☼ অজেয় রায় ☼
মানুক দেওতার রহস্য সন্ধানে
সাত
বিকেলে নৌকো নোঙর ফেলল এক দ্বীপে। জোড়া দ্বীপ এখনো নজরে আসেনি। দত্তদা বললেন, এখন খানিক বিশ্রাম। এখানে ঝরনা আছে, এটা মস্ত সুবিধে। কাল সকালে ফের রওনা হব।
একজন মাঝি দৌড়তে দৌড়তে এসে বলল, আসাপ! আসাপ!
মালয় ভাষায় আসা মানে ধোঁয়া। কোথায়? দ্বীপের অন্য ধারে গিয়েছিল লোকটি। সেখান থেকে দেখেছে—দূর সাগরের বুকে ধোঁয়া।
সবাই গেল সেই ধারে। কিছু দূরে এক পাহাড়ি দ্বীপ। তার ওপর ধোঁয়া জমেছে। কারখানার চিমনি দিয়ে যেমন ধোঁয়া বেরোয়, তেমনি দ্বীপের পাহাড়ের নেড়া চুড়োটা থেকে ধোঁয়ার রাশি আকাশে উঠে জমাট বাঁধছে—ছাতার মতো দেখতে যেন একখণ্ড গাঢ় কালো মেঘ।
পোকো বলল, আপি পুলো। অর্থাৎ আগুনে দ্বীপ।
আলী চমকে উঠে বলল, বাবা বলেছিল, পাশাপাশি দুটো দ্বীপের একটা আগুনে দ্বীপ। তবে এখন ঠাণ্ডা। মানে জোড়া দ্বীপের একটা, যেখানে গিয়েছিল বাবা ডিক্সন সাহেবের সঙ্গে।
দত্তদা দূরবিনে দেখে বললেন, জোড়া দ্বীপ তো কই দেখছি না। এই অঞ্চলে এমনি অ্যাকটিভ ভলক্যানো কিছু আছে। অনবরত ধোঁয়া বেরোয়। কখনো কখনো বিস্ফোরণও হয়।
পোকো বলল, ধোঁয়া বেরোয় এমন দ্বীপ এখানে আছে কই শুনিনি? হয়তো অল্প কিছ দিন হল বেরোচ্ছে।
পরদিন দত্তদা বললেন, আমি ওই আগ্নেয় দ্বীপটা থেকে একবার ঘুরে আসি। দেখতে চাই ওটার আড়ালে কোনো দ্বীপ আছে কিনা। ওখানেই কি ডিক্সন আইল্যান্ড? বিকেলের আগেই ফিরে আসব। মাইল তিনেকের বেশি তো দূর নয়।
তপন বলল, বেশ, সবাই মিলে যাই।
দত্তদা বললেন, না। এখুনি ওই দ্বীপে সবাই হাজির হওয়া ঠিক হবে না। দ্বীপটার অবস্থা সুবিধের নয়। যা ধোঁয়া বেরুচ্ছে! আমি শুধু পোকো, আলী এবং আর একজন মাঝিকে নিয়ে যাব। অন্যরা এখানে বিশ্রাম নিক।
ডন বলল, আমিও যাব।
দত্তদা বললেন, কোনো দরকার নেই।
ডন বলল, ধরুন ওটাই ডিক্সন আইল্যান্ড। এবং চ্যাং ইতিমধ্যে ওখানে আড্ডা গেড়েছে। তখন? অমি তাই সঙ্গে যেতে চাই।
হতে পারে, বললেন দত্তদা, তোমাকে এখন সঙ্গে নেব না। তোমার আঙুলে জখম। রেস্ট দরকার। চ্যাং থাকলে আমি গোঁয়ারের মতো ওদের মুখোমুখি হব না নিশ্চয়ই। লুকিয়ে পালিয়ে আসব। তারপর পন্থা স্থির করা যাবে, কীভাবে ওদের উৎখাত করব। তখন তোমার সাহায্য লাগবে বইকি!
দত্তদা একাই নৌকো আর কয়েকজন মাঝিকে নিয়ে সেই ধূমায়িত দ্বীপের উদ্দেশে রওনা হলেন।
সেদিন বিকেল গেল। সন্ধে গেল। রাত্রি নামল। দত্তদারা কিন্তু ফিরলেন না।
সমুদ্রতীরে অপেক্ষা করে ডন ও তপন। তাদের দৃষ্টি জলের দিকে। এখনও কেন ফিরলেন না দত্তদা! দুপুরে ঝোড়ো হাওয়া বয়েছিল খানিকক্ষণ। তাতে কি নৌকো ডুবতে পারে? না, অন্য কোনো বিপদে পড়লেন? দুজন কখনো বসছে, কখনো অস্থিরভাবে। পায়চারি করছে। যদি দত্তদা না ফেরেন? নৌকো ছাড়া তারা যে এই দ্বীপে বন্দী। বেরিয়ে। খোঁজখবর করারও উপায় নেই। এই দ্বীপ থেকে মুক্তির উপায় একদিন ঠিকই হবে কিন্তু দত্তদাকে ছাড়া ফিরতে হবে নাকি? এ ঘটনাটি স্বীকার করার কথা মনে এলেই বুক হিম হয়ে। যাচ্ছে তপনের। কোন্ মুখে সে বৌদির সামনে গিয়ে দাঁড়াবে ব্যাংককে ফিরে?
মাঝরাত। ফুটফুটে জ্যোৎস্নার আলো। ডন বলল, কী যেন একটা আসছে। মনে হচ্ছে নৌকো।
ঠিক তাই। লাফিয়ে উঠল তপন। নৌকো এসে নোঙর ফেলল তীরে। ছুটে কাছে গেল দুজনে।
নৌকো থেকে নামল পোকো, আলী আর একজন মাঝি। কিন্তু দত্তদা কই? পোকো জানাল যে, আগ্নেয় দ্বীপের ঠিক পিছনে আছে আর একটা দ্বীপ। সেই দ্বীপে যখন তারা পোঁছয় তখন দুপুর। দ্বীপ থেকে ভেসে আসে কতকগুলো শব্দ। মনে হল কেউ কাঠ কাটছে। দত্তদা বললেন যে, উনি দ্বীপে উঠে একবার উঁকি দিয়ে আসবেন। পোকোরা নৌকো নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে। দুত্তদা তীরে উঠে ঢুকে যান ভিতরে।
অল্পক্ষণ বাদে হঠাৎ একটা লোক এসে দাঁড়ায় তীরে। লম্বা—চওড়া এক শ্বেতাঙ্গ। হাতে বন্দুক। সে চিৎকার করে কী জানি বলে। তারপর বন্দুক তাক করে নৌকো লক্ষ্য করে। বেগতিক বুঝে পোকো নোঙর তুলে ফেলে। লোকটা গুলি চালায় একবার। ভাগ্যিস নৌকোর কারোর গায়ে লাগেনি! তখন প্রাণভয়ে দাঁড় টেনে পালায় মাঝিরা। হা—হা অট্টহাসি দেয় লোকটা। বন্দুক তুলে বুঝিয়ে দেয়, কাছে এলেই গুলি করবে।
পোকো নৌকো নিয়ে দূরে সরে গিছল। মতলব ছিল, ঘণ্টাখানেক বাদে আবার ওখানে ফিরে দত্তদাকে তুলে নেবে। কিন্তু ঝোড়ো বাতাস উঠল। নৌকোকে টেনে নিয়ে গেল অনেক তফাতে। যখন ফেরার সুবিধে হল তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে। অন্ধকারে ওই বিপজ্জজনক দ্বীপের কাছে যেতে ভরসা হয়নি তাদের। কারণ দ্বীপটার ধারে ধারে প্রচুর প্রবাল প্রাচীর। ভয়ে তাদের বুদ্ধিসুদ্ধিও কেমন গুলিয়ে গেছিল। কী করবে ভেবে না পেয়ে আপাতত নিজেদের আস্তানাতেই ফিরে এসেছে।
চল এখুনি, দত্তদাকে উদ্ধার করে আনি, তপন উত্তেজিত। ডন খানিক চুপ করে থেকে বলল, এখন নয়। এখন গেলে পোঁছতে সকাল হয়ে যাবে। ওরা দেখে ফেলতে পারে। আমরা ডাঙায় ওঠার আগেই গুলি চালালে বিপদে পড়ব। যাব কাল রাতে। অন্ধকারে গা—ঢাকা দিয়ে। প্রফেসর ঠিকই সব লক্ষ্য রেখেছেন এবং সাবধানে লুকিয়ে থাকবেন। ওটা যে আমাদের নৌকো ওরা বুঝতে পারেনি। ভেবেছে, সাধারণ জেলে—নৌকো। তাই ভয় দেখিয়ে তাড়াতে চেয়েছে।
ওটাই কি ডিক্সন আইল্যান্ড? তপন জিজ্ঞেস করল।
তাই মনে হচ্ছে, নইলে চ্যাং ওখানে আড্ডা গাড়বে কেন? বলল ডন।
রাতে রওনা হল তপনরা।
আগ্নেয়দ্বীপকে পাশ কাটিয়ে তপনদের নজরে এল ডিক্সন আইল্যান্ড। আগ্নেয়গিরির ধোঁয়ায় সেখানকার আকাশে চাঁদের আলো আড়াল হয়ে গেছে। এক হিসেবে ভালোই হল। সহজে কারো নজরে আসবে না আগুয়ান নৌকোখানি। তীর আর বড়জোর পঞ্চাশ হাত। পোকো বলল, সামনে প্রবাল প্রাচীর। আর এগনো বিপজ্জনক।
এইখানেই নেমেছিলেন দত্তদা। তখন দিনের বেলায় প্রবাল প্রাচীরের ফাঁকে ফাঁকে নৌকো তীরের কাছে গিয়েছিল। এখন রাতে কিছু বোঝার উপায় নেই।
ওই দেখ একটা আলো, দেখাল আলী।
সমুদ্রতীরে জলের ধারে একটা ছোট্ট বৃত্তাকার আলো। জ্বলছে আর নিভছে। ও আলো টর্চের। কেউ সংকেত জানাচ্ছে। নিশ্চয়ই দত্তদা।
নৌকো থেকে আলোর সংকেত দিতে ভয় হল। যদি চ্যাং—এর দলের কারও চোখে পড়ে যায়? ডন বলল, আমি.গিয়ে পথ দেখিয়ে নিয়ে আসছি প্রফেসরকে। আমাদের জবাব না পেলে নৌকোয় আসতে ভরসা পাচ্ছেন না উনি। এখানে ঢেউ বেশি নেই। পাথরগুলোর পাশ কাটিয়ে সাঁতরে যাব অনায়াসে।
আপনি নয়, আমি যাই, বলল জিয়ান।
কেন?
ধরুন প্রফেসর ওদের হাতে বন্দী। আর ওই আলোর সংকেত হচ্ছে ফাঁদ। চ্যাং—ই আলো দেখাচ্ছে, আমাদের কাছে টেনে এনে বেকায়দায় ফেলে আক্রমণ করার মতলবে। আপনিও বন্দী হলে সর্বনাশ। প্রফেসরকে রক্ষা করার জন্যই আপনার মুক্ত থাকা দরকার। আমি বন্দী হলেই বা ক্ষতি কী? আমার প্রাণ বাঁচিয়েছেন। দয়া করে, ঋণটুকু শোধ করার সুযোগ দিন।
ডন একটু ভেবে বলল, বেশ তুমিই যাও। যদি সত্যি ফাঁদ হয়, একটা চিৎকার দিয়ে আমাদের সাবধান করে দিও।
সেই মিটমিটে জ্বলা—নেভা আলোর দিকে তাকিয়ে কঠোর স্বরে বলল ডন, যদি প্রফেসরের কোনো ক্ষতি করে ওরা, আমি ঠিক ওই দ্বীপে উঠব লুকিয়ে। তারপর পাগলা কুকুরের মতো গুলি করে মারব সব কটাকে।
জলে নেমে নিঃশব্দে অদৃশ্য হল জিয়ান।
নৌকোর আরোহীরা প্রতীক্ষায় উৎকণ্ঠ। আলোটা আর জ্বলছে না। দত্তদার দেখা পেল কি জিয়ান? না, চেঁচিয়ে ওঠার আগেই ওকে স্তব্ধ করে দিয়েছে ধূর্ত চ্যাং?
সহসা নৌকোর ধারে ভেসে ওঠে দুটি দেহ।
ডন— দত্তদার গলা।
সবাই ঝুঁকে পড়ে হাত বাড়াল। নামিয়ে দেওয়া হল দড়ির সিঁড়ি।
প্রথমে উঠলে দত্তদা। তারপর জিয়ান। ডন জিয়ানের হাত ধরে ঝাঁকিয়ে বললেন ওয়েল ডান। থ্যাঙ্ক ইউ।
একটু জিরিয়ে নিয়ে দত্তদা বললেন, দোহাই, আগে কিছু খেতে দাও। পেট জ্বলছে।
ফ্লাক্স থেকে ঢালা গরম কফিতে চুমুক দিয়ে বিস্কুট চিবুতে চিবুতে দত্তদা বললেন তাঁর অভিজ্ঞতা।—হ্যাঁ, ওটা ডিক্সন আইল্যান্ড সন্দেহ নেই। দত্তদা প্যারাডাইস বার্ড—এর ডাক শুনেছেন। ঝোপ ও পাথরের আড়াল থেকে লক্ষ করেছেন চ্যাংদের। চ্যাং—এর দলে চার জন মাঝি। আর রয়েছে চ্যাং ও ঢ্যাঙা কিচিল। ওরা পাখি ধরছে। জালের ফাঁদ নিয়ে যেতে দেখেছেন মাঝিদের। হতভাগারা পাখি মারছেও। চ্যাংকে দেখেছেন দত্তদা, একটি মৃত প্যারাডাইস বার্ড হাতে ঝুলিয়ে নিয়ে যেতে। তবে বার্ড অফ প্যারাডাইসের নতুন স্পিশিস ওরা ধরতে পেরেছে কিনা ঠিক জানেন না। বেশি কাছে যেতেও ভরসা হয়নি।
দত্তদা বললেন, কাল রাতেই ডিক্সন আইল্যান্ডে চড়াও হতে হবে। রাতদিন ওরা সমুদ্রে নজর রাখে চ্যাং আর কিচিলকে কাবু করতে পারলেই কেল্লা ফতে। শুধু ওদের দুজনেরই বন্দুক আছে। বার্ড অফ প্যারাডাইস হত্যা বেআইনি। এই অপরাধেই ওদের গ্রেফতার করা যাবে। তারপর আমরা নতুন স্পিশিসটার সন্ধান করব। সাবধান, বিষাক্ত সাপ আছে দ্বীপটায়। ভীষণ বিষাক্ত ডেথ অ্যান্ডার। আমি দেখেছি নিজের চোখে। হয়তো এই ভয়েই ও দ্বীপে কেউ যায় না।
দত্তদাকে সঙ্গে নিয়ে সবাই নৌকোয় ফেরে ডিক্সন আইল্যান্ড থেকে।
পরদিন সাজ—সাজ রব পড়ে গেল।
আসন্ন লড়াইয়ের সম্ভাবনায় মাঝিদের কী উৎসাহ! তাদের কথাবার্তা শুনে তপনের ধারণা হল যে, অকারণে তাদের ওপর গুলি ছোঁড়ার জন্য মাঝিরা চ্যাং ও কিচিলের ওপর বেজায় চটে আছে। তারা জিয়ানের মুখে শুনেছে, চ্যাং লোকটা পাক্কা শয়তান। দা, কুঠার, লাঠি, তির, ধনুক ইত্যাদি হাতিয়ার জোগাড় হল। একটাই বন্দুক। সেটা নেবে ডন।