» » একচল্লিশ থেকে পঞ্চাশ পরিচ্ছেদ

বর্ণাকার

শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়

দূরবীন

চৌচল্লিশ

সেই একটা দিন কেটেছিল বটে রাজার সঙ্গে। কারণ তাদের কোনো উদ্দেশ্য ছিল না, লক্ষ্য ছিল না। ধ্রুবর খোঁজে তারা বেরিয়েছিল বটে, কিন্তু রাজা স্বীকার করে নিল, সে ধ্রুবর খোঁজ জানে না।

তাহলে?

তাহলে কী? রাজা বুক চিতিয়ে বলে।

আমাকে নিয়ে এলে কেন?

ওই রাক্ষসপুরীর অন্ধকারে দিনরাত মুখ গুজে পড়ে থাকো। তোমার জন্য কষ্ট হচ্ছিল।

রাক্ষসপুরী! রেমি ভ্রূ কুঁচকে বলল, রাক্ষসপুরী বলছ কেন?

আহা, কথাটা অত শব্দার্থে ধরছ কেন? বাড়িটাকে মোটেই রাক্ষসপুরীর মতো দেখায় না। যথেষ্ট আলোবাতাস খেলে। কলকাতার হালের বাজারদরে এ বাড়ির দাম লাখ সাতেক হলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই। সেই হিসেবে বলিনি। কিন্তু ওবাড়ি তোমার সব সত্তাটাকে গিলে বসে আছে। বাইরে বেরোও না, ঘোরো না, মুখ শুকনো করে থাকো, আড়ালে হয়তো কাঁদোও। কে জানে।

মোটেই মুখ শুকনো করে থাকি না। আর কান্না অত সস্তা নয়।

মেয়ে হয়ে জন্মেছো, আর কাঁদো না, একথা বিশ্বাস করতে বললো?

আমি সহজে কাঁদি না। রাক্ষসপুরী বলতে কী মীন করছে বলো তো! শ্বশুরমশাইকে ঠেস দিয়ে বলছ না তো!

রাজা শুনে খুব হোঃ হোঃ করে হাসল, তারপর বলল, ওঁর স্বভাব খানিকটা রাবণের মতোই বটে। দাম্ভিক, আত্মকেন্দ্রিক, ক্ষমতালোভী। তার ওপর রাবণের যেরকম স্বজনপ্রীতি ছিল কৃষ্ণকান্ত চৌধুরির স্বজনপ্রীতিও সেরকমই। খুব মিল আছে।

রেমি একটু বিরক্ত হয়ে বলল, তোমরা সবাই ওঁর এত নিন্দে কেন করো তা জানি না, তবে এটুকু জেনো ওই রাক্ষসপুরীতে যে আজও আমি আছি তা তোমাদের কুট্টিদার জন্য নয়, ওঁর জনাই।

রাজা মৃদু মৃদু হাসছিলই। বলল, রেগে যাচ্ছো কেন। রাবণের যেমন বিস্তর গুড সাইড ছিল ওঁরও তেমনি বিস্তর প্লাস পয়েন্ট আছে। সেগুলো তো বলিনি।

থাক, আর বলতে হবে না। তোমাদের চেয়ে ওঁর প্লাস পয়েন্টগুলো আমি অনেক বেশী জানি। ওঁর সম্পর্কে এইসব অপপ্রচার কে করেছে বলো তো? তোমার কুট্টিদা নাকি?

রাজা মাথা নেড়ে বলে, না বউদি, আমরা অর্থাৎ কৃষ্ণকান্তর আত্মীয়রা প্রায় সকলেই ওঁর গভীর প্রভাবে মানুষ হয়েছি। জন্ম থেকেই আমাদের শেখানো হয়েছে যে, ওই কৃষ্ণকান্তর ইচ্ছার বিরুদ্ধে চলা যাবে না। কে কোথায় মেয়ের বিয়ে দেবে, কে কার ছেলের পৈতে কোন বয়সে দেবে, কে কোথায় জমি কিনবে সবই ওঁর অনুমোদনসাপেক্ষ। এখন অবধি বড় একটা কেউ ওঁর বিরুদ্ধে চলেনি। তবে এও ঠিক লোকটি অসম্ভব ক্ল্যানিস। গোষ্ঠীপ্রবণ যাকে বলা যায় আর কি। আর সেই কারণেই ওঁর নিজের জন কেউ বিপদে পড়লে উনি সঙ্গে সঙ্গে মুশকিল-আসান হয়ে হাজির হন।

তবে ওঁর নিন্দে করো কেন?

রাজা মাথা নেড়ে বলল, তুমি ঠিক বুঝবে না। বিরল সৌভাগ্যবতীদের মধ্যে তুমি একজন যার সঙ্গে কৃষ্ণকান্ত চৌধুরির ক্ল্যাশ নেই। নইলে চৌধুরি বংশে এবং লতায়-পাতায় আত্মীয়দের মধ্যেও এমন লোক কমই আছে যে ওঁকে যমের মতো ভয় খায় না। সেটা উনি মন্ত্রী বলে নয়। এমনিতেই। আমরা আজ অবধি ওঁর ভয়ে প্রাণ খুলে প্রেম করতে পারি না, তা জানো? বংশে গোত্রে বর্ণে মিল না হলে বিয়ে উনি আটকে দেবেন। তার পরেও যদি সাহস করে এগোয় বা বিয়েটা করেই ফেলে তাহলে তাকে ভিটেমাটি ছাড়া করে ছাড়বেন।

এরকম হয়েছে নাকি?

বিস্তর। রিসেন্টলি কমলদা ওরকম একটা বিয়ে করতে চেয়েছিল, সে ঘটনা শোননি!

না তো! কমলদা কে? সেই হুগলি মহসিন কলেজের প্রফেসর? চশমা চোখে, মিষ্টি-মিষ্টি দেখতে?

সেই। একজন ছাত্রীর সঙ্গে লটঘট হয়েছিল। একে ছাত্রী তার ওপর বর্ণ আলাদা। কৃষ্ণকান্ত কমলদাকে ডাকিয়ে এনে এমন যাচ্ছেতাই অপমান করলেন বলার নয়।

বিয়েটা হয়েছিল?

পাগল! কমলদা সাহস করলেও পাত্রীপক্ষ এগোয়নি ভয়ে। পাত্রীকে তার বাবা ভয়ের চোটে বিহারে পার করে দেয়। কমলদা চাকরি ছেড়ে কিছুদিন পাগলের মতো ঘুরে বেড়াল। এখন আবার শুনছি একটা ইংরিজি খবরের কাগজে কলাম লিখছে। তাতে খুব ঝেড়েছে তোমার শ্বশুরকে। প্রবন্ধটার নাম বোধহয় কাস্ট-ইজম অ্যান্ড ডাওরি সিসটেম। বর্ণবিদ্বেষের ফলে বিয়েতে পণপ্রথা বৃদ্ধি পাচ্ছে, এরকমই একটা মত প্রচার করেছে সে। আমাদের বংশ এবং ঝড়ে মুষ্টিমেয় কয়েকজন বিদ্রোহীদের মধ্যে কমলদা একজন।

আর তোমার কুটিদা?

সেও একজন। কিন্তু তার বিদ্রোহটা এখন আত্মনিপীড়নে দাঁড়িয়ে গেছে।

সেটা কেমন?

তুমি তার বউ, টের পাও না?

না তোমার ধ্রুবদাকে আমি ঠিক বুঝি না।

রাজা একটু হাসল আবার। মাথা নেড়ে বলল, আমিও বুঝি না। শুধু জানি, ধ্রুবদা হ্যাভ বিন এ ব্রাইট বয়। ঠিক পথে থাকলে আজ ওকে ঠেকানোর কেউ ছিল না। কিন্তু ধ্রুবদা ট্র্যাকে থাকতে পারছে না। নিজের বাবাকে জব্দ করতে গিয়ে নিজেই জব্দ হচ্ছে বেশী। আসলে ধ্রুবদার পথটাই ভুল।

ভীষণ ভুল। ওকে তোমরা বোঝাতে পারো না?

রাজা হঠাৎ প্রসঙ্গটা ঝেড়ে ফেলে বলল, কোথায় তোমাকে নিয়ে যাচ্ছি জানো?

না তো! মিথ্যে কথা বলে তো ঘরের বার করেছে, এবার কী করবে?

একটা নাটক দেখাতে নিয়ে যাবো।

নাটক! ওসব আমার এখন ভাল লাগে না।

সে জানি। তোমার জীবনেই নানারকম নাটক ঘটে যাচ্ছে। স্টেজের নাটক তো তার কাছে নস্যি। তবে এ নাটকটার আলাদা একটা চার্ম আছে। আমি এটার মিউজিক করেছি।

মিউজিক করেছো মানে? তুমিই কি মিউজিক ডিরেকটর নাকি?

লাজুক মুখে রাজা বলে, ওরকমই।

তাহলেই হয়েছে।

কেন, আমি কি খারাপ মিউজিক করি? দুটো সিনেমায় মিউজিক করছি তা জানো?

শুনেছি। বাংলা সিনেমা এত ফ্লপ করে কেন তা তো বোঝাই যাচ্ছে।

বাজে বোকো না। ঘরের কোণে মুখ গুঁজে একাকিনী শোকাকুলা রাঘব-রমণী হয়ে পড়ে থাকো, কালচারাল ফিলডের খবর জানবে কী করে?

জানার দরকার নেই। আমি নাটক দেখব না।

প্লীজ বউদি।

আমার ভাল লাগছে না। তুমি মিথ্যে কথা বলে আমাকে যন্ত্রণা দিলে কেন বলল তো! তোমার কুটিদার সত্যি কোনো খবর রাখো না?

রাজা গম্ভীর হয়ে বলল, দুঃখিত বউদি। কী বললে যে তুমি বাড়ির বাইরে বেরোতে উৎসাহ পাবে তা বুঝতে পারছিলাম না। তবে কুটিদার খবর রাখি না, এটাও সত্যি কথা নয়।

রাখো তাহলে! বলছ না কেন?

সত্যিই শুনতে চাও?

চাই। কেন চাইব না?

একটু আগে কিন্তু উৎসাহ দেখাওনি।

এখন দেখাচ্ছি। শত হলেও সে আমার স্বামী।

ঠিক আছে। কুট্টিদা তিন দিন আগে আমাদের বাড়িতে এসেছিল। একরাত্রি ছিল।

এখন নেই?

না পরদিনই চলে গেছে। তবে কলকাতাতেই আছে এবং যতদূর জানি অফিসও করছে। আমাদের কী বলে গেছে জানো?

কী করে জানব?

বলে গেছে পুলিশের ভয়ে বাড়ি আসতে পারছে না।

বাজে কথা।

কৃষ্ণকান্ত চৌধুরি নাকি পুলিশকে অ্যালার্ট রেখেছেন, বাড়ি ফিরলেই কুট্টিদাকে অ্যারেস্ট করা হবে।।

মোটেই নয়।

হলেও কুট্টিদা ভয় খাওয়ার ছেলে নয়। ইন ফ্যাকট পুলিশের অনেক বড়কর্তা কুট্টিদার হাতের মুঠোয়।

তবে আসছে না কেন?

জানোই তো কুট্টিদা কীরকম। ওর লাইন অফ কনফ্রনটেশন একটু আলাদা ধরনের। নিজের বাপের বিরুদ্ধে সে একটা সাইকোলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার চালাচ্ছে। ফেরার হয়ে থাকলে নাকি মন্তীমশাইয়ের বেইজ্জতি হবে।

কোথায় আছে জানো না?

না। জানব কী করে?

জানো। বলবে না।

রাজা ঠোঁট একটু চেপে কী একটু ভেবে বলল, ধরো তাই।

ওর কি ধারণা খবর পেলেই আমি সেখানে গিয়ে ওকে ধরে আনব?

না। ওর ধারণা তুমি জানলে তোমার শ্বশুরও জেনে যাবেন।

কেন, আমি জানলে উনি জানবেন কেন?

তুমি নাকি শ্বশুরমশাইয়ের কাছে কিছুই গোপন রাখতে পারো না!

ভুল ধারণা। শ্বশুরমশাইয়ের কাছে ওর সম্পর্কে অনেক কথাই আমাকে গোপন রাখতে হয়।

সে আমি জানি না।।

জানো না তো বেশ বোলো না। তবে তোমার কুট্টিদা তো অফিসও করছে। আমি যদি সে খবরটা শ্বশুরমশাইকে দিই!

সেটা তুমি দেবে না, কুট্টিদা জানে।

কেন, এ খবরটা দেবো না কেন?

পুলিশ গিয়ে অফিসে হামলা করলে তোমার বরের চাকরি যাবে।

ওর আবার চাকরি। বছরে দুটো করে ছাড়ছে, দুটো করে পাচ্ছে। আর একটা কথা তোমার কুট্টিদাকে বোলো। যদি শ্বশুরমশাইকে অপমানই করতে চায় তবে ফেরার না থেকে পুলিশে সারেণ্ডার করলেই বরং শ্বশুরমশাইয়ের বেশী অপমান হবে।

কুট্টিদা অ্যারেস্টেড হলে তোমার শ্বশুরমশাইয়ের বিরুদ্ধে লড়াইটা চালাবে কী করে? তাই—

উঃ কী যে পাগল না তোমরা! সবাই পাগল। বাপের ওপর ছেলের এত আক্রোশ থাকতে পারে তা আমার কল্পনাতেও ছিল না।

তুমি তো ফ্যামিলির ইতিহাস জানোই বউদি। কী আর বলব! কুট্টিদা পাগল হলেও ন্যাচারাল পাগল নয়। পরিস্থিতির চাপে ডিসব্যাল্যানসড।

ওসব বাজে কথা। বানানো সমস্যা নিয়ে একটা ভড়ং করে যাচ্ছে।

আচ্ছা, প্রসঙ্গটা আজ থাক। তোমাকে একটু আনন্দ দেওয়ার জন্য আজ বের করে এনেছি।

হঠাৎ আমাকে আনন্দ দেওয়ার কথাই বা তোমার মনে হল কেন?

আমরা যে সবসময়ে তোমার কথা বলাবলি করি।

আমার কথা! আমি এমন একটা কে যে আমার কথা ভাবো তোমরা!

আমাদের পুরো বংশ এবং বাড়ি যেখানে যারা আছে সবাই তোমার জন্য খুব উদ্বিগ্ন। আমরা কুট্টিদা আর তার বাবার মধ্যে কনফ্রনটেশনটার কথা জানি। মাঝখানে কেচিকলে পড়ে তোমার অবস্থাটা কীরকম তাও অনুমান করতে পারি। সবাই বলে তুমি খুব ভালমানুষ টাইপের। আর সেজন্য সাফারও করছ।

কথাটা ঠিক নয় রাজা। আমি কষ্ট পাচ্ছি না। আমার মন শক্ত হয়ে গেছে।

রাজা মাথা নেড়ে বলে, সেটাও স্বাভাবিক। তোমার বাপের বাড়ির থেকে আমরা খবর পেয়েছি, কুট্টিদার সঙ্গে তোমার বিয়েটা ভেঙে দেওয়ার কথাও ওঁরা ভাবছেন।

রেমি বুকটা হঠাৎ ভারী ঠেকল। ধীরে ধীরে তারা হাজরা অবধি হেঁটে এসে উত্তরদিকে আরও এগিয়ে যাচ্ছিল। রাজা ট্যাকসি নেয়নি, রেমি ট্রামে উঠতে রাজি হয়নি।

চলো বউদি, ট্যাকসিই ধরি। তুমি বড় একগুঁয়ে।

কেন, আমার তো হাঁটতে বেশ লাগছে।

সেটা তোমার লাগছে। আমার লাগছে না। তোমাকে নিয়ে গিয়ে কলকাতা শহরটা একটু ঘুরে দেখাই চলো। তারপর সন্ধে সাড়ে ছটায় নাটক।

নাটকটা কি দেখতেই হবে?

তোমার ভাল লাগবে, দেখো।

কী করে বুঝলে যে ভাল লাগবে।

লাগবে। আমার কথা শুনেই দেখ না একদিন।

নাটক দেখা বা রেস্টুরেন্টে খাওয়া এগুলো আমার কাছে কোনো এনটারটেনমেন্ট নয়। আমার ভাল লাগে না।

তাহলে কী করবে?

আমাকে একবার ওর অফিসে নিয়ে যাবে?

ও বাবা!

কেন, ওবাবা কেন?

পারব না বউদি। কুট্টিদা মেরে ফেলবে।

তুমি কি ওকে ভয় পাও? ভীষণ।

কেন বলো তো! ওর মধ্যে ভয় পাওয়ার মতো কী আছে?

কুট্টিদা কতটা ভয়ংকর হতে পারে তুমি জানো না। এমনিতে রাগে না সহজে। কিন্তু রেগে গেলে লণ্ডভণ্ড কাণ্ড বাঁধিয়ে দেয়।

ঠিক আছে। চলো কোথায় যেতে হবে।

ট্যাকসি নিই?

রেমি থেমে গিয়ে বলল, নাও।

কি হয়েছিল তা আজ রেমির স্পষ্ট মনে নেই। কিছু একটা হয়েছিল নিশ্চয়ই। খুব ভাল কেটে গিয়েছিল দিনটা।।

এখন অপারেশন টেবিলে শোওয়া রেমি তার অর্ধচেতনার মধ্যেও টের পায়, দিনটা ছিল তড়িৎগর্ভ। রাজার সঙ্গে সেই তার প্রথম ঘনিষ্ঠতা।।

ডাক্তাররা চিন্তিত, উদ্বিগ্ন। রেমিকে একটি ঢেউ সংজ্ঞাহীনতার গভীর সমুদ্র থেকে কয়েক সেকেণ্ডের জন্য চেতনার বেলাভূমিতে নিয়ে এল। রেমির মনে হল, ডাক্তার নার্স সবাই বড় অসহায়।

বাস্তবিকই তাই। রেমির রক্তচাপ দ্রুত কমে আসছে। এ অবস্থায় তার শরীরে অস্ত্র চালানো বিপজ্জনক।

লবিতে কৃষ্ণকান্ত চারদিকে চেয়ে তাঁর গোষ্ঠীভুক্ত মানুষদের দেখছিলেন। তাঁর জন্যই আজও এরা সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন বা যোগাযোগহীন হয়ে যায়নি। দেশভাগের পর প্রত্যেকের জীবনেই উল্টোপাল্টা স্রোত বয়ে গেল। কে কোথায় যাবে, কোন ঠিকানায় গিয়ে ঠেকবে তার কোনো স্থিরতা নেই। সেই সময়ে কৃষ্ণকান্ত শক্ত হাতে হাল ধরলেন। রাজনীতিতে তিনি সুপরিচিত ব্যক্তিত্ব। রোখা-চোখা কালীঘাটের বাড়ি ছাড়াও কলকাতায় যত আত্মীয়স্বজনের বাড়ি বা বাসা ছিল সে সব যগায় নিজে গিয়ে ভিটেছাড়া আত্মীয়স্বজনদের সাময়িক থাকার বন্দোবস্ত করে দিয়েছিলেন তিনি। এমন কি দেশের বাড়ির চাকরবাকর, কর্মচারীরাও বাদ যায়নি। তারপর মাত্র কয়েক মাসের মধ্যে প্রত্যেকের জন্য নিজস্ব ভদ্রাসনের ব্যবস্থা করে দেন। অর্থসাহায্যে কোনো কার্পণ্য ছিল না। যারা পাকিস্তানেই থেকে গেল তাদের মধ্যে কেউ কেউ অনেক পরে চলে আসে। তাদের ব্যবস্থাও তিনি বিনা প্রশ্নে করে দেন। তাঁর বাবা হেমকান্ত চৌধুরি খুব কাজের মানুষ ছিলেন না। কিন্তু স্নেহপ্রবণ ছিলেন। বড় বেশী স্নেহপ্রবণ। হেমকান্তর ওই সদ্গুণটি উত্তরাধিকারসূত্রে কৃষ্ণকান্তর মধ্যেও এসেছে।

সবচেয়ে বড় কথা, উপকার যেমন করেছেন, তেমনি এদের টিকি বাঁধা পড়েছে তাঁর কাছে। আজও তাঁর বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস এদের কারো নেই। এরা কি তাঁকে ঘৃণা করে? করুক, সেই সঙ্গে এরা এও জানে, কৃষ্ণকান্ত চৌধুরিকে অস্বীকারও করা যায় না, উপেক্ষাও সম্ভব নয়। কৃষ্ণকান্ত একজন নবাগতকে দেখে স্তিমিত কণ্ঠে বললেন, কমল, এসেছিস?

কমল ভীড় ঠেলে এগিয়ে এসে বলল, এইমাত্র মামা। খবর পেতে একটু দেরী হয়েছিল।

দেখ, এখন আমার কপালে কী লেখা আছে।

রেমির অবস্থা কী?

ভাল নয় নিশ্চয়ই। ডাক্তার নার্স তো কেউ কিছু বলছে না স্পষ্ট করে। মুখচোখ দেখে বুঝতে পারছি কিছু ঘটতে চলেছে। তোরা দেখ কে কী করতে পারিস। ফুলু, তোর এক কে চেনাজানা তান্ত্রিক আছে না?

ফুলু এগিয়ে এসে বলে, আছে মামা। বারাসতে।

কিছু করতে পারবে?

যাবো মামা?

যা না। দেখ আমার গাড়িটা না হয় তো মহেন্দ্রর গাড়ি নিয়ে চলে যা। পারিস তো তুলে নিয়ে চলে আয়।

যাচ্ছি। বলে ফুলু দৌড়ে বেরিয়ে গেল।

কৃষ্ণকান্ত সকলের দিকে চেয়ে বললেন, আর কারো এরকম কেউ আছে? তান্ত্রিক, যোগী, হোমিওপ্যাথ যে কেউ।

চারদিকে একটা গুঞ্জন শুরু হল।

দুলাল—কৃষ্ণকান্তর এক নাস্তিক ভাইপো বলল, ওসবে কিছু হবে না কাকা। যা ডাক্তাররা করছে করুক।

কৃষ্ণকান্ত তার দিকে স্থির দৃষ্টিতে একটু চেয়ে থেকে মৃদু কঠিন সুরে বললেন, সব বুঝে গেছিস দেখছি।

দুলাল একটু লজ্জা পেয়ে সরে গেল।

জীবন—কৃষ্ণকান্তর এসটেটের প্রাক্তন নায়েবের ছেলে—বলল, যদি বলেন তো ডাক্তার গাঙ্গুলিকে নিয়ে আসি।

ডাক্তার গাঙ্গুলি কে?

মস্ত হোমিওপ্যাথ। এম আর সি পি, এফ আর সি এস।

হোমিওপ্যাথি করে কেন?

ওরকম অনেক অ্যালোপ্যাথই করে। তবে এঁকে আপনি চেনেন। অনুশীলন সমিতিতে ছিল। ব্রিটিশ আমলে সরকার সব ডিগ্রি কেড়ে নেয়।

কৃষ্ণকান্ত সোজা হয়ে বসে বলেন, খগেনের কথা বলছিস নাকি!

হ্যাঁ। সেই।

দূর! ও ডাক্তারির কী জানে। ধর্ম ছেড়ে একবার খ্রীষ্টান হয়েছিল মনে নেই?

সেটা দায়ে পড়ে।

ওসব জানি।

ডাক্তার কিন্তু খুব ভাল।

কৃষ্ণকান্ত এক সেকেন্ড চিন্তা করে বললেন, তাহলে যা। ট্যাকসি পেলে ভাল, না হলে কারো গাড়ি নিয়ে যা।

একজন অবাঙালি ব্যবসায়ী কৃষ্ণকান্তকে খুশি রাখতে এত রাতেও হাজির ছিলেন। তিনি বললেন, আমার গাড়ি আছে। বলুন, ড্রাইভারকে বলে দিচ্ছি।

কৃষ্ণকান্ত দৃকপাতও করলেন না। জীবন সেই ভদ্রলোকের সঙ্গে বেরিয়ে গেল।

কৃষ্ণকান্ত চোখ বুজলেন। তারপর টান শরীরটা শ্লথ করে আবার হেলান দিয়ে বসলেন। সকলেই এসেছে, সকলেই আসবে। কিন্তু এত মানুষের সদিচ্ছাও তাঁর বউমাকে বাঁচাতে পারবে কি?

বউমাটির জন্য কৃষ্ণকান্তর বুকের মধ্যে ক্রমশ ঘন হয়ে উঠছে ব্যথা। বড় ব্যথা। এই ব্যথাই একদা তাঁর মৃত্যুর কারণ হবে। হোক। আজ যদি কৃষ্ণকান্ত তাঁর নিজের জীবনের বিনিময়ে রেমির জীবন ফিরিয়ে দিতে পারতেন তো তাই দিতেন।

জীবনে এত স্নেহ তাঁর কাছ থেকে কেউ কখনো পায়নি। অথচ রেমি ছেড়ে যাচ্ছে তাঁকে।

কৃষ্ণকান্ত চোখ খুলে জিজ্ঞেস করলেন, রাজা এসেছে?

কয়েকজন সমস্বরে জবাব দিল, এসেছে।

একটা বিদ্যুৎ স্পর্শ করে গেল কৃষ্ণকান্তকে।

বহুকাল আগে, ধ্রুব যখন ফেরার, রেমি যখন বিবাহবিচ্ছেদের কথা ভাবছে, তখন এই রাজাকে তিনি ডেকে পাঠিয়েছিলেন নিজের চেম্বারে। খুব বিশ্বাসযোগ্য ছেলে। নির্ভর করা যায়।

বললেন, ক’দিনের জন্য আমি দিল্লি যাবো, তুই ক’টা দিন বউমাকে একটু দেখাশোনা করবি?

আমি! রাজা অবাক হয়ে বলল, আমি কেন?

তুই না কেন?

বউদির সঙ্গে আমার তো তেমন—

তার দরকার নেই। তুই-ই দেখবি।

রাজা দ্বিধা করে বলল, আচ্ছা, খোঁজ নেবো।

খোঁজ নয়। গিভ হার রেগুলার কমপ্যানি।

আচ্ছা।

শোন গাড়ল, যেমন তেমন কমপ্যানি নয়। ধ্রুবটা যা করেছে তা কহতব্য নয়। বউমা ডিভোর্সের কথা ভাবছে। আই ওয়ান্ট হার মোলডেড। তার জন্য যতদূর যা করতে হয় করবি।

আমি ঠিক বুঝতে পারছি না।

ঠিক আছে। বুঝিয়ে দিচ্ছি।

কৃষ্ণকান্ত সেদিন রাজাকে গোটা প্ল্যানটাই বুঝিয়ে দিয়েছিলেন।