» » মানুক দেওতার রহস্য সন্ধানে

বর্ণাকার

অজেয় রায়

মানুক দেওতার রহস্য সন্ধানে

দুই

সেই দিনই সন্ধ্যায় সে পাখিটাকে নিয়ে হাজির হল দত্তদার বাড়ি।

দত্তদা, আপনি বসে বসে বই পড়ুন, একটু পরে আপনাকে একটা জিনিস দেখাচ্ছি।

তপনের কথা শুনে দত্তদা একটু অবাক হয়ে বললেন, কী জিনিস?

দেখবেন—দেখবেন।

তপন দত্তদার দিকে পিছন ফিরে টেবিলের ওপর পাখিটা ফিট করতে থাকে।

দেখুন দত্তদা, ডাকল তপন।

বাঃ,, দত্তদা উৎফুল্ল, কোথায় পেলে? এ যে বার্ড অফ প্যারাডাইস!

কিনলাম।

কোত্থেকে?

রাজাবংশী রোডের গায়ে গলিতে, এক বুড়ির দোকান থেকে।

ও বুঝেছি। পা ইংএর দোকান।

এটা আপনাকে প্রেজেন্ট করব।

বল কী হে! থ্যাঙ্ক ইউ ভাই। কিন্তু কত নিল?

দশ ডলার।

যাক, তবু ভালো। খুব সস্তায় পেয়েছ। এখন তো নিউগিনি অস্ট্রেলিয়া থেকে এ পাখির চালান নিষিদ্ধ হয়ে গেছে। তবে লুকিয়ে চুরিয়ে যে হয় দেখতেই পাচ্ছি।

নিষিদ্ধ কেন?

সাফ হয়ে যাচ্ছিল। হাজার হাজার জীবন্ত বা মৃত পাখি চালান হয়ে যাচ্ছিল বাইরে। অপৰ্ব পালকের সৌন্দর্যই এদের কাল হয়েছে। পৃথিবীর নানা দেশের লোক এদের রঙচঙে পালক মুকুটে পরে, পাগড়িতে পরে, মেয়েদের পোশাকের শোভা বাড়ায়। ভীষণ চাহিদা। এখন শুধু বৈজ্ঞানিক গবেষণার কাজে বা চিড়িয়াখানার জন্য বিশেষ অনুমতি নিয়ে এই পাখি ধরা বা মারা চলে। ওখানকার আদিবাসীরা অবশ্য এখনো প্যারাডাইস বার্ড বিনা অনমতিতেই শিকার করতে পারে। তাদের পালক লাগিয়ে সাজগোজ করে। কিন্তু বাইরের লোককে পাখি বা পালক বিক্রি করা নিষেধ।

তপন বলল, জানেন দত্তদা, দোকানি বুড়ি এটার নাম বলছিল বুরং রাজা।

দত্তদা বললেন, বুরং রাজা? কথাটা মালয়ী। মানে রাজা পাখি। কিং বার্ড। বুরং মানে পাখি। আরও আগে মালয়ীরা প্যারাডাইস বার্ডের কী নাম দিয়েছিল জানো?—মানুক দেওতা। মানে দেবতার পাখি। নিউগিনির ধারে কাছে কিছু জায়গায় পাখিকে বলে মানুক।

সত্যি, যা সুন্দর দেখতে, বলল তপন।

ঠিক রূপের জন্য নয়। নামটার আর একটা কারণ ছিল। বহুকাল ধরে নিউগিনি অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীরা ছাড়া এই পাখি কেউ জীবন্ত দেখেনি। নিউগিনির আদিবাসী জংলি পাপুয়ানদের কাছ থেকে মালয় বণিকরা কিনত শুধু মৃত পাখি—পালকসুদ্ধ দেহ। কিন্তু তাদের পা থাকত না। কেন জানি না পা কেটে ফেলা হত। মালয়ীদের তাই ধারণা হয়েছিল, এই জাতের পাখির পা নেই। তারা মাটিতে বা ডালে বসে না। সর্বদাই উড়ে উড়ে বেড়ায়। খায় বৃষ্টির জল আর শিশির। এমন পাখি যার পা নেই, পালক এমন অপূর্ব সুন্দর, নিশ্চয়ই দেবলোক স্বর্গের পাখি। দেবপক্ষী বা দেবতার পাখি।

মালয়ীদের থেকে এই ধারণাটা হয় ইউরোপিয়ানদের। তাই পর্তুগীজরা এর নাম দেয় প্যারার—ডা—সোল। অর্থাৎ সূর্যের পাখি। ডাচরা বলে, অ্যাভিস প্যারালাইসিয়াস। মানে স্বর্গের পাখি। পরে অবশ্য জানা যায় এরা মর্তেরই পাখি এবং এদের দুটি পা—ও আছে। তবে নামের সঙ্গে স্বর্গ কথাটা জুড়ে গেল। বোধহয় ১৮২৪ খ্রিস্টাব্দে, প্রথম একজন ইউরোপিয়ান প্যারাডাইস—বার্ড জীবন্ত দেখে। এদের সম্পর্কে প্রথম বিস্তারিতভাবে লেখেন চার্লস ডারউইনের বন্ধু প্রাণিবিদ আলফ্রেড রাসেল ওয়ালেস, ১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দে।

ওটা কাছে নিয়ে এসো তো। দেখি স্পিশিসটা কী? বুরং রাজা সাধারণত বলা হয় কিং বার্ড অফ প্যারাডাইসকে।

পাখিটা আনতে আনতে তপন বলল, এর আরও স্পিশিস আছে নাকি?

আছে বইকি! প্যারাডাইসেমিডেয়ি পরিবারে প্রায় চল্লিশ রকম স্পিশিস অর্থাৎ প্রজাতি আবিষ্কৃত হয়েছে। তাদের পালকের রং ও আকার নানারকম।

পাখিটা হাতে নিয়ে ডক্টর দত্ত বললেন, ও এই জন্যে, এই খুঁতগুলোর জন্যে এত সস্তায় ছেড়েছে।

পাখিটা দেখতে দেখতে দত্তদা বললেন, জানো তো এরা কাকের জ্ঞাতি। একই গোত্রের পাখি।

বলেন কী!

হুঁ, প্রকৃতির কী অদ্ভুত খেয়াল। আর এই পালকের বাহার শুধু পুরুষ পাখিদের। মেয়ে প্যারাডাইস বার্ড দেখতে নেহাৎ সাদামাটা। নাঃ, এটা তো ঠিক কিং বার্ড অফ প্যারাডাইস নয়। একটু অন্যরকম। আচ্ছা, টেবিল থেকে ওই লাল মলাটের মোটা বইটা দাও দেখি।

তপন বইটার নাম দেখল—বার্ডস অফ নিউগিনি অ্যান্ড অস্ট্রেলিয়া! বইয়ের পাতায় পাতায় রঙিন ছবি। একজায়গায় পরপর দশটি পাতায় শুধু নানারকম বার্ড অফ প্যারাডাইসের ছবি। দত্তদার নজর একবার ছবির দিকে, আর একবার পাখিটার দিকে যায়। তপন চুপ করে দেখে। প্রত্যেক ছবির তলায় নাম লেখা। যেমন—রেড বার্ড অফ প্যারাডাইস, গ্রেট বার্ড অফ প্যারাডাইস, কিং বার্ড অফ প্যারাডাইস, প্রিন্স রুডলফ বার্ড অফ প্যারাডাইস—এমনি সব নাম।

দশটি পাতাই ওল্টানো হল। ডক্টর দত্তর ভুরু কুঁচকে গেছে। বললেন, স্ট্রেঞ্জ! একটার সঙ্গেও মিলল না। আমার ধারণা এই বইয়ে এ পর্যন্ত পাওয়া সব প্যারাডাইস বার্ড—এর ছবি আছে। এ কি তবে নতুন স্পিশিস? আচ্ছা আর একটু খুঁজব আমি। ওঃ তপন, তুমি একটা দারুণ জিনিস দিয়েছ।

পরদিন বিকেলে তপন দোকান থেকে বেরিয়ে সোজা হাজির হল দত্তদার বাড়ি। দত্তদা তপনের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। অস্থিরভাবে পায়চারি করছিলেন ড্রইংরুমে। তপনকে দেখেই বললেন, এটা নতুন স্পিশিস, আই অ্যাম অ্যাবসোলিউটলি সিওর। কোথাও এর রেফারেন্স নেই। তোমাকে পা ইং—এর দোকানে যেতে হবে, আজই। জানতে হবে এই পাখি সে কীভাবে পেয়েছে, কে দিয়েছে, কোথায় পাওয়া গেছে? আমি যাব না আজ। পাইং আমায় চেনে। হয়তো ঘাবড়ে যাবে আমায় দেখলে। কারণ এসব জিনিস চোরাপথে আসে। তুমি বিদেশি, তোমার কাছে হয়তো মুখ খুলতে পারে সহজে। তবে তোমায় না বললে, তখন জোর করতেই হবে। সে—ব্যবস্থা আমি করব। তুমি সোজাসুজি জিজ্ঞেস কোরো না। কথার ছলে জেনে নেবে। উইশ ইউ গুড লাক।

পা ইং—এর কিউরিও শপ ফাঁকাই ছিল। দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকল তপন। পা ইং উঠে দাঁড়াল। তার সোনা বাঁধানো দাঁতটি ঝিলিক দিল। দু—দিন আগের খদ্দের ফের ফিরে এসেছে দেখে সে ভারি খুশি। হাত বাড়িয়ে বলল, ওয়েল কাম।

কাছে গিয়ে তপনের চোখ পড়ল দোকানের ভিতরে পা ইং—এর কাছে আর একটি লোক চেয়ারে বসে। এতক্ষণ সে দেখতে পায়নি। লোকটি এদেশীয়। চিনা বা মালয়ী। বেঁটে গাট্টাগোট্টা। পরনে ছাই রঙের স্যুট, হাতে জ্বলন্ত চুরুট। বয়স বোঝা গেল না, তবে নেহাৎ ছোকরা নয়।

কীভাবে আসল কথাটা পাড়বে তপন মনে মনে ভেবে গিয়েছিল। কিন্তু অচেনা লোকের সামনে ও—প্রসঙ্গ তুলতে চাইল না। এটা—সেটা দেখে সময় কাটাতে লাগল। লোকটা কি উঠবে না? কে লোকটা?

পা ইং একটার পর একটা জিনিস নামিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখাচ্ছে। আর তপন এমন ভাব দেখাচ্ছে যেন সব কটাই তার বেজায় পছন্দ। তপনের বেশি জিনিস কেনার সামর্থ নেই তা বুড়ি বোঝে। তবু তার আগ্রহ দেখে একটু স্নেহ ভরেই বোঝাতে লাগল। জিনিসগুলোর বিশেষত্ব, তার সেই অদ্ভুত ইংরেজি আর থাই মেশানো ভাষায়।

স্যট—পরা লোকটি বসে বসে চুরুট টানছে। অধৈর্যভাবে তাকাচ্ছে। শেষে উঠেই পড়ল। পা ইংকে দুর্বোধ্য ভাষায় কয়েকটা শব্দ বলে বেরিয়ে গেল। তপনের মনে হল ও চিনা ভাষা বলল।

কয়েক মিনিট বাদেই আসল কথাটি পাড়ল তপন। মাদাম সেই দিনের পাখিটা চমৎকার। ওটা আমি দেশে নিয়ে যাব। সাজিয়ে রাখব ড্রইং রুমে।

উ উ—পা ইং খুশির আওয়াজ করল। বলল, এখানে তুমি কী করতে এসেছ?

চাকরি। বছরখানেক বাদে ফিরে যাব দেশে—ইন্ডিয়া। ক্যালকাটা।

বুড়ি ঘাড় নাড়ল। ক্যালকাটার নাম সে জানে।

তপন জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা মাদাম, ওই পাখিটা পেলে কীভাবে?

হোয়াই? পা ইং—এর চোখ কুঁচকে যায়।

মানে ওই পাখি শুনেছি খুব গভীর জঙ্গলে থাকে। ওটা মারতে নিশ্চয়ই ওইরকম জঙ্গলে যেতে হয়েছে। খুব অ্যাডভেঞ্চার হয়েছে। আসল কথাটা বলি—আমি গল্প লিখি। অ্যাডভেঞ্চারের গল্প। অনেকগুলো বই আছে আমার। ওই পাখির শিকারের অ্যাডভেঞ্চারটা যদি জানা যায়, ঢুকিয়ে দেব আমার কোনো গল্পে। দারুণ জমবে।

উ রাইতার! পা ইং—এর নরুণ—চেরা চোখে বিস্ময় জাগল। বলল, কী ভাষায় লেখো?

বেঙ্গলি।

পা ইং হতাশভাবে ঘাড় নাড়ল। অর্থাৎ সে বাংলা জানে না।

এই পাখিটা তুমি ধরেছ? জিজ্ঞেস করল তপন।

নো নো।

যে ধরেছে তার সঙ্গে দেখা হয় না?

হতে পারে, পা ইং মাথা দোলায়। তার মনে আর সন্দেহ নেই। তপনকে ঠাউরেছে নেহাৎ এক কল্পনাবিলাসী লেখক। এর সঙ্গে খোলাখুলি কথা বলতে ভয় কী? বরং মজাই পাচ্ছে। পা ইং নিজের মনেই বলল, জিয়ান কী আর মেরেছে পাখিটা? না কেউ দিয়েছে : ওকে? কে জানে!

জিয়ান কে? প্রশ্ন করল তপন।

ওই পাখির মৃতদেহটা যে আমায় বিক্রি করেছে। তারপর আমি স্টাফ করেছি, উত্তর দিল পা ইং।

কী করে সে? কোথায় থাকে?

থাকে সিঙ্গাপুরে। এখন ব্যাংককে আছে। জিয়ান একজন নাবিক। মালয়ী।

অ্যাঁ! সেলার। তপন একেবারে হামলে পড়ল, ওঃ! কক্ষনো কোনো নাবিকের সঙ্গে আমার আলাপ হয়নি। কত দেশ, কত সমুদ্র ঘুরেছে! কত অ্যাডভেঞ্চার! ভাবতেই পারি না। ওর গল্প আমায় শুনতেই হবে। জিয়ানের সঙ্গে কী করে দেখা করা যায়? বলো। বলো—প্লিজ।

পা ইং হেসে বলল, হবে হবে। জিয়ানের ঠিকানা আমি জানি না, তবে কাল ও আসবে। এখানে। আমার কাছে টাকা পাবে। ওকে বলব তোমার কথা। জিয়ান মাই ডিয়ার লোক। খুব ঘুরেছে। বেশ গল্প বলে। তোমার কাজে লাগতে পারে।

নিশ্চয় লাগবে। আলবৎ লাগবে। রিয়াল লাইফ অ্যাডভেঞ্চার, তপন উত্তেজিত, কাল সকালে আসবে? কখন? ইংরেজি জানে? বেশ বেশ। আমি আসব তাহলে দশটা নাগাদ। জিয়ান আগে এসে গেলে আমার জন্যে অপেক্ষা করতে বোলো। বলবে, আমায় গল্প শোনালে ওকে খুব ভালো প্রেজেন্ট দেব। প্লিজ বোলো কিন্তু—

ঠিক আছে, ঠিক আছে। পা ইং আশ্বাস দিল।

পা ইং—এর কাছে বিদায় নিয়ে তপন দত্তদাকে রিপোর্ট করল।

দত্তদা বললেন, তুমি জিয়ানকে নিয়ে তোমার ঘরে যাবে। আমিও হাজির হব তোমার ঘরে। সেখানে কথা হবে। পাখিটা নিয়ে যাও। তোমার ঘরে সাজিয়ে রাখো। অন্য কথা বলতে বলতে পাখির কথায় আসবে। আমার পরিচয় দিও—চেনা লোক। অ্যাডভেঞ্চারের গল্পের ভীষণ ভক্ত। টিচার। ভ্রমণ কাহিনি লেখে। জিয়ানের কথা শুনে থাকতে পারিনি। কিছু ভালোমন্দ খাবার—দাবারের ব্যবস্থা রেখো। তোয়াজ করতে হবে। যদি দামি খবর কিছু দেয় তখন আরও খাতির দেখানো যাবে।

গোবিন্দ সিং—এর কাছে ছুটি নিয়ে তপন সকাল দশটা নাগাদ পা ইং—এর দোকানে। হাজির হল। কাউন্টারের ভিতরে একটি লোক বসেছিল, সে উৎসুক চোখে দেখল তপনকে। পা ইংলোকটিকে দেখিয়ে বলল, এই হচ্ছে জিয়ান। বসিয়ে রেখেছি তোমার জন্যে।

জিয়ান তড়াক করে উঠে দাঁড়িয়ে হ্যান্ডশেক করল। জিয়ানের চেহারা রোগা পাকানো। মাঝারি লম্বা। হাত দুটো শিরাবহুল, তাতে ভর্তি উল্কি। খুদে খুদে চোখ দুটো পিটপিট করছে। পরনে হলুদের ওপর কালো ডোরা কাটা স্পোর্টস গেঞ্জি ও পুরনো নীল জিনস। পায়ে রবারের জুতো।

তপন কৃতার্থ হয়ে ইংরেজিতে বলল, আপনার কথা শুনেছি। আপনার গল্প শুনতে চাই। আমার কথা বলেছে কি পা ইং?

হ্যাঁ হ্যাঁ বলেছি বইকি, জানাল পা ইং, রায় ইন্ডিয়ান। অ্যাভেঞ্চার রাইতার।

জিয়ান বেশ গর্বিতভাবে বলল, তা ঘুরেছি অনেক। প্রচুর অ্যাডভেঞ্চার করেছি বটে।

তপন বলল, এখানে গল্প জমবে না, খদ্দের আসবে, চলো, আমার ঘরে যাই। কাছেই মহারাজ রোডে। বেশ বসা যাবে। সে জিয়ানকে বেশি ভাবনা—চিন্তার সুযোগ না দিয়ে প্রায়। ঠেলে বাইরে এনে ফেলল। একদফা ধন্যবাদ জানিয়ে আসল পা ইংকে। খানিকটা হেঁটে গিয়ে একটা ট্যাক্সি নিল।

তপনের ঘরে ঢুকেই জিয়ানের নজরে পড়ল টেবিলের ওপর সাজিয়ে রাখা সেই বার্ড অফ প্যারাডাইস।

তপন হেসে বলল, চিনতে পারছ? তোমার সেই পাখি। আমি কিনেছি। চমৎকার।

জিয়ান বসল। তপন তৎক্ষণাৎ তার সামনে এগিয়ে দিল এক বোতল উত্তম সুরা। তারপর এক প্যাকেট দামি সিগারেট সামনে রেখে বলল, দাঁড়াও, পাশের দোকান থেকে গরম গরম মাংসের চপ নিয়ে আসি। হ্যাঁ—আমার পরিচিত এক ভদ্রলোক, বাঙালি, তাকে বলেছিলাম তোমার কথা। তিনি তোমার গল্প শুনতে চান। খুব ধরেছিলেন আমায়। ভদ্রলোক টিচার, লেখেন—টেখেন—ভ্রমণ কাহিনি। এসে পড়তে পারেন। তোমার আপত্তি নেই তো?

একটা সিগারেট ধরিয়ে জিয়ান ঘাড় নেড়ে জানাল—না না, আপত্তির কী? তার মুখে গর্ব ও আত্মপ্রসাদ। সে বুঝে নিয়েছে, এই বিদেশিদের চোখে সে একজন হিরো। তার অতি কষ্টকর একঘেয়ে নাবিক জীবনের অভিজ্ঞতা কেউ যে এত আগ্রহ করে শুনতে চায়, সে বোধহয় এই প্রথম জানল।

তপন বাইরে গিয়ে দত্তদাকে টেলিফোন করল।

মিনিট পনেরোর ভিতর দত্তদা এসে পড়লেন। জিয়ানের সঙ্গে তার পরিচয় হল। তিনজনে বসল। জিয়ানের খাবার চটপট শেষ। বোতলের পানীয় ঢেলে অল্প অল্প চমক দিতে দিতে সিগারেটে টান মেরে জিয়ান বলল, কোথাকার গল্প শুনবেন? প্যাসিফিক? সাউথ সী আইল্যান্ডস না অ্যাটলান্টিক? আমি ক্যালকাটাতেও গেছি।

আগে সাউথ সীর কথাই বলো, দত্তদার অনুরোধ।

বাঁকা বাঁকা ইংরেজিতে জিয়ান বলে চলে তার বিচিত্র অভিজ্ঞতা। প্রায় একঘণ্টা কাটল। দত্তদা গোপনে ইশারা করলেন তপনকে—অর্থাৎ এবার পাখির কথা পাড়ো।

জিয়ানের সমুদ্র জীবনের কাহিনি; নতুন দেশ, নতুন জাতি; নতুন নতুন বন্দর। ঝড়ে পথ হারিয়ে দিক—দিশাহীন সাগরবক্ষে ভেসে চলা। কত অজানা প্রাণীর দেখা পাওয়া। কূলহীন অতল সাগরগর্ভে কত অজানা বিস্ময়, রোমাঞ্চ, ভীতি। মাঝে মাঝে সন্দেহ হচ্ছিল ওর একার জীবনে এত কাণ্ড সত্যি ঘটেছে কি না! হয়তো বা গুণমুগ্ধ শ্রোতা পেয়ে অন্যের কাছে শোনা গল্প ও নিজের নামে চালাচ্ছে। তবু তপনের চমৎকার লাগছিল। পাখির ব্যাপারটা না থাকলে খুশিমতো বলতে দিত জিয়ানকে।

গল্পের স্রোত একবার থামতেই তপন জিজ্ঞেস করল—আচ্ছা, এই পাখিটা কোত্থেকে পেলে? এ পাখি তো ঘোর জঙ্গলে থাকে শুনেছি।

তা বটে, টেবিলে খাড়া করা পাখিটা দেখে নিয়ে গম্ভীরভাবে জানাল জিয়ান।

পাহাড়ে উঠতে হয়েছিল বুঝি? তপনের আগ্রহভরা প্রশ্ন।

না, দ্বীপ। ভীষণ জঙ্গুলে দ্বীপ, বলল জিয়ান।

দ্বীপ? কোথায়? এবার প্রশ্ন করেন দত্তদা।

ওয়াইজিওর কাছে, দক্ষিণ—পশ্চিমে, ডেম্পিয়ার প্রণালীতে ঢোকার মুখে, মেসমন আইল্যান্ডস। উঃ, সেবার ঝড়ে মারা পড়েছিলাম আর কী!

কী রকম? কী রকম? ওখানে গিয়েছিলে কী করতে? বলল তপনদা। মলা সাগরে কচ্ছপ ধরতে বেরিয়েছিলাম একদল জেলের সঙ্গে। জাহাজের কাভা ছিল না তখন। ভাবলাম এইভাবে দু—পয়সা রোজগার করি। নির্জন দ্বীপের বেলাভূমিতে কচ্ছপ ডিম পাড়ে। আচ্ছা গাড়ে। সেখানে তাদের ধরা যায়।

পাখিটাকে কি তুমি নিজে শিকার করেছিলে? কোন দ্বীপে? নিশ্চয়ই খুব অ্যাডভেঞ্চার হয়েছিল? বলো, বলো, শুনি। ডক্টর দত্তর কণ্ঠে অধীর আগ্রহ।

জিয়ান থমকে গেল। বলল, না, ঠিক নিজে মারিনি, পেয়েছি একদল সামুদ্রিক জিপসির কাছ থেকে। তবে দ্বীপটা জানি, ওরা দেখিয়ে দিয়েছিল।

সেই দ্বীপটায় গিয়েছিলে তোমরা? ডক্টর দত্তর প্রশ্ন।

না। তখন আমরা ফিরছি। মেস্‌মন আইল্যান্ডস—এর একটা ছোট দ্বীপে থেমেছি। সেখানে জিপসিরা এল নৌকায়। ওদের কাছে মরা পাখিটাকে দেখলাম। চমৎকার পালক দেখে কিনে নিলাম, একখণ্ড কাপড়ের বদলে।

কী করে পেয়েছে ওটা বলল জিপসিরা? প্রশ্ন করল তপন।

বলেছিল। মৃত অবস্থায় সমুদ্রের জলে ভাসছিল একটা দ্বীপের পাশে। বোধহয় ঝড়ের তোড়ে ছিটকে পড়েছিল জলে। আমাদের একজন জেলে পাখিটার পেট—টেট কেটে পরিষ্কার করে দিল। তবে বেটা আনাড়ি ছিল। কেটে—কুটে নষ্ট করে দিল পাখিটা। নইলে ভালো দাম পেতাম।

দত্তদা আনমনে ভাবছেন কিছু। তপন কথা চালাতে জিজ্ঞেস করল, জিয়ান, তুমি তিমি শিকার দেখেছ?

দেখেছি বইকি। জিয়ান ফের বক্তৃতা শুরু করে।

মিনিট দশ বাদে দত্তদা বলে উঠলেন, আমার মাথায় একটা আইডিয়া এসেছে। ওই দ্বীপে আমি যাব, যে দ্বীপের পাশে পাখিটা ভাসছিল। তুমি হবে আমার গাইড। ওই দ্বীপে নিশ্চয় এরকম পাখি আরও আছে। সেই পাখিদের ফোটো তুলব। জীবন্ত পাখির মুভি ফোটোগ্রাফ। দারুণ হবে। ভয় নেই তোমার লোকন করব না। জাহাজে তুমি যা মাইনে আর যা যা পাও তাই দেব আমি।

এই পাখি? জিয়ান আমতা আমতা করে।

জিয়ানের মুখের ভাব দেখে দত্তদা বললেন, কেন, দ্বীপটা তো তুমি চেনো। ওই দ্বীপে গেলে এই পাখি ঠিক খুঁজে পাব।

হ্যাঁ, তা চিনি। তবে চোখে দেখিনি। জিপসিরা দেখিয়ে দিয়েছিল কোম্বারে। মেসমন আইল্যান্ডস—এর একদম পুবে। আমরা যে দ্বীপে গিয়েছিলাম তার থেকে বেশি দূরে নয়। পাখির দেহটা তখনো বেশ টাটকা ছিল। তবে ঠিক কোন দ্বীপটা কে জানে!

কেন, ওখানে কি অনেক দ্বীপ?

হ্যাঁ, অনেকগুলো, আর সবকটাই জঙ্গুলে। বেশির ভাগেই মানুষ থাকে না। কখনো আর যাইনি ওদিকে। শেষে যদি পাখি পাওয়া না যায়? এত কষ্ট করে যাবেন? জিয়ান যেন ভরসা পায় না। সে বলল, বুরং রাজা তো অন্য জায়গাতেও আছে।

না না, আমি ওইখানেই যেতে চাই, দত্তদা জোর দিলেন, প্যারাডাইস বার্ডের ফোটো তুলতে না পারলেই বা কী? খাসা একটা অ্যাডভেঞ্চার হবে। ভ্রমণ কাহিনি লিখে ফেলব। ওখানকার দ্বীপে ঘুরে ঘুরে ফোটো তুলব। জিপসিদের সঙ্গে যে দ্বীপে দেখা হয়েছিল সেখান অবধি চিনে যেতে পারবে তো?

হ্যাঁ, তা পারব।

ব্যস, তাহলেই হবে। তোমার কি এখন জাহাজে কাজ আছে?

না। তবে সাত—আট দিন বাদে একটা জুটবে।

দরকার নেই তোমার ও কাজে। আমরা সপ্তাহখানেকের ভিতরেই বেরিয়ে পড়ব।কাল এসো এখানে। আমার বাড়ি নিয়ে যাব। তারপর সব প্ল্যান ছকে ফেলব। কি, রাজি? জিয়ান বলল, অলরাইট। তবে কাল নয়, পরশু আসব, সন্ধে ছটা নাগাদ।

অমনি দত্তদা উঠে দাঁড়িয়ে সাড়ম্বরে করমর্দন করলেন জিয়ানের সঙ্গে। তারপর বললেন, বারোটা বাজে। চলো বাইরে কোথাও লাঞ্চ খাওয়া যাক। আমার মোটর আছে বাইরে। চলো—

এক নামকরা চিনা হোটেলে তিনজনে খেতে ঢুকল। জিয়ানকে দেখে মনে হচ্ছিল বেজায় খুশি। এমন খাতির—যত্ন তার ভাগ্যে কদাপি জুটেছে কিনা সন্দেহ। লোকটি বকে একটু বেশি। ফুর্তির চোটে সমানে কথা বলে চলেছে। মেনু এল। জিয়ানকে অনুরোধ জানানো হল খাবার পছন্দ করতে। সে একধারসে অর্ডার দিল—বার্ড—নেস্ট স্যুপ, চাওমিন, ডাক রোস্ট, গলদা চিংড়ি ভাজা ইত্যাদি। ভক্তদের পকেট হালকা করতে তার বিন্দুমাত্র সঙ্কোচ নেই। পয়সা বেশ খরচা হলেও খাওয়াটা হল তোফা।

বেলা একটা নাগাদ জিয়ান ঘড়ি দেখে বলল, এবার আমি উঠি। ব্লু—ড্রাগনে একজন আমার জন্য অপেক্ষা করবে। পরশু আসব মিস্টার রায়ের ঘরে সন্ধে ছটায়।

ব্লু—ড্রাগন কী? জিজ্ঞেস করল তপন।

রেস্টুরেন্ট, জবাব দিল জিয়ান।

সকলে উঠে পড়ল। জিয়ান বিদায় নিল। তপন ডক্টর দত্তর সঙ্গে গেল তার বাড়ি।

গাড়িতে যেতে যেতে তপন জিজ্ঞেস করল, দত্তদা, ওয়াইজিও কোথায়? আর মেস্‌মন আইল্যান্ডস?

বাড়ি চলো দেখাচ্ছি, দত্তদা জবাব দিলেন।