শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়

দূরবীন

গ্রন্থকথা

সাপ্তাহিক ‘দেশ’ পত্রিকায় দু-বছরেরও বেশি কাল ধরে ধারাবাহিকভাবে বেরিয়েছিল ‘দূরবীন’, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের জোরালো, সংবেদনশীল কলমে অন্যতম মহৎ সৃষ্টি। চলমান শতাব্দীর দুইয়ের দশকের শেষ ভাগ থেকে শুরু করে আটের দশক পর্যন্ত বিস্তৃত সময়ের প্ৰেক্ষাপটে সামাজিক জীবনের যাবতীয় পরিবর্তনকে এক আশ্চর্য কৌতুহলকর বিশাল কাহিনীর মধ্য দিয়ে ধরে রাখার প্রয়াসেরই অভিনন্দিত ফলশ্রুতি ‘দূরবীন’ উপন্যাস।

তিন প্রজন্মের এই কাহিনীতে প্রথম প্রজন্মের প্রতিভূ জমিদার হেমকান্ত। এ-উপন্যাসের সূচনায় দেখা যায়, হেমকান্তের হাত থেকে কুয়োর বালতি জলে পড়ে গেছে, আর এই আপাততুচ্ছ ঘটনায় হেমকান্ত আক্রান্ত হচ্ছেন মৃত্যুচিন্তায়। বিপত্নীক হেমকান্ত ও রঙ্গময়ী নামের প্রবল ব্যক্তিত্বসম্পন্ন এক পুরোহিত্যকন্যার, গোপন প্রণয়কাহিনী ও আনুষঙ্গিক অন্যান্য পারিবারিক কাহিনী নিয়ে এ-উপন্যাসের প্রথম পর্যায়। দ্বিতীয় প্রজন্মের নায়ক কৃষ্ণকান্ত। দেবোপম রূপ ও কঠোর চরিত্রবল বালক কৃষ্ণকান্তকে দাঁড় করিয়েছে পিতা হেমকান্তের বিপরীত মেরুতে। স্বদেশী আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ কৃষ্ণকান্তের ব্ৰহ্মচর্য-গ্রহণ ও দেশভাগের পর তাঁর আমূল পরিবর্তন—এই নিয়ে এ-উপন্যাসের দ্বিতীয় পর্যায়ের কাহিনী। তৃতীয় ও শেষ প্রজন্মের নায়ক ধ্রুব, বিশ শতকের উপান্তপর্বে এক দিগভ্ৰষ্ট, উদ্ধত বিদ্রোহী যুবা। ধ্রুবর স্ত্রী রেমি, যার সঙ্গে এক অদ্ভুত সম্পর্ক তার। কখনও ভালবাসা, কখনও উপেক্ষা, কখনও-বা প্রবল বিরাগ। অথচ রেমির ভালবাসা সাত-আঘাতেও অবিচল। একদিকে রেমির সঙ্গে সম্পর্ক অন্যদিকে পিতা কৃষ্ণকান্তের মধ্যে সেই ব্ৰহ্মচারী ও স্বদেশের জন্য উৎসর্গীকৃত প্রাণসত্তাটিকে খুঁজে না-পাওয়ার ব্যর্থতায় ক্ষতবিক্ষত ধ্রুবর আশ্চর্য কাহিনী নিয়েই শেষ পর্ব। শুধু তিন প্রজন্মের তিন নায়কের ব্যক্তিগত কাহিনীর জন্যই নয়, এ-উপন্যাসের বিশাল প্রেক্ষাপটে আরও বহু বিচিত্র ও কৌতুহলকর শাখা-কাহিনী, এবং এর চালচিত্রে স্বদেশী আন্দোলন, দেশভাগ ও স্বাধীনতা পরবর্তী উত্তাল দিনরাত্রির এক তাৎপর্যময় উপস্থাপনার জন্যও ‘দূরবীন’ চিহ্নিত হবে অবিস্মরণীয় সৃষ্টিরূপে।

শুধুদূরকেই কাছে আনে না, উল্টো করে ধরলে কাছের জিনিসও দূরে দেখায় দূরবীন। ‘দূরবীন’ উপন্যাসের নামকরণে যেমন সূক্ষ্মতা, রচনারীতিতেও তেমনই অভিনবত্ব এনেছেন শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। দ্বিস্তর এই উপন্যাসে সেকাল ও একাল, অতীত ও বর্তমান এক অনন্য কৌশলে একাকার।

শীর্ষেন্দুর লেখাতে সময় হচ্ছে মুখ্য বিষয়। তাঁর এই অসাধারণ কীর্তি ‘দূরবীন’ এ লেখক উনিশ শতকের ভারতের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং প্রজন্মগত ব্যবধান (জেনারেশন গ্যাপ) খুব সাবলীল ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন।

উপন্যাসটা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে মূলত হেমকান্ত এবং ধ্রুবর জবানীর মাধ্যমে। কিন্তু আসলে এদের দুজনের কেউই এই উপন্যাসের মূল নায়ক নন। আসল নায়ক হচ্ছেন কৃষ্ণকান্ত। উপন্যাসটা দুইটা অংশে বিভক্ত, আর দুই অংশের বর্ণনাই লেখক চমৎকার ভাবে লিখে গিয়েছেন। শতাধিক পরিচ্ছেদের বিশাল উপন্যাস; কিন্তু কোথাও খারাপ লাগে নি। বিজোড় পরিচ্ছেদ গুলো (১, ৩, ৫…) প্রথম কাহিনীর অন্তর্গত এবং জোড় পরিচ্ছেদ গুলো (২, ৩, ৪…) দ্বিতীয় কাহিনীর অন্তর্গত। কেউ যদি প্রথম অংশ গুলো পড়ে শেষ করেন, তবে দ্বিতীয় অংশে তিনি প্রথম অংশের পর থেকে ধারাবাহিক বর্ণনা পাবেন! আর গল্পের প্রয়োজনেই এখানে রেমি এবং ধ্রুবর যে মধ্যে যে ভালোবাসার টানাপোড়েনের চিত্র আঁকা হয়েছে তার মধ্যেও অনেক সময় আবেগে ডুবে গিয়েছি। কখনো মনে হয়েছে যে রেমিই ঠিক আবার কখনও মনে হয়েছে যে ধ্রুবই ঠিক। গল্পের প্রয়োজনে অনেক চরিত্রেরই আগমন ঘটেছে যার প্রত্যেকটিই উপভোগ্য।

এছাড়াও উপন্যাসটিতে ইংরেজদের হাত থেকে ভারতের স্বাধীনতার চিত্র খুব বড় ভাবে না হলেও সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। স্বাধীন হওয়ার আগে ও পরে সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার একটা চিত্রও তুলে ধরা হয়েছে। প্রথম অংশের ঘটনাস্থল আমাদের বাংলাদেশ এই এবং দ্বিতীয় অংশের ঘটনাস্থল পশ্চিমবঙ্গ। প্রথম অংশটুকুতে কৃষ্ণকান্তের সংগ্রাম এবং সাফল্য এবং দ্বিতীয় অংশে এর পরিণতি এবং কৃষ্ণকান্ত ও ধ্রুব এর মধ্যে ব্যবধান তুলে ধরা হয়েছে।

‘দূরবীন’ উপন্যাস প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৬০ সালের বইমেলায়; মুদ্রণ সংখ্যা ৩৩০০। আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেডের পক্ষে ফণিভূষণ দেব কর্তৃক ৪৫ বেনিয়াটোলা লেন, কলকাতা ৭০০ ০০৯ থেকে প্রকাশিত এবিং আনন্দ প্রেস অ্যাণ্ড পাবলিকেশনস প্রাইভেট লিমিটেডের পক্ষে দ্বিজেন্দ্রনাথ বসু কর্তৃক পি ২৮৪ সি আই টি স্কিম নং ৬ এম কলকাতা ৭০০ ০৫৪ থেকে মুদ্রিত। প্রচ্ছদ এঁকেছিলেন অমিয় ভট্টাচার্য। উপন্যাসটির প্রথম বিশ্ববাণী সংস্করণ প্রকাশিত হয় ১৩৭২ বঙ্গাব্দের জ্যৈষ্ঠে; প্রকাশক ব্রজকিশোর মণ্ডল, বিশ্ববাণী প্রকাশনী, ৯/১ বি মহাত্মা গান্ধী রোড, কলকাতা-৯। মুদ্রাকর পার্বতীচরণ রায়, দি গৌতম প্রিণ্টিং ওয়ার্কস প্রা. লি. ২০৯, এ বিধান সরণি, কলকাতা-৬।

বর্তমান সংস্করণে অনুসৃত হয়েছে আনন্দ পাবলিশার্স প্রকাশিত প্রথম সংস্করণ জানুয়ারি ১৯৮৬, দ্বাবিংশ মুদ্রণ জানুয়ারি ২০২২। এই সংস্করণের প্রচ্ছদ এঁকেছেন সুব্রত চৌধুরী।

“রা-সা”

পূজনীয়

শ্রীঅমরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী (বড়দা)

শ্রীচরণকমলেষু