঘগর্জনের মতো। সবাই সমুদ্রতীরে ছুটে গিয়ে চাইল পাশের দ্বীপে আগ্নেয়গিরিটার দিকে। দেখল, সেই পাহাড়ের চুড়ো দিয়ে ধোঁয়া উঠছে আরও মোটা হয়ে। দ্বীপের মাথায় ধোঁয়ার মেঘ বিশাল হয়ে উঠেছে।

গুরগুর ধ্বনি আর থামে না। কমে, আবার বাড়ে। মাঝে মাঝে পায়ের তলার কেঁপে কেঁপে উঠছে।

ডন বলল, প্রফেসর, আজ আমাদের অভিযান বন্ধ রাখতে হবে। এখন ওই ধাপের কাছে ঘেঁষা খুব বিপজ্জনক।

দত্তদা অস্থির হয়ে বললেন, কিন্তু চ্যাং যে সব পাখি শেষ করে দেবে।

ডন বলল, চ্যাং নেহাত গাধা না হলে এখনও ডিক্সন দ্বীপে বসে থাকবে না।

দত্তদা উত্তেজিতভাবে কী বলতে যাচ্ছেন, ঠিক তখনই যেন প্রলয় ঘটল। দ্বীপটা এমন কেঁপে উঠল যে সবাই টলে পড়ে গেল মাটিতে। সঙ্গে সঙ্গে কানফাটা আওয়াজ। আকাশ বাতাস যেন চৌচির হয়ে গেল। সবার নজরে এল, আগ্নেয়গিরির চুডোর মুখ দিয়ে আগুনের শিখা লাফিয়ে লাফিয়ে উঠে আকাশ ছুঁচ্ছে। ধোঁয়ার কুণ্ডলী ফুঁসে উঠছে—বিপল আকারে আগুনরাঙা কৃষ্ণবর্ণ ধূমরাশি। সে দৃশ্য যেমনই সুন্দর, তেমনই ভয়ঙ্কর।

প্রচণ্ড ভারী কী একটা আছড়ে পড়ল শ—খানেক হাত তফাতে ঝোঁপের ওপর। সবাই দেখল ফুটবলের আকারের একখানা পাথর, জ্বলন্ত কয়লার মতো গনগনে লাল। সঙ্গে সঙ্গে ঝোঁপটা জ্বলে উঠল।

ডন চেঁচাল, পালাও পালাও। পাথর ছিটকোচ্ছে। আড়ালে চলো।

দ্বীপের অপর প্রান্তে ছোট এক গুহার মধ্যে ঢুকে আশ্রয় নিল সবাই। আরও কয়েকখানা। পাথর পড়ার শব্দ হল। মাঝে মাঝে ভীষণ জোরে জোরে ছাক ছাক আওয়াজ। জলন্ত পাথর এসে পড়ছে সমুদ্রের জলে! হাওয়া তেতে উঠেছে। রীতিমতো গরম লাগছে। ভেসে আসছে গন্ধকের বিশ্রী কটু গন্ধ। এলোমেলো ঝোড়ো বাতাস বইছে প্রবল বেগে। সাগরে উথাল—পাথাল ঢেউ।

সন্ধ্যার সময় আর একবার বিরাট বিস্ফোরণ ঘটল। থরথর করে কেঁপে উঠল তপনদেন দ্বীপ। ফের একদফা জ্বলন্ত পাথর—বৃষ্টি। জ্বলে উঠল অনেক ঝোঁপ—জঙ্গল। সেই গুরুগুরু ধ্বনি এবং মৃদু মৃদু ভূকম্পন সমানেই হচ্ছিল। উন্মত্ত সাগরের কলরোল এবং বাতাসের হু—হু শব্দে কানে তালা লাগে। ঝড়ের দাপটে গুহার বাইরে বনভূমি যেন ছিন্নভিন্ন হচ্ছে।

দত্তদা তপনের পিঠে হাত রেখে বললেন, কি, ভয় করছে?

মাথা নাড়ল তপন। বাইরে স্বীকার না করলেও তপন ভাবল, ভয়? হ্যাঁ, তা করছে। বইকি! এ কী মহাদুযোগ! বিপদের এমন ভয়াল রূপ তার কল্পনার বাইরে। এক—একটা প্রচণ্ড শব্দের সঙ্গে সঙ্গে যেন চমকে লাফিয়ে উঠছে তার হৃৎপিণ্ডটা। প্রকৃতির এই তাণ্ডবে নিজেকে মনে হচ্ছে কত তুচ্ছ অসহায়। ভয় ও বিপদের সঙ্গে তার কি কখনো পরিচয় হয়নি? হয়েছে বইকি! কলকাতা শহরের পথেঘাটে কত বিপদ! কত রকম দুর্ঘটনা, খুনোখুনির মুখোমুখি হতে হয়েছে। কিন্তু এই বিপদের ধরন আলাদা।

শহুরে বিপদের হাত থেকে রক্ষা পেয়ে সে হাঁপ ছেড়েছে। একটা বিভীষিকাময় স্মৃতি। ওই বিপদ ও ভয়ের স্মৃতি মুছে ফেলতে চায় মন। কিন্তু আজকের এই বিপদ থেকে যদি সে রক্ষা পায়, এর স্মৃতি তার মনে চিরকাল থাকবে। ইচ্ছে করেই সে বাঁচিয়ে রাখবে এর স্মৃতি। এই বিপদ, এই দুর্যোগের কথা সে মনে রাখবে গর্বের সঙ্গে। এ বিপদ যে সাধ করে ডেকে আনা। এর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ায় বীরত্ব। হাত—জিত দুই—ই গৌরবের।

রাত নামল। ছোট ছোট বিস্ফোরণ বার কয়েক হলেও সৌভাগ্যের বিষয় বড় বিস্ফোরণ আর ঘটল না। আগ্নেয়গিরির গর্জানি এবং ভূমিকম্পের বেগ ক্রমে ক্ষীণ হতে হতে থেমে গেল। সমুদ্র ও বাতাস শান্ত হয়ে এল। তবে রাতে কেউ আর বাইরে বেরোতে সাহস পেল না। বড় পাথর পড়া কমলেও ছোট ছোট জ্বলন্ত নুড়ি এসে পড়ছিল তখনো। এমনি একখানার ঘায়েই ফুটো হয়ে যেতে পারে মাথা।

দিনের আলোয় দেখা গেল আগ্নেয়দ্বীপের চুড়ো দিয়ে তখনো ধোঁয়া বেরোচ্ছে, তবে সরু হয়ে। তপনদের দ্বীপের গাছপালা পাতার ওপর পুরু একগাদা ছাই জমেছে। দত্তদা ছটফট করছেন। ইচ্ছে, তখুনি ডিক্সন দ্বীপে যাবেন। ডন বারণ করল, আজকের দিনটা সবুর করুন। যদি ফের বিস্ফোরণ হয়?

তপন দত্তদাকে আটকাবার জন্য ডনকে সমর্থন জানিয়ে বলল, সত্যি, সামান্য পাখির জন্যে এরকম লাইফ—রিস্ক নেওয়া উচিত নয়।

খর চোখে তপনের দিকে চেয়ে দত্তদা বললেন, সামান্য পাখি, কী বলছ! একটা আশ্চর্য সন্দর নতন স্পিশিস। একজন ন্যাচারালিস্টের কাছে এমন একটা আবিষ্কারের মূল বোঝো? জানেনা এরকম কোনো আবিষ্কার তার কাছে কত বড় পরস্কার? এমনি পরস্কারের লোভেই ওয়ালেস, বেটস, হামবোন্ট, হার্ডসন, ডারউইন—এর মতো বিখ্যাত ন্যাচারালিস্টরা কত দুর্গম পাহাড়—জঙ্গলে ঘুরেছেন। যদি কোনো নতুন পশু পাখি, গাছপালা, কীটপতঙ্গ আবিষ্কার করা যায়? এমন একটা আবিষ্কারের জন্য প্রাণ তুচ্ছ করা যায়—সে তুমি ঠিক বুঝবে না তপন, কেবল টাকাকড়ি লাভের মাপকাঠি দিয়ে এসব আবিষ্কারের মূল্য বিচার হয় না। তবে জেনে রাখো, বৈজ্ঞানিক মহলে এমনি একটা আবিষ্কারের বিরাট দাম, বিরাট, সম্মান।

কিন্তু ডন কিছুতেই দত্তদাকে তখন ডিক্সন আইল্যান্ডে যেতে দিল না। বলল, যা হবার হয়ে গিয়েছে। একটা দিন আগে গেলে কি আর বেশি লাভ হবে? হয়তো শুধু প্রাণটা খোয়াবেন। এটা স্রেফ গোঁয়ার্তুমি। না, না, আজ আপনার কিছুতেই যাওয়া হবে না।

বাধ্য হয়ে দত্তদা নিরস্ত হলেন।

পরদিন সকালে নৌকোয় ডিক্সন দ্বীপে চলল সবাই। তখনো আকাশ জুড়ে কালো মেঘের মতো ভেসে বেড়াচ্ছে আগ্নেয়গিরির ছাই। সূর্যের আলো তাই ম্লান।

তপনদের নৌকো আগ্নেয়গিরিকে অনেকখানি পাশ কাটিয়ে গেল। ওই দ্বীপের চেহারাটা একদম পালটে গেছে। গাছপালা সব পুড়ে খাক। নেড়া পাথর বেরিয়ে পড়েছে। পাহাড়ের গা বেয়ে অনেকগুলো মোটা মোটা লাভার স্রোত নেমেছে। জ্বলন্ত গলিত লাভা অবশ্য তখন আর তরল নেই। জমাট বাঁধছে। তবে তখনো তাদের গা দিয়ে ধোঁয়া বেরোচ্ছে।

ডিক্সন দ্বীপ দেখে দত্তদার চোখে প্রায় জল এল। ছারখার হয়ে গেছে দ্বীপ। অর্ধেক গাছপালা শেষ। কিছু ঝোঁপ তখনো জ্বলছে। কত বিশাল বিশাল গাছের ডালপালা নির্মমভাবে মুচড়ে ভেঙে গেছে। কত গাছ ঝলসে কালো হয়ে গেছে। সারা দ্বীপময় নানা প্রাণীর মৃতদেহ ছড়ানো। তবে মৃত পাখি খুব কম। বিপদের আশঙ্কায় তারা নিশ্চয়ই বেশির ভাগই দ্বীপ ছেড়ে উড়ে পালিয়েছে। তবে বেচারা ডাঙার প্রাণীদের সে সুবিধা হয়নি।

সাবধান—হেঁচকা টানে ডনকে সরিয়ে আনল পোকো। দেখা গেল, ডনের পায়ের কাছে পাথরের আড়াল থেকে মাথা তুলছে এক ডেথ—অ্যাডার। অনেকটা চন্দ্রবোড়ার মতো দেখতে। আলী বিদ্যুৎবেগে দা—এর কোপ দিল। দুখানা হয়ে গেল সাপটা।

একটি মৃত প্যারাডাইস—বার্ড পাওয়া গেল। দগ্ধ বিকৃত দেহ। দত্তদা পরীক্ষা করে বললেন, মনে হচ্ছে কিং বার্ড অফ প্যারাডাইস। অথবা—তার কথা থমকে গেল। অর্থাৎ কিং বার্ড—এর মতন দেখতে ডিক্সন—সৃষ্ট নতুন স্পিশিসটাও হতে পারে।

সারা দ্বীপ খুঁজে চ্যাং বা তার দলের কারো চিহ্ন মিলল না।

দত্তদা উত্তেজিত হয়ে বললেন, চ্যাং পালিয়েছে। নিশ্চয়ই কিছু প্যারাডাইস বার্ড ধরে নিয়ে গেছে। চলো, এখুনি ফিরি। সোবরাং থেকে ওয়ারলেসে খবর পাঠাব চারদিকে। যদি পাচার করার আগেই ওদের পাখি সমেত ধরা যায়—

তপনদের নৌকো ভেসে চলেছিল মেসমন দ্বীপপুঞ্জের ভিতর দিয়ে, নানা দ্বীপকে পাশ কাটিয়ে। ইচ্ছে, সন্ধের আগে নোঙর ফেলা হবে না। যত তাড়াতাড়ি যাওয়া যায়। দত্তদা একবার বিষণ্ণ সুরে বললেন তপনকে, ইস্ এক সপ্তাহ আগে যদি ডিক্সন দ্বীপে পৌঁছতে পারতাম। বোকা জিয়ানটা সব ভণ্ডুল করে দিল।

বিকেলবেলা। সামনেই ছোট্ট এক দ্বীপ। দেখা গেল, দ্বীপের তীরে দাঁড়িয়ে তিন—চারজন লোক প্রাণপণে হাত নেড়ে ইশারা করছে তপনদের নৌকোর উদ্দেশে। দত্তদা চোখে দূরবীন লাগিয়ে তাদের নজর করে জিয়ানকে বললেন, দেখ তো।

জিয়ান দূরবীন দিয়ে দেখে চেঁচিয়ে উঠল, আরে এ যে কিচিল! আর অন্য লোকগুলো চ্যাং—এর নৌকোর মাঝি।

চলো ওই দ্বীপে, দত্তদা হুকুম দিলেন।

তীরে নৌকো ভিড়ল। ডন বন্দুক বাগিয়ে প্রস্তুত। ধূর্ত চ্যাংকে বিশ্বাস নেই। কে সে? এরা কী করছে এখানে? ডাকছিল কেন?

কাছে গিয়ে লোকগুলোর চেহারা দেখে তপনরা থ। সবার অবস্থাই অতি করুণ। ছিন্ন—ভিন্ন পোশাক, কালিমারা মুখ, উসকো—খুসকো চুল। কিচিলের মাথায় ব্যান্ডেজ জড়ানো, তাতে রক্তের ছোপ। একটা চোখ ফুলে উঠে প্রায় বন্ধ। কিচিল কাতর স্বরে ইংরেজিতে বলল, একটু জল। প্লিজ, একটু জল দাও খেতে।

খাবার জল দেওয়া হল।

কিচিল ও তার মাঝিরা আকণ্ঠ জল পান করল।

কী ব্যাপার? চ্যাং কোথায়? জিজ্ঞেস করলেন দত্তদা।

চ্যাং নেই, উত্তর দেয় কিচিল।

নেই মানে!

সমুদ্রে ডুবে গেছে।

কী করে?

থেমে থেমে হাঁপাতে হাঁপাতে যা বলল কিচিল তা এই—আগ্নেয়দ্বীপে ধোঁয়ার বহর দেখে ভয় পেয়ে তারা ডিক্সন দ্বীপ ছাড়ে। মাঝিরা আগেই পালাতে চেয়েছিল কিন্তু চ্যাং শোননি। সে তখন প্যারাডাইস—বার্ড ধরতে মত্ত। অগ্নৎপাত ঘটলে ডিক্সন দ্বীপ নষ্ট হয়ে যাবে, তাই তার আগেই যে কটা পাখি ধরা যায়। বিশেষত ওই নতুন জাতের প্যারাডাইস—বার্ড। সোনার ওজনেও নাকি ও—পাখির দাম হয় না। চ্যাং ভরসা দিয়েছিল যে এমনি ধোঁয়া অনেক পাহাড়েই বেরোয়, তা বলে চট করে বিস্ফোরণ ঘটে না। গতিক সুবিধের নয় দেখে শেষে মাঝিরা বেঁকে বসলে পর সে বাধ্য হয়ে দ্বীপ ছেড়েছিল। কিন্তু সেজন্য তার কী রাগ, আর মাঝিদের কী গালাগালি!

আসলে চ্যাং—এর মতলব ছিল সবচেয়ে কাছের দ্বীপটায় আশ্রয় নেবে। কিন্তু আগ্নেয় পাহাড়কে পাশ কাটিয়েই দূরবিনে দেখে ওই দ্বীপের সমুদ্রতীরে প্রফেসর দত্তর দলবল দাঁড়িয়ে। ফলে নৌকোর মুখ ঘুরিয়ে তারা অন্য দিকে পাড়ি দেয়। ঘন্টা দুই সমুদ্রযাত্রার পর হঠাৎ তাদের কানে ভেসে আসে বিস্ফোরণের আওয়াজ। তার একটু বাদেই এল ঝড়। সঙ্গে সঙ্গে প্রচণ্ড ঢেউ ওঠে। সেই দুর্যোগে মাঝিরা যখন নৌকো ও নিজেদের প্রাণ বাঁচাতে মরিয়া তখন চ্যাং মাঝিদের হুকুম করে, পাখির খাঁচাগুলো নৌকোর খোলের গায়ে শক্ত করে বেঁধে ধরে থাকতে। যাতে সেগুলো ঠোকর না খায়। মাঝিরা তার আদেশ মানেনি। তখন চ্যাং তাদের মারতে থাকে। বন্দুক নিয়ে গুলি করার ভয় দেখায়। মাঝিরা তার হাত থেকে বন্দুক কেড়ে নেবার চেষ্টা করে। সেই ধস্তাধস্তির সময় চ্যাং উল্টে পড়ে যায় জলে। আর তার দেখা পাওয়া যায়নি। নৌকো বেটাল হয়ে ছোটে। শেষে এই দ্বীপের গায়ে সজোরে ধাক্কা খায়। আহত হলেও বাকিরা প্রাণে বেঁচেছে। ওই যে নৌকো—

দেখা গেল চ্যাংদের নৌকোটা দুমড়ে ভেঙে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে দ্বীপের সমুদ্রতটে।

প্যারাডাইস বার্ড ধরতে পেরেছিলে? দত্তদা প্রশ্ন করলেন কিচিলকে।

হ্যাঁ! জবাব দিল কিচিল।

কটা? ঠিক করে বলো। দত্তদা ধমকে উঠলেন।

কিচিল ঢোঁক গিলে বলল, চারটে। আমার দোষ নেই স্যার। আমি শুধ সঙ্গে এসেছিলাম। যা করছে সব ওই চ্যাং।

নতুন জাতের প্যারাডাইস—বার্ড ধরতে পেরেছিলে? জিজ্ঞেস করলেন দত্তদা।

হ্যাঁ। মাত্র একজোড়া। বেশি পাখি ছিল না দ্বীপে। সব উড়ে পালাচ্ছিল ধোঁয়ার ভয়ে।

পাখিগুলো কোথায়?

চ্যাং জলে পড়ে যাওয়ার পর মাঝিরা খাঁচা খুলে সব পাখি উড়িয়ে দিয়েছে। এর ধারণা হয়েছিল, পাখিগুলো অপয়া। ওদের জন্যেই এই বিপদ।

পাখি মেরেছ কটা?

মাত্র একটা। জ্যান্ত ধরার চেষ্টাতেই ছিল চ্যাং। কারণ জীবন্ত পাখির দাম ঢের বেশি।

মৃত পাখিটা আছে?

না। মাঝিরা ফেলে দিয়েছে জলে।

আর কথা না বলে দত্তদা গুম হয়ে রইলেন খানিক। চ্যাং—এর মাঝিরা দত্তদার পায়ের কাছে হাঁটু গেড়ে বসে কাতর কণ্ঠে বলতে লাগল, দোহাই, আমাদের ফেলে রেখে যাবেন না। এখানে থাকলে আমরা মারা পড়ব। এ—দ্বীপে খাবার জল নেই।

ঠিক আছে। আশ্বাস দিলেন দত্তদা। তারপর পিছনে ফিরে হাঁটতে শুরু করলেন, তপনও তার সঙ্গে সঙ্গে চলল।

গভীর নিশ্বাস ফেলে দত্তদা বললেন, বুঝলে তপন, চ্যাং উচিত শাস্তিই পেয়েছে। কিন্তু ওর লোভের জন্য দুর্লভ পাখিগুলো হাতছাড়া হল, এ বড় আপশোসের।

সত্যি আপনার এত চেষ্টা ব্যর্থ হল। তপন সান্ত্বনা জানায়।

না, পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছি বলা যায় না, ম্লান হেসে বললেন দত্তদা, একটা ধূর্ত শয়তানের চক্রান্ত ব্যর্থ করেছি। পাখিগুলো তাকে অধিকার করতে দিইনি। এইটুকু যা লাভ! কাছের দ্বীপটায় আশ্রয় নিতে পারলে ওদের উদ্দেশ্য সফল হত, আমরা গিয়ে পড়তেই তা সম্ভব হয়নি।

পড়ন্ত বেলায় অস্তরবির আলোয় মলুক্কা সাগরের নীল জল যেন সিঁদুর—গোলা। কিছু দূরে একটা দ্বীপের দিকে খানিকক্ষণ উদাসভাবে চেয়ে থেকে দত্তদা বললেন, প্রার্থনা করো তপন, ডিক্সন দ্বীপের পাখিরা যেন নিরাপদে আশ্রয় পায়। বার্ডস অফ প্যারাডাইস—এর ওই নতুন স্পিশিসটি যেন টিকে থাকে! হয়তো ভবিষ্যতে একদিন কোনো পক্ষিবিদের চোখ মেস্‌মন আইল্যান্ডস—এর কোনো দ্বীপে আবিষ্কার করবে এক নতুন ধরনের মানুক—দেওতা। সার্থক হবে জন ডিক্সনের স্বপ্ন।

তারপরই তিনি হাসিভরা উজ্জ্বল মুখে তপনের দিকে তাকিয়ে বললেন, কি ব্রাদার, অ্যাডভেঞ্চার চেয়েছিলে, সাধ মিটেছে?

তপন চুপ করে থাকে। ভাবে, সাধ কি সত্যি মিটেছে? বোধ হয় না। একবার এর স্বাদ পেলে তৃষ্ণা যে বেড়ে যায়!

আপাতত ব্যাংকক। তারপর কখনো কলকাতায় ফেরা। শহরের সেই বাঁধাধরা দিন যাপন। কিন্তু মাঝে মাঝে কি সে দত্তদার মতন ছটফটিয়ে উঠবে না? বিচিত্র অজানা দেশের ডাক, অ্যাডভেঞ্চারের সুযোগ এলে কি সে এড়াতে পারবে? তার মন বলছে পারবে না। ঠিক সাড়া দেবে। দিতেই হবে।

ধন্যবাদ দত্তদা। ধন্যবাদ গোবিন্দ সিং। ধন্যবাদ বন্ধু গুরুর দাদা সুনীল ব্যানার্জি। তোমাদের দৌলতেই আমার অতিসাধারণ জীবনটা বদলে গেল। এমন আশ্চর্য অভিজ্ঞতার স্বাদে ভরপুর হয়ে উঠল।