» » আমাজনের গহনে

বর্ণাকার

অজেয় রায়

আমাজনের গহনে

দুই

কুজকো থেকে আমরা উড়োজাহাজে চেপে মাদ্রে দে দিওস নদীর পারে ছোট্ট শহর পুয়ার্টো ম্যালডোনাডোয় উপস্থিত হলাম। এখান থেকে লঞ্চে রওনা হব হিথ নদী দিয়ে।

মামাবাবু ও মার্কো ডক্টর কেন্ট নামে এক ব্যক্তির খোঁজ করতে শুরু করলেন। প্রকৃতপক্ষে এই কেন্টের সন্ধানেই আমাদের ম্যালডোনাডোয় আসা।

মামাবাবু বললেন, সার্চ-পার্টির রিপোর্টে আছে, ডক্টর সর্বজ্ঞ তাঁর নিরুদ্দেশ যাত্রার আগে এই লোকটির বাড়িতে কয়েক দিন থাকেন। আমি জানতে চাই সর্বজ্ঞ ডাক্তারকে কোনো গোপন জায়গায় যাত্রা সম্বন্ধে কিছু আভাস দিয়েছিলেন কিনা! মনে হয় দেননি। কারণ অনুসন্ধানী দল ডাক্তারের কাছে খোঁজখবর করেছিল। কিছু জানতে পারেনি। দেখা যাক চেষ্টা করে।

মার্কোর ইচ্ছে ডাক্তারের কাছে একজন ভালো মাঝির খোঁজ করবেন। সেই হবে গাইড। অচেনা গাইড নেওয়া বিপজ্জনক। এখানকার স্থানীয় রেড ইন্ডিয়ানরা খুব ভালো মাঝি, কিন্তু খামখেয়ালি। হঠাৎ তাদের মেজাজ বিগড়ে গেলে যাত্রীদের ফেলে পালাবে। সভ্য জগৎ থেকে বহু দূরে অজানা গভীর বনের মধ্যে তখন এক অসহায় অবস্থায় পড়তে হয়। গতবার মার্কো একবার এমনি বিপদে পড়েছিল। তাই ডাক্তারকে চাই।

মার্কো শুনেছে বিচিত্র লোক এই ডাক্তার। ডাক্তারি বিদ্যায় রীতিমতো সুনাম আছে, কিন্তু প্র্যাকটিসে মন নেই। অন্তত পয়সা রোজগারে উৎসাহ নেই। এই অখ্যাত জায়গায় পড়ে আছেন, প্রায়ই বনের ভিতর ঘুরে বেড়ান আর রেড ইন্ডিয়ানদের গ্রামে গ্রামে গিয়ে তাদের চিকিৎসা করেন। এ অঞ্চলের দরিদ্র অধিবাসীরা নাকি ডাক্তারকে ভীষণ শ্রদ্ধা করে। কেন্ট-এর নেশা নাকি অর্কিড ফুল। তিনি একজন জগদ্বিখ্যাত অর্কিড-বিশেষজ্ঞ।

একেবারে শহরের সীমানায় ডাক্তারের বাড়ি। ডাক্তারের বাড়ির গেটের সামনে এসেছি এমন সময় এক শ্বেতাঙ্গ ভদ্রলোক সাইকেল চেপে বাইরে থেকে এসে আমাদের দেখে নেমে পড়লেন। বেঁটেখাটো গোলগাল লোকটি, মাথাজোড়া টাক। মার্কো বলল, এটা কি ডাক্তার কেন্টের বাড়ি? আমরা তার সঙ্গে দেখা করতে চাই।

লোকটি কৌতূহলী চোখে চেয়ে বলল, “আমিই জর্জ কেন্ট। আপনারা?

মার্কো আমাদের পরিচয় দিল। ডাক্তার বললেন, চলুন ভিতরে।

প্রকাণ্ড কম্পাউন্ডওলা কাঠের তৈরি বাংলো ধরনের বাড়ি। চারপাশে বাগান, তাতে নানান ফল-ফুলের গাছ। সামনে বারান্দার ছাদে বুগেনভিলিয়ার লতা টকটকে লাল ফুলে ছেয়ে আছে। বারান্দায় উঠে বেতের চেয়ারে বসলাম। মার্কো তার আগমনের উদ্দেশ্য বলল। কেন্ট বললেন-আচ্ছা সে হবে। আপাতত কফি হোক। মেরি! মেরি!

ডাক্তারের স্ত্রী বেরিয়ে এলেন। ভারি স্নিগ্ধ চেহারা মহিলার। আলাপের পর হেসে বললেন, আপনাদের ডাক্তার যে এমন খ্যাতিমান ব্যক্তি হয়ে উঠেছেন জানতাম না। দেশবিদেশ থেকে সম্মানিত ভদ্রলোকরা সব আসছেন তার কাছে। যাক, ভালো ভালো। আমি তো ভাবি ও বুনো হয়ে গেছে।

একটু পরে এল কফি, স্যান্ডউইচ আর কাজুবাদাম ভাজা।

ডাক্তারের স্ত্রী জিজ্ঞাসা করলেন, এখানে উঠেছেন কোথায়?

বললাম, “ইচ্ছে আছে কোনো হোটেলে থাকব।

আরে ছি! ছি! এখানকার হোটেল অতি জঘন্য। আমাদের বাড়িতে থাকুন। আমরা খুব খুশি হব। ডাক্তারের ভদ্রতা-জ্ঞান নেই। এখনও পর্যন্ত এ-বিষয়ে কোনো খোঁজই নেয়নি।

ডাক্তার গম্ভীরভাবে বললেন, “দেখ মেরি, ওঁরা যে এখানে থাকবেন সে ডিসিশন আমি অলরেডি নিয়ে ফেলেছি। শুধু সুযোগ বুঝে কথাটাপাড়বার অপেক্ষায় ছিলাম। ডাক্তার ও মেরি কখনও ইংরেজি কখনও স্প্যানিশ ভাষায় কথা বলছিলেন। মেরি জাতিতে ইংরেজ। ডাক্তার স্কচ। তারা কয়েক পুরুষ এ দেশে আছেন।

এদেশের বেশিরভাগ লোক স্প্যানিশ ভাষায় কথা বলে, কারণ স্প্যানিয়ার্ডরাই প্রথম পেরুতে বসতি স্থাপন করে। এখানে আসার আগে মামাবাবুর নির্দেশে আমরা কিছু স্প্যানিশ ভাষায় তালিম নিয়েছিলাম, আর অভিযানে বেরুবার আগে মার্কো শিখিয়েছেন, এখানকার অধিবাসীদের প্রচলিত ভাষা টোপি, সামান্য কাজ চালাবার মতো। ফলে কথাবার্তা আমরা মোটামুটি বুঝতে পারছিলাম।

কথার ফাঁকে ডাক্তার মামাবাবুকে প্রশ্ন করলেন, আপনারা ইন্ডিয়ার কোন অংশের লোক?

ইন্ডিয়া এবং ক্যালকাটা শুনে একটু থমকে গিয়ে বললেন, কী আশ্চর্য! আর একজন ক্যালকাটার লোকের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছে। সায়ান্টিস্ট সর্বজ্ঞ। চেনেন তাকে?

মামাবাবুর চোখ চকচক করে উঠল। বললেন, চিনি, তবে সামান্য। আচ্ছা, সবজ্ঞর নিরুদ্দেশ হওয়ার ব্যাপারটা কেমন রহস্যজনক নয় কি? না পাওয়া গেল দেহ, না পাওয়া গেল তার জিনিসপত্র। এমনও হতে পারে বৈজ্ঞানিক কোথাও আটকে পড়েছেন। বন্দী বা। অসুস্থ হয়ে আছেন। ফিরে আসতে পারছেন না।

হুঁ। হতে পারে। ডাক্তার মাথা নাড়েন। আমি একবার নিরুদ্দেশ হয়েছিলাম মেক্সিকোয়। মেরি তিন মাস আমার কোনো খবর পায়নি।

আচ্ছা, সর্বজ্ঞ ম্যালডোনাডো ছাড়বার আগে উনি কোথায় যাচ্ছেন সে-বিষয়ে আপনাকে কিছু বলেছিলেন?

না।

সংক্ষিপ্ত উত্তর। মনে হল যে এ-বিষয়ে আলোচনা করতে ডাক্তার অনিচ্ছুক। হয়তো তাকে অনেক জেরা করা হয়েছে, তাই এ-ব্যাপারে তার বিরক্তি জন্মেছে।

মার্কো ছবি তুলতে লেগে গেল। রক্তবর্ণ বুগেনভিলিয়ার ঝাড় ব্যাকগ্রাউন্ডে রেখে মেরির ফোটো তুলল। মামাবাবু বললেন, একটা কথা মনে পড়ল। আমি সাউথ আমেরিকায় আসার আগে বৈজ্ঞানিক সর্বজ্ঞর মেয়ে আমার সঙ্গে দেখা করে। দুর্ঘটনার কিছুদিন আগে সর্বজ্ঞ মেয়েকে তার একখানা ফোটো পাঠিয়েছিলেন। ওঁর মেয়ে বলেছে, ফোটোতে সর্বজ্ঞ মাথায় শোলার হ্যাট ও লাল নেকটাই পরেছিলেন। গায়ে নেভি-বু শার্ট। ফোটোটা মেয়ে হারিয়ে ফেলেছে। ওই ফোটোর আরও কপি সে চায়। আমায় জোগাড় করে নিয়ে যেতে বলেছে। একমাত্র মেয়ে। বড্ড ভেঙে পড়েছে। আচ্ছা এখানে সর্বজ্ঞ কি কোনো ফোটো তুলেছিলেন? তুললে, কে তুলেছেন সেটা জানেন?

ডাক্তার বলল, “আমি স্বয়ং ওই ফোটো তুলি। দেব আপনাকে এক কপি। ফেরার সময় নিয়ে যাবেন।

মেরি আক্ষেপের সুরে বললেন, বৈজ্ঞানিক তার মেয়েকে খুব ভালোবাসতেন, জানি। কী চমৎকার লোক ছিলেন! অত বড় পণ্ডিত, অথচ কোনো অহঙ্কার নেই। ইস, কী কাণ্ড যে হয়ে গেল!

আমি সুনন্দর দিকে অর্থপূর্ণভাবে চাইলাম। অর্থাৎ মামাবাবুর অনুমান ঠিক। যেখানে দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে মনে করা হচ্ছে বৈজ্ঞানিক সর্বজ্ঞ তার চেয়ে অনেক দূরে গিয়েছিলেন। নইলে তাঁর টুপি আর টাই ওই সর্দার পেল কী করে?

মামাবাবু নির্বিকার। বললেন, মিসেস কেন্ট, ফেরার সময় দয়া করে ছবিটার কথা আমায় মনে করিয়ে দেবেন। নইলে লজ্জায় পড়ব রূপার কাছে।

কথায় কথায় মামাবাবু ডাক্তারকে বললেন, শুনেছি আপনি রেড-ইন্ডিয়ান উপজাতিদের গ্রামে গ্রামে গিয়ে তাদের চিকিৎসা করেন?

ডাক্তার বললেন, হ্যাঁ করি। কারণ সরল আদিবাসীদের আমি ভালোবাসি। আর আমি মনে করি, এটা আমার কর্তব্য। আমার শ্বেতাঙ্গ পূর্বপুরুষরা এখানকার আদিবাসীদের অনেক অত্যাচার করেছে। তাদের ক্রীতদাস করে, পশুর মতো ব্যবহার করেছে। আমি কলঙ্ক মুছে ফেলার চেষ্টা করছি। অনেকে আমায় পাগল বলে। বলুকগে। আমি নিজে কী ভাবি জানেন? ইংকা। আমার দেহে ইংকা-রক্ত আছে। আমার ঠাকুরমা ছিলেন ইংকা-রমণী। অমন সুসভ্য জাতির লোক হওয়া আমি গৌরবের বিষয় মনে করি। স্প্যানিয়ার্ডরা অস্ত্রের জোরে এক বিরাট সভ্যতাকে ধ্বংস করে ফেলেছিল। ইংকাদের বহু জ্ঞানভাণ্ডার হারিয়ে গেল। শ্বেতাঙ্গরা যদি সেসব বিদ্যা শিখে নিত তবে মানুষের অনেক অনেক উপকারে লাগত।

ডাক্তার বেশ উত্তেজিত হয়ে উঠেছিলেন। হঠাৎ অতিথিদের সামনে বক্তৃতা দেবার লজ্জায় চুপ মেরে গেলেন। আমাদের কিন্তু এই আদর্শবাদী মানুষটির ওপর বড় শ্রদ্ধা জাগল।

সেদিন বিকেলে এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হল।

মার্কো আর মামাবাবু শহরে গেছেন। সুনন্দ একটা বইয়ে ডুব দিয়েছে। ডাক্তারকে দেখছি না। মিসেস কেন্ট রান্নাঘরে ব্যস্ত। আমি বেরিয়ে পড়লাম বাগানটা এক ঘুরে দেখতে।

অনেকটা জায়গা জুড়ে ডাক্তার কেন্টের বাগান। ফুল-ফলের গাছগুলি কিছু চেনা, কিছু অচেনা। কয়েকজন দেশি মালি কাজ করছিল বাগানে। একধারে পরপর কয়েকটা তামেন জালে তৈরি ঘর। জালে লতা উঠে ছেয়ে গেছে। কোনো ঘরে বাঁশের কঞ্চির বেড়ায় তৈরি দেওয়াল বা ছাদ। কাছে গিয়ে বুঝলাম গ্রিনহাউস। যার মধ্যে আলো, বাতাস, উত্তাপকে নিয়ন্ত্রণ করে নানারকম ফুলগাছ রাখা হয়। প্রথম ঘরের দরজা একটু ফাঁক। ভিতরে ডাক দিলাম। সবই অর্কিড গাছ। ছাদ থেকে তারে বাঁধা কাঠ বা শুকনো গাছের ডাল আঁকড়ে ঝুলছে নানা জাতের অর্কিড। কয়েকটা গাছসুদ্ধ টব ঝোলানো রয়েছে ছাদ থেকে। শুনেছি এই ধরনের বায়বীয় অর্কিড বৃষ্টির জল, রোদ, হাওয়া থেকে খাদ্য গ্রহণ করে। মাটিতে টবে কিছু গাছ রয়েছে। ফুল ফুটেছে কোনোটায়। ভালো করে দেখতে ভিতরে ঢুকলাম।

পিছনে পায়ের শব্দ। ফিরে দেখি দরজার মুখে দাঁড়িয়ে আছেন ডাক্তার কেন্ট। থমথমে মুখ। রুক্ষ গলায় প্রশ্ন করলেন, কী করছেন এখানে?

উত্তর দিলাম, এই দেখছিলাম, কত রকম অর্কিড?

রীতিমতো আদেশের সুরে ডাক্তার বললেন, এখন যান। পরে আমি দেখিয়ে দেব।

অপ্রস্তুত হয়ে বাংলোয় ফিরলাম। এ-ঘটনা বললাম না কাউকে।