» » একুশ থেকে ত্রিশ পরিচ্ছেদ

বর্ণাকার

শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়

দূরবীন

তেইশ

গভীর রাত্রি পর্যন্ত হেমকান্তর ঘুম হল না। মাথায় ধিকি ধিকি অঙ্গার জ্বলছে। আত্মধিক্কার ও চারিদিককার কলুষিত পরিবেশের ওপর ঘৃণা তাঁকে আজ পাগলের মত করে তুলেছে।

কোন রন্ধ্র দিয়ে নিয়তি আসে তা মানুষের অনুমান করা অসাধ্য। তাঁর ক্ষেত্রে সেই নিয়তি এল শশিভূষণের রূপ ধরে অনুকম্পার রন্ধ্র দিয়ে। তিনি শশিভূষণকে ধরিয়ে দিতে পারতেন বটে, কিন্তু ও কথাটাই তাঁর মনে কখনো উদয় হয়নি। নিজের গাঁটের কড়ি দিয়ে তার চিকিৎসা করিয়েছিলেন। এখন তার ফল ভোগ করতে হবে। লোকে কারও সম্পর্কে ভাল কথা শুনলে গা করে না, কিন্তু মন্দ কথা শুনলে তৎক্ষণাৎ তা বিশ্বাস করে। লোকচরিত্র সম্পর্কে হেমকান্তর জ্ঞান সীমাবদ্ধ বটে, কিন্তু তিনি যেটুকু জানেন সেটুকুই বিষাক্ত।

শীতের প্রকোপ অনেকটাই কমে গেছে। আজকাল কোকিল ডাকে। শিমূলের গাছে ফুল এল।

উত্তরের ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ান হেমকান্ত। প্রকৃতি শান্ত, ও সীমাহীন। নির্মেঘ আকাশ থেকে দেবতাদের লক্ষ লক্ষ চোখ নক্ষত্রের আলোয় তাঁকে নিরীক্ষণ করে। হতোদ্যম হেমকান্ত উর্ধ্বমুখে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকেন আকাশের দিকে। তাঁর বুক থেকে উর্ধ্বেধাবিত হয় পুঞ্জীভূত অভিমান, আমি কী করেছি? কেন এই কলঙ্ক? ভগবান!

অনেকক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে থাকেন তিনি। মাথার চুলে এলোমেলো হাওয়া এসে লাগে। চোখ জ্বালা করে এবং জল আসে।

ঘর থেকে একটা ভারী চেয়ার টেনে আনেন তিনি। বসেন এবং বসেই থাকেন। মানুষের সমাজকে তিনি কোনোদিন ভাল চোখে দেখেননি। কিন্তু এতদিন সেই সমাজ তাঁকে নিয়ে তেমন কথাও বলেনি। তিনি একাচোরা মানুষ, ঘটনাবিহীন। রঙ্গময়ীর সঙ্গে তাঁকে জড়িয়ে একটা রটনা আছে বটে, কিন্তু সেটা তাকে ততটা স্পর্শ করেনি। ইচ্ছে করলে রঙ্গময়ীকে বিয়ে করে আজও তিনি সেই রটনা বন্ধ করতে পারেন। কাজটা এমনিতে শক্ত হলেও অসম্ভব নয়। কিন্তু শশিভূষণকে নিয়ে যে রটনা তা অন্যরকম। তা দেশদ্রোহিতা, বিশ্বাসঘাতকতা, মিরজাফরের কত দয়িতা বা শয্যাসঙ্গিনী ছিল তা নিয়ে ইতিহাস মাথা ঘামায় না, কিন্তু দেশদ্রোহিতার কথা আগুনের অক্ষরে লেখা থাকে।

হেমকান্ত চেয়ারে মাথা হেলিয়ে চোখ বুজলেন।

সকালে তাঁকে জাগাল সূর্যের আলো আর পাখির ডাক। হু হু শব্দে কোকিল ডাকছে আজ। হেমকান্ত টের পেলেন, খোলা আকাশের নীচে রাত কাটানোর ফলে তাঁর গলা খুশখুশ করছে। মাথায় কিছু যন্ত্রণাও টের পান তিনি। একটু শ্বাসকষ্ট হচ্ছে।

নিস্তেজ শরীরে উঠে তিনি প্রাতঃকৃত্য সারলেন। তারপর কাউকে কিছু না জানিয়ে কোচোয়ানকে গাড়ি ঠিক করতে হুকুম পাঠালেন। পোশাক পরে গাড়িতে উঠে বললেন, সোজা থানায় চল।

রামকান্ত রায় থানার হাতার মধ্যেই থাকেন। খবর পেয়ে বেরিয়ে এসে বললেন, আরে আসুন! আসুন!

হেমকান্তকে প্রায় হাত ধরেই নিয়ে গিয়ে বসালেন বাইরের ঘরে।

হেমকান্ত বিনা ভূমিকায় বললেন, আমি একটু শশিভূষণের সঙ্গে দেখা করতে চাই।

রামকান্ত রায় ভূ কুঁচকে বললেন, কেন বলুন তো।

তাকে আমার একটা কথা জিজ্ঞেস করার আছে।

কী কথা?

সেটা তাকে ছাড়া অন্য কাউকে বলা যাবে না।

আপনি খুব উত্তেজিত মনে হচ্ছে।

তা ঠিক। আমার মনটা ভারী অস্থির।

রামকান্ত রায় একটা শ্বাস ফেলে বলেন, হওয়ারই কথা। শশিভূষণ ধরা পড়ুক এটা তো আপনি চাননি।

হেমকান্ত সরল ভাবেই বলেন, না, চাইনি।

কেন? হঠাৎ ধমকের মতো শোনায় রামকান্তর গলা।

হেমকান্ত তটস্থ হয়ে বলেন, কেনই বা চাইব?

আপনি কি স্বদেশীদের প্রতি সিমপ্যাথী পোষণ করেন?

না তো! তা কেন?

আপনার অস্থিরতা দেখে তো তাই মনে হয় হেমকান্তবাবু।

হেমকান্ত ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলেন, বিশ্বাস করুন, আমি কিছুই জানতাম না।

রামকান্তর মুখের কুটিলতা তবু সরল হল না। ধমকের স্বরটা বজায় রেখেই বললেন, ঘটনাটা আপনি যেভাবে চাপা দেওয়ার চেষ্টা করছেন সেটা ছেলেমানুষী। আমাদের চোখ কান মগজ তো আর কারও কাছে বাঁধা দিইনি। একজন মারাত্মক অপরাধীকে আপনি যেভাবে আড়াল করে রেখেছিলেন তা মোটেই ভাল ব্যাপার নয়। তবু আমি আপনাকে বাঁচানোর একটা চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু আপনি আজও সেই স্টেটমেন্টটা দেননি।

হেমকান্তকে আজ যেন জুজুবুড়ির ভয় পেয়ে বসেছে। একজন তিন পয়সার দারোগা তাঁকে চোখ রাঙাচ্ছে তবু তিনি কেমন যেন আকুপাকু করছেন ভিতরে ভিতরে। তেতে উঠছেন না, ফেটে পড়ছেন না। মিন মিন করেই বললেন, স্টেটমেন্ট তৈরি হচ্ছে। কিন্তু বিশ্বাস করুন, আমি কিছু জানতাম না।

আপনি না জানলেও কেউ তো জানত! কারও মাথা থেকে তো প্ল্যানটা বেরিয়েছিল!

হতভম্বের মতো চেয়ে থাকেন হেমকান্ত।

বামকান্ত নিজের হাতের প্রকাণ্ড চেটোটার দিকে চেয়ে ভূকুটি করে বললেন, আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন, গর্তের সব সাপ আমি টেনে বার করবই। ওই মেয়েটা, রঙ্গময়ী, ও কেমন মেয়ে?

ভাল! খুব ভাল।

আপনার কাছে ভাল হলেই তো হবে না। সে যে ভাল এমন কোনো প্রমাণ নেই। শশিভূষণকে সে যে বাঁচানোর চেষ্টা করেছিল তাৰ যথেষ্ট প্রমাণ আছে।

বঙ্গময়ী জানত না।

রামকান্তর গলায় বাজ ডাকল, আলবাৎ জানত। তাকে অ্যারেস্ট করে থানায় আনলেই সব কথা কবুল করবে।

হেমকান্ত নিজের শরীরে একটা শীতলতা টের পান। একটা কাঁপুনি ধরেছে তাঁকে দাঁতে দাঁতে ঠকঠক শব্দ হল একটু। জ্বর আসছে? হবে? শরীরটা আজ বশে নেই। বললেন, ওকে ধরে আনবেন?

আনাই তো উচিত।

বঙ্গময়ীকে? যেন বুঝতে পারছেন না এমন ভ্যাবলার মতো বলেন হেমকান্ত।

রামকান্তর গলা কিছু নরম হল। বললেন, অন্য কোনো উপায় নেই। তবে আপনি যাতে নিজেকে বাঁচাতে পারেন আমি সেই পথ খোলা রেখেছি। এখনো রেখেছি। আপনি যদি সুযোগটা নেন তবে বাধ্য হয়ে আমাকে আইনমতো ব্যবস্থা নিতে হবে।

হেমকান্ত নিশ্চুপ বসে রইলেন। লোকে জানে, তিনি শশিভূষণকে ধরিয়ে দিয়েছেন। পুলিশের বিশ্বাস, তিনি শশিভূষণকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছিলেন। বড় অদ্ভুত অবস্থা।

হেমকান্ত একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। লোকের সঙ্গে তিনি কখনো ঝগড়া বা তর্ক করেননি। কী করে যুক্তি প্রয়োগ করতে হয় তাও তাঁর অজানা। তার ওপর এক আতঙ্কে তাঁর মন ও মাথা ছেয়ে আছে।

রামকান্ত বললেন, শশিভূষণের সঙ্গে দেখা করতে চান কেন?

একটু দরকার ছিল। কোনো অসুবিধে আছে?

হাসপাতাল থেকে এনে তাকে এখনো থানার হাজতেই রাখা হয়েছে। অসুবিধে আছে বৈকি। তবে আপনার জন্য ব্যবস্থা করে দিতে পারি।

খুব ভাল হয় তাহলে।

আসুন, বলে রামকান্ত উঠলেন! থানার দিকে হাঁটতে হাঁটতে বললেন, রঙ্গময়ী আপনার কে হন? কোনো আত্মীয়া নয় তো?

ঠিক তা নয়।

মেয়েটির প্রতি লক্ষ রাখবেন। ওর অ্যাকটিভিটি যথেষ্ট সন্দেহজনক

রঙ্গময়ী কী করেছে?

সে আপনিও নিশ্চয়ই জানেন।

হেমকান্ত ভয় খেয়ে চুপ করে গেলেন। বেফাঁস কোনো কথা যদি বেরিয়ে যায়!

প্রথম দর্শনেই বোঝা গেল যে, শশিভূষণ বড় একটা যত্নে নেই। খুব রোগা হয়ে গেছে। সুকুমার মুখশ্রীতে একটা হাড় উচু লাবণ্যহীনতা। গালের কোমল দাড়ি রুক্ষ। চুল পিঙ্গল। মোটা কম্বলে গা ঢেকে বিছানায় বসে ছিল।

হেমকান্তকে দেখে হঠাৎ চিনতে পারল না। না চেনারই কথা। মাত্র একবারই পরস্পর দেখা হয়েছিল। তারপর জল ঘোলা হয়েছে কিছু কম নয়।

হেমকান্ত আত্মপরিচয় দিতেই কিন্তু শশিভূষণের মুখ ভীষণ খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। তাড়াতাড়ি উঠে এল বিছানা থেকে। আশ্চর্যের কথা, নীচু হয়ে গরাদের ফাঁক দিয়ে হাত বাড়িয়ে সে হেমকান্তর পায়ের ধূলো নেওয়ারও চেষ্টা করল।

হেমকান্ত পিছিয়ে গিয়ে বললেন, থাক থাক। তাঁর মনে হল, এরকম তেজী ও প্রাণভয়হীন যুবকের প্রণাম নেওয়াটা তাঁর পক্ষে পাপ হবে।

সাগ্রহে শশিভূষণ জিজ্ঞেস করল, বাড়ির সবাই কেমন আছেন?

ভাল।

বঙ্গমাসী ভাল?

হ্যাঁ। তোমার জন্য খুব দুশ্চিন্তা করছে।

ওঁকে বলবেন, আমি ভাল আছি।

বলব। কিন্তু তুমি সত্যিই কেমন আছো?

শশিভূষণ হাসল। বলল, এখনো খারাপ কিছু লাগছে না।

এখানকার খাওয়া দাওয়া?

জঘন্য, তবে আমার ওসব অভ্যাস আছে।

মারধোর করে না তো!

না না। এখনো ওগুলো শুরু হয়নি। শুনছি বরিশালে চালান দেবে। তখন কী হয় বলতে পারি না।

তোমার বাড়িতে একটা খবর দেবো?

শশিভূষণ আবার শুকনো ঠোঁটে হাসে। ঠোঁট দুটো চড়চড়ে শুকনো। মামড়ি এবং রক্ত শুকিয়ে আছে। কষ্টেই হাসতে হয়। বলল, ওসব পুলিশ নিজের গরজেই করবে। আপনি ভাববেন না।

শোনো শশী, আমি তোমার জন্য উকিল লাগিয়েছি। তুমি তাকে যথাসাধ্য সাহায্য কোরো।

শশিভূষণ অবাক হয়ে বলে, আপনি উকিল লাগালেন কেন?

এমনি। তুমি আমার অতিথি ছিলে। পুলিশ তোমাকে সেই অবস্থায় ধরে এনেছে। আমার মনে হল তোমার জন্য কিছু করা আমার আতিথেয়তা হিসেবেই কর্তব্য।

শশী ম্লান হেসে বলল, যথেষ্টই করেছেন; রঙ্গমাসী দিনরাত আমার সেবা করেছেন। কয়েকদিন আরামের আশ্রয় জুটেছিল। আর কী চাই?

ওটুকু কিছুই নয়। তুমি তার চেয়ে ঢের বেশী কষ্ট করেছে। দেশের লোকের জন্যই করেছে। তোমার জন্য কিছু করতে পারলে আমার নিজেরই ভাল লাগবে।

শশী বলল, উকিল আমার বাবাও নিশ্চয়ই দেবেন।

তা তো জানি। তবে অধিকন্তু ন দোষায়। ভাল কথা, তুমি তোমার বাড়ির যে ঠিকানাটা দিয়েছিলে সেটা কি যথার্থ?

শশিভূষণ লজ্জার হাসি হেসে বলে, না। সত্যি ঠিকানা দেওয়ার নিয়ম নেই।

তোমার বাবা কী করেন?

ব্যবসা।

তোমরা কি ধনী?

ধনী না হলেও বাবার অবস্থা খারাপ নয়।

তাহলে তুমি আদরেই মানুষ হয়েছে!

তা হয়েছি।

এখন যে এত কষ্ট তা সইছো কী করে?

মনটাকে শক্ত করে ফেললে আর কষ্ট থাকে না

মনকে শক্ত করা কি সহজ কাজ শশী?

তা নয়। খুব শক্ত কাজ। তবে অভ্যাস করে নিতে হয়েছিল।

তোমার এত কম বয়স, এত অভ্যাস করার সময় পেলে কবে?

শশিভূষণ একটু হাসল মাত্র।

হেমকান্ত গলা খাকারি দিলেন। শরীরটা ভাল নেই। মাথা ঝিমঝিম করছে। গায়ে জ্বরের সঞ্চার টের পাচ্ছেন। প্রবল শীত করছে। গৱাদটা শক্ত করে চেপে ধরে বললেন, একটা কথা।

বলুন। সসমে শশী বলে।

লোকে বলছে আমিই নাকি তোমাকে পুলিশে ধরিয়ে দিয়েছি।

আপনি! শশী আকাশ থেকে পড়ে।

লোকে তাই ভাবছে। একটা প্রচার হচ্ছে।

কে একথা রটাল?

তা বলা শক্ত। তবে রটেছে। কথাটা কি তুমি বিশ্বাস করো?

শশী হতভম্বের মতো চেয়ে থেকে বলে, আপনি আমাকে ধরিয়ে দেবেন একথা কি বিশ্বাসযোগ্য?

তুমি বিশ্বাস করো না তো!

ওরকম কথা আমি স্বপ্নেও ভাবতে পারি না। রঙ্গমাসীর কাছে আপনার কথা কত শুনেছি!

আমার কথা! মনু মানে রঙ্গময়ী তোমাকে আমার কথা বলত নাকি?

বলত মানে! রঙ্গমাসী শুধু আপনার কথাই তো বলতেন।

আমার সম্পর্কে এত কী বলার থাকতে পারে তার?

ও বাবা, সে অনেক আছে। ওঁর কাছে বোধহয় আপনিই ভগবান।

হেমকান্ত ভীষণ অবাক হয়ে যান। রঙ্গময়ী তাঁর সম্পর্কে ভাল কথা বলে বেড়ায় তাহলে? কিন্তু কী কথা?

একবার ইচ্ছে হল জিজ্ঞেস করেন। কিন্তু লজ্জা করতে লাগল। নিজের প্রশংসা অন্যের মুখ থেকে টেনে বের করার প্রবণতা ভাল না।

হেমকান্ত একটা নিশ্চিন্তের শ্বাস ছেড়ে বলেন, তাহলে তুমি বিশ্বাস করো না? আমি স্বস্তির শ্বাস ফেললাম।

কারা এসব বলছে বলুন তো। তাদের চাবকাননা দরকার।

লোকে নিন্দা করতে এবং শুনতে ভালবাসে। প্রায় সকলেই। কজনকে চাবকাবে? লাভ নেই।

শশী বলে, বরং পুলিশের ধারণা তো উল্টোই। তারা বলে যে, আপনি আমাকে লুকিয়ে রেখেছিলেন।

বলে নাকি?

বলে। রঙ্গমাসীর ওপরে দারোগাবাবুর খুব রাগ।

জানি। হেমকান্ত বিষঃ গলায় বলেন, ওকেও ধরে আনতে চাইছে।

কথাটা শুনে শশী অবাক হল না। খানিকটা উদাস গলায় বলল, ধরতেই পারে। একদিন। রঙ্গমাসী ধরা পড়বেনই। উনি ভীষণ বেপরোয়া।

তাই নাকি? দেখ শশী, ওকে ছেলেবেলা থেকে চিনি বটে, কিন্তু কী যে ওর চরিত্র তা আজও ভাল বুঝলাম না। অদ্ভুত মেয়ে।

শশী মাথা নাড়ল। তারপর বলল, কৃষ্ণ কেমন আছে?

ভালই। তোমার খুব ভক্ত হয়ে উঠেছিল কয়দিনে! তাই না?

হ্যাঁ। খুব স্পিরিটেড ছেলে আপনার।

হেমকান্ত আবার দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন। ছেলেকে তিনি ইদানীং একটু কাছে ভিড়তে দিয়েছেন বটে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে কৃষ্ণকান্ত কেমন ছেলে তা তিনি খুব ভাল জানেন না।

শশী বলল, আপনার বাড়িতে আমার খুব ভাল কেটেছিল। জ্বরটা না হলে আরো ভাল কাটত।

সব ভাল যার শেষ ভাল। শেষ অবধি আর ভাল কাটল কই তোমার! ধরা পড়ে গেলে।

শশী মাথা নেড়ে বলে, ধরা পড়তেই হত। উপায় ছিল না। আমার ওপর কমানডারের অরডার ছিল সুইসাইড করার। তা আমি করিনি।

হেমকান্ত শিউরে উঠলেন।

শশী আপনমনেই বলল, মার মুখ মনে পড়ায় ভেবেছিলাম, একবার মাকে দেখে নিয়ে তারপর দূরে কোনো নির্জন জায়গায় গিয়ে সুইসাইড করব। যাতে আমার লাশ কেউ খুঁজে না পায়। মা যাতে ধরে নেয়, আমি নিরুদ্দেশ। কিন্তু হল না।

যেতে পারলে না মার কাছে?

না। অসুবিধে ছিল। কিন্তু সুইসাইডও করা হল না। প্রথম চোটে না করতে পারলে পরে নানারকম দুর্বলতা দেখা দেয়।

ওসব কথা ভেবো না শশী। আমি ভাল উকিল দিয়েছি। সে তোমাকে খালাস করে আনবে।

পারবে? শশী ব্যথভাবে জিজ্ঞেস করে।

কেন পারবে না? তাকে সব বোলো।

শশী ঘাড় নাড়ল। কেমন অন্যমনস্ক দেখাচ্ছিল তাকে। জিব দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে সে বলল, আপনাদের অনেক কষ্ট দিয়েছি। কিছু মনে করবেন না।

হেমকান্ত ধীর স্বরে বলেন, তোমার বয়সী এবং তোমার চেয়ে বড় ছেলে আমার আছে। কেউ স্বদেশী করেনি কখনো। কিন্তু এক আধজন যদি করত তবে খুশি হতাম।

শশী বলল, আপনাদের বংশে তো স্বদেশীর রক্ত আছেই।

হ্যাঁ। আমার ভাই ছিল।

শুনেছি। রঙ্গমাসী সব বলেছে।

হেমকান্ত জ্বরের ঘোরে কাঁপছিলেন। উঠলেন। অস্ফুট স্বরে বললেন, আসি।

ফেরার পথে সারা রাস্তায় হেমকান্ত আচ্ছন্নের মতো এলিয়ে রইলেন। বাড়িতে ফিরে নামতে যাবেন, একটা হাত তাঁকে ধরল।

মনু! আমার বড় জ্বর আসছে মনু!

জানি। খারাপ শরীর নিয়ে কোন রাজকার্যে গিয়েছিলে?

শশীর কাছে।

কেন? চলো, ওপরে চলো, এখন আর কথা নয়।

হেমকান্ত ওপরে উঠতে উঠতে হাঁফিয়ে গেলেন। বড় বড় শ্বাস পড়তে লাগল। বিছানায় শুয়ে এক আচ্ছন্নতার সঙ্গে প্রাণপণ লড়াই করতে করতে বললেন, ও বিশ্বাস করে না।

কী বিশ্বাস করে না?

ও গুজবটায় বিশ্বাস করে না।

কোন গুজব?

আমি যে ওকে ধরিয়ে দিয়েছি তা ও বিশ্বাস করে না।

ঠিক আছে। এখন চুপ করে শুয়ে থাকো।

তুমি ওকে আমার কথা কী বলেছো মনু?

তোমার কথা! তোমার কথা বলতে যাবো কেন?

বলেছো।

রঙ্গময়ী লেপ দিয়ে হেমকান্তকে ঠেসে চেপে ঢাকা দিয়ে বলে, বেশ করেছি বলেছি। বলেছি আমার মাথা আর মুণ্ডু।

কই আমাকে তো আমার কথা বলো না!

বলার কিছু নেই বলে।

আমাকে তো কেবল বকো, ধমকাও।

বেশ করি।

মনু, আমি মরে যাবো এবার? কত জ্বর বলো তো!

যত জ্বরই হোক, মরণ তোমার কাছে ঘেঁষুক তো একবার! চুপ করে থাকো। তোমার মনুর শরীরে এখনো প্রাণ আছে।