» » আমাজনের গহনে

বর্ণাকার

অজেয় রায়

আমাজনের গহনে

চার

নিবিড় অরণ্যময় আদিম প্রাকৃতিক পরিবেশের মধ্যে দিয়ে চলেছি আমরা। গত তিন দিনে একটিমাত্র অন্য নৌকোর দেখা পেয়েছি। দুজন স্পেনীয় ব্যবসায়ী উপজাতিদের গ্রাম থেকে রবার সংগ্রহ করে ফিরছিল।

হিথ নদী চওড়া নয়, কিন্তু খরস্রোতা। দুধারে ঘন উদ্ভিদের রাজ্য। এ-বনের মজা হচ্ছে পাখি বা কীটপতঙ্গ ছাড়া বড় জীবজন্তুর দেখা সহজে পাওয়া যায় না। তবে কান পাতলে নানারকম ডাক শোনা যায়। আমাদের মাঝিদের তীক্ষ্ণ চোখ অবশ্য গাছের পাতার আড়ালে অনেক অদৃশ্য জীবের অস্তিত্ব আবিষ্কার করে। আর যেটা সকলেই দেখতে পায় সেটা হল বাঁদরের দাপাদাপি।

পাখি আর প্রজাপতি কত রকমের! সন্ধ্যার মুখে ঝাঁকে ঝাকে ওড়ে হলদে-সবুজ টিয়াপাখিরা। কর্কশ কলরবে নদীতট মুখর করে তোলে। দক্ষিণ আমেরিকার বড় জাতের টিয়া, যাদের বলে ম্যাকাও, সেগুলির পালকের রঙ দেখবার মতো। সবুজ, হলদে, লাল ও নীল মেশানো বিচিত্র বর্ণ। ঝড়ের মতো উড়ে যায় জোড়ায় জোড়ায়।

জলের মধ্যে ছোঁ মারে মাছরাঙা। বেনেবউয়ের মিষ্টি ডাক শোনা যায়। জলের ধারে লম্বা পা ফেলে পায়চারি করে সারস। কখনও দেখি ধ্যানমগ্ন বক। টুকটুকে লাল আইবিস সবুজের ভিতর চমৎকার দেখায়।

ধীরে ধীরে এগোই! কখনও নৌকো থামিয়ে তীরে উঠে বনে ঢুকি। মার্কো ছবি তোলে। পশু-পাখির। খোঁজে উপজাতি বসতি। মামাবাবু খোঁজেন নতুন প্রাণীর স্পেসিমেন। নদীতীরে যাও-বা কিছু পশুপাখি চোখে পড়ে, বনে ঢুকলে সব মিলিয়ে যায়, মিশে যায় গাছপাতার আবরণে।

এ-বনে পায়ে হেঁটে ঘোরা বড় কঠিন কাজ। বিশাল বিশাল মহীরুহের তলায় দিনের বেলাতেও সন্ধ্যার অন্ধকার। গাছের গুঁড়িকে পাক খেয়ে খেয়ে ওপরে উঠে গেছে মোটা মোটা লতা সূর্যালোকের সন্ধানে। মাথার অনেক ওপরে ডাল-পাতার ঘন আচ্ছাদন। কদাচিৎ একফালি রোদ এসে তিরের মতো মাটিতে পড়ে। বড় গাছের তলায় ঝোঁপঝাড়। কাটাগাছে গা ছড়ে যায়।

গাছপালা বেশিরভাগ অচেনা। মার্কো চিনিয়ে দেয়। কটন-উড, ব্রেজিল-নাট, নানা জাতীয় পাম। কোথাও দেখি জংলা পেঁপে আর কলা বন। একদিন মার্কো বলল, কাছেই নিশ্চয় রবার গাছ আছে। ওই শোন সেরিংগারো পাখির ডাক। ওই পাখি রবার গাছের গায়ে পোকা খায়।

প্যাচপ্যাচে কাদা জমিতে পুরু পাতার আস্তরণ। আমাদের বুট বসে যায়। মার্কো সাবধান করে দিল, দেখে শুনে পা ফেল। গর্তের মধ্যে পাতা জমে দিব্যি মরণফাঁদ হয়ে থাকে। ভুল করে ডুবে যাবে।

সবুজ, সবুজ আর সবুজ! রঙিন ফুল বনের ভিতর খুব কম। শুধু কখনও দেখিস গাছ উঁচু কোনো গাছের ডালে দুলছে। লম্বা উঁটির মাথায় গুচ্ছ গুচ্ছ নানা রঙের ফুল। চোখ-কান সজাগ রেখে এগোই।

একদিন বনের মধ্যে দিয়ে চলেছি, হঠাৎ আমার মাথায়, মুখে মাকড়সার জাল জড়িয়ে গেল। ছাড়াতে পারি না। মনে হচ্ছে যেন একটা মাছধরার জাল। স্থির হয়ে দাঁড়াও অসিট। মার্কোর কণ্ঠস্বর। তারপরই লাঠির আওয়াজ পাই–সপাং! চোখ পরিষ্কার করে দেখলাম মাটিতে মস্ত এক কোঁকড়ানো মাকড়সা। মার্কো বলল, আপাজাইকা স্পাইডার। ভাষণ বিষাক্ত এর কামড়।

প্রত্যেকের হাতে লাঠি থাকে। বিষাক্ত সাপের ভয়।–জারারাকা, বুস মাস্টার, ব্যাটল সাপ।

একটা জলাভূমিতে ফোটো তুলতে গিয়েছিলাম মার্কোর সঙ্গে। জলাতে প্রচুর এলিগেটর-কুমির ছিল। বেশ বড় কিন্তু অগভীর জলা। কুয়ারানা গাছ জন্মেছে জলার ভিতর। কুয়ারানা অনেকটা বাংলাদেশের সুঁদরী গাছের মতো। ছবি কিন্তু বেশিক্ষণ তোলা গেল না। কারণ প্রাণ বাঁচাতে দৌড় দিতে হল। না, কুমিরের তাড়া নয়, জোঁক। অসংখ্য জোঁক লাফাতে লাফাতে এল তেড়ে। আঙুলের মতো মোটা আর বিঘৎ খানেক লম্বা জোঁকগুলো। বাপরে, ওদের খপ্পড়ে পড়লে আর রক্ষা ছিল না।

নদীপথে ছোট ছোট জলপ্রপাত পড়ে প্রায়ই। দুরন্ত গতিতে জল ছুটেছে প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড পাথরের চাইয়ের পাশ দিয়ে। লাফ দিয়ে পড়ছে কয়েক হাত নিচের পাথরের ওপর। মাঝিরা কী নিপুণ কৌশলে পাথর কাটিয়ে নৌকো নিয়ে যায়! কখনও জলে নেমে হাতে নৌকো টেনে পার করে জলপ্রপাতের বাধা। আমি ও সুনন্দ সুযোগ পেলেই নৌকো চালানো অভ্যেস করি। মার্কো অবশ্য এ-বিদ্যেতে ওস্তাদ।

রাতে বেশির ভাগসময় শুই তীরে গাছের ডালে হ্যামক বা দড়ির দোলনা-বিছানা টাঙিয়ে। কখনও শুই নৌকোয় বা তীরে তাঁবু খাঁটিয়ে। ভোরবেলা প্রায়ই বাঁদরের উৎপাতে মেজাজ বিগড়ে যায়। চকচকে লাল-রঙা মাইসিটি জাতের বাঁদরের গর্জনে কঁচা ঘুম যায়। ভেঙে। উঃ, কী বিকট চিৎকার! মনে হয় একদল উন্মাদ রণহুঙ্কার দিচ্ছে। আসলে কিন্তু মাত্র একটি বা দুটি পুরুষ-বাঁদরের গলা। কালো রঙের মেরিমোলে নামে বাঁদরগুলোও কম শয়তান নয়। হ্যামকের দড়ি ধরে এমন ঝাঁকায় যে ভয় হয় বুঝি ছিটকে পড়ব মাটিতে। ইচ্ছে হতো দিই বেটাদের গুলি মেরে খতম করে।

হ্যামকে শুয়ে মাথার ওপর দেখি গাছের ফাঁকে ফাঁকে ঝকঝকে নক্ষত্রখচিত টুকরো টুকরো আকাশপট। শুনি কানে তালা-ধরানো ঝিঁঝির ডাক। ব্যাঙের কর্কশ গম্ভীর গলার গান। ঝক ঝক জোনাকির আলোয় একটি একটি গাছ কেমন ভুতুড়ে লাগে। অবাক হয়ে ভাবি, এ কোথায় আমি? যে উদ্দেশ্য নিয়ে আমরা অভিযানে বেরিয়েছি তা সফল হবে। তো? ডক্টর সর্বজ্ঞকে খুঁজে পাব কি আমরা? তিনি কি বেঁচে আছেন, না সত্যিই তার সলিলসমাধি হয়েছে?

চারদিনের দিন মার্কো জানাল যে এক উপজাতি গ্রাম আছে সামনে তীরের কাছে বনের মধ্যে। আমরা গিয়ে দেখি একটু ফাঁকা জায়গায় তিন-চারটে বড় বড় কুটির। চারজন অচেনা বিদেশির আবির্ভাব প্রথমে কিছু আদিবাসী স্ত্রীলোক এবং ছোট ছেলেমেয়েদের নজরে পড়ল। অমনি দুড়দাড় করে সবাই দিল ছুট। সঙ্গে ছুটল তাদের পোষা কুকরগুলো। মানষে পশুতে পায়ে পায়ে জড়িয়ে কেউ পড়ল গড়িয়ে। চেঁচামেচি করতে করতে লাফ দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এল কয়েকজন পুরুষ। তাদের হাতে তির, ধনুক, বর্শা।

মার্কো চিৎকার করে দেশি ভাষায় বলতে লাগল–আমরা বন্ধু, আমরা বন্ধু। তখন গ্রামবাসীরা ধীরে ধীরে কাছে এগিয়ে এল। ওরা আমাদের সর্বাঙ্গ চাপড়ালো। আমরাও তাই করলাম। দেখতে দেখতে তাদের সন্দেহ কেটে গেল, আমাদের তারা বন্ধু বলে মেনে নিন

রেড-ইন্ডিয়ানদের চেহারা অনেকটা আমাদের দেশের নাগাদের মতো। খালি গায়ে নানা রঙের নকশা। মজার ব্যাপার লক্ষ করলাম, মেয়েদের চেয়ে পুরুষদের সাজসজ্জার বহর কিঞ্চিৎ বেশি। ছেলে বা মেয়েদের পরনে গাছের ছাল বা সুতির পোশাক। আধুনিক প্যান্ট বা পেটিকোটও পরেছে কেউ কেউ।

এই উপজাতিরা চাষ করে, মাছ ধরে। আমাদের উপহার দিল–কলা, ভুট্টা, ম্যানডিওকা। ম্যানডিওকা রাঙালুর মতো উদ্ভিদমূল। তার আটা বানিয়ে রুটি করে খায় এখানকার আদিবাসীরা। আমরা পরিবর্তে দিলাম পুঁতির মালা, লোহার বঁড়শি, রঙিন কাপড়।

মার্কো ওদের পিয়ানো একর্ডিয়ান বাজিয়ে শোনাল। ওরা তো মুগ্ধ। কেবল বলে, আরও বাজাও। শব্দ বের হলেই সবাই হেসে কুটিপাটি। এমন অদ্ভুত আওয়াজ তারা। কস্মিনকালেও শোনেনি।

আরও দু-তিনটে উপজাতি গ্রামে গিয়ে ছবি তোলা হল। সবার মেজাজই যে নরম তা নয়। কেউ কেউ বেশ উগ্র, বিদেশিদের পছন্দ করে না।–মার্কো কিন্তু ঠিক তাদের সঙ্গে ভাব জমিয়ে ফেলল।

একদিন নদী তীরে তাঁবু ফেলে বিশ্রাম করছি। দুপুরবেলা। মার্কো হঠাৎ প্রশ্ন করল, প্রোফেসর ঘোষ, এইভাবে খুঁজে বৈজ্ঞানিক সর্বজ্ঞর হদিশ পাবেন কি?

চমকে গেলাম মার্কোর কথা শুনে। মামাবাবুও অবাক। বললেন–আপনি জানলেন কী করে যে আমি বৈজ্ঞানিক সর্বজ্ঞর খোঁজ করছি?

মার্কো হাসল। আমার চোখ ও কান আছে। ডক্টর কেন্টকে অত প্রশ্ন করলেন আপনি। ইন্ডিয়ানদের গ্রামে গিয়ে সর্বজ্ঞর ফোটো দেখিয়ে খোঁজখবর করছেন। সব আমি লক্ষ করেছি। জানি বৈজ্ঞানিক সর্বত্তর কেস রহস্যজনক। কিন্তু সঠিক কোনো ক্লু পেয়েছেন কি?

মামাবাবু খানিক চুপ করে থেকে বললেন, পেয়েছি।

কী?

মামাবাবু সমস্ত বললেন। ভিক্টরের তোলা সেই ফোটো, দুর্ঘটনাস্থল থেকে অনেক দূরে সত্যনাথ সর্বজ্ঞর হ্যাট ও টাই পরা উপজাতি সর্দারের ছবি। এ-বিষয়ে মামাবাবুর অনুমান।

শুনে মার্কো উত্তেজিত হয়ে উঠল–ইস, আগে বলতে হয়! মিছিমিছি কটা দিন নষ্ট হল। চলুন সোজা সর্দারকে ধরিগে।

সেইদিনই এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটল।

আমি আর সুনন্দ বনে ঢুকেছি। ইচ্ছে সজারু বা এগুটি পেলে শিকার করব। প্রকাণ্ড একটা গাছের কাছে গিয়ে শুনি কেমন বিচিত্র আওয়াজ হচ্ছে। কড়মড় মড়মড় জাতীয়। কীসের শব্দ? আবিষ্কারের চেষ্টায় ওপরে চেয়ে আছি, দেখলাম এক দঙ্গল টিয়াপাখি গাছ থেকে বেরিয়ে উড়ে পালাল। হঠাৎ সামনে আমাদের দুজনকেই চমকে দিয়ে আবির্ভূত হল আমাদের এক চেনা লোক।-পেড্রো লোপেজ। সে হুঙ্কার ছাড়ল–সরে এসো ওখান থেকে–এক্ষুনি।

অবাক হয়ে দেখছি তাকে। পেড্রো খ্যাঁক করে আমাদের জামা ধরে হিড়হিড় করে টানতে টানতে নিয়ে চলল। ওঃ, বুড়োর গায়ে তো আচ্ছা জোর!

বেশ খানিকটা যাবার পর নিজেদের ছাড়িয়ে নিয়ে রেগে বললাম, কী ব্যাপার।

উত্তরের আগেই এক কর্ণভেদী শব্দে শিউরে উঠলাম। সেই বিশাল গাছটা সমস্ত অরণ্যটাকে কাঁপিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। আর আধ মিনিট ওখানে থাকলে আমরা ওই গাছের তলায় চাপা পড়ে পিষে যেতাম।

পেড্রো পাইপে টান দিয়ে বলল, বৃষ্টির জলে শিকড় আলগা হয়ে গিয়েছিল। অনেকক্ষণ ধরে পড়ছিল গাছটা। জঙ্গলের জ্ঞান নেই মূর্খ। মরতে এক্ষুনি!

কী বলে ওঁকে ধন্যবাদ দেব ভাবছি, এমন সময় পেড্রো বলল–ম্যাপটা পেলে কোথায়?

বললাম, ম্যাপ! কীসের ম্যাপ?

পেড্রো তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠল। বটে, বলবে না? চেপে যাচ্ছ? দেখ, একজন ভারতীয় মরেছে। তোরাও মরবি। লোপেজ বংশের হক্কের ধন গাপ মারা অত সোজা নয়। বুঝলি?

পেড্রো হন করে বনের ভিতর অদৃশ্য হল।

স্তম্ভিত হয়ে থেকে বললাম, লোকটা পাগল নাকি?

সুনন্দ বলল, হতে পারে। কিন্তু বৈজ্ঞানিক সর্বজ্ঞর বিষয়ে কি ও কিছু জানে? ওর কোনো হাত আছে নাকি? শুনলি ওর কথা? এমন খ্যাপাটে লোক অনেক সময় ডেনজারেস হয়।

তাঁবুতে ফিরে মামাবাবু ও মার্কোকে পেড্রোর কথা জানালাম। দুজনেই একটু চিন্তিত হলেন। মার্কো বলল, খেয়াল রেখো, লোকটাকে আবার দেখলে ধরব। জানতে হবে সর্বত সম্বন্ধে ও কী জানে!

দুঃখের বিষয় আমরা আর পেড্রোর দেখা পেলাম না। কিন্তু আমার মনে হচ্ছিল, পেডো ঠিক আমাদের অনুসরণ করছে লুকিয়ে লুকিয়ে।