☼ অজেয় রায় ☼
আমাজনের গহনে
তিন
পরদিন সকালে দেখলাম ডাক্তারের আবার দিব্যি হাসিখুশি মেজাজ। আমাদের আমন্ত্রণ জানালেন, চলুন অর্কিড দেখবেন।
গ্রিন-হাউসের দিকে যেতে যেতে বললেন, অর্কিড আমার নেশা। মেরি রাগ করে। বলে, বৃথা সময় আর অর্থ ব্যয় হচ্ছে। আবার নতুন কোনো ফুল ফুটলে যখন ডেকে দেখাই, তখন রাগ ভুলে যায়। অর্কিড গাছে বড় যত্ন লাগে। ফুল ফুটতে অনেক সময় নেয়। সাত-আট বছরও লেগে যায়। তবে হ্যাঁ, একবার ফুটলে সে-ফুল থাকে অনেক দিন। দু-তিন সপ্তাহ থেকে তিন-চার মাসও কোনো কোনো ফুল গাছে তাজা থাকে। তখন মনে হয় পরিশ্রম সার্থক।
সুনন্দ প্রশ্ন করল, অর্কিড ফুলের বিশেষত্ব কী?
মামাবাবু বললেন, প্রধানত ফুলের গড়ন। ফুলের একটি পাপড়ির গড়ন অন্য ফলের চেয়ে আলাদা হয়। একটু বড় হয় সাধারণত।
ডাক্তার বললেন, “আমি সাধারণত দক্ষিণ আমেরিকার ট্রপিকাল অঞ্চলে যত বকা অর্কিড পাওয়া যায় তাই জোগাড় করি। অবশ্য অন্য দেশের অর্কিডও আছে।
একটা গ্রিন-হাউসের ভিতর ঢুকে ডাক্তার ঘোষণা করলেন, এর মধ্যে আছে প্রধানত ক্যাটলিয়া প্রজাতীয় অর্কিড। এদের আদি বাস মধ্য আমেরিকা এবং দক্ষিণ আমেরিকার উত্তর অংশে।
ডাক্তার গাছগুলির কখনও ল্যাটিন নাম কখনও বা চলতি নাম বলতে লাগলেন।–ওই ছোট ছোট লাল ফলগুলি মিলটোনিয়া। ওই যে সাদা ফুল, মধ্যিখানে গোলাপি হলুদ মেশানো একটি পাপড়ি, ওটি ব্রাজিলের ক্যাটলিয়া ট্রিয়ানাল।
ওইসব নাম-গোত্র আমার মাথায় ঢুকছিল না।
ক্রমে গ্রিন-হাউস দেখা শেষ হল। আমার মনটা খচখচ করছে। কাল একটা অর্কিড দেখেছিলাম, সেটা আজ আর নেই। কোথায় গেল? দেখছি না তো! খোলা বাগানেও কি অর্কিড গাছ রয়েছে। গাছের ডালে ঝুলছে, মাটিতে জন্মেছে। একটা লতা দেখিয়ে ডাক্তার বললেন, এই হচ্ছে ভ্যানিলা লতা। এও একরকম অর্কিড।
ঝাঁকড়া লতা একটা বড় গাছে পাকিয়ে পাকিয়ে উঠেছে। তাতে শিমের মতো ফল। চ্যাটাল সবুজ পাতা, আর হালকা সবুজ ফুল।
যে ভ্যানিলা আইসক্রিম বা চকোলেটে দেয়? আমি আশ্চর্য হয়ে বলি।
ডাক্তার বললেন, হ্যাঁ। ওই ফলের বীচি থেকে ভ্যানিলার গন্ধ তৈরি হয়। ভ্যানিলা কিন্তু আধুনিক মানুষের আবিষ্কার নয়, পাঁচশো বছর আগে মেক্সিকোর আজটো চকোলেটে ভ্যানিলা মিশিয়ে খেত।
একটার দিকে আঙুল দেখিয়ে ডাক্তার বললেন, এই অর্কিড আমার সৃষ্টি। চার রকম অর্কিডের মিশ্রণে এটা তৈরি। এরকম আরও কটা নতুন ফুল আমি তৈরি করতে পেরেছি।
একটু গর্বের সঙ্গে বললেন ডাক্তার, তাছাড়া পাঁচ রকম নতুন অর্কিড আমি আবিষ্কার করেছি, কুড়ি বছর দুর্গম পাহাড়-জঙ্গলে ঘুরে বেরিয়ে।
কুড়ি বছরে মাত্র পাঁচ! সুনন্দ অবাক হয়ে প্রশ্ন করে।
ডাক্তার বললেন, আমি তো সৌভাগ্যবান। অনেকে সারা জীবনে একটাও নতুন অর্কিড আবিষ্কার করতে পারে না।
ঘণ্টা দুই পরে ফিরলাম।
সুযোগ পাওয়া মাত্র মামাবাবুকে জানালাম, কাল একটা ফুল দেখেছিলাম, সেটা আজ আর কোথাও দেখলাম না। একটু আশ্চর্য লাগছে।
কাল? মানে?
মামাবাবুকে গতকালের ঘটনাটা খুলে বললাম। ডাক্তার কেন্টের অদ্ভুত ব্যবহারের কথাটাও বাদ দিলাম না। বললাম, চমৎকার ফুলটা। ঢুকেই আমার চোখে পড়েছিল। গাঢ় নীলরঙা পাপড়িগুলি। মাঝের একটা পাপড়ি শিঙার মতো মাথা উঁচু করে রয়েছে, তার গায়ে গোলাপি আভা। আজ সেটা সরিয়ে ফেলা হয়েছে। কোনো গ্রিন-হাউসে নেই।
মামাবাবু ভুরু কুঁচকে বললেন, রঙ ঠিক মনে আছে?
হুঁ আছে। গন্ধও মনে আছে। চমৎকার মিষ্টি সুবাস।
সুনন্দ বলল, কোণের গ্রিনহাউসটা তালা মারা ছিল। আমরা ঢুকিনি। সেটায় রাখা হয়েছে হয়তো।
মামাবাব গম্ভীরভাবে বললেন, আজ সন্ধেবেলা সেটা জানার চেষ্টা করব। অসিত কাউকে বোলো না কিছু এ-বিষয়ে।
ব্যাপারটা মামাবাবু এত সিরিয়াসলি নেবেন ভাবিনি।
সন্ধ্যার অন্ধকার নামতেই মামাবাবু হুকুম দিলেন–চলো। ডাক্তার রুগী দেখতে বেরিয়েছেন, মার্কো ক্যামেরা নিয়ে খুটখাট করছে। এই সুযোগ।
হালকা জ্যোৎস্না ফুটেছে। দূরে মালিদের কুটিরের সামনে আগুন জ্বেলে রান্না হচ্ছে। আমরা ধীরে ধীরে সেই বন্ধ গ্রিনহাউসের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। মামাবাবু জালের ভিতর দিয়ে টর্চের আলো ফেললেন ভিতরে। ওই তো সেই গাছ! সেই নীল ফুল। আমি উত্তেজিতভাবে দেখাই।
মামাবাবু প্রায় আধ মিনিট ফুলটা লক্ষ করলেন। তারপর চিন্তিতভাবে বাড়ির দিকে ফিরে চললেন।
আমরা দুজনও তার পাশাপাশি চলেছি, হঠাৎ অন্ধকারে বিদ্যুতের মতো কী এক প্রাণী লাফিয়ে পড়ল সামনে। সঙ্গে সঙ্গে টর্চ ফেলে ভয়ে কাঠ হয়ে গেলাম। একটা জাগুয়ার। প্রকাণ্ড আকার। হলদের ওপর কালো ছোপ ছোপ, দেহটা টান টান। ওৎ পেতে বসে দন্ত বিকশিত করে গরগর করছে আমাদের দিকে চেয়ে। তার লেজ অল্প অল্প নড়ছে, সবুজ চোখ দুটো জ্বলছে হিংস্র রাগে।
এবার দেবে লাফ। আমার গলা শুকিয়ে এসেছে, বুকের ভেতর হাতুড়ি পিটছে। কিন্তু বাঘটা দেরি করছে কেন? সহসা কানে এল ডাক্তারের গলা–মাংকো।
অমনি বাঘটা পিছন ফিরে দেখল একবার। পরমুহূর্তে দীর্ঘ লাফে অদৃশ্য হয়ে ঝোঁপের আড়ালে।
দৌড়ে এলেন ডাক্তার। একি, অন্ধকারে বেরিয়েছেন কেন? খুব ভয় পেয়েছেন তো?
মামাবাবু প্রথম কথা বললেন, ওটা কি আপনার পোষা বাঘ?
হ্যাঁ, আক্রমণ করে না কাউকে। তবে অচেনা মানুষ দেখলে ভয় দেখায়। দিনেও ছাড়া থাকে। আপনারা আছেন বলে শুধু রাতে ছাড়ছি। আমার বলে রাখা উচিত ছিল।
বুক ধড়ফড়ানি কমতে বেশ কিছুটা সময় নিল। আজকের ঘটনার পর ডক্টর কেন্টকে আরও রহস্যময় বলে মনে হচ্ছে।
পরদিন আমরা ম্যালডোনাডো ছাড়লাম। লঞ্চে মামাবাবু আমাদের দুজনকে আড়ালে বললেন, ওই নীল অর্কিড বড় ভাবিয়ে তুলল যে!
কেন?
বৈজ্ঞানিক সর্বজ্ঞ তাঁর মেয়েকে লিখেছিলেন–একটা নতুন অর্কিড পেয়েছি। অপূর্ব নীল রঙের ফুল। তারপর যা বর্ণনা দিয়েছেন তা হুবহু এই ফুলের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে। প্রশ্ন হল- সর্বজ্ঞর আবিষ্কার ডাক্তার কেন্টের হাতে এল কী করে? কেনই-বা উনি এ-ফুল। আমাদের কাছ থেকে লুকিয়ে রাখতে চান?
বললাম, “হয়তো সর্বজ্ঞ ডাক্তারকে গাছটা উপহার দিয়েছেন।
মামাবাবু বললেন, তাহলে এত লুকোচুরির দরকার কী?
সুনন্দ বলল,ডাক্তারকে তো প্রথমে দেখে খুব ভালো লোক বলেই মনে হয়েছিল।
মামাবাবু গম্ভীরভাবে বললেন, পৃথিবীতে এমন অনেক সৎ লোক আছেন যাঁরা তাঁদের শখের জিনিস সংগ্রহ করতে এমন সব কাণ্ড করে বসেন যা সুস্থ মস্তিষ্কে চিন্তাই করা যায় না! রূপা বলেছে, অর্কিড ফুলে নীল রঙ দুর্লভ! আর সর্বজ্ঞ লিখেছেন যে, এমন চমৎকার নীল অর্কিড আগে নাকি কখনও পাওয়া যায়নি।
আমি বললাম, ডাক্তারকে ওই ফুল সম্বন্ধে প্রশ্ন করলেন না কেন?
মামাবাবু বললেন, তাতে লাভ হত না। কারণ প্রমাণ কী? যদি বৈজ্ঞানিক সর্বজ্ঞর হদিস পাই তখন এ-রহস্যের কিনারা হতে পারে। আর তা না হলে বাধ্য হয়ে ডাক্তারের মুখ থেকে জোর করেই ওই অর্কিড এবং সর্বজ্ঞ সম্বন্ধে কথা আদায় করতে চেষ্টা করব।
বেশ চওড়া নদী মাদ্রে দ্য দিওস। দুপাশে ঘন উদ্ভিদরাজি। লোকালয় প্রায় নেই বললেই চলে। আমাদের লঞ্চ বেশ বড়, তাতে যাত্রীও অনেক। শ্বেতাঙ্গ, কৃষ্ণাঙ্গ, তাম্রবর্ণ রেড-ইন্ডিয়ান ইত্যাদি নানা জাতের মানুষ রয়েছে। আর রয়েছে কিছু গরু, ছাগল, মুরগি।
নানা বাণিজ্যসম্ভার উঠেছে লঞ্চে। কাঁদি কাঁদি কলা, রবারের গোলা, আখ, পেঁপে, ভুট্টা ইত্যাদি। তাছাড়া আধুনিক জগতে তৈরি টিনের খাবার, জামা-কাপড়, ওষুধপত্র। বনভূমিতে নিঃসঙ্গ খামারগুলির এসব জিনিস বড় দরকার।
এখানে লোকগুলো কেমন বেপরোয়া। কেমন যেন একটা গা-ছাড়া ভাব। সময় কেউ যেন ব্যস্ত নয়। লঞ্চ থামলে ধীরেসুস্থে ওঠে নামে, কথায় কথায় তর্ক বাধে। প্রায় কাছে পিস্তল বা ছুরি থাকে, যখন তখন টেনে বার করে। আবার দেখেছি পরস্পরের ভাবও হয়ে যায় চট করে! আমরাও আগ্নেয়াস্ত্র নিয়েছি। তবে মার্কোর ভাষায় শুধু আত্মরক্ষা এবং খাদ্য সংগ্রহের প্রয়োজনে। অরণ্য-অভিযানে উপস্থিত বুদ্ধি এবং দৃঢ় নার্ভই প্রধান হাতিয়ার।
এই লঞ্চেই বুড়ো পেড্রো লোপেজ আমার ও সুনন্দর নজরে পড়ে। ছোটখাটো মানুষটি নোংরা পোশাক পরে রেলিংয়ে ঠেস দিয়ে বসে আছে। মুখে অজস্র ভাঁজ। হুড দেওয়া জকি টুপি মাথায়। দাঁতে পাইপ কামড়ে চক্ষু মুদে ঝিমুচ্ছে।
একজন খালাসি চেঁচিয়ে বলে উঠল, “কী গো পেড্রো লোপেজ! যাচ্ছ কোথায়? নতুন কোনো খোঁজ-টোজ পেলে নাকি?
বৃদ্ধ তির্যক দৃষ্টিতে চাইল খালাসির দিকে, উত্তর দিল না।
খালাসি আবার বলল, এই বয়সে বেশি ঘোরাঘুরি কিন্তু ভালো নয় বুড়ো।
চকিতে খাড়া হয়ে উঠল বৃদ্ধের দেহ। ভাঙা গলায় হুঙ্কার ছাড়ল, খবরদার, বুড়ো বলবি নে! জানিস আমার হাতের টিপ এখনও কেমন? দেখবি নাকি পরীক্ষা করে?
ছোকরা খালাসি চট করে আড়ালে সরে গিয়ে মন্তব্য করল, উঃ, কী রাগী বুড়ো রে বাবা!
একজন বয়স্ক লোক পেড্রোকে কী জানি কী বলতেই সে তেড়ে উঠল। থাক, আর উপদেশ দিতে হবে না। আমার ভালো-মন্দ আমি বুঝব। জেনে রাখ–লোপেজ বংশের কেউ বিছানায় শুয়ে মরে না। মূখের দল! আমায় ঠাট্টা করা! হু-বরাত যদি ভালো হয় তো প্রমাণ করে দেব ফার্দিনান্দ লোপেজের কথা সত্যি কিনা।
পেড্রো সবার মুখের পানে চ্যালেঞ্জের ভঙ্গিতে তাকাল। মামাবাবু ও মার্কো অবশ্য ও-দৃশ্য দেখেননি।
হিথ নদীর সঙ্গমস্থলে আমরা লঞ্চ থেকে নামলাম।
গ্রামের ঘাটে পেড্রো লোপেজকে আবার দেখলাম। শুধু দেখা নয়, কথাও হল। পেড্রো। নিজেই এসে আমাদের বলল, তোমরা কোন দেশের লোক?
সুনন্দ বলল, ইন্ডিয়া।
উত্তরটা শুনে পেড্রো কিছুক্ষণ আমাদের দিকে চেয়ে থেকে আবার প্রশ্ন করল–তোমরা যাচ্ছ কোথায়?
সুনন্দ জবাব দিল, হিথ নদীতে ঘুরব। ছবি তুলব।
হুঁ…
পেড্রো ভুরু কুঁচকে বলল, “তোমাদের দেশ থেকে আরেকজন এসেছিল এখানে, তোমরা তার কেউ হও কি?
আমরা অবাক। কী উত্তর দেব ভেবে পাই না।
বুড়ো কিছুক্ষণ আমাদের দিকে চেয়ে থেকে উল্টোদিকে ঘুরে চলে গেল।
এবার আমরা টমকে খুঁজে বের করলাম। টম অল্পবয়সী আধা-ইন্ডিয়ান। ভালো মাঝি! দুটো ক্যান জোগাড় হল। ক্যানু হচ্ছে একরকম হালকা ছোট নৌকো। টম ছাড়া আরও তিনজন দেশি মাঝি নিলাম সঙ্গে। প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রে নৌকো বোঝাই করে আমরা দুদিন পরে জলে পড়লাম। ক্রমে হিথ নদীতে প্রবেশ করলাম। শুরু হল আমাদের আসল অভিযান।