☼ অজেয় রায় ☼
আমাজনের গহনে
সাত
বৈজ্ঞানিক সর্বজ্ঞকে দেখে আমাদের মুখ দিয়ে কিছুক্ষণ কোনো কথা বেরোল না। তারপর মামাবাবু প্রায় চেঁচিয়ে উঠলেন, আপনি বেঁচে আছেন!
সর্বজ্ঞ বললেন, সশরীরে এবং সুস্থ দেহে। কিন্তু আপনাদের এ কী অবস্থা! সর্বজ্ঞ ইশারা করা মাত্র রেড-ইন্ডিয়ানরা আমাদের হাত-পায়ের বাঁধন খুলে দিল। মামাবাবু বললেন, আপনি এখানে কী করছেন? আপনি কি স্বেচ্ছায়–?
হ্যাঁ, আমি স্বেচ্ছায় এসেছি এখানে। বিশেষ কাজ। কিন্তু আমাকে প্রশ্ন করার আগে আমার কয়েকটা প্রশ্নের উত্তর আমি চাই।
বেশ, বলুন।
আমার এই ফোটো আপনাদের হাতে এল কী করে?
রূপা আমায় দিয়েছে।
ও, রূপা বুঝি আপনাকে আমার খোঁজ করতে বলেছে?
হ্যাঁ।
মেয়েটাকে ইঙ্গিত দেওয়াই আমার ভুল হয়ে গেছে। আচ্ছা প্রোফেসর ঘোষ, আমি যে এখানে আছি এ-সন্ধান আপনি পেলেন কীভাবে?
মামাবাবু, ভিক্টরের তোলা ফোটোয় সর্বজ্ঞর টুপি ও টাই-এর কথা, র্যাপসোদের মুখে এই পাহাড়ে সর্বজ্ঞর আগমনের খোঁজ পাওয়া ইত্যাদি সমস্ত বিবরণ অল্প কথায় জানালেন।
বৈজ্ঞানিক সর্বজ্ঞ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, এত আঁটঘাট বেঁধে কাজে নেমেও দেখছি কতগুলো খুঁত থেকে গেছে।
মামাবাবু বলে উঠলেন, ডক্টর সর্বজ্ঞ, একটা কথা। আমার ভাগনে সুনন্দকে এই ইন্ডিয়ানরা ধরে এনেছে, দয়া করে ওদের জিজ্ঞেস করুন সে কোথায়, কেমন আছে?
সেকি! সর্বজ্ঞ তৎক্ষণাৎ ইন্ডিয়ানদের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করলেন। একটু পরে ফিরে মামাবাবুকে বললেন, বেঁচে আছে আপনার ভাগনে। ভালোই আছে। যদিও বন্দী। আমি তাকে এক্ষুনি এখানে আনতে বলেছি।
কয়েকজন ইন্ডিয়ান দেখলাম চলে গেল পাহাড়ের পথে। আঃ! আমাদের মনের ওপর। থেকে কী ভীষণ যে ভার নেমে গেল!
মামাবাবু বললেন, ডক্টর সর্বজ্ঞ, আপনার এই অজ্ঞাতবাসের কারণ জানতে পারি কি?
সর্বজ্ঞ বললেন, সবই আমি বলব, কিন্তু এখন এখানে নয়। আপনাদের আমার সঙ্গে যেতে হবে একটা জায়গায়। কিন্তু আপনাদের প্রতিজ্ঞা করতে হবে আমি যতদিন না নিজে থেকে আত্মপ্রকাশ করি, ততদিন আমার এই অজ্ঞাতবাসের বা এখানে যা দেখবেন এবং যা শুনবেন তার কণামাত্র খবর কাউকে জানাতে পারবেন না। মনে রাখবেন তাতে আমার গবেষণার ক্ষতি হবে। এব্যাপারে আপনি সম্মত কিনা বলুন।
রাজি, মামাবাবু সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দেন, আপনি সুস্থ দেহে বর্তমান এইটুকু জেনেই আমি সন্তুষ্ট। আপনার সব খবর আমরা সম্পূর্ণ গোপন রাখব। মার্কো, আশা করি আমার কথায় আপনি সায় দেবেন?
আলবাৎ, বলল মার্কো। আমিও মামাবাবুকে সমর্থন জানালাম।
প্রায় ঘণ্টাখানেক অপেক্ষা করলাম। সর্বজ্ঞ মামাবাবুর কাছে কিছু পরিচিত বিজ্ঞানীর খবরাখবর নিতে লাগলেন। সহসা বনের ভিতর কাদের পায়ের শব্দ? উদগ্রীব হয়ে তাকিয়ে থাকি। পাথরের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল কয়েকজন ইন্ডিয়ান এবং তাদের মাঝে সুনন্দ।
আমি লাফ দিয়ে গিয়ে সুনন্দকে জড়িয়ে ধরলাম। মামাবাবু তার গায়ে হাত বুলিয়ে বললেন, অত্যাচার করেনি তো?
না। সুনন্দ উত্তর দেয়, তবে বড় জোরে বেঁধে রেখেছিল, হাতে-পায়ে কালশিরা পড়ে গেছে।
তোকে নিয়ে কী করত ওরা? আমি জানতে চাই।
সুনন্দ ক্ষীণ হেসে বলল, নির্ঘাত মৃত্যুদণ্ড দিত। তবে কী উপায়ে মারবে বোধহয় ঠিক করতে পারছিল না। মনে হচ্ছিল, তাই নিয়ে বেজায় তর্কাতর্কি চলছে।
মার্কো হ্যান্ডসেক করে বলল, “ব্রাদার সুনন্দ, আমাদের ফাঁকি দিয়ে একা বেড়াতে যাওয়া তোমার কিন্তু উচিত হয়নি। যাক, আপাতত এককাপ কফি খাবে নাকি?
“না না, শুধু কফি নয়, সুনন্দ কাতর স্বরে বলে ওঠে, কিছু খাবার দাও। কিচ্ছু খাইনি। কী একটা খেতে দিয়েছিল, খেতে পারিনি। বাপরে কী ঝাল!
সুনন্দর সঙ্গে বৈজ্ঞানিক সর্বজ্ঞর আলাপ করিয়ে দেওয়া হল। সুনন্দ অনেক ধন্যবাদ জানাল তাকে।
গরম কফি খেয়ে আমরা বৈজ্ঞানিক সর্বজ্ঞর সঙ্গে রওনা দিলাম।
পাহাড়ের অনেক চড়াই উৎরাই পেরিয়ে প্রায় ঘণ্টা তিন চলার পর দুই পাহাড়ের মানে এক সমতলভূমিতে পা দিয়ে আমরা থমকে দাঁড়ালাম।
আশ্চর্য দৃশ্য। ছোট মালভূমিতে এক প্রস্তরনগরীর ধ্বংসাবশেষ। প্রাসাদ, প্রাচীর, বেদি, সোপানশ্রেণি মিলিয়ে প্রাচীন নগরীর কঙ্কালকে ঢেকে ফেলেছে আগাছা, লতা, আর বড় বড় গাছ। মামাবাবু বললেন, এ যে আর এক মাচুপিচু। অদ্ভুত ব্যাপার!
বৈজ্ঞানিক সর্বজ্ঞ বললেন, ঠিক ধরেছেন। মাচুপিছু থেকে যারা পালিয়ে এসেছিল খুব সম্ভব তারাই এ নগর তৈরি করে। মাচুপিচুর শেষদিনের ইতিহাস মনে করুন। ইংকা রাজা টুপাক আমারু স্প্যানিয়ার্ডদের তাড়া খেয়ে মাচুপিচু ত্যাগ করে পালাল। কিন্তু কিছু দূর এসে সে ধরা পড়ল। ধরা পড়েছিল বলা উচিত নয়, সে আত্মসমর্পণ করেছিল। স্প্যানিয়ার্ডরা তাকে কুজকোয় নিয়ে গিয়ে হত্যা করল। কিন্তু রাজার সঙ্গীরা সবাই নিশ্চয় বিদেশিদের হাতে আত্মসমর্পণ করতে রাজি হয়নি। তারা কেউ কেউ দুর্ভেদ্য আমাজনের বনে পালিয়ে যায়। আমার বিশ্বাস তারাই এখানে এসে আশ্রয় নিয়েছিল। গড়ে তুলেছিল এই নগর। জানি না কতকাল তারা এখানে বাস করেছিল? কীভাবে তারা লুপ্ত হয়ে গেল?
হঠাৎ সর্বজ্ঞ সুর পাল্টালেন।–দেখুন প্রোফেসর ঘোষ, একটা ইংকা ধ্বংসাবশেষ নিয়ে রিসার্চ করতে আমি এখানে পড়ে নেই। আমার উদ্দেশ্য অন্য। চলুন পাহাড়ের ওপাশে। সর্বজ্ঞ আমাদের সঙ্গে নিয়ে চললেন।
–ওই দেখুন, ওগুলো ছিল প্রাচীন ইংকা চাযের ক্ষেত।
কিছু দূরে পাহাড়ের গায়ে অনেকগুলো চাতাল কাটা রয়েছে। সর্বজ্ঞ সেই দিকে হাত বাড়িয়ে দেখালেন। চাতালে নানারকম গাছ ও ঝোঁপ জন্মেছে। সর্বজ্ঞ বললেন, এই ক্ষেত ছাড়াও পাহাড়ের পাদদেশে জঙ্গল সাফ করে ইংকারা কিছু ক্ষেত বানিয়েছিল। বাগান। করেছিল। এখন অবশ্য সব জঙ্গলে ঢাকা পড়ে গেছে। আমি এদের সেইসব ক্ষেত এবং বাগান খোঁজ করে আট-দশ রকম সম্পূর্ণ নতুন ধরনের ফল-মূল-তরকারি পেয়েছি।
প্রথমবার এসেই আমি ইন্ডিয়ানদের নানারকম নতুন ফল-মূল খেতে দেখি। তাদের প্রশ্ন করে আবিষ্কার করি এই ইংকা ক্ষেত এবং বাগানের সন্ধান। জানেন তো ইংকা জাতি ছিল আশ্চর্য প্রতিভাধর কৃষিবিজ্ঞানী। আধুনিককালে আমাদের প্রিয় অনেক ফল-মূল-শস্যই তাদের আবিষ্কারের দান। পেরুর পাহাড়-জঙ্গল থেকে খুঁজে এনে কত যে ফল-মূল-শস্য আর গাছপালাকে তারা মানুষের খাদ্য বা অন্য ব্যবহারে লাগিয়েছিল!
–কী কী? আমি কৌতূহল চাপতে পারি না। ব্যাপারটা খানিক জানলেও ভালো করে জানতাম না আমি।
সুনন্দ ভুরু কুঁচকিয়ে কড়া চোখে তাকায় আমার দিকে। ভাবখানা যেন, এই অতি সামান্য জ্ঞানটুকু নেই তোর! অযথা সময় নষ্ট করছিস।
বৈজ্ঞানিক সর্বজ্ঞ কিন্তু বিরক্ত হন না। হেসে বলেন, শুধু আপনি নন, অনেকেই ব্যাপারটা তেমন বিশদে জানে না। সব কটার নাম মনে পড়ছে না এখন। কয়েক কয়েকটা বলছি। এই যেমন– আল, টমেটো, ভুট্টা, আনারস, পেয়ারা, তামাক, সিঙ্কোনা, রবার, কাকাও মানে যার থেকে কোকো অর্থাৎ চকোলেট হয়…
মামাবার থামিয়ে দেন সর্বজ্ঞকে। বলেন, মনে হচ্ছে এখানেও ইংকারা তেমন নতুন কিছু আবিষ্কার করেছিল?
হ্যাঁ তাই, জানান সর্বজ্ঞ, পলাতক ইংকারা এই সুদূরে একরকম বন্দী জীবনযাপন করত। গবেষণার নেশায় তখন তারা আমাজনের বন থেকে নানারকম নতুন ফলমূল উদ্ভিদ সংগ্রহ করে সেগুলি মানুষের ব্যবহারের উপযোগী করেছিল।
এখানকার ইন্ডিয়ানরা বঝি ইংকাদের আবিষ্কার করা ফল-মূল খায়? আমি প্রশ্ন কার।
হ্যাঁ খায়, তবে সব নয়। কয়েকটা মাত্র। সেগুলো তারা চাষও করে। বাকি আবিষ্কারগুলি প্রায় জংলি হয়ে গেছে। তবে ইন্ডিয়ানরা জানে কোন্ কোন্টা খাওয়া যায়। আমি এদের সাহায্যে সেইসব গাছপালা উদ্ধার করেছি। তাদের চারা তৈরি করেছি। আশা। করছি আগামী কয়েক বছরের মধ্যে পৃথিবীর লোক অনেক নতুন ফল-মূলের স্বাদ গ্রহণ করতে পারবে। তবে আমার সবচেয়ে মূল্যবান আবিষ্কার হবে কতকগুলি ভেষজ উদ্ভিদ। পাহাড়ি ইন্ডিয়ানরা ইংকাদের কাছে চিকিৎসার জন্য অনেক গাছ-গাছড়ার ব্যবহার শিখেছে, আর তাদের কাছ থেকে জেনেছি আমি। সেইসব উদ্ভিদ থেকে অনেক দুরারোগ্য রোগের ওষুধ তৈরি হবে ভবিষ্যতে।…এই হল আমার গবেষণা এবং এই জন্যই আমার অজ্ঞাতবাস।
এর জন্য অজ্ঞাতবাসের কী প্রয়োজন? মার্কো একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে।
কারণ জানিয়ে শুনিয়ে এখানে বেশিদিন থাকলে লোকে সন্দেহ করত। খবরটা রটে যেত। তখন দলে দলে বৈজ্ঞানিক এসে হাজির হত। এবং আমার আবিষ্কারে তারা ভাগ বসাত। এটা আমার পছন্দ নয়। এ-জায়গা আমি তন্ন তন্ন করে খুঁজব, তারপর আমার আবিষ্কার সমেত আত্মপ্রকাশ করব। বৈজ্ঞানিক গর্বিত ভঙ্গিতে তাকালেন।
দুর্ঘটনার ব্যাপারটা তাহলে সাজানো? সুনন্দ জিজ্ঞেস করল।
“নিশ্চয়। প্রথমবার এখানে এসে দেখে শুনে ম্যালডোনাডায় ফিরে গেলাম। তারপর প্ল্যান করে আবার অভিযানে বের হলাম। পথে উধাও হলাম লোককে ধোঁকা দিয়ে। কিন্তু তাতেই বা সফল হলাম কই? এই তো ধরা পড়ে গেছি। বৈজ্ঞানিক সর্বজ্ঞ নিজের ওপর রাগ করে ভুরু কোঁচকালেন।
ফেরার পথে সর্বজ্ঞ দেখালেন, এই গাছ চেনেন? কোকা। যার পাতা থেকে কোকেন হয়। ইংকারা এনার্জি বাড়াতে এর পাতা চিবুত। এখানে ইন্ডিয়ানদেরও দেখছি সেই অভ্যেস।
আর একরকম গাছ দেখালেন সর্বজ্ঞ।–এই নগরের নির্মাতারা যে মাচুপিচু থেকে এসেছিল তার প্রমাণ এই হুলিকা গাছ। জানেন নিশ্চয় মাচুপিচুর আসল নাম ভিলকাপাম্পা। ভিলকাঁপা শব্দের অর্থ যেখানে হুলিকা গাছ জন্মায়। হুলিকা ফলের বীচি গুঁড়ো কত ইংকারা নস্যি নিত এবং তার ফলে নেশা হত। আফিং খেলে যেমন হয়। মাচুপিচু পাহাড়ে এই গাছ আছে। নিশ্চয় ইংকারা এই গাছ সঙ্গে এনেছিল। কারণ আমাজনের জঙ্গলে আর কোথাও হুলিকা গাছ নেই।
পাহাড়ের গায়ে বৈজ্ঞানিক সর্বজ্ঞর ছোট কাঠের বাংলো। সামনে টুকরো টুকরো বাগান করা হয়েছে। একজন দেশি অনুচর থাকে তার সঙ্গে। এই লোকটিই সর্বজ্ঞর সঙ্গে এসেছিল।
সর্বজ্ঞ জানালেন, একরকম শাক পেয়েছি। মোটা উঁটা। খেতে খুব মিষ্টি। প্রচুর কার্বোহাইড্রেড আছে। নিংড়ে অনেক চিনি পাওয়া যায়। এই শাক আখের চেয়ে সহজে জন্মায়, তাড়াতাড়ি বাড়ে।
এমনি আরও ইংকাদের আবিষ্কৃত কিছু উদ্ভিদের বর্ণনা দিলেন তিনি। তার ল্যাবরেটরি দেখালেন। দেখলাম ভদ্রলোক অনেক যন্ত্রপাতি সঙ্গে নিয়ে এসেছেন।
দুপুরবেলা মার্কো ইংকা ধ্বংসাবশেষের ছবি তুলতে চলল। আমি, সুনন্দ আর মামাবাবুও সঙ্গে গেলাম। সর্বজ্ঞ কী একটা কাজ করছিলেন। বললেন, “আপনারা যান, আমি পরে আসছি। সাবধানে চলাফেরা করবেন, খুব সাপ আছে ওখানে।
ঘুরে ঘুরে দেখছি সেই মৃত নগরী, হঠাৎ পাহাড়ের গা বেয়ে একজনকে নেমে আসতে দেখে আমরা স্তম্ভিত হয়ে গেলাম।
–আগন্তুক, ডাক্তার জর্জ কেন্ট।
কেন্ট হাঁক দিলেন, হ্যালো প্রোফেসর? তিনি হাসিমুখে এগিয়ে এসে আমাদের সঙ্গে হ্যান্ডসেক করতে করতে বললেন।–উঃ কী যে দুশ্চিন্তা হচ্ছিল। পথে যদি বিপদে পড়েন!
মার্কো বলল, ডাক্তার, আপনি বুঝি আমাদের ফলো করেছেন?
বাধ্য হয়ে। কারণ আপনারা চলে যাবার পর ভেবে ঠিক করলাম, আপনারা নিশ্চয় স্যায়ান্টিস্ট সর্বজ্ঞর খোঁজে বেরিয়েছেন। তাই আপনাদের পিছনে পিছনে রওনা দিলাম। কিন্তু একটা উপজাতি গ্রামে কদিন আটকে পড়ে গেলাম। সেখানে ইয়োলো ফিভার লেগেছে। লোক মরছে। বেচারাদের ছেড়ে আসি কী করে? নইলে আগেই আপনাদের ধরে ফেলতাম। যাক এখন নিশ্চিন্ত।
বঝলাম কেন্ট যখন এখানে এসে পড়েছেন, তখন তার দৃষ্টি থেকে সর্বজ্ঞকে আর লুকানো যাবে না। হয়তো ইতিমধ্যেই ইন্ডিয়ানদের কাছ থেকে সর্বজ্ঞর হদিসও জেনে ফেলেছেন।
আমি দু-পা এগিয়ে গেলাম। ম্যালডোনাডায় কেন্ট আমাকে যে অপমান করেছিলেন তার জ্বালা আমি ভুলিনি। ভারি মোলায়েম কণ্ঠে বিদ্রূপ মিশিয়ে বললাম, জানেন ডক্টর কেন্ট, আমরা বৈজ্ঞানিক সর্বজ্ঞকে আবিষ্কার করে ফেলেছি, একবারে সশরীরে এবং সুস্থ দেহে।
কেন্ট কেমন থমকে গেলেন। বললেন, “ওঃ, তাই নাকি! ভেরি গুড, ভেরি গুড়।
সুনন্দ ফট করে বলল, বড় হতাশ হলেন তাই না ডাক্তার?
ডাক্তার কেন্ট ভারি অবাক মুখ করে বললেন, হতাশ? আমি? কেন?
কারণ আপনি খুব আশায় ছিলেন সর্বজ্ঞ আর ফিরবেন না। ভেবেছিলেন দুর্ঘটনায় নদীতে ডুবে নির্ঘাত অক্কা পেয়েছেন। আহা, ব্যাপারটা সত্যি হলে আপনার কত সুবিধে হত।
হাঃ হাঃ হাঃ…। একটা প্রচণ্ড হাসির গমকে আমরা চমকে পিছনে ফিরলাম। হাসছেন বৈজ্ঞানিক সর্বজ্ঞ। কখন তিনি আমাদের পিছনে এসে দাঁড়িয়েছেন টের পাইনি। আমরা থতমত খেয়ে চেয়ে থাকি। এই অট্টহাসির কারণ ধরতে পারি না। কোনো রকমে হাসি থামিয়ে সর্বজ্ঞ বললেন, “আরে, আপনারা মস্ত ভুল করেছেন। ডাক্তার আমার সব খবর জানে। ওর সঙ্গে প্ল্যান করেই তো এখানে এসেছি। আর ওই তো আমাকে এই পাহাড়ে নিয়ে আসে।
অ্যাঁ! আমরা অপ্রস্তুত হয়ে মাথা চুলকাই।
সর্বজ্ঞ বলে চলেন, কেন্টের সঙ্গে এই পাহাড়ি ইন্ডিয়ানদের ভাব হয়। হিথ নদীর তারে সাপের কামড়ে মৃতপ্রায় এই উপজাতির একজনকে চিকিৎসা করে কেন্ট বাঁচিয়ে তোলে। তারপর এদের গ্রামে আসত মাঝে মাঝে। ডাক্তারকে এরা খুব শ্রদ্ধা করে। আমার সঙ্গে ওর হঠাৎ দেখা হয় হিথ নদীতে। আমাদের আগে থেকেই বন্ধুত্ব ছিল। তখন ডাক্তার ফিরছিল এই পাহাড় থেকে। সেইবারেই সে আবিষ্কার করেছে এই ইংকা নগর। খুব উত্তেজিত। আমায় বলল সব। আমি তক্ষুনি ডাক্তারকে নিয়ে পাহাড়ে এলাম ধ্বংসাবশেষ দেখতে। ডাক্তার না থাকলে অবশ্য আমি এই পাহাড়ে ঢুকতেই পারতাম না।
কেন? আমি জানতে চাই।
কারণ এই ইন্ডিয়ানরা বিদেশিদের এখানে আসতে দিতে চায় না। কিছু স্প্যানিয়ার্ড নাকি একবার অযথা গুলি চালিয়ে ওদের অনেক লোককে মেরে ফেলে। বিদেশিদের ওপর তাই এদের ভীষণ রাগ। অবশ্য যাদের বন্ধু বলে মনে করে তাদের কথা আলাদা।
এই ইন্ডিয়ানরা কারা? এদের সঙ্গে কি ইংকাদের কোনো সম্পর্ক ছিল? এতক্ষণে মামাবাবু কথা বললেন।
বোধহয় ছিল। বললেন সর্বজ্ঞ। মনে হয় এই উপজাতি ছিল সুসভ্য ইংকাদের অনুগত রক্ষী। ইংকাদের সঙ্গে এদের মেলামেশাও হয়েছিল কারণ এদের মধ্যে অনেক প্রাচীন ইংকা আচার-ব্যবহার আমি লক্ষ করেছি। জানেন, এরা প্রতিদিন ভোরে প্রাচীন ইংকাদের মতো সূর্য দেবতার বন্দনা করে–ও ভিরাকোচা (সূর্যদেব), ও পাচাকামাক (আলোর দেবতা)।
মামাবাবু ডাক্তার কেন্টের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে, তার হাত ধরে বিনীত স্বরে বললেন। “ডক্টর আপনার কাছে আমি মাফ চাইছি। আপনাকে আমরা অন্যায়ভাবে সন্দেহ করেছিলাম।
“কেন? কীজন্যে সন্দেহ? ডাক্তার রীতিমতো অবাক হয়ে বলেন।
মামাবাবু এবার সর্বজ্ঞকে উদ্দেশ্য করে বললেন, আমরা প্রথমে ভেবেছিলাম আw নিখোঁজ হওয়ার জন্য ডাক্তারই দায়ী। আপনাকে উনি কোনো কায়দায় পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিয়েছেন। পরে এখানে এসে ভাবলাম ডাক্তার হত্যাকারী নয়, কিন্তু আর পাঁচজনের মতো বিশ্বাস করেছেন আপনি দুর্ঘটনায় মারা পড়েছেন।
কিন্তু সায়ান্টিস্ট মারা গেলে আমার লাভ? কারণটা দয়া করে বলবেন কি? কেন্ট অধৈর্যভাবে বলে ওঠেন।
লাভ সেই মহামূল্যবান ব্লু-অর্কিড। আমরা সন্দেহ করেছিলাম সর্বজ্ঞর অবর্তমানে তার আবিষ্কার ব্লু-অর্কিড আপনি অধিকার করতে চান।
কেন্ট আঁতকে উঠলেন, মাই গড, ব্লু-অর্কিডটা আপনার চোখে পড়েছে? ঠিক এই ভয়েই আমি ওটা লুকিয়ে রেখেছিলাম। পাছে লোকে আমায় সন্দেহ করে?
ব্লু-অর্কিড সম্বন্ধে আপনি জানলেন কী করে? সর্বজ্ঞ মামাবাবুকে প্রশ্ন করলেন।
রূপার চিঠি পড়ে। মামাবাবু জবাব দিলেন।
ওঃ, মনে পড়েছে। বড় কাঁচা কাজ করেছি আমি। মেয়েটা অর্কিড ভালোবাসে, তাই ভাবলাম খুশি হবে। তা ডক্টর, আপনার অত লুকোচুরির দরকার কী ছিল?
কেন্ট বললেন, কারণ আমি চাইছিলাম, আপনি আত্মপ্রকাশ করার পর লোকে এই অর্কিড আবিষ্কারের খবর জানুক। নইলে আপনার এত বড় আবিষ্কার আমার হেফাজতে রেখে আপনি নিখোঁজ হয়েছেন জানলে লোকে স্বাভাবিকভাবে আমায় সন্দেহ করত, আমাকে জেরা করত। ফলে আমি বাধ্য হতাম আপনার অজ্ঞাতবাসের কাহিনি বলে দিতে।
তা বেশ, ওটা আপনার আবিষ্কার বলে দিলেই তো ল্যাঠা চুকে যেত। আমি তো বারবার বলেছি ও ফুলের প্রকৃত আবিষ্কারক হওয়া উচিত আপনি, আমি নয়।
ডাক্তার বললেন, “তা হয় না। কেন হয় না?ওই অর্কিড পাওয়া গেছে এই পাহাড়ে। এ-পাহাড়ে আপনি আমায় নিয়ে এলেন। দৈবাৎ আমার চোখে পড়ে গেল ফুলটা। নইলে ও-ফুল আপনি পরে ঠিক আবিষ্কার করতেন। আপনি নিয়ে না এলে এখানে আমার আসার কোনো সম্ভাবনা ছিল না। সুতরাং এ-ফুলের প্রকৃত আবিষ্কারক ডক্টর জর্জ কেন্ট।
ডাক্তার দৃঢ়ভাবে মাথা নাড়লেন।–না-না।
সর্বজ্ঞ খিঁচিয়ে উঠলেন, জানেন ঘোষ, এই ডাক্তারের সব ভালো। শুধু বড় এঁড়ে তর্কের বাতিক। সোজা যুক্তি মাথায় ঢোকে না। ঠিক আছে, প্রোফেসর ঘোষ আপনি পণ্ডিত ব্যক্তি। তৃতীয় পক্ষ। আপনি স্থির করে দিন এই ব্লু-অর্কিডের আবিষ্কারকর্তা কে হবে? আমরা তা মেনে নেব।
মামাবাবু সর্বজ্ঞকে বললেন, আপনি এই ফুল প্রথম পেয়েছিলেন?
হ্যাঁ। দৈবাৎ।
তারপর কী করলেন?
কয়েকবার গন্ধ শুঁকে ফুলটা আমার জামার পকেটে রেখেছিলাম। ভেবেছিলাম ডাক্তারকে উপহার দেব। ও অর্কিড ভালোবাসে।
তারপর?
ডাক্তার তো ফুলটা দেখেই উত্তেজনায় লাফিয়ে উঠল। এ-ফুল যে এত মূল্যবান এবং নতুন ধরনের তা আমি ধারণাও করিনি। ডাক্তারের সঙ্গে অনেক খুঁজে ফের বের করলাম। ওই অর্কিডের গাছ।
মামাবাবু বললেন, যদি ডাক্তার না থাকত তাহলে ওই ফুল নিয়ে কী করতেন?
নির্ঘাত ফেলে দিতাম। শৌখিন ফুল বা অর্কিড নিয়ে আমি কোনোকালে মাথা ঘামাই । তাছাড়া আমার মাথায় তখন ঘুরছে অন্য এক বিরাট আবিষ্কারের চিন্তা।
মামাবাবু বললেন, “আমার মতে এই নীল অর্কিডের আবিষ্কারক হবেন আপনারা দুজনে একসঙ্গে। জয়েন্ট ডিসকভারার।
সর্বজ্ঞ ভুরু কুঁচকে বললেন, বেশ, ডাক্তারের সঙ্গে যদি আমার নামটা জুড়ে দিতে চান, তাই হোক। হ্যাঁ, ডাক্তার রাজি তো? এ-শর্তে ও রাজি না হলে আমি কিন্তু সত্যি চটে যাব।
ডাক্তারের মুখ লাল। আবেগরুদ্ধ স্বরে বললেন, উত্তম। আপনাদের বিচার আমি মেনে নিলাম। এত বড় আবিষ্কারের ভাগ দিলেন বলে আমি কৃতজ্ঞ। ধন্যবাদ।
সর্বজ্ঞ তেডে উঠলেন, “বিনয় দেখানো হচ্ছে? বটে! আমার আবিষ্কারে যখন সবাই থ মেরে যাবে, তখন সারা জগৎকে জানিয়ে আমিও ধন্যবাদ দেব ডাক্তার কেন্টকে। মনে থাকে যেন।
মার্কো বলে উঠল, ঝগড়া নয়। ওং শান্তি! শান্তি! দুজনে এবার হাত মেলান।
ডাক্তার ও সর্বজ্ঞ পরস্পরের হাত চেপে ধরলেন। অমনি ক্যামেরার ক্লিক।
সর্বজ্ঞ রেগে বললেন, ছবি তুললেন যে?
মার্কো বলল, ভয় নেই। এ-ফোটো ছাপা হবে আপনার আত্মপ্রকাশের পর।
সর্বজ্ঞ মামাবাবুকে বললেন, রূপাকে বলবেন, তার বাবা তোফা আছে। বছরখানেক পরে ফিরবে। তবে এ-খবর যেন সে গোপন রাখে। ব্যস। কোথায় আছি, কী করছি বলার দরকার নেই।
গল্পের ফাঁকে ডাক্তার সুনন্দকে বললেন, শুনলাম তোমরা দুই ইয়াংম্যান নাকি ভারি ওস্তাদ। র্যাপসো বলছিল। ওদের আচ্ছা জব্দ করেছ।
সুনন্দ বলল, সেই দুই বিদ্রোহী সৈনিক? আপনার সঙ্গে ওদের দেখা হয়েছে বুঝি?
হ্যাঁ, ওদের আস্তানায় গিয়ে আমিই দেখা করেছি। একটা জরুরি খবর জানাতে।
কী খবর?
বললাম যে জেনারেল ফ্রাঙ্কো এবং তার বিদ্রোহী সৈন্যদের বলিভিয়া সরকার ক্ষমা করেছে। শুনে ওরা খুশি হয়ে দেশে রওনা দিল।
দুদিন বিশ্রাম নিলাম। সঙ্গে ডাক্তার রয়েছে, সুতরাং ফেরার ব্যাপারে আমরা নির্ভাবনা। ডাক্তারের দুই অনুচর নৌকো নিয়ে অপেক্ষা করছে নদীতে। তারা আমাদের নৌকো মেরামত করে দেবে।
হিথ নদীর সঙ্গমের কাছে পৌঁছেছি। দেখি একটা ক্যানুর ওপর দাঁড়িয়ে একজন আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। সেই রহস্যময় পেড্রো লোপেজ।
আমি বললাম, ডাক্তার কেন্ট, এই লোকটি আমাদের অনুসরণ করছিল।
বুঝেছি। ডাক্তার মাথা নাড়েন। তারপর চেঁচিয়ে ডাকেন, ওহে পেড্রো, কেমন আছ? নাঃ, তুমি আবার ভুল করেছ। এরা গুপ্তধনের খোঁজে যায়নি। পাহাড়ি ইন্ডিয়ান গ্রামে ফোটো তুলতে গিয়েছিল। খুব বিপদে পড়েছিল। তুমি যেও না ওদিকে।
পেড্রো আমতা আমতা করে বলল, তবে যে ওরা বলল?
কী বলল? কারা?
লঞ্চের খালাসিরা। এরা নাকি একটা প্রাচীন নগর আবিষ্কার করতে যাচ্ছে। একটা ম্যাপ পেয়েছে।
ঠাট্টা করেছে। বুঝতে পারোনি। বললেন ডাক্তার।
অ্যাঁ? ঠাট্টা! আমার সঙ্গে? দাঁড়াও, হতচ্ছাড়া শয়তানগুলোকে দেখাচ্ছি মজা। পেড়ো ঘুঁষি পাকাল। তারপর ধপ্ করে নৌকোর মধ্যে বসে পড়ল।
আমরা জিজ্ঞাসা করলাম, কী ব্যাপার ডক্টর?
ডাক্তার হেসে বললেন, সে এক বিচিত্র কাহিনি। প্রায় দেড়শো বছর আগে পেড্রোর এক পূর্বপুরুষ এই অঞ্চলের জঙ্গলে পাহাড়ের ওপর নাকি এক নগর আবিষ্কার করে। সেখানে ইংকাদের বাস। তাদের অঢেল সোনাদানা। পেড্রোর পূর্বপুরুষ লুকিয়ে দেখেছিল তাদের। কিন্তু সোনা আনতে পারেনি। জংলি ইন্ডিয়ানদের তাড়া খেয়ে কোনোরকমে পালিয়ে বাঁচে। কাউকে বলেনি সে-খবর। শুধু তার ডাইরিতে লিখে রেখেছিল সব কথা। তার কিছু পরে সেই পূর্বপুরুষ এক দুর্ঘটনায় মারা যায়। এতকাল পরে তার ডাইরি পেয়েছে পেড্রো। ডাইরির পাতা ছেঁড়া, লেখা ধেবড়ে গেছে। তাতে ইংকা নগরীর কোনো ঠিকানা পাওয়া যায়নি। তবু পেড্রো ক্ষেপে উঠেছে। সে আবিষ্কার করবে সেই নগর এবং ইংকাদের ধনরত্ন। পেরুর মন্টানা প্রদেশের কত পাহাড়-জঙ্গল যে সে চষে বেড়িয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। লোকে ওকে খ্যাপায়, তাতে ওর আরও জেদ বাড়ে।
একটুক্ষণ চুপ করে থেকে ডাক্তার বললেন, এবার কিন্তু পেড্রো ঠিক লোককেই ফলো করেছিল। অবশ্য জানি না, ওই পাহাড়ে খুঁজলে ইংকাদের ট্রেজার সত্যি পাওয়া যাবে কিনা?
ম্যালডোনাডোয় ডাক্তারের বাড়িতে তিনদিন থাকলাম। তারপর গেলাম কুজকো।
কুজকোয় বিদায় নিল মার্কো। এয়ারপোর্টে সে হাত নেড়ে চিৎকার করে বলল–আদিওস (বিদায়) প্রোফেসর। আদিওস অসিট। আদিওস সুনন্দ। সামনের বছর ইন্ডিয়ায় যাচ্ছি, তখন দেখা হবে।
ঠিক তের মাস পরে একদিন সংবাদপত্রের পাতায় চোখ আটকে গেল। দেখলাম বড় বড় হরফে ছাপা–নিখোঁজ বৈজ্ঞানিক সত্যনাথ সর্বজ্ঞর বিস্ময়কর প্রত্যাবর্তন।