» » আমাজনের গহনে

বর্ণাকার

অজেয় রায়

আমাজনের গহনে

এক

টোনি মার্কোর সঙ্গে আমাদের আলাপ হয় এক বিচিত্র পরিবেশে, আর সেই আলাপই হল এক রোমাঞ্চকর অ্যাডভেঞ্চারের সূত্রপাত।

দক্ষিণ আমেরিকার পেরু রাজ্য। বিশাল আন্ডিজ পর্বতমালার এক অংশ পড়েছে এই পেরুর মধ্যে। আন্ডিজের এক সুউচ্চ মালভূমিতে লুকনো প্রাচীন ইংকা জাতির এক নগরের ধ্বংসাবশেষ দেখতে গিয়েছিলাম আমরা তিনজন–আমি, সুনন্দ ও মামাবাবু। সঙ্গে ছিল আরও প্রায় জনা কুড়ি নানা দেশীয় ট্যুরিস্ট।

দুর্গম পথ, কিন্তু আশ্চর্য সুন্দর প্রাকৃতিক পরিবেশ। সরু ফিতের মতো রাস্তা বেয়ে আমাদের ছোট ট্রেন ঘুরে ঘুরে পাহাড়ে চড়েছে। মাঝখানে উরুবাম্বা নদীর গিরিখাত, তার ওপর লোহার ব্রিজ। ট্রেন থেকে নেমে পায়ে হেঁটে ব্রিজ পেরিয়ে ওপারে ট্যুরিস্ট বাসে উঠতে হয়েছে। হাজার ফুট তলায় উদ্দাম পাহাড়ি নদীর আস্ফালন দেখলে মাথা ঘুরে যায়।

এ সমস্তই রীতিমতো রোমহর্ষক অভিজ্ঞতা। কিন্তু এর পর পাহাড়ে চড়ে যা দেখলাম তাতে অভিভূত হয়ে গেলাম সবাই।

দূরে, যত দূরে চোখ যায় শুধু ঢেউয়ের মতো পর্বতমালা। আর সামনে পাহাড়-ঘেরা মালভূমির ওপর এক আশ্চর্য নগরীর কঙ্কালদেহ। উঁচু চওড়া প্রাচীর, বিস্তৃত সোপান শ্রেণি, আর সারি সারি ছাদহীন কক্ষ সব পাথরে তৈরি। এই নির্জন মৃত প্রস্তরপুরী হচ্ছে ইংকাদের হারানো শহর ভিস্কাপম্পা যার আধুনিক নাম মাচুপিচু। আশ্চর্য জাতি এই ইংকারা; পাহাড়ের ওপর কী অদ্ভুত সব নগর গড়ে তুলেছিল। আমরা কুজকো শহরেও এমনি প্রকাণ্ড চৌকো পাথরের তৈরি প্রাচীন মন্দির প্রাসাদ ইত্যাদি দেখেছি, কিন্তু এমন খাড়া পাহাড়ের ওপর তাদের এই কীর্তি না দেখলে বিশ্বাসই হত না।

এক্সকিউজ মি।

মৃদু স্ত্রী-কণ্ঠ শুনে ফিরে দেখি এক প্রৌঢ়া মেমসাহেব। মাথায় পানামা হ্যাট, চোখে সানগ্লাস, হাতে একটি ক্যামেরা, পরনে সোয়েটার ও স্ন্যাকস। ভদ্রমহিলা হেসে বললেন, আপনারা কি এই সাইটটা নিয়ে আলোচনা করছেন?

আজ্ঞে হ্যাঁ। আমি জানাই। যদি দয়া করে ইংরেজিতে বলেন, আমিও শুনি। আমার পুরনো সভ্যতা সম্বন্ধে খুব আগ্রহ। আমার নাম মিসেস এমিলি জোন্স। বাড়ি ক্যালিফোর্নিয়া। আপনারা বোধহয় ভারতীয়?

ঠিক বলেছেন। আমি উত্তর দিলাম।

আমার সঙ্গে অনেক ভারতীয়ের চেনা আছে। একবার ইন্ডিয়া গিয়েছিলাম যে। মিসেস জোন্স উৎসাহিত হয়ে জানান।

বললাম, “আমরা ইংরেজিতেই আলোচনা করব। তাহলে আপনিও বুঝতে পারবেন। একটু গর্বের সঙ্গে সুনন্দর দিকে তাকালাম, যেন বোঝাবার দায়িত্বটা আমারই।

মিসেস জোন্স প্রশ্ন করলেন, আচ্ছা, এখানে থাকত কারা?

আমি উত্তর দিলাম, ইংকা রাজা ও রাজপরিবারের লোক, পুরোহিত এবং কিছু সৈন্য।

অ্যাঁ, তবে যে হোটেল ম্যানেজার আমায় বলল কুজকো ছিল ইংকাদের রাজধানী, মিসেস জোন্স সানগ্লাস খুলে আমায় কটমট করে দেখলেন। ভাবখানা যেন আমি ভুল বোঝাচ্ছি।

থতমত খেয়ে গেলাম। সুনন্দ মুখ লুকিয়ে হাসে। মামাবাবু উদ্ধার করলেন।–ম্যানেজার ঠিকই বলেছে। স্প্যানিয়ার্ডরা ষোলশো শতাব্দীতে পেরুর ইংকা সাম্রাজ্য এবং রাজধানী কুজকো অধিকার করে নেবার কিছু দিন পরে ইংকা রাজা মংকো সদলবলে পালিয়ে গিয়ে পাহাড়ের ওপর এই নগরে আশ্রয় নেয়। তারপর বলা যায় এটাই ছিল তাদের রাজধানী।

তারপর বুঝি স্প্যানিয়ার্ডরা মাচুপিচু দখল করে?

আজ্ঞে না। স্প্যানিয়ার্ডরা কোনোদিনই মাচুপিচুর সন্ধান পায়নি।

মিসেস জোন্স বললেন, তাহলে ইংকারা এখানে অনেক দিন রাজত্ব করেছিল বুঝি?

বেশি দিন নয়। মাত্র চল্লিশ বছর। ইংকারা মাঝে মাঝে পাহাড় থেকে নেমে এসে স্প্যানিয়ার্ডদের ওপর উৎপাত করত। শেষে একদল স্প্যানিয়ার্ড সৈন্য ইংকাদের দমন করতে পাহাড়ে চড়তে শুরু করল। তখন তরুণ টুপাক-আমারু ইংকাদের রাজা। সে ভয় পেয়ে মাচুপিচু ছেড়ে পাহাড়ের অন্য পাশে পালাতে চেষ্টা করে। স্প্যানিয়ার্ডরা তাদের তাড়া করল। ইংকারা পাহাড় থেকে নেমে বনের মধ্যে হাজির হল। সামনে আমাজনের অববাহিকার গভীর অরণ্য। রাজা আর এগোতে ভরসা পেল না। সন্ধি করার মতলবে সে স্প্যানিয়ার্ডদের হাতে ধরা দিল। কিন্তু স্প্যানিয়ার্ডরা তাদের কুজকোয় নিয়ে গিয়ে স্রেফ গর্দান নিল। ব্যস, ইংকা রাজবংশ ধ্বংস হল। স্প্যানিয়ার্ডরা পাহাড়ের ওপর কী আছে তা নিয়ে আর মাথা ঘামায়নি। ইংকাদের পবিত্র নগরী ভিলকাঁপাম্প বহুকালের জন্য হারিয়ে গেল।

আই সি! ভেরি ইন্টারেস্টিং। ভদ্রমহিলা মন্তব্য করলেন।

মিসেস জোন্স দেখেন, প্রশ্ন করেন, আর কেবল বলেন—’ভেরি ইন্টারেস্টিং!

আমি ও সুনন্দ বিরক্ত হচ্ছিলাম। ভদ্রমহিলা খুটখুট করে চলেছেন আর গুচ্ছের প্রশ্ন করে আমাদের সময় নষ্ট করছেন। আমি একটা মতলব আঁটলাম। বললাম, মামাবাবু, চলুন। ওই উঁচু পাঁচিলটার ওপর চড়ি। অনেক দূর দেখা যাবে।

মামাবাবু বুঝলেন। আমাদের দিকে আড়চোখে হেসে বললেন, বেশ চলো।

মিসেস জোন্স ঘাবড়ে গেলেন। এতটা বাড়াবাড়ি করার ইচ্ছে তার নেই। বললেন, অনেক ধন্যবাদ, এবার আমি বরং ফিরে গিয়ে রেস্ট নিই। অগত্যা তিনি ফিরে চললেন।

আর পরমুহূর্তেই পুরুষকণ্ঠে ইংরেজিতে কথা এল–যাক, মিসেস জোন্স-এর খপ্পর থেকে ছাড়া পেয়েছেন।

ফিরে দেখি এক শ্বেতাঙ্গ ভদ্রলোক। লালচে লম্বা চুল এবং প্রচুর দাড়ি-গোঁফের জঙ্গলে মুখ প্রায় ঢাকা। শুধু একজোড়া হাসিভরা ধূসর চোখ এবং তীক্ষ্ণ নাসিকা দেখা যাচ্ছে। উচ্চতা মাঝারি, তবে খুব জোয়ান বপু। বয়স মনে হল আমার চেয়ে কিছু বেশি। তার কাথে ঝলছে দুটো ক্যামেরা। লোকটি এগিয়ে এসে আমাদের সঙ্গে হ্যান্ডসেক করে বলল–আমার নাম টোনি মার্কো। পেশা ফোটোগ্রাফি। বাড়ি সুইজারল্যান্ড।

মামাবাবু পরিচয় দিলেন।–আমি নবগোপাল ঘোষ, এই হচ্ছে আমার ভাগনে সুপ বোস, আর এ সুনন্দের বন্ধু অসিত রায়। আমরা ভারতীয়। আমি লেকচার ট্যুরে এসেছি সাউথ আমেরিকায়। এরা দুজনও সঙ্গে এসেছে। কাজ শেষ, হাতে সময় আছে, তাই দ্রষ্টব্য জায়গাগুলো ঘুরে দেখছি। তা মিসেস জোন্স-এর সঙ্গে আপনার আলাপ আছে নাকি?

আছে। অতি সামান্য। আসার পথে উনি আমাকে মাচুপিচু সম্বন্ধে এমন নানা জেরা শুরু করলেন যে বাধ্য হয়ে আপনাদের দেখিয়ে দিলাম। বললাম–ওঁরা খুব ভালো জানেন এ-বিষয়ে। যাক, এখন মাপ চেয়ে নিচ্ছি। কেমন লাগছে মাচুপিচু? আমি এ-জায়গার বড় ভক্ত। যতবার এদিকে এসেছি জায়গাটি দেখে গেছি?

আমি বললাম, আপনি সাউথ আমেরিকায় আরও এসেছেন নাকি?

–হ্যাঁ । দুবার।

–ছবি তুলতে এসেছেন? সুনন্দ জানতে চাইল।

হ্যাঁ। আমাজনের অরণ্যে ঢুকব আদিম উপজাতিদের ছবি তুলতে। গতবারও গিয়েছিলাম এই ধরনের ছবি তুলতে, কিন্তু নানা ঝাটে তাড়াতাড়ি ফিরতে হল! তাই আবার এসেছি।

মার্কোর সঙ্গে মাচুপিচু ঘুরে ঘুরে দেখলাম। সূর্যমন্দির, রাজপ্রাসাদ, পূজাবেদি। মার্কো। ভারি আলাপী ও রসিক ব্যক্তি। জানলাম কুজকোয় আমরা যে হোটেলে উঠেছি মার্কোও। সেই হোটেলে আছে। আমরা একসঙ্গে ফিরলাম।

পরদিন সকালবেলা। হোটেলের ঘরে বসে কফি খাচ্ছি, এমন সময় মার্কো এসে জুটলেন, সঙ্গে তার তোলা ছবির অ্যালবাম।

অপূর্ব রঙিন ফোটোগুলি। জঙ্গল, পশু-পাখি এবং ইন্ডিয়ান উপজাতির ছবি। ক্রিস্টোফার কলম্বাস আমেরিকা আবিষ্কারের পর এদেশকে ভুল করে ইন্ডিয়া, মানে ভারতবর্ষ ভেবেছিলেন। তাই আজও এখানকার আদিবাসীদের লোকে সংক্ষেপে ইন্ডিয়ান বলে ডাকে।

কতরকম উপজাতি। বিচিত্র তাদের সাজপোশাক। ছবি দেখলে বোঝা যায় কী গভীর জঙ্গলে ঢুকেছিল মার্কো। মার্কো বলল, সেবার আমার সঙ্গে ছিল ভিক্টর। ভিক্টর। আমেরিকান ছাত্র। শখ করে আমার সঙ্গে অ্যাডভেঞ্চারে বেরিয়েছিল। এবার ভিক্টর আসতেন পারেনি।

তারপর হঠাৎ মার্কো বলল, আচ্ছা, প্রোফেসর ঘোষ আপনার সঙ্গে কি কেনিয়ার ডেয়ারিং বিল-এর পরিচয় আছে?

মামাবাবু অবাক হয়ে বলেন, আছে। কেন?

মার্কো খুশি হয়ে বলে, “ঠিক। কাল থেকে ভাবছি কোথায় যেন দেখেছি আপনাকে। বিলের কাছে আপনার ফোটো দেখেছি। গল্প শুনেছি। ওঃ, আপনি তো বিখ্যাত প্রাণিবিজ্ঞানী।

প্রশ্ন করলাম, আপনার সঙ্গে বিলের আলাপ হল কোথায়? আফ্রিকায়?

হুঁ। দুজনে যে অনেক শিকার করেছি।

আপনি শিকার করতেন?

করতাম বইকি! রীতিমতো প্রফেসনাল হান্টার ছিলাম। কিন্তু পরে হলাম ক্যামেরা হান্টার। প্রাণী হত্যা আর ভালো লাগল না। তার চেয়ে ফোটো তোলা অনেক ইন্টারেস্টিং। যথেষ্ট সাহসের কাজও বটে। কারণ দূর থেকে গুলি ছোঁড়া নয়। খুব কাছে যেতে হয় ক্যামেরা বাগিয়ে।

অ্যালবামের পাতা উলটিয়ে যাচ্ছি, হঠাৎ মামাবাবু একটা ছবির ওপর ঝুঁকে পড়ে মন দিয়ে দেখতে লাগলেন। তিনজন উপজাতীয় লোকের ছবি। একজনের পোশাক বড় মজার। সেই বোধহয় প্রধান। কারণ সে দাঁড়িয়ে আছে মাঝখানে। তার হাতে তিরধনুক, আর মুখে। একগাল হাসি। কোমরে হাতে-বোনা সুতির খাটো কাপড়। খালি গায়ে নানারকম নশা। কিন্তু সেই সঙ্গে আবার মাথায় একটি শোলার গোল টুপি এবং গলায় একখানা গিট দিয়ে বাঁধা নেকটাই। তার দুই সঙ্গীদের গায়ে অবশ্য কোনো আধুনিক সাজসজ্জা নেই।

মামাবাবু দেরাজ থেকে একটা ম্যাগনিফাইং গ্লাস বের করে কাঁচের মধ্যে দিয়ে ফোটোখানা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলেন। মার্কো হেসে বলল, “এখানকার গহন বনের অধিবাসীদের মধ্যে অনেক সময় এমনি অদ্ভুত পোশাক দেখা যায়। যারা এদের কাছে রবার বা পশুচর্ম কিনতে যায়, তাদের কাছ থেকে আদায় করে। কিংবা কোনো পর্যটকের কাছ। থেকে পায়। আমি দেখেছি স্রেফ নেংটির ওপর দামি একখানা টেরিলিনের শার্ট চড়িয়েছে কেউ কেউ।

মামাবাবু মুখ তুলে বললেন, এ ছবি কোথায় তুলেছেন?

আমি তুলিনি। তুলেছে ভিক্টর।

কোথায়?

হিথ নদীর তীরে। আমি কয়েকদিন পায়ের ব্যথায় কাবু হয়ে তাঁবুতে শুয়েছিলাম। ভিক্টর সেই সময় একা নৌকো নিয়ে অনেক ঘুরে আসে।

মাদ্রে দ্য দিওস নদীর সঙ্গম থেকে ও জায়গাটা কত দূর? মামাবাবু প্রশ্ন করলেন।

প্রায় একশো মাইল। এরা হিথ নদীর পাশেই থাকে। ইচোকাস ইন্ডিয়ান। এই লোকটা ওদের সর্দার।

আপনি কি ওই অঞ্চলে যাবেন এবার?

তাই তো ইচ্ছে আছে।

ছবি দেখা শেষ হল। মার্কো উঠল, ঘরে যাবে। মামাবাবু বললেন, মিঃ মার্কো, অরণ্য-যাত্রায় আমরা যদি আপনার সঙ্গী হই তাতে রাজি আছেন?

সে কি! মামাবাবুর এ আবার কী উদ্ভট খেয়াল! কী ভয়ঙ্কর জঙ্গল ছবিতে দেখেই বুঝেছি। সুনন্দর দিকে চাইলাম। সেও স্তম্ভিত। মার্কো আশ্চর্য হয়ে মামাবাবুর দিকে তাকিয়ে রইল।

মামাবাবু বললেন, “আমার খুব ইচ্ছে একবার আমাজনের অরণ্যে ঢুকব। ঠিক একা যেতে ভরসা হচ্ছিল না। অবশ্য আপনার যদি অসুবিধা না হয়।

মার্কো বলল, আমার আর কী অসুবিধা! একা যাচ্ছিলাম, আপনার মতো সঙ্গী পেলে সুবিধেই হবে। কিন্তু বড় কষ্টের জার্নি এবং খুব বিপজ্জনক বটে।

মামাবাবু হাসলেন। আমাজন অববাহিকার অরণ্য যে কী বস্তু আমি তা জানি মিঃ মার্কো।

মার্কো উৎফুল্লভাবে বলল, হা হা, বিলের কাছে আপনাদের অনেক অভিযানের গল্প শুনেছি। উত্তম। চলুন তবে। ভাবছিলাম একা একা একঘেয়ে লাগবে, ভগবান সঙ্গী জুটিয়ে দিলেন। আপনারা তৈরি হোন। তিন-চার দিনের মধ্যেই আমি যাত্রা করব।

মার্কো বিদায় নেবার সঙ্গে সঙ্গে আমি ও সুনন্দ উত্তেজিতভাবে চেঁচিয়ে উঠলাম– মামাবাবু, কী ব্যাপার?

মামাবাবু শান্ত কণ্ঠে বললেন–ব্যাপার আছে।

বলছি। বিছানার ওপর আরাম করে পা গুটিয়ে বসে মামাবাবু বললেন–ডক্টর সত্যনাথ সর্বজ্ঞর নাম শুনেছ?

বললাম, “শুনেছি। বিখ্যাত উদ্ভিদবিজ্ঞানী। বাঙালি। মাস আষ্টেক আগে পেরু না বলিভিয়ার জঙ্গলে অভিযানে গিয়ে নিখোঁজ হয়েছেন। কাগজে লিখেছিল, খুব সম্ভব জলে ডুবে মৃত্যু। কিন্তু মৃতদেহ পাওয়া যায়নি।

মামাবাবু বললেন, অনেক কিছুই পাওয়া যায়নি। রীতিমতো রহস্যময় এই অন্তর্ধান। নদীর তীরে তার তাঁবু এবং কয়েকটা আজেবাজে জিনিস পড়ে থাকতে দেখা যায়। কিন্তু তার গবেষণা-সংক্রান্ত কাগজপত্র, বাক্স-ভরা স্পেসিমেন-সংগ্রহ এবং আরও অনেক নিজস্ব জিনিসের কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি। ডক্টর সর্বজ্ঞ তখন একটি মাত্র উপজাতীয় লোক সঙ্গে করে পেরুর লা-মন্টানা অঞ্চলে আদিম উপজাতিদের গ্রামে গ্রামে ভেষজ উদ্ভিদের সন্ধান করছিলেন। লা-মন্টানা হচ্ছে আন্ডিজ পর্বতের পূর্বে আমাজন অববাহিকার অরণ্য যেখানে শুরু হয়েছে তার নাম। এই অঞ্চলে অজস্র নদী, পাহাড় এবং গভীর বনভমি। জগতের খুব কম লোকই সেখানে গিয়েছে। মন্টানার বেশিরভাগ অংশ আজও অজানা। ঘুরতে ঘুরতে বৈজ্ঞানিক হঠাৎ নিখোঁজ হন। তার সঙ্গের লোকটিরও পাত্তা পাওয়া যায়নি। সমস্ত ব্যাপারটাই ধোঁয়াটে।

ওঁর খোঁজ করা হয়েছিল ভালো করে? আমি জিজ্ঞেস করলাম।

পেরু সরকারের উদ্যোগে এক অনুসন্ধানী দল দুর্ঘটনার জায়গায় গিয়ে কিছু খোঁজাখুঁজি করে। তারপর রিপোর্ট দেয়, সম্ভবত নদীতে ডুবে মৃত্যু ঘটেছে। জিনিসপত্র ভেঙে গেছে। দেহ কুমিরে খেয়ে ফেলেছে।

অর্থাৎ তুমি সর্বজ্ঞর সন্ধানে আমাজনের বনে যেতে চাও? সুনন্দ গম্ভীর মুখে বলল।

হ্যাঁ।

কিন্তু সার্চ-পার্টি কোনো খোঁজ পায়নি, তুমি কি পাবে?

এতদিন সেই ভেবেই কিছু করিনি। বললেন মামাবাবু। কিন্তু ওই ফোটোটা দেখে আমার আশা জেগেছে।

কোন ফোটো?

যে ফোটোটায় দেখলে একজন জংলি ইন্ডিয়ান হ্যাট আর টাই পরে রয়েছে, ওইটে।

তার মানে?

মামাবাবু বলতে লাগলেন, অদ্ভুত লোক এই সত্যনাথ সর্বজ্ঞ। অতি প্রতিভাবান বৈজ্ঞানিক, কিন্তু একেবারে ভবঘুরে টাইপ। কোথাও স্থির হয়ে বেশিদিন বাস করা ওঁর ধাতে ছিল না। একা একা দেশে দেশে ঘুরে বেড়াতেন নতুন উদ্ভিদের খোঁজে। দুনিয়ায় তার একমাত্র বন্ধন একটিমাত্র মেয়ে রূপা। রূপা কলকাতায় থেকে কলেজে পড়ে। বেচারা খামখেয়ালি বাবার জন্য সর্বদাই উদ্বিগ্ন। সর্বজ্ঞ এর আগেও এক্সপিডিশনে গিয়ে ভীষণ বিপদে পড়েছেন। সাময়িকভাবে নিখোঁজ হয়েছেন কয়েকবার। তবে এবারে আট মাস হয়ে গেল। তবু রূপার ধারণা, ওর বাবা ঠিক বেঁচে আছেন। হয়তো কোথাও গিয়ে আটকে পড়েছেন, তাই ফিরে আসতে পারছেন না।

রূপা দেবীর সঙ্গে তোমার দেখা হয়েছিল বুঝি? সুনন্দ প্রশ্ন করল।

হয়েছিল। রূপা নিজেই এসেছিল আমার কাছে। সর্বজ্ঞর সঙ্গে আমার সামান্য আলাপ ছিল। সেই সূত্রে রূপাকেও চিনি। আমি এদেশে যাচ্ছি শুনে রূপা দেখা করতে আসে। আমাকে ভালো করে ওর বাবার খোঁজ করতে বলে। নিখোঁজ হবার কিছুদিন আগে ডক্টর সর্বজ্ঞ তার মেয়েকে একটা চিঠি লেখেন। তাতে আভাস দেন যে, তিনি শিগগিরি এক দুরূহ অভিযানে যাবেন কোনো এক গোপন জায়গায়। চিঠির ভাষা আমার মনে আছে–এক অজ্ঞাত জায়গায় আবিষ্কারের সন্ধানে যাচ্ছি। কিছুদিন আমার খবর না পেলে চিন্তা কোরো না। তাই রূপা আজও আশা ছাড়েনি।

কিন্তু ওই ফোটোতে আপনি কী কু পেলেন? আমি অধৈর্যভাবে জিজ্ঞেস করলাম। কু-টা হল, ওই হ্যাট এবং টাই। ওগুলো খুব সম্ভব ডক্টর সর্বজ্ঞর। খেয়ালি মানুষ ডক্টর সর্বজ্ঞর আর এক খেয়াল ছিল সর্বদা ওইরকম হ্যাট আর ওই রকম লালের ওপর নীল ডোরাকাটা টাই ব্যবহার করা। আমি রূপার কাছ থেকে ডঃ সর্বজ্ঞর একটা ফোটো এনেছি। সেটা তিনি মেয়েকে চিঠির সঙ্গে পাঠিয়েছিলেন। তাতেও ঠিক ওই রকম হ্যাট ও টাই পরা।

শুধু তাই না, আমি বলব, ঠিক ওই হ্যাটটাই তিনি পরে রয়েছেন। কারণ ফোটোতে ডক্টর সর্বজ্ঞর টুপির সামনের দিকে একটা খাঁজকাটা ভাঙা চিহ্ন রয়েছে। আমি মিলিয়ে দেখলাম সর্দারের টুপিতেও হুবহু ওই একই রকম খাঁজ রয়েছে। ওই টুপি আর টাই ইন্ডিয়ান সর্দার পেল কী করে, তাই আমি জানতে চাই।

খুব সোজা। সুনন্দ বলল। ডক্টর সর্বজ্ঞ সর্দারকে ওগুলো দিয়েছিলেন।

কিন্তু দেবে কীভাবে? সেটাই তো রহস্য। ডক্টর সর্বজ্ঞ যেখানে নিখোঁজ হন সেখান থেকে ওই সর্দারের বাস অন্তত ষাট-সত্তর মাইল দূরে।

সুনন্দ বলল, হতে পারে ডক্টর সর্বজ্ঞ নিরুদ্দেশ হবার আগে ওই জায়গায় গিয়েছিলেন। তখন সর্দার ওই হ্যাট আর টাই আদায় করে।

কিন্তু সেখানেও একটা প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে, মামাবাবু বলেন, কারণ ডক্টর সর্বজ্ঞ মেয়েকে তার শেষ চিঠিতে লেখেন–অনেক দিন কোনো ফোটো পাঠাইনি বলে রাগ করেছিস। কী করব, ছিল না যে! এবারে তাই পাঠালাম। দেখ তোর বাবা কেমন দারুণ। পোজ দিয়েছে। অর্থাৎ মনে হয় ফোটোটা তোলা হয়েছিল চিঠিটা লেখার অল্প দিন আগে। চিঠিতে পেরুতে এক ছোট্ট শহর পুয়ার্টো ম্যালভোনাডোর পোস্টমার্ক। ওই শহরে ডক্টর সর্বজ্ঞ তাঁর শেষযাত্রার আগে কয়েকদিন কাটিয়েছিলেন…যাহোক, ওই হ্যাট-পরা সর্দারের দেখা পেলে এসব ধাঁধা পরিষ্কার হবে। জানা যাবে, কবে এবং কীভাবে ও হ্যাট-টাই পেয়েছে। আর তারপর হয়তো জানব ডক্টর সর্বজ্ঞর ভাগ্যে কী ঘটেছে।

শেষ চেষ্টা করলাম, “আচ্ছা মামাবাবু, এই ফোটোর ক্লু যদি অনুসন্ধান কমিটিকে জানিয়ে দেন?

মাথা নাড়লেন মামাবাবু।–কোনো লাভ নেই। একজন বিদেশির জন্যে ওরা খুব গা দিয়ে খুঁজেছে বলে মনে হয় না। তাদের এ বিষয়ে প্রশ্ন করে দেখেছি। বিরক্ত হয়। তাদের ধারণা, বৈজ্ঞানিক সর্বজ্ঞ আমাজনের বনে একা একা যখন ঘুরতে গেছেন তখন এমন দুর্ঘটনা তো হতেই পারে। ওই সরকারি কর্মচারীদের মতে, ডক্টর সর্বজ্ঞ একজন ছিটগ্রস্ত ব্যক্তি। নিখোঁজ হয়ে তাদের অযথা হয়রানি করেছেন। আমার বিশ্বাস, ক্ল-টা পেলে ওরা তো কিছু চেষ্টা করবেই না, উল্টে আমরা ওখানে যেতে চাইলে ভাববে ওদের ওপর টেক্কা দিচ্ছি। ফলে তারা বাধাও দিতে পারে। তার চেয়ে না জানানোই ভালো। লোকে জানুক বেড়াতে যাচ্ছি, ছবি তুলতে যাচ্ছি। হ্যাঁ, মার্কোকেও আমাদের মতলব এখন না বলাই উচিত। কী জানি যদি বেঁকে বসে?