☼ অজেয় রায় ☼
মানুক দেওতার রহস্য সন্ধানে
তিন
দত্তদার পড়ার ঘরের দেওয়ালে দক্ষিণ—পূর্ব এশিয়ার মস্ত একখানা ম্যাপ ঝোলানো। দত্তদা দেখালেন, এই দেখ ডাচ নিউগিনির উত্তর—পশ্চিম প্রান্ত। তারপর সমুদ্র। ডেম্পিয়ার প্রণালী। তার উত্তরে এই ওয়াইজিও দ্বীপ। প্রায় নিরক্ষরেখার ওপরে। আর ওয়াইজিওর একটু নীচে দক্ষিণ—পশ্চিমে এই যে ফুটকিগুলো, এই হচ্ছে মেস্মন আইল্যান্ডস। এই দ্বীপগুলো ছোট ছোট, জঙ্গুলে, ভলক্যানিক বা কোরাল আইল্যান্ড। বেশির ভাগেই মানষের বসতি নেই। অস্বাস্থ্যকর। কাঠ, জায়ফল, নারকেল ইত্যাদির খোঁজে লোক এসব দ্বীপে কখনো কখনো যায় বটে, কিন্তু থাকে না। মেস্মন আইল্যান্ডস—এর দ্বীপগুলোর আলাদাভাবে নাম দেওয়া নেই। ম্যাপে পয়েন্ট—আউট করা হয়নি ভালোভাবে। কিন্তু তপন আমার একটা সন্দেহ হচ্ছে—
কী?
এটা ডিক্সন দ্বীপের পাখি।
——ডিক্সন দ্বীপ?
—নামটা আমার দেওয়া। জন ডিক্সন ছিল একজন অর্নির্থলজিস্ট অর্থাৎ পক্ষিবিদ। বিশেষত বার্ড অফ প্যারাডাইস স্পেশালিস্ট! পাঁচ বছর আগে ম্যানিলায় এক কনফারেন্সে ওর সঙ্গে আমার খুব ভাব হয়। কথায় কথায় ডিক্সন বলেছিল যে ও একটা এক্সপেরিমেন্ট। করছে। পাপুয়া নিউগিনি থেকে কয়েক জাতের প্যারাডাইস বার্ড এনে মলুক্কা সী—তে একটা জনহীন জঙ্গুলে দ্বীপে ছেড়েছে। দেখা যাক তাদের মধ্যে মিশ্রণ ঘটে নতুন স্পিশিস তোর হয় কিনা! প্যারাডাইস বার্ডস—এর মধ্যে একরকম মিশ্রণ ঘটেছে আগে। ডিক্সন খুব গোপনে করেছে ব্যাপারটা। সেই দ্বীপটা যে ঠিক কোন জায়গায় বলতে চায়নি ডিক্সন। শুধু বলেছিল, মেস্মন আইল্যান্ডস—এ।
আমি বলেছিলাম, দ্বীপে ছাড়লে? যদি লোকে জানতে পারে, সব ধরে মেরে সাফ করে দেবে। জানোই তো বার্ড অফ প্যারাডাইস—এর কী ভীষণ দাম! উত্তরে ডিক্সন বলেছিল, একটা চান্স নিয়েছি। বন্য পরিবেশ ছাড়া এদের মিশ্রণ ঘটে না। তেমন রিজার্ভ—ফরেস্ট পাচ্ছি কোথায়? দ্বীপ হলে পাখিগুলো একটা জায়গায় আটকে থাকবে। যদি সফল হই, ওখানে তৈরি নতুন স্পিশিস নিয়ে গিয়ে অন্য জঙ্গলে বা রিজার্ভ ফরেস্টে ছাড়ব। তবে। এমন দ্বীপে ছেড়েছি যেখানে কেউ পা দেয় না। তাই ভরসা এখুনি কেউ টের পাবে না। তবে যত তাড়াতাড়ি পারি পাখিগুলোর প্রোটেকশনের একটা ব্যবস্থা করতে হবে। তোমায় লিখব তখন, সাহায্যের জন্য।
দুঃখের বিষয়, এর তিন মাস বাদে মোটর অ্যাক্সিডেন্টে ডিক্সন মারা যায়। তাই ওর দ্বীপের হদিশও গোপন থেকে যায়। আমার বিশ্বাস, জিয়ানের পাওয়া স্পেসিমেনটা ডিক্সনের তৈরি কোনো নতুন প্রজাতি। ডিক্সন দ্বীপের পাশেই সমুদ্রে পেয়েছিল জিপসিরা! কারণ পাপুয়া—নিউগিনির কাছাকাছি মিশুল, আরু, জোবি ইত্যাদি কয়েকটা দ্বীপে বার্ড অফ প্যারাডাইস পাওয়া যায় বা আগে পাওয়া যেত, কিন্তু মেস্মন আইল্যান্ডস—এ এই পাখি পাওয়া গেছে বলে কখনো শুনিনি। এইজন্যে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দ্বীপটা আবিষ্কার করা দরকার। পাখিগুলোর রক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। নতুন কোনো স্পিশিস পেলে নিয়ে গিয়ে চিড়িয়াখানায় রাখব বা রিজার্ভ—ফরেস্টে ছাড়ব।
পরদিন বিকেলে তপন গোবিন্দ সিং—এর অফিস থেকে নিজের ঘরে ফিরে দেখে দরজার তালাটা ভাঙা। সে ঘরে ঢুকল। আলনায় ঝোলানো একটা নতুন শার্ট নেই এবং টেবিলের ওপর বসানো তার প্যারাডাইস বার্ডটি উধাও। ঘরে আর কোনো জিনিস বেপাত্তা হয়নি। চুরি করার মতো দামি জিনিস কী বা আছে তার? কিন্তু পাখিটা নিল কেন? এ—বস্তুর দাম কি চোর জানে? আশ্চর্য!
তপন থাকে এক তলায় একখানা ঘরে। এক তলার বাকি অংশে থাকে এক বর্মী পরিবার স্বামী ও স্ত্রী। তারা দুজনেই দিনের বেলা চাকরি করতে বেরিয়ে যায়। তাদের দরজায় তালা দিব্যি ঝুলছে। দোতলায় থাকে এক পরিবার। তারা একতলায় নজর রাখে না। তপন তক্ষুনি টেলিফোন করল দত্তদাকে।
দত্তদা আধঘণ্টার মধ্যে হাজির হলেন। ব্যাপার দেখে তিনি থ। বললেন, ইস, পাখিটা আমার এখান থেকে নিয়ে যাওয়া উচিত ছিল। গতকাল সময় পেলাম না আসতে।
পুলিসে ডায়রি করা হল।
একটা স্টাফ—করা পাখি এবং একখানা মাত্র শার্ট খোয়া গেছে জেনে ইন্সপেক্টর চুরির ব্যাপারে বিশেষ গা করলেন বলে মনে হল না।
থানা থেকে বেরিয়ে দত্তদা বললেন, স্পেসিমেনটা হারাল, এটা মস্ত ক্ষতি। ও—পাখির রং চেহারা আমার মুখস্থ হয়ে গেছে। দেখলে ঠিক চিনব। এখন জিয়ান আসুক।
স্টাফ—করা পাখিটা চুরি যাওয়ার পরদিন সন্ধ্যা ছটায় তপনের ঘরে জিয়ানের আসার কথা ছিল। বিকেল সাড়ে পাঁচটা থেকে রাত নটা অবধি দত্তদা ও তপন অপেক্ষায় রইল। জিয়ান এল না।
পরদিনও এল না জিয়ান। দুশ্চিন্তায় দত্তদার মুখ কালো হয়ে গেল। কী ব্যাপার? জিয়ানের ঠিকানা তারা জানে না। জিজ্ঞেস করেছিল, জিয়ান এড়িয়ে গেছে—এক ফ্রেন্ডের কাছে থাকি। সে আপনারা খুঁজে পাবেন না। বোঝা গিয়েছিল কোনো ঘুপচি নাবিকদের আস্তানায় তার বাস। সেখানে তপন বা ডক্টর দত্তর আগমন তার পছন্দ নয়।
দত্তদা তপনকে পা ইং—এর দোকানে পাঠালেন জিয়ানের খোঁজে। না, জিয়ান আসেনি। জিয়ান কোথায় থাকে তাও বুড়ি জানে না। বলে আসা হল, জিয়ান এলেই বলতে, তপনের কাছে যেন সে অবশ্যই যায়, ভীষণ দরকার।
পা ইং—এর দোকানে পরপর তিনদিন খোঁজ করেও জিয়ানের পাত্তা পাওয়া গেল না। মোটে আসেনি সে। পা ইং বেশ কৌতূহলী হয়ে উঠল—কী এত দরকার? এত ঘনঘন খোঁজ?
তপন দত্তদার বাড়িতে বসে। একটি লোক এল। মাঝারি লম্বা, মজবুত গড়ন, চেহারায় মঙ্গোলীয় এবং শ্বেতাঙ্গের মিশ্রণ। লাল চুল, চৌকো চোয়াল, গায়ের রং লালচে, তবে নাক চাপা। সরু বাঁকা চোখ। দত্তদা ইংরেজিতে বললেন, এসো ডন, তোমাকে খুব দরকার। একজনের খোঁজ করতে হবে। নাম—জিয়ান, মালয়ী নাবিক। সে কোথায় থাকে জানি না, তবে ব্লু—ড্রাগন নামে একটা রেস্টোরেন্টে যায়। চেন ব্লু—ড্রাগন?
নিঃশব্দে মাথা ঝাঁকাল ডন। লোকটির দৃষ্টি স্থির, মুখে কোনো ভাবান্তর নেই।
ব্লু—ড্রাগন কোথায়? দত্তদার প্রশ্ন।
নদীর ধারে। জাহাজীদের আড্ডাখানা। ইংরেজিতে উত্তর দিল ডন।
তবে একবার খোঁজ করে এসো। জিয়ান কেমন দেখতে বুঝিয়ে দিচ্ছি। আমার গাড়িটা নিয়ে যাও। হ্যাঁ, এ হচ্ছে তপন রায়—
ডন চলে গেল। দত্তদা তপনকে বললেন, ডন আমার অনেক অভিযানের সঙ্গী। ভালো শিকারী! ওর পূর্বপুরুষ ছিল পর্তুগীজ বোম্বেটে। ব্যাংককে থাকে। কাঠের ব্যবসা করে।
আধঘণ্টা বাদে ডন ফিরে এল। জানাল, ব্ল—ড্রাগনে জিয়ান যায় মাঝে মাঝে। তবে বেশ কয়েকদিন যায়নি। ও কোথায় থাকে কেউ বলতে পারল না। বলে এসেছি, জিয়ান এলে তাকে যেন মিস্টার রায়ের কাছে অবশ্য যেতে বলা হয়।
কিন্তু তবু জিয়ানের পাত্তা পাওয়া গেল না।
জিয়ানের সঙ্গে তপনদের শেষ দেখার পর আট দিন কেটে গেল। ডন প্রত্যেক দিন একবার ব্লু—ড্রাগনে খোঁজ নেয়। তপন যায় পা ইং—এর কাছে খোঁজ নিতে। কিন্তু জিয়ান যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। ও ব্যাংককে আছে কিনা তাও বোঝা যাচ্ছে না। দত্তদা দিনে দিনে অস্থির হয়ে উঠলেন। তিনি শান্ত প্রকৃতির আমুদে লোক। কিন্তু এখন সর্বদা তার মুখ গম্ভীর। হলটা কী জিয়ানের? অ্যাক্সিডেন্টে পড়ল নাকি? ডনের সঙ্গে ইতিমধ্যে তপনের আলাপ গাঢ় হয়েছে। দুজন দুজনকে নাম ধরে ডাকে। তবে ডন কথা বলে খুব কম।
আট দিনের মাথায় ডন এসে খবর দিল, জিয়ান ব্ল—ড্রাগনে এসেছিল আজ সকালে। সঙ্গে আর একজন ছিল। মাঝারি হাইট। গাঁট্টাগোট্টা। ছাই রঙের স্যুট পরা। চুরুট খায়। রেস্টোরেন্টের বাকি পাওনা দিয়ে গেছে জিয়ান। কথাবার্তায় মনে হয়েছে, সে বাইরে যাচ্ছে কোথাও। অল্পক্ষণ থেকে দুজনে চলে যায় একটা ছোট কালো রঙের মোটরে চেপে। ব্ল—ড্রাগনের ম্যানেজার বলেছিল জিয়ানকে, তপন ও আপনার কথা। বোঝা যাচ্ছে, লাভ হয়নি। ও ইচ্ছে করেই আপনাদের এড়াচ্ছে।
জিয়ানের সঙ্গীর বর্ণনা শুনে তপনের ধাঁ করে মনে পড়ে গেল একজনের কথা। সে বলে উঠল, দত্তদা, ঠিক এমনি চেহারার একটা লোককে দেখেছিলাম পা ইং—এর দোকানে, যেদিন প্রথম পাখিটার বিষয়ে খোঁজ করতে যাই। পা ইং—এর সঙ্গে বসে গল্প করছিল। আমি ঢুকতে একটু বাদে বেরিয়ে যায়। ঠিক ওইরকম দেখতে আর চুরুট খায়। লোকটাকে ফের দেখেছি আমি। জিয়ানকে নিয়ে যখন আমরা লাঞ্চ খেয়ে বেরুচ্ছি চিনা হোটেল থেকে, সেই লোকটা রাস্তার উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে দেখছিল আমাদের।
দত্তদা যেন চমকে উঠলেন। উত্তেজিতভাবে বললেন, আরে একথা আগে বলোনি কেন? ডন, বুঝতে পারছ, লোকটা কে? নির্ঘাৎ চ্যাং। চ্যাং—এর তো একটা ছোট কালো গাড়ি আছে। এইবার আন্দাজ করছি ব্যাপার। তপন, চল এখুনি আমার সঙ্গে পা ইং—এর কাছে। ডন, আমি ফিরে এসে তোমায় টেলিফোন করব।
পা ইং—এর দোকানের উল্টো দিকে দত্তদা গাড়ি থামালেন।
দোকানে একজন খদ্দের ছিল। গাড়িতে বসে দত্তদা ও তপন অপেক্ষা করে। খদ্দেরটি বেরিয়ে গেলে দুজনে দোকানে ঢুকল।
দত্তদাকে দেখেই পা ইং প্রথমে কেমন আড়ষ্ট হয়ে গেল। তারপর হেসে অভ্যর্থনা জানাল, ওয়েলকাম ওয়েলকাম, কী সৌভাগ্য আমার। মিস্টার দত্ত অনেক দিন বাদে। বলুন কী খুঁজছেন?—সেই থাই আর ইংরেজি মেশানো অদ্ভুত ভাষায়।
দত্তদা কোনো ভণিতা না করেই পা ইং—এর কাছে গিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে ইংরেজিতে বললেন, পা ইং, আমি একবার তোমার উপকার করেছিলাম, মনে আছে?
আছে বইকি! পা ইং—এর হাসি মিলিয়ে যায়।
তবে আশা করি উপকারীর মর্যাদা দেবে। আমায় ঠকাবে না।
না না, এ কথা কেন?
বেশ, তাহলে বলো, এই তপন তোমার দোকান থেকে যে একটা স্টাফ—করা পাখি কিনে নিয়ে গিয়েছিল সে খবর কি চ্যাং জানে? আর পাখিটা সম্বন্ধে সে কি তোমায় কিছু জিজ্ঞেস করেছে? আর জিয়ানের সঙ্গে কি তার আলাপ হয়েছে? সত্যি করে বলো।
পা ইং—এর মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেল। খানিকক্ষণ চুপ করে পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে থেকে সে খুব নিচু স্বরে আস্তে আস্তে বলল, প্লিজ মিস্তার দত্ত, আমি সত্যি কথা সব বলছি। কিন্তু চ্যাং যেন না জানতে পারে আমি আপনাকে এসব বলেছি। ও আমায় বারণ করে দিয়েছে বলতে। জান তো ও কী করম ভয়ঙ্কর লোক।
দত্তদা বললেন, বেশ, চ্যাং জানতে পারবে না, কথা দিলাম। এবার বলো।
পা ইং বলল, ওই রায় পাখিটা সম্বন্ধে খোঁজখবর করে বেরিয়ে যাবার পর চ্যাং ফের আসে। পাখিটা নিয়ে রায় খোঁজ করছিল জেনে কৌতূহলী হয়। জিয়ানের খোঁজখবর নেয়। পরদিন রায় জিয়ানকে সঙ্গে নিয়ে দোকান থেকে বেরিয়ে যেতেই চ্যাং ওদের অনুসরণ করে।ও আমার শো—কেসের পিছনে লুকিয়ে ছিল কী কথা হয় শুনতে। আমায় ভয় দেখিয়ে বাধ্য করেছিল এই ব্যবস্থায়। এরপর চ্যাং কী করেছে, না করেছে আমি কিছু জানি না, দিব্যি গালছি। এ শুধু আমায় নিষেধ করে যায় এই বিষয়ে কাউকে কিছু না বলতে। দোহাই মিস্তার, চ্যাং যেন জানতে না পারে আমি এসব বলেছি, তাহলে মারা পড়ব।
দত্তদা আর কথা না বাড়িয়ে বিদায় নিলেন। কেবল পা ইংকে বলে এলেন—জিয়ানের কোনো খবর পেলে আমায় জানিও।
পথে বেরিয়ে তপন জানতে চাইল, চ্যাং কে?
দত্তদা বললেন, নামে পশুপাখির ব্যবসায়ী, কিন্তু ওর আসল কারবার—দুর্লভ পশুপাখির চোরাই চালান। এই করে প্রচুর পয়সা কামিয়েছে। মহা ধূর্ত। পুলিস একবারও ওকে বাগে পায়নি। সাউথ—ইস্ট এশিয়ার অনেক দুষ্প্রাপ্য জন্তু ও পাখি ওর কল্যাণে নির্বংশ হতে চলেছে। আগের বছরই সুলু সাগরে ফিলিপিনো পুলিস একটা লঞ্চ আটক করে। তাতে পাওয়া যায়, খাঁচায় বন্দী ছটা লুচু র্যাবিট, দুটো ব্ল্যাক সেলিবিস এপ এবং তিনটি সেলিবিস দ্বীপের পিগমি বাফেলো। সব কটিই দুর্লভ প্রাণী। এদের ধরতে বা রপ্তানি করতে স্পেশাল পারমিশন নিতে হয়। জন্তুগুলি কে পাঠাচ্ছে, কার কাছে, কোনো হদিশই পাওয়া যায়নি। দেখা গেল সব ভুয়ো নাম—ঠিকানা। তবে কানাঘুষায় জানা যায় যে এটা চ্যাং—এর কীর্তি।
এসব প্রাণী কেনে কে? তপন জানতে চায়।
কিছু কেনে চিড়িয়াখানাগুলো। সোজা পথে না পেলে তারা এইভাবেও সংগ্রহ করে। তাছাড়া আছে বেশ কিছু প্রাইভেট কালেক্টর। নানা দেশের অনেক ধনীরই পশুপাখির শখ। তারা রীতিমতো চিড়িয়াখানা বানায়। তাতে দুর্লভ প্রাণী রাখা ভীষণ প্রেস্টিজের ব্যাপার। ফলে চোরা পথে, টাকার জোরে রেয়ার পশুপাখি জোগাড় করে। আর চ্যাং—এর মতো লোক আছে তাদের শখ মেটাতে।
এ ব্যবসায় তো খুব রিস্ক? বলল তপন।
তা বটে, তবে লাভও তেমনি। যেমন ধরো, ব্রেজিলের হায়াসিনথ ম্যাকাও—এর এক্সপোর্ট নিষিদ্ধ। কিন্তু সেই পাখি চোরাই পথে বিক্রি হয় এক—একটি দশ হাজার ডলারে। চোরাবাজারে এমনি নিষিদ্ধ পাখি, একজোড়া অস্ট্রেলিয়ান গোল্ডেন সোলডার্ড প্যারাকীট বা ব্রাউন প্যারাকীটের দাম কমপক্ষে দশ—বারো হাজার ডলার।
তপন বলল, লুকিয়ে মেরে বাঘের চামড়া, গণ্ডারের সিং খুব দামে বিক্রি হয় শুনেছি। কিন্তু জ্যান্ত প্রাণীরও যে এমন চোরাই—চালান হয় জানতাম না।
হয় হয়, দত্তদার কণ্ঠে ক্ষোভ উত্তেজনা, এই প্রাইভেট কালেক্টরের শখ আছে, টাকা আছে, কিন্তু জ্ঞান কম। তাই রেয়ার স্পিশিস সংগ্রহ করে প্রায়ই তাদের বাঁচাতে পারে না। ফলে স্পিশিসগুলি সংখ্যায় দিন দিন কমছে।
দত্তদা বলে উঠলেন, বুঝছ ব্যাপার। পাখিটার বিষয়ে খোঁজ করার কথা চ্যাং—এর কানে যায়। তার সন্দেহ হয়। পরে জিয়ানকে ধরে। বুঝতে পারে দেশ—ভ্রমণ বা অ্যাডভেঞ্চারটা ছল। আসলে লক্ষ্য পাখিটা। হয়তো এটা দুর্লভ কোনো বার্ড অফ প্যারাডাইস এবং তুমি নয়, আসলে আমিই খোঁজখবর করছি। ওই ঠিক চুরি করেছে পাখিটা লোক দিয়ে। ওর মতলবটা কী?
মোটরে উঠে স্টিয়ারিং—এ হাত রেখে খানিক চুপ করে বসে থেকে দত্তদা বললেন, চলো একবার চ্যাং—এর সঙ্গে মোলাকাত করে আসা যাক।
গাড়ি স্টার্ট নিল।
মিনিট দশেক এঁকেবেঁকে চলে থামল গাড়ি। পাড়াটা নির্জন। রাস্তা পেরিয়ে ওধারে একটা মাঝারি দোতলা বাড়ির নিচের দরজার বেল টিপলেন দত্তদা। একজন মালয়ী দরজা খুলে দিল। দত্তদা মালয়ী ভাষায় বললেন, মিস্টার চ্যাং আছেন?
লোকটি ভাবলেশহীন মুখে তাকিয়ে রইল। জবাব দিল না।
দত্তদা ফের বললেন, বলো গিয়ে প্রফেসর দত্ত এসেছেন।
লোকটি তখনো চুপ। নড়ছেও না। এমন সময় তার পিছন থেকে কেউ ইংরেজিতে বলে উঠল, আরে প্রফেসর দত্ত! কী সৌভাগ্য! আসুন, আসুন।
তপন দেখল, সেই ছাইরঙা স্যুট পরা লোকটি। এখন অবশ্য তার পরনে হাফশার্ট ও ট্রাউজার্স। তবে ঠোঁটে সেইরকমই চুরুট। লোকটির কণ্ঠস্বরে বিনয় ও ভদ্রতা যেন ঝরে পড়ছে। মুখে বিগলিত হাসি।
ঝকঝকে সাজানো ড্রইংরুমে বসল তিনজনে। কোনো ড্রিঙ্কস? জানতে চাইল চ্যাং।
না, ধন্যবাদ, উত্তর দিলেন দত্তদা। তারপর গম্ভীর স্বরে বললেন, মিস্টার চ্যাং, আমি একজনের খোঁজে এসেছি। লোকটির নাম জিয়ান। নাবিক! ওর কোনো হদিশ দিতে পারেন?
জিয়ান? চুরুটে একটা লম্বা টান মেরে ঊর্ধ্ব মুখে তাকিয়ে চ্যাং না জানার ভান করে।
দত্তদা দৃঢ়স্বরে বললেন, জিয়ানকে আপনি চেনেন মিস্টার চ্যাং, আমি ভালোভাবেই জানি।
তাই নাকি! কে বলল? চ্যাং—এর চোখ ছোট হয়।
কেউ বলেনি। তবে ব্লু—ড্রাগনে আপনাদের একসঙ্গে দেখা গেছে। ওর বিল আপনি মিটিয়েছেন। ব্লু—ড্রাগনের অনেকেই দেখেছে।
হুঁ। মনে পড়েছে। চ্যাং যেন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। লোকটা আমার কাছে ধার চাইল। কিছু। ব্লু—ড্রাগনের পাওনা শোধ করবে। নইলে নাকি রেস্টোরেন্টের ম্যানেজার ওকে ঠ্যাঙাবে। ওইখানেই জিয়ানের সঙ্গে আমার সামান্য আলাপ হয়েছিল কয়েকদিন আগে। খুব ঝুলোঝুলি করতে মিটিয়ে দিলাম ওর ধার। বলেছে তো শোধ করে দিয়ে যাবে বাড়িতে এসে। জানি ওসব বাজে কথা। তবু জানেন তো, কেউ হাত পাতলে আমি না বলতে পারি না। চ্যাং উদার হাসি হাসল।
জিয়ানের ঠিকানাটা জানেন? বললেন দত্তদা।
নাঃ। তা, ব্যাপারটা কী? ওকে কী জন্যে দরকার? আপনারও টাকা মেরেছে নাকি?
না। অন্য একটা কাজ আছে। যাক, চলি এখন। দত্তদা উঠে পড়লেন।
ঠিক আছে, ও যদি আসে ধার শোধ করতে, ওর ঠিকানাটা নিয়ে রাখব, সবিনয়ে জানাল চ্যাং, তবে সে—আশা খুবই কম। চ্যাং—এর বাড়ি থেকে বেরিয়ে তপনরা রাস্তায় দাঁড়িয়েছে। পিছনে চ্যাং—এর দরজা বন্ধ হয়ে গেছে। ঠিক তখুনি একটা প্রকাণ্ড ঝকঝকে মোটরগাড়ি এসে থামল সামনে। গাড়ির পিছনের দরজা খুলে নামল এক মাঝবয়সী ভদ্রলোক—টকটকে রং, বেজায় মোটা, পরনে দামি স্যুট। লোকটিকে দেখে মনে হয় আধা—ইউরোপিয়ান।
আগন্তুক দত্তদাকে একমুহূর্ত ভুরু কুঁচকে দেখে চোস্ত ইংরেজিতে বললেন, হ্যাল্লো প্রফেসর, খবর ভালো?
দত্তদা কেমন আড়ষ্টভাবে বললেন, হুঁ।
চ্যাং—এর কাছে এসেছিলেন বুঝি? দেখা হল? বললেন আগন্তুক।
দত্তদা একবার মাথা নেড়েই পা চালালেন।
আবার শিগগিরি কোনো অভিযানে যাচ্ছেন নাকি? আমার সেই অফারটা কিন্তু মনে রাখবেন প্রফেসর। প্লিজ। আগন্তুকের কথা ভেসে এল।
দত্তদা থমকে দাঁড়িয়ে ঘাড় ফেরালেন। আগন্তুকের মুখে যেন বাঁকা হাসি।
ঝটিতি ফিরে দত্তদা গটগট করে নিজের গাড়িতে উঠলেন। তপন উঠে বসল পাশে। বাকি পথ দত্তদা থমথমে মুখে গাড়ি চালালেন। একেবারে চুপ। বাড়ি এসেই টেলিফোন করতে গেলেন ডনকে।
দত্তদা ফোন করে ফিরে আসতেই তপন বলল, ওই লোকটা কে? মস্ত গাড়ি থেকে নামল?
প্রিন্স, জবাব দিলেন দত্তদা, মানে আমরা প্রিন্স বলেই ডাকি। ওর আসল নাম হেনরি উয়ান। থাকে রেঙ্গুনে। মহা ধনী। গণ্যমান্য ব্যক্তি। রাজার মতোই বিলাসিতায় থাকে। ওর খুব পাখির শখ। ফেমাস বার্ড কালেক্টর। অনেক রেয়ার স্পেসিমেন আছে ওর সংগ্রহে। কিন্তু ইদানীং ওর অ্যামবিশন বেড়েছে। শুধু কালেক্টর নয়, আবিষ্কারক হতে চায়। তবে নতুন পাখির খোঁজে বন—জঙ্গলে ঘুরে দিনের পর দিন কষ্টভোগ করে অভিযান চালাবার মতো ধৈর্য ওর নেই। তাই টাকার জোরে আবিষ্কার কিনতে চায়।
আবিষ্কার কেনা! সে আবার কী! তপন অবাক।
অর্থাৎ অন্য কারও আবিষ্কার করা কোনো নতুন পাখি ও নিজের আবিষ্কার বলে চালাবে। তার জন্য প্রকৃত আবিষ্কারককে দেবে প্রচুর টাকা। এইভাবে কিনবে। তিন বছর আগে চ্যাং মারফত প্রিন্স আমার কাছে এইরকম এক প্রস্তাব পাঠায়। আমি তখন ইস্ট জাভার অঞ্চলে এক এক্সপিডিশনে যাবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছি। প্রিন্স আমায় মোটা টাকা অফার করে এই শর্তে।
আপনার আবিষ্কার প্রিন্সের নামে চালাবে কীভাবে? ও যদি সঙ্গে না যায়? তপন ঠিক বুঝে উঠতে পারে না।
খুব সোজা ব্যাপার, বললেন দত্তদা, ধরো আমি একটা নতুন পাখি আবিষ্কার করলাম। তার দু—একটা জীবিত বা মৃত স্পেসিমেন নিয়ে গেলাম। তাদের ফোটো তলে আনলাম। ফিরে এসে স্পেসিমেন এবং ফিলম—রোল সমর্পণ করলাম প্রিন্সের হাতে। আর কেউ জানবে না ব্যাপারটা। এরপর প্রিন্স ঘটা করে এক্সপিডিশনে যাবে সেই জঙ্গলে। পাখির দেখা পাক বা না পাক, ওখান থেকে একটু ঘুরে এসে ঘোষণা করবে যে সে একটি নতুন জাতির পাখি আবিষ্কার করেছে। লোককে দেখাবে, আমার দেওয়া স্পেসিমেন, এবং ফিলম থেকে ডেভেলপ করা ফোটো। ফলে আবিষ্কারক হিসেবে তার নাম রেকর্ডেড হয়ে যাবে। খুব সম্মান মিলবে। বদলে আমি পাব প্রচুর টাকা। চ্যাং পাবে মোটা কমিশন। প্রিন্সের প্রস্তাব। আমি কড়াভাবে নাকচ করি। সেই থেকে চ্যাং এবং প্রিন্স আমার ওপর বেজায় চটা।
দত্তদা উত্তেজিতভাবে বললেন, চ্যাং ডাহা মিথ্যে কথা বলেছে। জিয়ানকে ও ঠিক কোথাও লুকিয়ে রেখেছে। তবে প্রথমে ভেবেছিলাম চ্যাং শুধু আমায় জব্দ করতে চায়। জিয়ানকে সরিয়ে দিয়ে আমার অভিযানটা ভেস্তে দিতে চাইছে। এবং হয়তো চুরি করা স্পিশিসটা বিক্রি করবে কোথাও। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে এর পিছনে প্রিন্স আছে। ব্যাপারটা আরও গোলমেলে। আমি ডনকে বলেছি চ্যাং—এর ওপর নজর রাখতে।
দু—দিন বাদে বিকেলে ডন এসে জানাল, প্রফেসর দত্ত, খবর পেলাম চ্যাং আজ দুপুরে সিঙ্গাপুরে চলে গেছে প্লেনে। প্রিন্সও চলে গেছে ব্যাংকক থেকে।
দত্তদা একটুক্ষণ গুম মেরে থেকে বললেন, আমার বিশ্বাস, চ্যাং প্রিন্সকে জানিয়েছিল জিয়ানের আনা পাখির বিষয়ে আমার আগ্রহের কথা। তারপর প্রিন্সের নির্দেশেই চ্যাং ওটা চুরি করায়। এবং পাখিটা দেখে প্রিন্স ধরতে পেরেছে যে এটা নতুন স্পিশিস। এখন প্রিন্স নির্ঘাৎ চ্যাংকে পাঠাবে ওই পাখির খোঁজে। ওই টাকা জোগাবে। প্যারাডাইস বার্ড—এর নতুন স্পিশিসটা চ্যাং খুঁজে পেলে প্রিন্স তার আবিষ্কারটা কিনে নেবে। ফলে প্রিন্সের অনেক দিনের সাধ পূর্ণ হবে। এর জন্যে সে প্রচুর টাকা ঢালতে পিছপা হবে না। হ্যাঁ, এর সঙ্গে আমাকেও জব্দ করাটা হবে ফাউ। এক ঢিলে দুই পাখি বধ।
নাঃ, আর একটা দিনও বাজে নষ্ট নয়। চ্যাং ঠিক ডিক্সন আইল্যান্ডের পথে রওনা হয়ে। গেছে। কিন্তু জন ডিক্সনের কীর্তি চুরি করে কেউ বিখ্যাত হবে, তা আমি হতে দেব না। ডন, চলো বেরোই, কাজ আছে।
দত্তদা ও ডন বেরিয়ে গেলেন। তপন তার ঘরে ফিরল।