» » মানুক দেওতার রহস্য সন্ধানে

বর্ণাকার

অজেয় রায়

মানুক দেওতার রহস্য সন্ধানে

ছয়

নৌকো স্পর্শ করল মেস্‌মন আইল্যান্ডস—এর পশ্চিম প্রান্তের একটি দ্বীপ। সমুদ্রগর্ভের কোনো পাহাড়ের চূড়া জলের বাইরে দ্বীপ হয়ে জেগে আছে। চার—পাঁচশো ফুট উঠেছে। অন্তত। পাহাড়ের গায়ে উদ্ভিদের আবরণ।

দত্তদা বললেন, মাঝিরা বিশ্রাম করুক। এবার আমরা বেরব জল খুঁজতে।

পোকো কিন্তু ছাড়ল না। সেও সঙ্গে চলল। দত্তদা তপনকে বললেন, তুমি নৌকো থেকে দূরে যেও না। কাছাকাছি খোঁজো। না হয় আমার সঙ্গে চলো।

তপন একাই খুঁজতে চাইল।

জলের ধারে ধারে খানিক চক্কর দিল তপন। ঝরনা, নদী বা জমে থাকা বৃষ্টির জলের কোনো চিহ্ন নেই। সে পাহাড়ে উঠতে লাগল।

পাহাড়ের গায়ে ছোট—বড় গাছ—ক্যাসুয়ারিনা, ধ্রু—পাইন, মানুষ—সমান উঁচু ফার্ন। একজাতীয় ডুমুর গাছ। লালচে মাটি ধুয়ে বেরিয়ে পড়েছে খোঁচা খোঁচা পাথর। বার কয়েক তপন হোঁচট খেল। নেহাৎ পুরু চামড়ার জুতো ছিল পায়ে, তাই পা কাটেনি। অনেক পাখি। চোখে পড়ছে। কাঠবেড়ালী, বুনো শুয়োরও দেখল। এরা জল খায় কোত্থেকে?

প্রায় নাকের ডগায় লাফ দিয়ে পড়ল একটা প্রকাণ্ড বীভৎস দেখতে মাকড়শা। ছিটকে পিছিয়ে এল তপন। সে শুনেছে, এমনি মাকড়শার কামড়ে ভীষণ বিষ।

উঠতে উঠতে বুকে হাঁপ ধরে। মাটিতে বসে জিরোয় তপন। এবার নামা যাক। আমি ব্যর্থ হলাম, তবে অন্যদের অভিজ্ঞ চোখ ঠিক আবিষ্কার করবে তাদের তৃষ্ণার জল।

নামতে নামতে তপন থমকে দাঁড়াল। একটা গুহা—মুখ যেন? ভিতরটা অন্ধকার। কৌতূহলী হয়ে সে উঁকি দিল। কতটা লম্বা বোঝা গেল না। পিঠের হ্যাঁভারস্যাক খুলে বের করল টর্চ। আলো ফেলে মনে হল গুহাটা বেশ গভীর। আলো শেষ অবধি পৌঁছচ্ছে না। কেমন বোটকা গন্ধ। মেঝেয় আলো ফেলে দেখল, মাটিতে জলের দাগ। দতদা Iশখিয়েছিলেন যে, জল বয়ে যাওয়ার চিহ্ন দেখলে অনুসরণ করবে। ঝরনার উৎস বা বটিস জমা জল খুঁজে পেতে পারো।

গুহাটা নিচ দিকে গড়ানো। ভিতরে ঢুকুল তপন। যদি বুনো জানোয়ার বা সাপ থাকে? এখানে হিংস্র জন্তু নেই শুনেছে। তবে বিষাক্ত সাপ থাকতে পারে বইকি! কোমরে ঝোলানো মোটা বেঁটে বেতের লাঠিটা এক হাতে, অন্য হাতে টর্চ জ্বেলে তপন পা টিপে চিপে এগোল জলের ধারার চিহ্ন অনুসরণ করে।

বিকট বোঁটকা গন্ধটা তীব্র হল। মাথার ওপর কীসের নড়াচড়া? ছাদে আলো ফেলে। তপন চমকে গেল। সারি সারি বাদুড় ঝুলছে উল্টো মুখে। আঁধারের জীব। আলোর আবির্ভাবে চঞ্চল হয়ে উঠেছে। যাক, বাদুড়কে ভয় করার কিছু নেই। এগোল তপন।

বারবার টর্চের জোরাল আলো পড়তে কিছু বাদুড় উড়তে শুরু করল। তারা বাইরে দিনের আলো গেল না। গুহার মধ্যেই পাক খেতে থাকে। স্যাঁৎ স্যাঁৎ করে কাটিয়ে যায় তপনকে। মাঝে মাঝে উড়ন্ত জীবগুলোর ডানার শীতল ছোঁয়া লাগে। গা শিরশির করে ওঠে। আর এগোতে ভরসা পায় না তপন। ডাইনে দরজার মতো একটা ফাটল। গুহার শাখা। তার ভিতরে সে পা বাড়ায়। একঝাঁক বাদুড় ভেসে আসে অন্ধকার ভেদ করে।

তাদের এড়াতে গিয়ে তপন হুমড়ি খেয়ে পড়ল। গড়াতে গড়াতে নেমে চলল পাথুরে ঢালু জমি বেয়ে। তারপর আছড়ে চিৎপাত হয়ে পড়ল কঠিন ভূমিতে।

বোধহয় চার—পাঁচ সেকেন্ড সম্বিত ছিল না তপনের। হুঁশ হতে উঠে বসল। দেহে কয়েক জায়গায় দারুণ ব্যথা। টর্চটা হাত ফসকে গেছে। হাতড়ে হাতড়ে সে টর্চ খোঁজে। ভিজে ভিজে জমি। তারপরই শিহরণ। জল! কনকনে ঠাণ্ডা জলে হাত পড়েছে। আঁজলা করে একটু জল নিয়ে তপন মুখে দিল। আঃ কী চমৎকার! গলা জিভ জুড়িয়ে গেল। পেট ভরে সে জল খেল। চোখে—মুখে জলের ঝাঁপটা দিল। হাত দিয়ে অনুভব করল একটা জলের কুণ্ড। এগোতে আর সাহস হল না। কত গভীর কুণ্ড কে জানে! ওপরে তাকাল। ক্ষীণ আলোর রেখা ফাটলের মুখে প্রায় হাত কুড়ি ওপরে। চোখ একটু সয়ে যেতে অন্ধকার একটু ফিকে ঠেকল। ওয়াটার বটলটায় জল ভরল। তারপর দেয়াল আঁকড়ে আঁকড়ে ওপরে ওঠার চেষ্টা করে। ঢালুর ধারে অনেক খাজ খাঁজ, তাই ওঠাটা তেমন শক্ত হল না। বাইরে গিয়ে সে সোজা নেমে গেল নৌকোর কাছে। দত্তদারা তখনো ফেরেনি।

নৌকো থেকে ডনের বন্দুকটা নিয়ে তপন দুবার ফায়ার করল। এটা সংকেত। সবাইকে ফিরে আসতে ডাকা হচ্ছে।

পনেরো মিনিটের মধ্যে পৌঁছল ডন। তপনকে দেখে বলল, কী ব্যাপার, পড়ে গিছলে। নাকি? তোমার কপালটা ফোলা কেন?

ওসবে ভ্রূক্ষেপ নেই তপনের। জিজ্ঞেস করল, জল পেয়েছ?

না। হতাশভাবে ঘাড় নাড়ল ডন।

আমি পেয়েছি। তপন সংক্ষেপে জানাল গুহার বিবরণ।

কই দেখি?

জলের বোতলটা হাতে পেতেই ডন ঢকঢক করে অনেকখানি জল খেল। বোঝা গেল কতখানি তেষ্টা চাপা ছিল তার বুকে।

মিনিট পাঁচেক বাদে এলেন দত্তদা। ডন জিজ্ঞেস করল তাকে—জল পেয়েছেন?

না।

আমিও পাইনি। কিন্তু তপন পেয়েছে। চমৎকার জল।

সাব্বাস! সব শুনে দত্তদা তপনের পিঠ চাপড়ে দিলেন। তিনিও জল খেলেন তৃপ্তি ভরে। ডনকে নিয়ে ছুটলেন আরও জল আনতে। তপনের কাছে জেনে নিলেন গুহাটার হদিশ। তপনকে সঙ্গে যেতে দিলেন না। বললেন, তুমি রেস্ট নাও।

আমার টর্চটা আনবেন। মনে করিয়ে দিল তপন।

পোকোও ফিরল। সে একটা গর্তে জমা জল পেয়েছে। তবে খুবই সামান্য। জল নিশ্চয়। আরও জায়গায় আছে। তবে খুঁজতে সময় লাগবে।

ঠাণ্ডা স্বাদু জল পান করে সবাই ফের তাজা হয়ে উঠল। আলী মেতে উঠল বানার তোড়জোড়ে। জালে পড়ল একঝাক অতি সুস্বাদু চাদা মাছ। তোফা ভাজা হবে। মানিক। পাহাড়ের গায়ে পাথরের খাঁজে পেল একগাদা পায়রার ডিম। টগবগিয়ে ভাত ফোটে। রাক্ষসের মতো খেল সবাই। খেয়েই গড়িয়ে পড়ল মাটিতে। ব্যস, ঘুম।

রাতটা সেখানেই কাটল। ভোর রাতে ফের যাত্রা শুরু হল।

মাইল দেড়েক এগিয়েছে নৌকো। জলের বুকে দেখা গেল দু—তিনটে কালো কালো বিন্দু। দত্তদা দূরবিন দিয়ে দেখতে দেখতে বললেন, ডুবো পাহাড়ের চুড়ো। আরে ওটা কী! নড়ছে। এ যে মানুষ! একটা পাথরের মাথায়। ডাকছে আমাদের হাত নেড়ে। আরে কী আশ্চর্য, এ যে জিয়ান! চালাও চালাও নৌকো ওইখানে—

তপনদের নৌকো কাছে যেতেই স্পষ্ট দেখা গেল—হাত তিরিশ উঁচু গম্বুজের মতো একখণ্ড নেড়া পাথর জলের বাইরে খাড়া হয়ে আছে, তার মাথায় গিরগিটির মতন লেপটে রয়েছে জিয়ান। নৌকো লক্ষ্য করে প্রাণপণে হাত নাড়ছে।

জিয়ানের কাছ অবধি নৌকো এগোল না। ওই গম্বুজের আশেপাশে আরও ডুবো পাহাড়। কোনোটার ডগা দেখা যাচ্ছে, কোনোটা বা জলের তলায়। জায়গায় জায়গায় জল। ঘুরছে, বুজকুড়ি কাটছে ফেনা। বোঝা যায় স্রোত বাধা পাচ্ছে। শুশুকের শিরদাঁড়ার মতো কোথাও জলের ওপরে কালো পাথরের রেখা। একগাছি মোটা দড়ি ঘুরিয়ে ছুঁড়ে দিল। পোকো। একটা ছোট স্কুপের গায়ে জড়িয়ে গেল দড়ির ফঁস। থেমে গেল তরী।

জিয়ান হাত তিরিশ দুরে। ওকে ইশারা করা হল—ঝাঁপিয়ে পড়ো। সাঁতরে এসো।

জিয়ান একটু ইতস্তত করে লাফিয়ে পড়ল জলে।

কিন্তু আধাআধি পেরোবার আগেই জিয়ান শ্রান্ত হয়ে পড়ল। হাবুডুবু খাচ্ছে। ক্রমেই ভেসে যাচ্ছে দূরে।

ও পারছে না। ডুবে যাবে, বললেন দত্তদা। তিনি ছুটে গিয়ে এক বান্ডিল দড়ি বের করে আনলেন। সরু লম্বা নাইলনের দড়ি। চটপট খুলতে লাগলেন নিজের পোশাক। বোঝা গেল জিয়ানকে বাঁচাতে তিনি স্বয়ং জলে ঝাপাতে চান।

আপনি থাকুন, বাধা দিল পোকো, আব্দুর, সে চেঁচিয়ে ডাকল।

তৎক্ষণাৎ আব্দুর মাঝি দড়ির এক প্রান্ত কোমরে বেঁধে লাফিয়ে পড়ল জলে। দড়ির অন্য ধার রইল পোকোর হাতে।

মাছের মতো জল কেটে চলল আব্দুর। মিনিট দশেকের মধ্যেই সে ধরে ফেলল জিয়ানকে। জিয়ান দু—মুঠোয় চেপে ধরল দড়ি। নৌকো থেকে ধীরে ধীরে গুটিয়ে আনা হল দড়ি। নৌকোয় টেনে তোলা হল দুজনকে। হাঁপাতে হাঁপাতে জিয়ান চেতনা হারিয়ে ঢলে পড়ল।

খানিক শুশ্রূষার পর সুস্থ হয়ে উঠলে জিয়ানকে সকলে মিলে প্রশ্ন শুরু করল। ওখানে কেন? কীভাবে?

জিয়ান যা উত্তর দিল তা মোটামুটি এই—

চ্যাং—এর সঙ্গে যাচ্ছিল জিয়ান ডিক্সন দ্বীপের খোঁজে। চ্যাং একজন শাগরেদ এনেছে। নাম তার কিচিল। মালয় ভাষায় কিচিল মানে খুদে। লোকটা কিন্তু বিরাট লম্বা—চওড়া এবং গুণ্ডা প্রকৃতির। যে দ্বীপে পাখির চামড়াটা জিপসিদের কাছ থেকে কেনা হয়েছিল সেখানে তারা থামে। তারপর জিপসিদের নির্দেশমতো নৌকো চালায়। এই জায়গা দিয়ে যখন যাচ্ছিল জিয়ানরা তখন সন্ধেবেলা। ছইয়ের গা ঘেঁষে বাইরে বসেছিল জিয়ান। ভিতরে ছিল। চাং ও কিচিল। তাদের কথাবার্তা শুনতে পাচ্ছিল জিয়ান। এটা সেটা কথার পর কিচি বলে ওঠে— পাখি পাব তো?

মনে তো হয়। চ্যাং জবাব দেয়।

যদি না পাই?

তাহলে মুশকিল। প্রিন্সের কাছে ধ্যাতানি খেতে হবে। এত খরচপত্তর দিয়েছে। তবে মনে হয় জিয়ানের খবর ঠিক।

ওঃ, পেলে কিন্তু দারুণ দাঁও। প্রিন্স আমাদের লক্ষপতি করে দেবে বলেছে। আচ্ছা জিয়ানকে কত দেবে? মানে যদি পাখি পাওয়া যায়?

খিকখিক করে চ্যাং—এর হাসি শোনা যায় এবং বলে, জিয়ান? ফুঃ! একটি পয়সাও নয়। ওর ভাগটা আমরা নেব।

না দিলে ছাড়বে কেন? কষ্ট করে নিয়ে এল পথ দেখিয়ে, বলল কিচিল।

নেবার জন্যে ও বেটা তখন থাকলে তো?

মানে?

মানে ওটাকে আগেই সাবড়ে দেব। নতুন জাতের প্যারাডাইস বার্ড—এর ঠিকানা প্রিন্স আর আমরা দুজন ছাড়া আর কারও জানা থাকবে না। এই জন্যেই মাঝিগুলোকে এনেছি দূর থেকে। ওরা এ—পথে আসে না। ওরা বুঝতেও পারবে না পাখিগুলোর দাম কতখানি। তাছাড়া ভয় দেখিয়ে, টাকা দিয়ে ওদের মুখ বন্ধ করে দেব—খবরদার কাউকে বলবে না যে এখানে প্যারাডাইস বার্ড পাওয়া গেছে।

জিয়ানকে মারবে কেন? ওর মুখও যদি বন্ধ করা যায়?

এখন বন্ধ করা যাবে। কিন্তু পরে যদি বেটা ফাঁস করে দেয়। প্রিন্সের বেইজ্জত হবে। না না ওকে রাখা চলবে না। শেষে সব ভণ্ডুল হয়ে যাবে।

মাঝিরা যদি বলে ফেলে পরে?

ওরা কাকেই বা বলবে? কিন্তু জিয়ান হয়তো বলে দেবে ব্যাংককের সেই প্রফেসরকে।

ওকে শেষ করবে কখন? জিজ্ঞেস করে কিচিল।

চ্যাং বলে ওঠে, এখনই করা যায়। মাথায় মোক্ষম এক ঘা মেরে নৌকো থেকে দেব ফেলে। তবে মাঝিরা যেন টের না পায়। ভড়কে যাবে। ঝামেলা করবে। থাক বরং সামনের দ্বীপে যেখানে থামব, সেখানেই ডাঙায় নেমে ওকে লুকিয়ে খতম করে ফেলে দেব জলে। ওকে আর আমাদের দরকার কী?

চ্যাং—এর এই কথা শুনে জিয়ানের দারুণ ভয় হয়। উঃ, কী শয়তান! আর অপেক্ষা করতে তার সাহস হয়নি। অন্ধকারেই সটান লাফিয়ে পড়েছিল জলে। ইচ্ছে ছিল কাছের দ্বীপটায় গিয়ে উঠবে। কিন্তু পারেনি। স্রোতের টানে যখন সে ক্রমে দূরে ভেসে যেতে থাকে, তখন কাছে পেয়ে আঁকড়ে ধরেছিল এই ডুবো পাহাড়ের গা। তারপর প্রাণের তাগিদে কী করে যে এর ডগায় চড়ে বসল তা সে নিজেই জানে না। এক দিন, এক রাত, সে ওই পাথরটার ওপর বসেছিল। জোয়ারের জল উঠেছিল পায়ের নিচে তিন—চার হাতের মধ্যে। ভাগ্যিস ঝড়—তুফান আসেনি!

প্রিন্স এই আবিষ্কারটা নিজের নামে চালাতে চায় বুঝি? দত্তদা জিজ্ঞেস করলেন।

হুঁ। ঘাড় নাড়ল জিয়ান।

দত্তদার মুখে একটা তিক্ত হাসি ফুটে ওঠে। তিনি ডনের সঙ্গে একবার অর্থপূর্ণ ভাবে চোখাচোখি করলেন। ভাবখানা যেন, ঠিক যা ভেবেছি।

চ্যাং টের পেয়েছিল তোমার পালানো? জানতে চাইলেন দত্তদা।

হ্যাঁ, জলে শব্দ হতেই বেরিয়ে এসেছিল। মাঝিরা আমায় বাঁচাবার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু চ্যাং বারণ করে থামিয়ে দেয়। আমি যে ইচ্ছে করে ঝাঁপিয়েছি হয়তো তা বোঝেনি। ভেবেছিল, আপদ গেল, বেকায়দায় পড়ে গেছি জলে।

জিয়ান মাথা নিচু করে বলল, লোভে পড়ে আপনাদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলাম, সেই পাপেরই ফল।

চ্যাং কোন দিকে গেছে? দত্তদার প্রশ্ন।

ওই দিকে, হাত তুলে দেখাল জিয়ান, ওই দিকটাই দেখিয়েছিল জিপসিরা।

আবার তপনদের নৌকো ছাড়ল। চ্যাংদের অনুসরণ করে যাত্রা শুরু হল।

মিনিট পনেরো কেটেছে, সহসা কানে এল একটা গুমগুম শব্দ। আওয়াজটা ক্রমেই বাড়তে লাগল। যেন একটা ভারী ট্রেন গড়িয়ে আসছে। ঝড় আসছে নাকি? পোকো চটপট পাল নামিয়ে ফেলল। না, ঝড় নয়। পিছনে অনেক দূরে দেখা গেল এক অদ্ভুত দৃশ্য। অন্তত সিকি মাইল বিস্তার, মাথায় ফেনার রেখা, ফেঁপে ওঠা বিশাল জলস্রোত হু—হুঁ করে ধেয়ে আসছে। দেখতে দেখতে সেই জলোচ্ছ্বাস ভয়ঙ্কর গর্জনে একেবারে ঘাডের ওপর এসে পড়ল। গঙ্গায় কোটালের বানে এমনি ধেয়ে আসা ঢেউ, এমনি জলের গর্জানি দেখেছে। তপন। তবে এ আরও বিরাট, আরও প্রচণ্ড ব্যাপার।

শুয়ে পড়ুন। ধরে থাকুন নৌকো, চেঁচিয়ে উঠল পোকো। তার কথা শেষ হতে না হতেই নৌকোটা যেন সোজা লাফ দিয়ে উঠল শূন্যে। পলকের জন্য ঢেউয়ের মাথায় চড়ে বসেই তলিয়ে গেল নিচে। তবে ডুবল না। প্রধান ঢেউটা পেরিয়ে যাওয়ার পর সমুদ্র টগবগ করছিল। নৌকো থরথর করে কাঁপছিল, দুলছিল, নাচছিল। সবাই শক্ত মুঠোয় কাঠ বাশ আঁকড়ে ধরেছিল, নইলে ছিটকে পড়ত জলে।

মিনিট দশেকের মধ্যে সমুদ্র শান্ত হয়ে গেল। ডন বলল—ভূমিকম্প। তারই ফল। এখানে সমুদ্রগর্ভে প্রায়ই ভূমিকম্প হয়।

দত্তদা জিয়ানকে বললেন, ওই পাথরটার ওপরে থাকলে কী অবস্থা হত বুঝেছ?

জিয়ান শিউরে উঠল। সবাই দেখেছিল, ফণা তুলে ধেয়ে আসা তরঙ্গটি জিয়ানের আশ্রয়স্থল ডুবো পাহাড়টার মাথাটাকে কেমন সম্পূর্ণ গ্রাস করে ফেলেছিল। ওখানে থাকলে জিয়ান নির্ঘাত মরত।

একটু বাদেই ফের গুমগুম আওয়াজ। আবার সেই রকম তরঙ্গের আবির্ভাব। আবার সেই নাকানি—চোবানি। পরপর আটটি ঢেউ এল ছুটে, ঘণ্টাখানেকের ভিতরে।

নৌকোয় যাত্রীরা সবাই অল্পবিস্তর আঘাত পেল। জিনিসপত্র ছত্রাকার। কিছু ভেঙেও ছিল। ঢেউয়ের দোলায় নৌকো কিন্তু মোটেই এগোয়নি। প্রায় একই জায়গায় ছিল।