» » মানুক দেওতার রহস্য সন্ধানে

বর্ণাকার

অজেয় রায়

মানুক দেওতার রহস্য সন্ধানে

পাঁচ

মাইলখানেক এগিয়েছে নৌকো। পালে হাওয়া লেগে তরতর করে চলেছে। তপন দেখল, আলী একবার ছইয়ের ভিতরে গিয়ে ব্যস্ত হয়ে বেরিয়ে এসে কী জানি বলল পোকোকে। পোকো, ডন ও দত্তদার কাছে গিয়ে নিচু স্বরে কিছু বলল। ডনের ভুরু কুঁচকে গেল। তারা দুজনে উঠে ঢুকল ছইয়ে। বেরিয়ে এল খানিক বাদে। দুজনের মুখ থমথমে। তপন আর থাকতে পারল না। গুটিগুটি গিয়ে প্রশ্ন করল, কী ব্যাপার দত্তদা?

দত্তদা বললেন, ব্যাপার মুশকিল। খাবার জল নেই। পড়ে গেছে। পিপের তলায় একটা চিড় খেয়েছে। সেখান দিয়ে সব জল চুঁইয়ে বেরিয়ে গেছে।

একটা বড় পিপেতে খাওয়া ও রান্নার জল থাকে। ছইয়ের কোণে দড়ি দিয়ে বাঁধা থাকে পিপেটা। তপন দেখল, পিপের তলার দিকে কাঠে সামান্য ফাটা। চোখে দেখে চট করে বোঝা যায় না। সেখানটা ভিজে ভিজে। জল চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়েছে। পিপের তলায় ওই ছিদ্রটুকুর নিচে আর সামান্যই জল তখনো রয়েছে।

পোকো বলল, গতকাল পিপেটা পরিষ্কার করার জন্য নামানো হয়েছিল। তখন একবার হাত ফসকে আছড়ে পড়ে পাথরে। চিড় তখনই খেয়েছে। তারপর জল ভর্তি করে রাখা হয়। সারা রাতে একটু একটু করে জল বেরিয়ে গেছে। কেউ খেয়াল করেনি।

পিপের ফাটল আঠা দিয়ে বন্ধ করা হল। দত্তদা ভরসা দিলেন, ভাবনার কিছু নেই, সামনের দ্বীপ থেকে খাবার জল ভরে নেব। তবে সময় নষ্ট। জল খুঁজতে হবে। ভেবেছিলাম সোজা গিয়ে থামব মেস্‌মনে।

সাগরের বুকে একটা দ্বীপ দেখা গেল। নৌকো চলল সেই দিকে। ঘণ্টা দুই বাদে পোছল সেখানে। নিবিড় বনে ভরা ছোট্ট দ্বীপ। নৌকোর নোঙর পড়ল। আলী বাদে চারজন মাঝি বালতি হাতে নেমে পড়ল ডাঙায়। তারা অদৃশ্য হল গাছপালার ভিতরে।

তখনো পিপের তলায় প্রায় এক বালতি জল ছিল। তারই কিছুটা খরচ করে রান্না করল আলী। প্রায় দু—ঘণ্টা বাদে প্রথম ফিরল পোকো। ডাঙা থেকে হাত নেড়ে জানাল—জল। পাওয়া যায়নি। আধঘণ্টার মধ্যে বাকি তিনজন মাঝিও ফিরল। তারাও এল শূন্য পাত্র নিয়ে।

দত্তদা বললেন, জল হয়তো আছে। ছোট ছোট গর্তে জমা বৃষ্টির জল। কিন্তু এ—বন ভেদ করে তা খুঁজে পাওয়া খুব কঠিন কাজ। এসব দ্বীপের মাটির পাথর প্রায়ই এমন হয় যে বৃষ্টির জল চুঁইয়ে ভিতরে ঢুকে যায়। ওপরে জমতে পায় না।

দুপুরে খাওয়া হল। বাকি জল থেকে ভাগ করে খেল সবাই। সন্ধের সময় জোয়ার। আসতে ফের নৌকো ছাড়ল। পোকো বলল, সামনে পুবে আর একটা দ্বীপ আছে। বেশ বড় দ্বীপ। ওখানে ঠিক জল মিলবে।

হঠাৎ বাতাস একেবারে পড়ে গেল। পাল চুপসে গেছে। নৌকো এগুচ্ছে অতি ধীরে। অস্পষ্ট চাঁদের আলোয় দেখা যাচ্ছে সামনে দিগন্তরেখায় কালো পাহাড়ের মতন এক দ্বীপ। কিন্তু ওটা আর কাছে এগিয়ে আসছে না কেন? বেগতিক বুঝে মাঝিরা দাঁড় হাতে নিল। ঝপাঝপ দাঁড় বাইতে শুরু করল। নৌকো এগোয়। আর সিকি মাইলও নেই। সহসা মাঝিরা চিৎকার করে উঠল। খোলের ভিতরে ছিল তপন, দত্তদা ও ডন। পোকোর গলা শুনে তারা সবাই বাইরে গিয়ে দাঁড়াল।

কী হয়েছে পোকো?

সর্বনাশ হয়েছে, বলল, আমরা চোরাস্রোতে পড়েছি। দ্বীপ থেকে সরে যাচ্ছি।

মাঝিরা পাগলের মতো দাঁড় বাইছে। পোকো ঝুঁকে পড়ে, সমস্ত শক্তি দিয়ে আঁকড়ে ধরেছে হালের চাকা। তবু শেষ রক্ষা হল না। দেখতে দেখতে দ্বীপকে পাশ কাটিয়ে যেতে লাগল নৌকো। ক্রমে ছাড়িয়ে গেল দ্বীপ।

কাতর আর্তনাদ করে দাঁড় ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে মাঝিরা লুটিয়ে পড়ল পাটাতনে। বাকিরা স্তব্ধ। হতাশ চোখে চেয়ে আছে পিছনে ফেলে আসা দ্বীপটার দিকে। দত্তদা শুধু একবার বলে উঠলেন, সাবধান, মেস্‌মনে পৌঁছনো চাই তাড়াতাড়ি, নইলে বিপদ।

ঘণ্টাখানেকের মধ্যে অনুকূল বাতাস দিল। স্রোত গেল ঘুরে। নৌকো চলতে লাগল ঠিক পথে, সামান্য উত্তরমুখো হয়ে পুবে। লক্ষ্য—মেসমন আইল্যান্ডস।

মাঝিদের অবস্থা শোচনীয়। প্রচণ্ড পরিশ্রমে শ্রান্ত ঘর্মাক্ত। জলের অভাবে শরীর টলছে। কেবল ঠোঁট চাটছে, হাঁপাচ্ছে।

পিপের তলায় কয়েক মগ জল বাকি। সেইটুকু ভাগ করে দেওয়া হল সবার মধ্যে। মাঝিরা একটু বেশি জল খেল। ভাগ্য প্রসন্ন হলে কাল দুপুরের আগেই মেস্‌মন দ্বীপপুঞ্জের দেখা পাওয়া উচিত।

সূর্য উঠল। বেলা আটটা না বাজতেই ট্রপিকাল গ্রীষ্মের রোদের কী তেজ! আরও এক ঘণ্টা কাটল। বড় কষ্ট হচ্ছে তপনের। জিভটা শুকিয়ে ফুলে উঠেছে। গলা দিয়ে স্বর বেরোতে চায় না। তেষ্টায় যেন ছাতি ফেটে যাবে। চারপাশে এত জল। অকূল পাথার জলের ভাণ্ডার। তবু তৃষ্ণা নিবারণের উপায় নেই। তপন ভাবে, আচ্ছা কখনো কখনো কতক্ষণই তো জল না খেয়ে কাটাই। তেষ্টায় এত কাতর হই না। এখন কেন এত কষ্ট? জল নেই। চাইলে পাব না এই সত্যটাই বুঝি অভাবকে এত তীব্র করে তুলেছে। কিছুকে পাওয়া যাবে না। জানলেই তার প্রতি আমাদের আকাঙ্ক্ষা বেশি তীব্র হয়। মরুভূমিতে তৃষ্ণার কবলে যারা পড়ে তাদেরও এমনি কষ্ট হয়? বোধহয় না। এই জলের রাজ্যে বসে তেষ্টার জল না পাওয়া আরও কষ্টকর।

তপনের মাথা ঝিমঝিম করছে। বারো ঘণ্টার ওপর সে প্রায় কিছুই খায়নি। অন্যরাও কেউ খায়নি ভয়ে। কারণ খেলে গলা আরও শুকিয়ে যাবে। তেষ্টা বাড়বে। সকালে টিন খুলে টোমাটো—সস দিয়েছিল ডন। সেই সামান্য খেয়েছে। দুটো নারকেল ছিল। মাঝিরা খেয়েছে তার জল ও শাঁস।

ওয়াইজিও ছাড়িয়ে পথে দুদিন বৃষ্টি হয়েছিল। নৌকোয় বসে তখন কী বিরক্তিকরই না লেগেছিল! আহা এখন যদি বৃষ্টি নামে। নাঃ, কোনো আশা নেই। নির্মেঘ আকাশ।

আলী ছিল হালে। চেঁচিয়ে উঠল, পুলো, পুলো!

মালয় ভাষায় পুলো মানে দ্বীপ। সকলে দেখল সাগরের বুকে জেগে উঠেছে একটা কালো বিন্দু। বড় জোর মাইল তিন দূরে।

কী আশ্চর্য! অমনি শরীরের জ্বালা কমে গেল তপনের। আর ভয় কী!

দ্বীপটা থেকে মাইলখানেক দূরে, হঠাৎ দমকা হাওয়ার ঝাঁপটা লাগতে লাগল নৌকোর গায়ে। ফুলে ওঠা পালের কাপড় বেঁকে যাচ্ছে। নৌকো সরে যাচ্ছে ডাইনে!

হে ভগবান, হে আল্লা বাঁচাও—চিৎকার করে উঠল মাঝিরা। এই দ্বীপ ফসকালে যে আর নিস্তার নেই। তিলে তিলে অতি নিষ্ঠুর পরিণতি।

পোকো চটপট পালের কাপড়গুলো সামান্য বাঁকিয়ে কী সব কারিকুরি করল। চার মাঝি হাতে তুলে নিল দাঁড়। প্রাণপণে নৌকোর গতি ঘোরাতে চেষ্টা করে।

বেচারা মাঝিরা। বারবার ঠোঁট চাটছে। সেই কখন একটু জল খেয়েছে। শরীরে শক্তি আর বুঝি কিছু অবশিষ্ট নেই। তপন ফের বুকের ভিতর শুকনো জালাটা টের পায়।

ডন ঢুকে গেল ছইয়ের ভিতর। বেরিয়ে এল হাতে একটা ওয়াটার—বটল। তপনের কাছে এসে বলল, এক ঢোক খাও। বোঝা গেল এই শেষ সম্বলটুকু সে বাঁচিয়ে রেখেছিল চরম দুঃসময়ের জন্য।

মাত্র এক ঢোক গলা দিয়ে নামতেই দেহ যেন জুড়িয়ে গেল তপনের। প্রাণ আরও চায় কিন্তু উপায় নেই।

ডন এবার দাঁড়াল দত্তদার সামনে। দত্তদা ইশারায় বোঝালেন, আগে মাঝিদের দাও। মাঝিরাও এক ঢোক করে পেল। আলী আরও চায়। তার চোখে কাতর অনুরোধ। ওকে দিতে হল আর—একটু। ডন কিন্তু নিজে খেল না। দত্তদাও না। অর্থাৎ ফুরিয়ে গেছে জল। বড় লজ্জা হল তপনের। ডন ও দত্তদা নির্বিকার।

ওইটক জল যেন নতুন জীবন দিল। ঝপাঝপ দাঁড় পড়ছে। দ্বীপ কাছে এগিয়ে আসছে। শ—দুই হাত এমনি যাওয়ার পর পোকো বলল, ব্যস, দাঁড় থামাও। আর খেটে দরকার নেই। ভরা পালই নৌকোকে নিয়ে যাবে ঠিক জায়গায়।