» » একচল্লিশ থেকে পঞ্চাশ পরিচ্ছেদ

বর্ণাকার

শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়

দূরবীন

সাতচল্লিশ

সকালবেলাতেই মামুদ সাহেব এসে হাজির। ছোটোখাটো মানুষ। মাকুন্দ। খুব ফটফটে সাদা পাজামা আর পানজাবি পরনে। মাথায় জালি কাজ করা ফেজ। গা থেকে মৃদু গোলাপী আতরের সুবাস ছড়াচ্ছে। মুখে একখানা লবঙ্গ। চোখের দৃষ্টিতে খর বুদ্ধির চিকিমিকি।

হেমকান্ত মামুদকে আবাল্য চেনেন। তাঁর সমবয়সী। স্কুলে এক ক্লাস উঁচুতে পড়ত। বরাবরই দারুণ ভাল ছাত্র। কলকাতা থেকে ডাক্তারি পাশ করে এসে কিছুকাল প্র্যাকটিস করার চেষ্টা করে। কিন্তু পসার তেমন হয়নি। গোঁড়া হিন্দু পরিবারে মুসলমান ডাক্তার কল পায় না। ফলে মামুদকে একটা সীমাবদ্ধ গণ্ডীর মধ্যে প্র্যাকটিস করতে হয়। হেমকান্ত শুনেছেন, মামুদ বিলেতে যাওয়ার চেষ্টা করেছিল। বড় ডাক্তার হয়ে এলে হয়তো পসার জমত। কিন্তু সেটাও হয়ে ওঠেনি টাকার। অভাবে।

অনেককাল মামুদের সঙ্গে দেখা হয়নি।

হেমকান্ত তাকে দেখে খুশি হয়ে বললেন, কেমন রে মামুদ, ভাল আছিস?

মামুদ বললেন, তুই কেমন?

বহুকাল তোর দেখা নেই। কী করছিস?

কী আর করব! হজটা সেরে এলাম।

হজ! সে তো মক্কায়! হেমকান্ত খুব বিস্মিত হয়ে চেয়ে থাকেন।

মামুদ সাহেব মৃদু হেসে বলেন, কাবা তো মক্কাতেই। সেটা কোন আহাম্মক না জানে?

অত দূরে গিয়েছিলি!

হ্যাঁ। এদিক ওদিক একটু ঘুরেও এলাম।

যাওয়ার আগে বলে যাসনি তো!

মেলা লোকের মেলা ফরমাস ছিল। মাথা গড়বড় হয়ে গিয়েছিল তখন। দেখা করার ফুরসৎ ছিল না।

হেমকান্ত একটা বিক্ষুব্ধ শ্বাস ছাড়লেন। মক্কা কতদূর! তিনি নিজে কখনো অত দূরে যাবেন না।

মামুদ সাহেব গলাটা সাফ করে নিলেন। তারপর বললেন, কাবুলে খুব গণ্ডগোল।

হেমকান্ত মাথা নাড়লেন। কাবুলের গণ্ডগোলের কথা তিনি জানেন। আর একটা বিশ্বযুদ্ধ লেগে যেতে পারে। তবে সম্ভাব্য বিশ্বযুদ্ধ তাঁকে উদ্বিগ্ন করে না। বাইরের বড় বড় ঘটনা তাঁকে স্পর্শ করে কমই। তিনি শুধু মুখে একটা দুশ্চিন্তার ভাব ফুটিয়ে তুলতে চেষ্টা করলেন। হেমকান্ত জিজ্ঞেস করলেন, মক্কায় কিসে গেলি? জাহাজে?

মামুদ সাহেব এইসব আহাম্মকী প্রশ্নে মৃদু হাসলেন। বললেন, জাহাজ ছাড়া আর কিসে? তবে কষ্ট হয়েছে খুব। বমিটমি করে একদম শয্যা নিতে হয়েছিল।

জাহাজ! হেমকান্তর মাঝে মাঝে জাহাজের কথা মনে হয়। স্টিমারে কয়েকবার চেপেছেন বটে, কিন্তু অকূল সমুদ্রে বিশাল জাহাজে নিরুদ্দেশযাত্রা খুবই অন্যরকম ব্যাপার। এই জীবনে জাহাজে চড়াও হল না হেমকান্তর।

হেমকান্ত নড়েচড়ে বসে বললেন, বল তোর মক্কার গল্প। শুনি।

মামুদ সাহেব পকেট থেকে একটা দস্তার কৌটো বের করে আর একটা লবঙ্গ মুখে ফেলে কৌটোটা বাড়িয়ে দিলেন হেমকান্তর দিকে, নিবি একটা?

হেমকান্ত নিলেন।

কৌটোটা পকেটে পুরে মামুদ সাহেব তাঁর ভ্রমণকাহিনী বলতে লাগলেন। কলকাতা হয়ে বোমবাই যাত্রা। তারপর জাহাজে। মক্কা ও মদিনার রুক্ষ ভূ-প্রকৃতি ও জলবায়ু। তীর্থযাত্রীদের জন্য ব্যবস্থা ইত্যাদি। মামুদ সাহেব কম কথার মানুষ, বিশেষ রসিক-প্রকৃতিরও নন। সেইজন্য মিনিট দশ পনেরোর মধ্যেই তাঁর ভ্রমণবৃত্তান্ত শেষ হয়ে গেল।

হেমকান্ত সব শুনেটুনে বললেন, তোর তো ধর্মে এত মতি ছিল না।

মামুদ সাহেব একটু সঙ্কুচিত হয়ে বললেন, হজটা সেরে রাখা নাকি ভাল, সবাই বলে।

আমাকেও তীর্থে যাওয়ার কথা বলে অনেকে।

মামুদ সাহেব হেসে বললেন, গেলেই পারিস। তোদের তো কষ্ট নেই, খরচও কম। গয়া কাশী বৃন্দাবন সবই ঘরের কাছে।

হেমকান্ত মাথা নেড়ে রসিকতা করে বললেন, অলস লোকদের কাছে এ ঘর থেকে ও ঘরটাও দূর বলে মনে হয়।

মামুদ সাহেব চুপ করে রইলেন।

হেমকান্ত কথা খুঁজে না পেয়ে প্রশ্ন করলেন, তোর প্র্যাকটিস কেমন?

কোথায় প্র্যাকটিস? হিন্দুরা তো আর ডাকবে না আমাকে। তা আমি এখন ডাক্তারি প্রায় ভুলেই যাচ্ছি।

মামুদের সমস্যা হেমকান্ত জানেন। কী বলবেন, চুপ করে রইলেন।

মামুদ সাহেব বললেন, হেমভাই, দিনকালটা বড় ভাল নয়। হিন্দু-মুসলমানে হুট বলতেই দাঙ্গা লেগে যাচ্ছে। বিহিত কিছু ভাবছো?

হেমকান্ত কাঁচুমাচু হয়ে পড়েন। বাস্তবিকই তিনি সমাজ-সংসারের তেমন খোঁজ রাখেন না। বললেন, আমি তো ভাই রাজনীতি করি না, কী ভাবব?

তোমাকেই ভাবতে হবে। রাজনীতি না কর, তোমার হাজারের ওপর মুসলমান প্রজা আছে। তাদের ভালমন্দ তুমি ছাড়া কে দেখবে?

ভালমন্দ দেখার জন্য লোক লস্কর পেয়াদা লাঠিয়াল লাগে। সেসব তো আমার নেই।

মামুদ সাহেব বললেন, আমি শুধু মুসলমানদের পক্ষ হয়ে বলতে আসিনি। হিন্দুদের হয়েও বলছি। দাঙ্গা লাগলে দু’পক্ষেরই নিরীহ লোকের বিপদ।

সে তো বুঝি। ভাবিও। কিন্তু কী করব বল।

সেটা বলতেই আসা। আমি হিন্দু মুসলমান সব বিশিষ্ট লোেককে নিয়ে একটা কমিটি করতে চাই।

কমিটি! তা বেশ তো, কর না।

ওভাবে বললে হবে না। কমিটি-টমিটি মেলা তৈরি হচ্ছে আজকাল। তাতে তেমন কাজ হয়। আমি ভাবছি যা যা করলে দাঙ্গা হবে না এই কমিটি তা তা করবে।

কিছু ভেবেছো?

ভেবেছি। মৌলবি লিয়াকত হোসেন কিছুদিন আগে খবরের কাগজে এক বিবৃতি দিয়ে মুসলমানদের গো-হত্যা বন্ধ রাখার অনুরোধ জানিয়েছিলেন। কিন্তু খবরের কাগজ আর কজন পড়ে বলো! তাই আমাদের কমিটির লোকেরা এসব কথা গ্রামে গ্রামে গিয়ে সকলকে বুঝিয়ে বলতে পারে। তাতে কাজ হবে। এরকম আরো অনেক কিছুই করা যায়। হিন্দুরাও করবে, মুসলমানরাও করবে। তাদের দিয়ে করাতে হবে।

হেমকান্ত অসহায়ভাবে বলেন, আমি যত মানুষকে রোজ দেখি তারা তো তেমন খারাপ লোক নয়! তবে দাঙ্গা খুনোখুনী কারা করে বল তো!

গেরস্থ সাধারণ মানুষেরা করে না। করে কিছু গুণ্ডা বদমাশ। তারা হিন্দু মুসলমান কিছু নয়। তাদের জাতই ওই। এদের ঠেকানোই বড় কাজ।

হেমকান্ত মাথা নেড়ে বলেন, শুধু এদের ঠেকালে হবে কেন। উসকে দিচ্ছে কারা তাও তো দেখতে হবে।

সে আমরা জানি। উসকে দেয় ইংরেজ, উসকে দেয় রাজনীতির লোকেরা। সে কথাটাই যদি মানুষকে বুঝিয়ে বলা যায় তাহলে কেমন হয়?

হেমকান্ত বললেন, ক’দিন আগেই বোমবাইয়ে কী কাণ্ড হয়ে গেল! আমার মনে হয় কমিটি করে এ জিনিস বন্ধ করা যাবে না।

তাহলে তুই কী করতে বলিস?

হেমকান্ত হাসলেন, আমার কি জানিস? আমার হল নেগেটিভ প্রমিনেন্ট। সর্বদা “হবে না” কথাটাই জপ করি। আমার কথা ছেড়ে দে। কমিটিই কর বরং।

মামুদ সাহেব হেসে বললেন, আমরা কমিটি করব আর তুমি আলগোছে বসে থাকবে তা হবে না।

আমাকে আবার কেন?

তোমাকে প্রেসিডেন্ট করা হবে।

ও বাবা।

মামুদ সাহেব গভীর ও আন্তরিক গলায় বললেন, আমি তোমাকে জানি হেম। তুমি সব কিছু থেকে দূরে থাকতে চাও। কিন্তু কত আর দূরে থাকবে বলো। ঘরের কাছে আগুন লাগলে মানুষ কি আর বসে থাকতে পারে। দেখছিস না, দেশে যে-কোনরকম গণ্ডগোল লাগলেই সেটা গিয়ে হিন্দু-মুসলমানের দাঙ্গায় দাঁড়ায়। বোমবাইয়ে কী হয়েছিল মনে নেই? কাপড়কলে শ্রমিকরা ধর্মঘট করেছিল। ধর্মঘটের বিরুদ্ধেও ছিল কিছু লোক। কপাল এমন যে, ধর্মঘটীরা হিন্দু আর বিরোধীরা মুসলমান। ফলং রায়ট। দুমদাম কিছু লোক মরে গেল। এরকমটা এদিকেও হতে পারে।

হেমকান্ত খুব বেশী খবর রাখেন না। বললেন, তা তো পারেই। হয়েছেও।

হয়েছে সে জানি। কিন্তু আর হতে দিতে চাই না। পানজাবের এক গবরনর ছিল মাইকেল ও’ডায়ার। সে বিলেতের এক কাগজে লিখেছে, ১৯১৯ সালের সেই রাউলাট আইনের বিরুদ্ধতা থেকেই এসব দাঙ্গাহাঙ্গামার শুরু। আরো বলেছে এসবের পিছনে জারমানির উস্কানি আছে। কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট মতিলাল নেহরু আর সেকরেটারি জহরলাল নেহরু নাকি রীতিমত জারমানির সঙ্গে ফন্দি আঁটছেন। ১৯৩২ সালে রাশিয়া নাকি ব্রিটিশের বিরুদ্ধে লড়াইতে নামবে, আর তখন ভারতেও বিদ্রোহ ঘটবে। এই বিদ্রোহ ঘটানোর জন্য বলশেভিকরা কংগ্রেসের মাধ্যমে বাঙালী আর মাদ্রাজী ছেলেদের তৈরি করছে। জানিস এতসব কথা?

না। এসব কি খবরের কাগজে বেরিয়েছে?

হ্যাঁ, তবে খবরের কাগজে খবরটাকে বেশী পাত্তা দেয়নি। তারা না দিক আমি দিই। ও’ডায়ারের ওসব কথা বিশ্বাস করার মতো লোকও কিন্তু অনেক আছে।

তা অবশ্য আছে।

আমাদের কাজ হবে এই ভুল ধারণাগুলোকে ভেঙে দেওয়া। মহাত্মাজী তাঁর আন্দোলন করছেন করুন, নেতারা স্বরাজ আনুন, কিন্তু হিন্দু-মুসলমানের ব্যাপারটা আমাদের ঘাড়ের ওপর এসে পড়েছে। এটাকে এক্ষুনি ফাইট-টাইট করা দরকার।

হেমকান্ত করুণ নয়নে মামুদের দিকে চেয়ে বললেন, তা বেশ ভারী কাউকে প্রেসিডেন্ট করলে হয় না?

হয়। কিন্তু আমি তোকে দিয়ে একটু কাজ করাতে চাই।

আমি কি কাজের লোক?

না। সেইজন্যই তোকে কাজের লোক করে তুলতে চাই।

মামুদ সাহেব উঠলেন। পকেট থেকে কৌটো বের করে একটা লবঙ্গ মুখে ফেলে বললেন, বাগদাদে কিনেছিলাম। ভারী সস্তা। নিবি?

হেমকান্ত মাথা নাড়লেন, না। লবঙ্গ কে খাবে?

তাহলে আসি।

মামুদ সাহেব চলে যাওয়ার পর বেশ অস্বস্তি বোধ করতে লাগলেন হেমকান্ত। হিন্দু-মুসলমানে দাঙ্গা এ দেশের কালব্যাধি হয়ে দাঁড়িয়েছে। রক্তপাত হেমকান্ত একদম সইতে পারেন না। তাই খবরের কাগজে এসব ঘটনা তিনি ভাল করে পড়েনও না। তবু এই যে মামুদ এসে তাঁকে একটা কমিটির সঙ্গে জড়িয়ে দিয়ে গেল এতে কাজটা ভাল হল না মন্দ হল তা তিনি বুঝতে পারছেন না।

সমস্যা তার একরকম নয়। একটা বিষাক্ত সন্দেহ ইতিমধ্যেই তার ভিতরে সঞ্চার করেছে মনু। কী করবেন তা বুঝতে পারছেন না।

হেমকান্ত ঝুম হয়ে বসে রইলেন।

বিকেলে শচীন কখন কাছারিঘরে আসে তা আজকাল লক্ষ রাখে বিশাখা। ছাদটা আজকাল চপলার দখলে। তাই সে ছাদে ওঠে না। বাইরের দিককার দোতলা একটা ঘরের জানালা একা, ফাঁক করে দেখে।

শচীন সাইকেলটা বারান্দার গায়ে ঠেস দিয়ে রেখে ভিতরে ঢোকে। ঢোকবার আগে একবার ছাদের দিকে তাকায়। মুচকি একটু হাসে। ওই হাসিটাই গায়ে জ্বালা ধরিয়ে দেয় বিশাখার। কাকে দেখে শচীন হাসে এবং কেন হাসে তা সে জানে।

চপলার সঙ্গে আজকাল সে প্রয়োজন ছাড়া কথা বলে না। মুখ দেখাদেখিও প্রায় বন্ধ। কৃষ্ণকেও বউদির সঙ্গে মেলামেশা করতে বারণ করেছে সে। কিন্তু বোকা এবং জেদী কৃষ্ণকান্ত কারো কথা শোনার পাত্রই নয়।

একা একা জ্বলে মরছে বিশাখা।

আজ বিকেলে সে আর পারল না। চিকন নামে একটা নতুন বাচ্চা ঝি বহাল হয়েছে সবে। চালাকচতুর। তাকে ডেকে একটা চিঠি পাঠাল শচীনকে। লিখল, কাছারির পিছনের বাগানে একবার আসবেন এক্ষুনি? বড় দরকার।

বিকেলের আলো আজকাল সহজে মরতে চায় না বলে বিশাখা চিঠিটা পাঠাল সন্ধের মুখটায়। আলো-আঁধারি ভাবটা যখন ঘনিয়ে এসেছে, শঙ্খে ফুঁ পড়েছে, জ্বলে উঠছে দু-একটা ঘরের আলো, ঠিক তখন।

একটু সাজল বিশাখা। বেশী নয়। চোখের নীচে কাজল টানল। তারপর চুপিসাড়ে নেমে এল সিঁড়ি দিয়ে।

কুঞ্জবনটা হেমকান্তর সম্পত্তি। তবে সব দিন তিনি থাকেন না। আজকাল অনেক বিকেল তিনি ঘরে বসেই কাটিয়ে দেন। কখনো বা বড় বউমার তাগাদায় গাড়ি নিয়ে হাওয়া খেতে বেরোন। আজও তাঁকে ঘোড়ার গাড়িতে বেরিয়ে যেতে দেখেছে বিশাখা।

সেদিন যেখানে বসেছিল, সেই ভাঙা গাড়ির পাদানীতে আজও এসে বসল বিশাখা।।

বেশীক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না। কাছারিঘর থেকে বেরিয়ে দীর্ঘকায় শচীন লতাপাতায় আচ্ছন্ন শুড়িপথটা দিয়ে মাথা নীচু করে এসে কুঞ্জবনে ঢুকল।

বিশাখার বুক কাঁপছিল। আগেরবার তার সঙ্গে শচীনের সাক্ষাৎকার ঘটিয়েছিল চপলা। তার নিজের কোনো দায় ছিল না। কিন্তু এবার শচীনকে ডেকেছে সে নিজেই।

শচীনের হাবভাবে লজ্জা সংকোচের বালাই নেই। সামনে এসে বুঝিবা একটু ভ্রূ কুঁচকেই দেখল তাকে। বিশাখা মাথা নত করে উঠে দাঁড়াল।

শচীন বলল, তুমি ডেকেছো? কী ব্যাপার?

বিশাখা কিছু ভেবে আসেনি। কী যে বলবে তা তার মাথায় আসছিল না। পায়ের আঙুলে মাটি খুঁটতে খুঁটতে সে বলল, আমার কয়েকটা কথা ছিল।

বলো।

আপনি রাগ করবেন না?

তুমি তো অনেক কথাই আড়ালে বলেছো। তাতে কি আর তেমন রাগ করেছি? আজ কী বলবে?

আমার দোষ হয়েছে।

কিসের দোষ?

ওসব কথা বলা ঠিক হয়নি সুফলাকে।

যা বলেছে তা আমি মনে রাখিনি। কিন্তু তোমার মনোভাবটা ভাল নয়। ওরকম মন থাকলে জীবনে সুখী হওয়া মুশকিল।

আমি শুনেছি আপনার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে!

তা একরকম বলতে পারো। কেন বলো তো!

আমি বলছিলাম কি… বিশাখা থেমে যায়।

বলো না, লজ্জা কিসের?

আমি বলছিলাম, বউদি খুব ভাল লোক নয়।

কোন বউদি? চপলা?

বিশাখা এবার তীক্ষ্ণ একটা কটাক্ষে এক পলক দেখে নিল শচীনের মুখ। কিছু বুঝতে পারল না। বলল, হ্যাঁ। বউদি আমার নামে হয়তো আপনার কাছে অনেক কিছু বলেছে।

কী বলেছে?

জানি না। কিন্তু বউদির ওরকম স্বভাব।

তোমার বউদির সঙ্গে আমার তোমাকে নিয়ে তেমন কথা হয়নি।

তাহলে কী নিয়ে আপনাদের কথা হয়?

কেন, জেনে কী করবে?

বলুন না।

অনেক কিছু নিয়ে। সে সব তুমি বুঝবে না।

বউদি কলকাতায় গেল না কেন জানেন?

জানি।

কেন বলুন তো!

শচীন একটু অস্বস্তি বোধ করল নাকি! খানিকটা সময় নিয়ে বলল, জেরা করছ?

না! জেরা করব কেন?

তোমার বউদি কেন যায় নি সেটা তোমাদেরই ভাল জানার কথা।

বউদি লোককে যা বলছে তা নয়।

কী বলছে?

বলছে এখানকার স্বাস্থ্য ভাল, হাওয়া ভাল। একদম বাজে কথা।

তবে আসল কথাটা কী?

বউদি যাচ্ছে না আপনার জন্য।

আমার জন্য? শচীন যেন একটু উদ্বিগ্ন গলায় বলে, আমার জন্য উনি কলকাতায় যাবেন না কেন?

সেই কথা বলার জন্যই আমি আপনাকে ডেকেছি।

কথা না হেঁয়ালি! এ সব কী বলছ?

ঠিকই বলছি। আপনি তো পুরুষ মানুষ। তার ওপর কাজের লোক। সব কিছু বোঝেন না।

ঠিক আছে। তুমিই বোঝাও।

বউদি ভাল মেয়ে নয়। ওর বাপের বাড়ির সবাই ভীষণ সাহেব। ওরা কোনো নিয়মকানুন মানে।।

তা জেনে আমার কী হবে?

ওর সঙ্গে আপনি একটু সাবধানে মিশবেন।

শচীন একটু হাসল। তারপর বলল, সাবধানে না মিশলে কী পরিণাম হতে পারে বলো তো!

বিশাখা আবার নতমুখী হয়। খুব দ্রুত ভাববার চেষ্টা করে সে। আর যত ভাবে ততই তার মাথা গুলিয়ে যায়।

খুব মৃদুস্বরে বিশাখা বলে, আপনি কি জানেন না?

কী জানব বিশাখা?

বিশাখার বুক কাঁপল। সে লড়াইটা হেরে যাচ্ছে।

শচীন হঠাৎ গলাটা খুব নামিয়ে বলল, তুমি কি চপলাকে সন্দেহ কর? করলেও লাভ নেই।

ও কথা কেন বলছেন?

চপলাকে নিয়ে যদি আমি পালিয়ে যাই তোমরা কেউ কিছু করতে পারবে না। পারবে?

পালাবেন?

সে কথা বলিনি। যদির কথা বলছি। তুমি কথাটা তোমার বাবাকেও বলতে পারো।

বাবাকে? বিশাখা কেমন দিশাহারা হয়ে গেল। শচীন যে তার মনের একটুখানি সন্দেহের এত স্পষ্ট জবাব দেবে তা সে স্বপ্নেও ভাবেনি।

শচীন মৃদু একটু হেসে বলল, তোমাদের পরিবারে কত কী ঘটে বিশাখা। বড় বড় বাড়ির বড় বড় কেচ্ছা। সে সব যদি ভাবো তাহলে দেখবে আমরা কিছুই পাপ-টাপ করছি না। তোমার বউদি চালাক চতুর মেয়ে, লেখাপড়া জানে, কলকাতায় থাকে, ওঁর সঙ্গে কথা বলে আরাম পাই। তার বেশী কিছু না। আর সব মেয়েই কি আর সস্তা হয়? যাও, বাড়ি গিয়ে মাথায় জল ঢেলে মাথাটা ঠাণ্ডা করো। এ সব ভেবো না।

শচীন যেমন এসেছিল তেমনি চলে গেল হঠাৎ।

বিশাখা খানিকক্ষণ থম ধরে বসে রইল। তারপর স্বাভাবিক নারীধর্ম অনুসারে হাতে মুখ ঢেকে কাঁদতে লাগল।

শচীন আজ আর কাজে মন দিতে পারল না। উঠে পড়ল তাড়াতাড়ি। সাইকেলটা আস্তে চালিয়ে বারবাড়ি পার হয়ে ব্রহ্মপুত্রের ধার ঘেঁষে যেতে যেতে তার মনে হল, সে চমৎকারভাবে একটা পরিস্থিতি আজ সামাল দিয়েছে। কিন্তু শেষ অবধি পারবে কি?

চপলা, চপলা যে তার ধ্যান জ্ঞান!