☼ অজেয় রায় ☼
মানুক দেওতার রহস্য সন্ধানে
চার
পরদিন সকালে দত্তদার বাড়ি হাজির হয়ে তপন দেখল সেখানে হুলুস্থুল চলছে। দত্তদার হাতে একটা লিস্ট। সামনে নানা আকারের কয়েকটা ব্যাগ। চারপাশে হরেক রকম জিনিস। ছড়ানো। বউদি সমানে এ—ঘর ও—ঘর ছুটছেন। রবি নেচে নেচে বেড়াচ্ছে।
দত্তদা বললেন, বসো তপন, বসো। এই গোছগাছ করছি। বউদি তপনকে এক কাপ কফি ধরিয়ে দিলেন।
কোথায় যাচ্ছেন আপনি? তপন জিজ্ঞেস করল।
প্রথমে ওয়াইজিও, সেখান থেকে মেস্মন আইল্যান্ডস।
ওয়াইজিও কেন? চ্যাং কি ওখানে গেছে, হদিশ পেলেন?
না। চ্যাং—এর কোনো খবর পাইনি। তবে ডিক্সন বলেছিল, সে ওয়াইজিও থেকে মেস্মনের দিকে যাত্রা করে। গিয়ে খুঁজে দেখব, ডিক্সন কোন দ্বীপে গিয়েছিল কেউ বলতে পারে কিনা।
যদি তেমন কাউকে না পান?
তাহলে অগত্যা অজানার পথে পাড়ি। মেস্মনের পুব ধারের দ্বীপগুলো খুঁজে দেখব, যদিও কাজটা বেশ শক্ত।
একাই যাবেন?
না। ডনকে সঙ্গে নিচ্ছি। জিয়ানকে পেলে অবশ্য ডনকে দরকার হত না। বিশেষ খোঁজাখুঁজিও করতে হত না তাহলে।
আপনি আগে কখনো ওয়াইজিও গেছেন?
না।
ডন?
না ডনও যায়নি।
দ্বীপগুলো তো ভালো নয়, সেদিন বললেন।
হুঁ, মোটেই ভালো নয়। তাছাড়া ইকুয়েটরের ওপরে বলে ওই অঞ্চলে সারা বছর ঝড়—জল লেগেই থাকে।
তবে তো রিস্কি।
তা একটু। হাসলেন দত্তদা।
তপন বলল, বউদি, আপনি বারণ করছেন না যে?
বউদি হেসে বললেন, বারণ করলেই কী আর শোনে, যা মানুষ।
ব্যাগের স্ট্র্যাপ বাঁধতে বাঁধতে দত্তদা মুখ তুলে বললেন, এ ভারি জব্বর নেশা ভাই। একবার স্বাদ পেলে আর ছাড়ান নেই। একটা কবিতা পড়েছিলাম, বাংলা। কবির নামটা মনে নেই। কয়েকটা লাইন মুখস্থ করে রেখেছি।—
শুনে কাল হল ভাই।
অরণ্য—পথ গভীর গহন সাগরের তল নাই!
ঠিক লিখেছেন। আমার মনের কথা। অমন কোনো জায়গার কথা শুনলেই যে ছটফটিয়ে উঠি।
তপনের মনটা আনচান করে উঠল। ব্যাংককে এসে তার মনে হয়েছিল মস্ত এক অ্যাডভেঞ্চার করেছি। বেশ গর্ব হয়েছিল মনে মনে। কিন্তু সে এসেছিল পেটের দায়ে, বাধ্য হয়ে, অনেক সাতপাঁচ ভেবে। আর এই মানুষটি? কেমন সাজানো সংসার, চাকরি, নিশ্চিন্ত জীবন—সব ছেড়ে হুট করে পা বাড়াচ্ছেন অজানা পথে, বিপদের মাঝে, প্রায় শখ করে। নাঃ,—এর তুলনায় তার জীবনটা নেহাৎই সাদামাটা। অ্যাডভেঞ্চারের সে কিছুই জানে না।
খানিক চুপচাপ থেকে ধাঁ করে বলে বসল তপন, দত্তদা, আপনাদের সঙ্গে যেতে ভীষণ লোভ হচ্ছে।
হো—হো করে হেসে উঠলেন দত্তদা, বটে, বটে। কিন্তু ভাই এ লোভ না করাই ভালো।
সিরিয়াসলি বলছি দত্তদা।
ডক্টর দত্ত তীক্ষ্ণ চোখে তপনের দিকে তাকিয়ে বললেন, রিস্কগুলো খেয়াল আছে?
আছে।
কিন্তু তোমার চাকরি? ছুটি পাবে?
তা সত্যি। তপন দমে গেল। নতুন চাকরি। ছুটি কি আর দেবে?
দত্তদা উঠে এসে তপনের পিঠে হাত রেখে বললেন, দুঃখ কোরো না ভাই। যার অজানাকে জানবার ইচ্ছে আছে, বিপদে ঝাঁপ দেবার সাহস আছে, তার বরাতে অ্যাডভেঞ্চার ঠিক জুটে যায়। জীবনভোর সামনে দিয়ে কত রোমাঞ্চের সুযোগ পেরিয়ে যায়। কেউ তা দেখে এড়ায়। আর যে তাকে ধরতে চায়—ঠিক ধরে। তাই বলছি, হতাশ হয়ো না।
ধরুন যদি ছুটি পাই?
নিশ্চয়ই নেব তোমায়। খুশি হয়ে নেব। তোমার খরচাও কিছু লাগবে না। সে ভার আমার, বললেন দত্তদা।
দুপুরে গোবিন্দ সিংকে ব্যাপারটা বলল তপন।
একটুক্ষণ চুপ করে থেকে সিংজি বললেন, তুমি সত্যি যেতে চাও?
হ্যাঁ। অবশ্য যদি ছুটি পাই। সবে জয়েন করেছি—
গোবিন্দ সিং—এর দাড়ি—গোঁফ ভরা মুখে বিচিত্র হাসি ফুটল। তিনি বললেন, বেশ, ছুটি তুমি পাবে। যাও। তোমার উৎসাহ দেখে আমি খুশি হয়েছি। এই তো দেখার বয়স। তোমার চেয়েও কম বয়সে আমি ঘর ছেড়েছি। কত দেশ ঘরেছি। কত কী দেখলাম। এখনো ইচ্ছে করে বেরিয়ে পড়তে, কিন্তু আর তাগদ নেই। তবে হ্যাঁ, বৃদ্ধের পরামর্শ নাও তো বলি। রোজগার করাও দরকার। তাই চোখ—কান খোলা রাখবে। কোথায় কী রোজগারের ধান্দা জেনে নেবে।
একটা ঘটনা বলি শোনো। তখন আমার বয়স তিরিশ। ব্যাটাভিয়ায় এক রবার বাগানে কাজ করি। এক ফিলিপিনোর সঙ্গে ভাব হল। ফিলিপিনো জিপ একদিন বলল যে, সে টরেস্স্ট্রেটে একটা ডুবে—যাওয়া জাহাজের খোঁজ পেয়েছে, তাতে অনেক দামি মাল আছে। একজন পার্টনার পেলে সে জাহাজটা খুঁজে দেখে। টরে—স্ট্রেট কোথায় জানো? অস্ট্রেলিয়া আর নিউগিনির মাঝখানে। ওখানে অগুনতি দ্বীপ আর ডুবো পাহাড়। রাজি হয়ে গেলাম। চলে গেলাম ওর সঙ্গে। একটা মোটর—বোট ভাড়া করলাম। ডুবুরির পোশাক কেনা হল। জিপই শেখাল আমায় সমুদ্রে ডাইভিং। জাহাজটা খুঁজেও পেলাম। খুব অ্যাডভেঞ্চার হল। আবার দু—পয়সা রোজগারও হয়ে গেল।
কী পেয়েছিলেন জাহাজটায়? তপনের ভারি আগ্রহ।
খুব দামি কিছু নয়। তবে অনেক রুপোর জিনিস ছিল। তাই বলছি, অ্যাডভেঞ্চারের সঙ্গে পয়সার মতলবটাও ছেড়ো না। যদি কিছু মেলে মন্দ কী? জাহাজটা পেলাম ভালো, না পেতেও পারতাম।
আচ্ছা, তোমরা সিঙ্গাপুর হয়ে যাবে নিশ্চয়ই? ওখানকার এক পার্টি অনেকদিন ধরে আমায় মাল পাঠাচ্ছে না। চিঠি দিচ্ছি, উত্তর নেই। ঠিকানা দিয়ে দেব। ওদের সঙ্গে দেখা করে, কথা বলবে। আমি নিজেই একবার সিঙ্গাপুর যাব ভাবছিলাম। তুমিই ভারটা নাও। তাহলে ছুটির মাইনেটা পাবে।
তপন তক্ষুনি ফোন করল, দত্তদা, ছুটি মিলেছে। আমি যাচ্ছি।
ব্যাংকক থেকে রওনা হয়ে বর—কয়েক প্লেন বদল করে তপনরা পৌঁছল নিউগিনির উত্তর ভাগে সোবরাং বন্দরে। সোবরাং থেকে লঞ্চে ডেম্পিয়ার প্রণালী পেরিয়ে ওয়াইজিওর দক্ষিণ তটে মুকা গ্রামে হাজির হল।
মুকা ছোট্ট গ্রাম। সামনে সমুদ্র পিছনে চাষের ক্ষেত। তারপর বনজঙ্গল। একটি পাতা—ছাওয়া মাটির কুটিরে ওরা আস্তানা করল। এর চেয়ে ভালো ব্যবস্থা ওখানে সম্ভব নয়। দত্তদা ডনকে বললেন, খবর নাও, জন ডিক্সনকে কেউ চেনে কিনা? দেখ এমন কাউকে পাও কিনা যে ডিক্সনের সঙ্গে মেমেন আইল্যান্ডস, এ গিয়েছিল।
আগস্ট মাস। রাতে একদিন বৃষ্টি হল। ঘরের চাল চুঁইয়ে জল পড়ে। মশার প্রচণ্ড উৎপাত। রাতে ভালো ঘুম হয় না। তপন টের পেতে শুরু করল অ্যাডভেঞ্চারের ধকল। এ তো কলির সন্ধে। এখনো আসল অভিযানটাই বাকি। দত্তদা ও ডন কিন্তু নির্বিকার। কোনো অসুবিধাতেই তাদের যেন ভ্রূক্ষেপ নেই।
মুকার অধিবাসীরা মালয় ও পাপুয়ান জাতের মিশ্রণ। বছরের অনেকখানি সময় এরা সমুদ্রে ঘুরে বেড়ায়। মাছ, কাঁকড়া, কচ্ছপ ইত্যাদি ধরে। জংলি দ্বীপ থেকে ফল—পাকুড় সংগ্রহ করে আনে।
চারদিন কেটে গেল। ডিক্সনকে দেখেছে এমন দু—চারজনের খোঁজ মিললেও ওর সঙ্গে সমুদ্রযাত্রা করেছে তেমন কারও সন্ধান পাওয়া গেল না। দত্তদা অধীর হয়ে উঠলেন। জানালেন—আর দু—তিন দিন দেখব। কাউকে না পেলে গাইড ছাড়াই রওনা দেব।
চ্যাং বা জিয়ানের কোনো খবর মেলেনি। তবে একজন জেলে জানাল যে দুজন বিদেশিসহ একটা নৌকোকে তারা আমাহেরার দিক থেকে মেস্মনের দিকে যেতে দেখেছে।
ডন একটি বছর কুড়ির যুবককে দত্তদার কাছে নিয়ে এল। বলল, এ নাকি জানে ডিক্সন কোন্ দ্বীপে গিয়েছিল। এর নাম আলী। ও মালয় জানে।
তুমি ডিক্সন সাহেবের সঙ্গে গিয়েছিলে? দত্তদা মালয় ভাষায় আলীকে জিজ্ঞেস করলেন।
না। আমার বাবা গিয়েছিল। আমি বাবার কাছে গল্প শুনেছি, উত্তর দিল আলী।
তোমার বাবা কোথায়?
বাবা সমদ্রে বেরিয়েছে। কবে ফিরবে ঠিক নেই। মাস দুইয়ের আগে নয়।
বাবা তোমায় বলেছে, ডিক্সন কোন দ্বীপে গিয়েছিল?
আলী বলল, ঠিক কোন দ্বীপটায় বলেনি বাবা। সাহেবের বারণ ছিল বলতে। বাবা শুধু বলেছিল, মোরগ দ্বীপ থেকে সোজা পুবে, খানিক খোলা সমুদ্র পেরিয়ে ফের অনেকগুলো দ্বীপ। সেখানে কাছাকাছি একজোড়া দ্বীপ। তারই একটায় গিয়েছিল তারা।
দত্তদা ডনকে বললেন, বুঝেছ, মেসমন আইল্যান্ডস—এর কথা বলছে। জোড়া দ্বীপ এইখানেই হবে। মেস্মনের পশ্চিমে কয়েকটা দ্বীপ আছে, তারই একটা নিশ্চয়ই মোরগ। দ্বীপ।
তিনি ফের আলীকে বললেন, সাহেব কী করতে গিয়েছিল, সে—কথা কি বাবা বলেছে তোমাকে?
না।
সেই নৌকোর অন্য মাঝিরা কোথায়? জিজ্ঞেস করলেন দত্তদা।
আলী বলল, সাহেব বাইরে থেকে নৌকা এনেছিল। কোত্থেকে জানি না। মাঝিদের চেনে না কেউ। একজন মাঝি অসুস্থ হয়ে পড়ায় তার জায়গায় বাবাকে নেয়। অসুস্থ মাঝিকে। ফেরত পাঠায়।
তুমি মোরগ দ্বীপ চেন? দত্তদার প্রশ্ন।
হ্যাঁ, চিনি।
আর জোড়া দ্বীপ? সেখানে গেছ কখনো?
না।
ঠিক আছে। তুমি আমাদের সঙ্গে যেতে পারবে? মোরগ দ্বীপের পুবে যাব। ডিক্সন সাহেব যে দ্বীপে গিয়েছিলেন সেই দ্বীপটা খুঁজে বের করতে চাই।
বেশ, যাব।
আলী এককথায় রাজি।
মলুক্কা সাগর দিয়ে ভেসে চলেছে এক বড় নৌকো। মালয় ভাষায় একে বলে প্রাউ। আলীকে নিয়ে নৌকোয় মাঝি পাঁচজন। অন্য আরোহীরা হচ্ছে—ডক্টর দত্ত, ডন এবং তপন।
ক্রমে ওয়াইজিওর তটরেখা মিলিয়ে গেল। এবার কূলহীন সাগর। ফেনার মুকুট পরে ঢেউগুলি নাচতে নাচতে ছুটে চলেছে। আছড়ে পড়ছে নৌকোর গায়ে। একটানা ছলাৎ ছলাৎ শব্দ কানে আসে।
ছইয়ের বাইরে এলে হু—হু বাতাস। লোনা জলের ছিটে লাগে গায়ে। মুকা গ্রাম ছাড়ার পর দু—দিন দু—রাত ওয়াইজিওর দক্ষিণ কূল ঘেঁষে চলেছিল তরী। মাঝে মাঝে থেমেছে কোনো দ্বীপে। বড় বিপজ্জনক যাত্রা। ডেম্পিয়ার প্রণালীর এই ধারটায় অসংখ্য ছোট ছোট দ্বীপ, শিলাস্তূপ ও প্রবাল প্রাচীর। খাঁজ খাঁজ কাটা প্রবাল স্কুপে ধাক্কা খেলে ফুটো হয়ে যাবে। নোকোর কাঠ। তাই খুব সাবধানে এগোতে হয়েছে।
সর্দার মাঝি পোকো মাঝবয়সী, দীর্ঘকায়, কৃষ্ণবর্ণ। মাথায় ঘন কোঁকড়া কালো চল। পরনে লুঙ্গি ও কুর্তা।
প্রণালীটা পেরোবার সময় পোকো প্রায় সমস্তক্ষণ স্বয়ং হালের কাছে ছিল। খোলা সাগরে পৌঁছে সে হাঁপ ছাড়ল। কারণে অকারণে দাঁত বের করে তার কেবলই হাসি। পোকো জাতিতে পাপুয়ান। এরা খুব ফুর্তিবাজ।
দত্তদা চিনিয়ে দিচ্ছিলেন, তপন, প্রবাল দ্বীপ দেখ। ওই দেখ প্রবাল প্রাচীর। দ্বীপের ধারে ধারে জল থেকে মাথা তুলে আছে। কাটা কাটা গা, খাঁজ খাঁজ। ডেনজারাস। নৌকো ঠোক্কর খেলেই চিত্তির। এর ভয়ে ডেম্পিয়ার প্রণালীর এই ধারটায় জাহাজ বা স্টিমার চলে না। এই দেশি নৌকোগুলোই কেবল দেখে দেখে বাঁচিয়ে চলতে পারে।
দু—চারটে ন্যাড়া শিলাস্তূপ ছাড়া সব দ্বীপই বন—জঙ্গলে ঠাসা। তীর ঘিরে সাগরজলে পা ডুবিয়ে রয়েছে ম্যানগ্রোভের ঘন বন।
মলুক্কা সাগরে ঢোকার মুখে একটা ছোট্ট দ্বীপ দেখিয়ে দত্তদা বললেন, ওই দেখ ভস্ক্যানিক আইল্যান্ড। এখন অবশ্য মৃত।
সমুদ্র থেকে খাড়া উঠেছে দ্বীপটা। পিরামিডের মতন দেখতে। মাথাটা ক্রমশ সরু হয়ে গেছে। কয়েক শো ফুট উঁচু। পাহাড়ের গায়ে ঘন উদ্ভিদের আবরণ, দূর থেকে দেখাচ্ছে। কালচে—সবুজ।
পশ্চিম দিগন্তে সূর্য অস্ত গেল। সাগরের গাঢ় নীল জল যেন আবির—রাঙা। কী অপূর্ব দৃশ্য! এরপর আকাশে একফালি চাঁদ এবং অজস্র তারা। ঢেউয়ের মাথায় নৌকাখানি দুলছে দুলছে।
ছইয়ের বাইরে পাটাতনে চিৎ হয়ে শুয়ে তপন চোখ মেলে ভাবে—জীবন কী বিচিত্র! মাত্র ছমাস আগে কলকাতায় গলির মোড়ে সেই সকাল—সন্ধে আড্ডা। মাঝে মাঝে ঠাকুরের দোকানের চা। দুপুরে ঘুম। টিউশনি। কখনো কখনো টাইপ—মেশিন খটখটিয়ে কিছু রোজগার। চাকরি খোঁজা। মোহনবাগান—ইস্টবেঙ্গল, টেস্ট—ক্রিকেট নিয়ে তুমুল তর্ক, উত্তেজনা। সদ্যমুক্ত কোনো হিট সিনেমার টিকিট জোগাড় করে ভারি গর্ব, মস্ত বীরত্ব। একঘেয়েমির অবসাদ কাটাতে ওই যা জুটত। আর এখন?
এমন জীবন কি সে কল্পনা করেছে কখনো? করেছে। বইয়ের পাতায় ছবি দেখে, কল্পনায় কত নতুন নতুন অজানা দেশে মন চলে গেছে। কিন্তু এখন বুঝছে কল্পনা আর বাস্তবে কী ভীষণ ফারাক! প্রতি ঘণ্টা, প্রতি মিনিটে এ কী বিচিত্র অভিজ্ঞতা! বদলে যাচ্ছে প্রকৃতি। বদলাচ্ছে শব্দ গন্ধ জীবজগৎ। স্নায়ু টান—টান। নতুনের স্বাদ নিতে উন্মুখ। যেন নেশা লাগে।
কলকাতার ছকে—বাঁধা জীবন, বহুদিনের চেনা মানুষ—জন বাড়িঘরের গণ্ডি কাটিয়ে কখনো বোঝেনি সে এই পৃথিবীটা কী বিশাল, কী অভিনব। কত কী দেখার আছে। দত্তদা ঠিকই বলেছিলেন, নেশা ধরে যায়। এই দশ দিনেই সে খুব টের পেয়েছে এর মর্ম।
অসীম জলরাশির বুকে মোচার ভোলার মতো এই আশ্রয়টুকু। বাতাস বাড়লে ঢেউ উত্তাল হয়। ভয়ে বুক কাঁপে। কিন্তু সে ভয় রোমাঞ্চকর, উত্তেজনায় ভরা। মন মুষড়ে পড়ে না, উল্লসিত হয়।
অনেক রাত অবধি তপন বাইরে শুয়ে শুয়ে জল ও বাতাসের মাতামাতি শুনল। কখনো উঠে বসে দেখল, সাগরজলে চাঁদের আলোর কাপন। ঢেউয়ের মাথায় মাথায় শুভ্র ফেনার গতি, ফসফরাসের ঝিকিমিকি।
পরদিন উড়ুক্কু মাছ দেখল তপন। এই মাছের কথা বইয়ে পড়েছিল, ছবি দেখেছিল, নিজের চোখে দেখে বুঝল কী অদ্ভুত দৃশ্য। পারশে মাছের মতো আকার, চকচকে রুপোলি গা। খানিকক্ষণ তারা জল থেকে হাত তিনেক ওপর দিয়ে হাওয়ায় ভেসে চলল। পাক খেল বাতাসে। কখনো একটু ওপরে ওঠে, কখনো ফের নিচে নামে। ঠিক যেন পাখি। অন্তত শ—খানেক গজ এমনি ভেসে ভেসে গিয়ে মাছগুলো ফের ডুব দিল জলে। কে বলবে ওদের ডানা নেই!
কোত্থেকে একটা বড়সড় পাখি এসে বসল মাস্তুলের বাঁশে। হয়তো অনেক উড়ে উড়ে ক্লান্ত, তাই একটু জিরিয়ে নিতে চায়। একজন মাঝি টপ করে ধরে ফেলল পাখিটা। খানিক ছটফটিয়ে সে ভয়ে কাঠ হয়ে গেল। গায়ে তার চকচকে সবুজ আর তামাটে পালক। ল্যাজ ধবধবে সাদা। দত্তদা দেখে বললেন, এটা নিকোবর পিজিয়ন। খুব উড়তে পারে।
তপনের মায়া হল। ইঙ্গিতে মাঝিকে বোঝাল, ছেড়ে দাও। মাঝি তার কথা রাখল। মুক্তি পেয়ে তির বেগে উড়ে পালাল পাখিটা।
সর্দার মাঝি পোকো হাল ধরে দাঁড়িয়েছিল। সে উত্তেজিতভাবে কী জানি বলে উঠল। অমনি বাকি মাঝিরা ছুটে গিয়ে দাঁড়াল তার পাশে। তাদের দৃষ্টি দূর সাগরের বুকে। ডন। বসেছিল বাইরে। সেও গেল। কী বলছে ওরা? মালয় ভাষা বোঝে না তপন। দত্তদা ছইয়ের ভিতরে বসে বই পড়ছিলেন। তপন তাকে বলল, ওরা কী দেখছে দত্তদা?
দত্তদা ওদের কথা একটু শুনে বললেন, তিমি। চলো দেখি।
দত্তদা চোখে দূরবিন লাগিয়ে তাকিয়ে থাকেন। ডন তপনকে বলল, লক্ষ কর, জলের ফোয়ারা উঠছে।
কোথায়? কত দূরে? অবশেষে দেখল তপন, অনেক দূরে দক্ষিণে। ছোট তোরণের মতো জলের বাঁকা ধারা। রোদ পড়ে চিকচিক করছে। কী আশ্চর্য চোখ ওদের! দত্তদার দূরবিনটা নিয়ে ভালো করে দেখল সে। পাঁচটা প্রকাণ্ড কালচে পিঠ ঢেউয়ের তালে তালে ভাসছে ডুবছে। যেন এক—একখানা মস্ত নৌকো উল্টো হয়ে ভেসে চলেছে। জলের ফোয়ারাটা সে দেখতে পেল স্পষ্ট। মোটা ধারায় অর্ধচন্দ্রাকারে পড়ছে। দত্তদা জানালেন, তিমি ডুব দিয়ে জলে ভেসে ওঠে গরম বাষ্পপূর্ণ নিঃশ্বাস ছাড়ে। সেই বাষ্প বাইরের ঠাণ্ডা হাওয়ার সংস্পর্শে এসে জলকণায় পরিণত হয়ে ফোয়ারার মতো পড়ে।
তিমিগুলো কাছে এল না। ক্রমে মিলিয়ে গেল দূরে।
দুপুরে উল্টো দিক থেকে এসে বড় বড় দুটো নৌকো পাশ কাটিয়ে চলে গেল। দু—দিকের যাত্রীরাই আগ্রহভরা চোখে তাকিয়ে রইল পরস্পরের পানে। ওদের একটা নৌকো থেকে একজন চিনা হাতে ঝুলিয়ে তুলে দেখাতে লাগল—কলার কাদি, নারকেল, কচ্ছপের খোলা, আরও কী কী। অর্থাৎ ব্যবসা করতে চায়। কিনতে চাইলে গায়ে ভেড়াবে তাদের। প্রাউ। আঙুল তুলে বোঝাতে চাইল জিনিসগুলোর দাম। তবে তাদের হতাশ হতে হল। পার। হয়ে মিলিয়ে গেল নৌকো দুটো। এই জলের রাজ্যে মানুষের দেখা পেলে ভারি আনন্দ হয়।
খানিক বাদে দেখা গেল সাগরের বুকে একটা কালো ফুটকি। আলী কী দেখাচ্ছে? দত্তদা জানালেন, মোরগ দ্বীপ এসে গেছে। ওখানে থামব আমরা। তারপর যাব পুবমুখো। ডিক্সন আইল্যান্ড আমি ঠিক খুঁজে বের করব। শুধু একটা ভাবনা—আমাদের আগেই যদি চ্যাং ওখানে হাজির হয়।
যদি হয় কী হবে? প্রশ্ন করল তপন।
ঝামেলা হবে। চ্যাং সোজা লোক নয়। উত্তর দিলেন দত্তদা।
সন্ধের ঠিক আগে মোরগ দ্বীপে পৌঁছল নৌকো।
ছোট্ট দ্বীপ। লম্বায় মাইলখানেকের বেশি নয়। জলের ধারে কোথাও ম্যানগ্রোভের বন, কোথাও খোলা বালুময় তট। পিছনে জঙ্গল। তীরে সুদীর্ঘ নারকেল গাছের সারি। একটা খাঁড়ির মধ্যে ঢুকিয়ে নৌকোর নোঙর ফেলা হল। রাতে দত্তদা, তপন ও ডন রইল সমুদ্রতীরে তাঁবু ফেলে। মাঝিরা শুলো নৌকোয়। অন্ধকার হয়ে গিছল। দ্বীপের ভিতরে তখন তাই ঢোকা হল না। এখানে মাঝিরা খানিক জিরিয়ে নেবে। তাজা মাংস আর খাবার জল নেওয়া হবে সঙ্গে।
পরদিন সবাই দ্বীপ ঘুরতে বেরোল।
দত্তদার সঙ্গ ধরল তপন। সমুদ্রতট থেকে বেশি দূরে নয়, একটা ঝরনার উৎস থেকে গুবগুব করে জল বেরোচ্ছে ঠেলে। এছাড়া নাকি আর কোথাও এখানে খাওয়ার মতো মিষ্টি জল মেলে না। ওই জল ক্ষীণধারায় বয়ে গিয়ে বালিতে হারিয়ে যাচ্ছে।
জঙ্গলে ঢুকল তারা। বনের মাঝে পায়ের চলার পথ। সেই পথ ধরে এগোয়। কতরকম অজানা গাছ। মোটা মোটা লতা উঠেছে গাছ বেয়ে। মাথার উপর ডালপালা পাতার ঘন আচ্ছাদন। বড় গাছের তলায় ঝোঁপ—ঝাড় কম। তাই হাঁটতে অসুবিধা হয় না। তবে ছায়া—ছায়া স্যাঁতসেঁতে। নিস্তব্ধ বনভূমি। মাঝে মাঝে শুধু পাখির ডাক কানে আসে। কোনোটা সুরেলা শিস। কোনোটা তীক্ষ্ণ কর্কশ। দত্তদা মন দিয়ে শুনে বললেন, ওই চাচাছোলা ডাকটা টিয়াপাখির। রেড—লরি।
ঢং ঢং ঢং—গুরুগম্ভীর ঘণ্টাধ্বনির মতো পরপর কয়েকটা আওয়াজে চমকে উঠল তপন। বন যেন কেঁপে উঠল।
দত্তদা বললেন, নাট্মেগ পিজিয়নের ডাক। নাট্মেগ হচ্ছে জায়ফল। এই পায়রারা জায়ফলের দারুণ ভক্ত। ফলের শাঁসটুকু খেয়ে নিয়ে বীচি ফেলে দেয়। এরাই সাউথ—ইস্ট এশিয়ার দ্বীপে দ্বীপে জায়ফলের গাছ ছড়ায়। এ—দ্বীপেও নিশ্চয়ই জায়ফলের গাছ আছে।
একটা জলাভূমি। চারপাশে সাগু গাছ—সুপুরি গাছের মতো দেখতে। জলের ধারে এগোলেন না দত্তদা। বিষাক্ত সাপ থাকতে পারে। বললেন, এসব দ্বীপে বুনো বেড়াল, হরিণ বা বুনো শুয়োর ছাড়া বড় স্তন্যপায়ী জন্তু নেই।
বন একটু পাতলা হল। জমি ঢালু হয়ে উঠে গেছে টিলার মতন! তার গায়ে ঘন। বাঁশঝাড়। কী একটা প্রাণী উড়ে গেল এক গাছ থেকে আর এক গাছে। ঠিক যেন। কাঠবেড়ালী। হ্যাঁ, তাই বটে। দত্তদা বললেন, মলুক্কায় উড়ুকু কাঠবেড়ালী আছে। মোটা ল্যাজ ফুলিয়ে হাওয়ায় ভেসে লাফ দেয়। উড়ুকু অপোসামও আছে কোথাও কোথাও।
তপন আবিষ্কার করল, মাথার ওপর গাছের ডালে কী একটা অদ্ভুত প্রাণী। লম্বা ল্যাজ। ছোট্ট মাথা। মস্ত গোল গোল চোখ। ধবধবে সাদা লোমে ঢাকা গায়ে কালো কালো ছোপ। খুদে ভাল্লুক যেন। দত্তদা দেখে বললেন, কুস্কুস্। একরকম মারসুপিয়াল। মানে, যে জন্তু পেটের তলায় থলিতে শাবক বহন করে। যেমন ক্যাঙারু। কুস্কুস্ ভারি কুঁড়ে প্রাণী। শুধু পাতা খায়।
মোরগ দ্বীপে মোরগ কই? জিজ্ঞেস করল তপন।
একসময় ছিল, এখন নেই। যারা দ্বীপে আসে, খাওয়ার লোভে মেরে শেষ করে দিয়েছে।
একবার বন্দুকের আওয়াজ শোনা গেল। ডন হয়তো শিকার পেয়েছে। কিছুক্ষণ বাদে। আর একবার। ক
সাপ—লাফ দিয়ে ছিটকে গেল তপন।
কই? না! সাপ নয়। দত্তদা দেখালেন—ফার্ন গাছের পাতার তলা দিয়ে বেরিয়ে আছে এক সবুজ গিরগিটির লম্বা ল্যাজ।
কী অদ্ভুত জনহীন দ্বীপ। নির্জন ট্রপিকাল বনভূমি। তপন মুগ্ধ। এমন জগতে কোনোদিন পা দেবে কখনো সে ভাবেনি।
একজোড়া সবুজ রঙের পায়রা উড়ে গেল ঝটপট করে। কী সুন্দর সব প্রজাপতি। কোনোটা এক বিঘতের চেয়েও বড়। ছোট্ট মৌচুষি পাখি নেচে নেচে বেড়াচ্ছে। দত্তদা সাবধান করে দিলেন—দেখে চলে, বড় বড় মৌচাক আছে বনে। কাছে ঘেঁষলে আক্রমণ করবে।
আবার সমুদ্রতীরে ফিরল দুজনে।
ডন তিনটে নাটমেগ পিজিয়ন শিকার করেছে। বেশ বড় আকারের গোলা পায়রার মতো। তবে রং ঢের সুন্দর। মাঝিরা তির দিয়ে মেরেছে একটা ছোট হরিণ। মহা ফুর্তি তাদের। পাকা জংলি কলাও জোগাড় করেছে। স্বাদ একটু কষা কষা। কঁচা থাকলে এ—কলা ভাজা খাওয়া যায়। কয়েক কাদি নারকেল আর ডাব পাড়া হয়েছে। তপন ডাবের জল খেল প্রাণ ভরে। বাবুর্চি আলীর খাসা হাত। সে আজ বেজায় ব্যস্ত। দাউদাউ করে কাঠের উনুন জ্বলল। দুপুরে খাওয়াটা হল রীতিমতো ভোজ।
এক জায়গায় প্রবাল প্রাচীরে ঘেরা কিছুটা সমুদ্র। যেন এক ছোট্ট শান্ত হ্রদ। পাঁচিলের মাথায় মাথায় হেঁটে গিয়ে নিচে তাকাল তপন।
স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ জল। মধ্যাহ্নের দীপ্ত সূর্যরশ্মিতে জলের ভিতরে রামধনুর বাহার। কত রঙের, কত বিচিত্র আকারের মাছ সাঁতার কেটে খেলে বেড়াচ্ছে। প্রবালকীট জমে জমে উঠেছে তলায়। যেন ডালপালা মেলা নানান আকৃতির ক্যাকটাস গাছ। কত রঙের নুড়িপাথর। ভেসে ভেসে দুলছে লম্বা লম্বা ঘন সবুজ জলজ উদ্ভিদ। ওই বুঝি পাতালপুরী, পরীর দেশ। আশা মিটিয়ে দেখল তপন। অ্যাকোয়ারিয়ামে অনেকটা এমনি সাজায়। তবে তা সাজানো। আসলে নকলে আকাশ—পাতাল তফাত। এই দৃশ্য সে কখনো ভুলবে না। চোখ বুজে ভাবলেই ভেসে উঠবে মনে।
পরদিন নৌকো ছাড়ল। মোরগ দ্বীপ থেকে সোজা পুব মুখে। এখানে কাছাকাছি তিন—চারটে দ্বীপ আছে। এরপর মাইল পনেরো খোলা সমুদ্র। তারপর মেস্মন আইল্যান্ডস।