নবম পরিচ্ছেদ

সিপাহীরা পালে পালে বিদ্রোহী ধরিয়া আনিতে লাগিল। যাহারা লাঠি চালাইয়াছিল, তাহারা নির্ব্বিঘ্নে স্বস্থানে অবস্থানপূর্ব্বক তামাসা দেখিতে লাগিল। যাহারা ধৃত হইল, তাহারা প্রায় নির্দ্দোষী। লোক ধরিয়া আনিতে হইবে, কাজেই সিপাহীরা যাহাকে পাইল, তাহাকে ধরিয়া আনিল। দোষীরা সাবধান ছিল, তাহাদিগকে পাওয়া গেল না। নির্দ্দোষীরা সতর্ক থাকা আবশ্যক বিবেচনা করে নাই—তাহারা ধৃত হইতে লাগিল। কেহ হাঁ করিয়া সিপাহী দেখিতেছিল, অতি সাহসী বলিয়া সে ধৃত হইল। কেহু সিপাহী দেখিয়া ভয়ে পলাইল, যে পলায়, সে দোষী বলিয়া ধৃত হইল। কেহ সিপাহীর প্রশ্নে চোট পাট উত্তর দিল; সে চতুর, কাজেই, “বদ্‌মাষ” বলিয়া ধৃত হইল। কেহ কোন উত্তর দিতে পারিল না,—অপরাধীই নিরুত্তর হয়, এই বলিয়া সেও ধৃত হইল। কেহ দুৰ্ব্বল, তাহাকে ধৃত করার কোন কষ্ট নাই, সিপাহীরা অনুগ্রহ করিয়া তাহাকে ধৃত করিলেন; কেহ বলবান্, কাজেই দাঙ্গাবাজ, সেও ধৃত হইল। কেহ দরিদ্র, দরিদ্রেরাই বদমাষ হইয়া থাকে, এজন্য সে ধৃত হইল; কেহ ধনী, ধনীরা টাকা দিয়া লোক নিযুক্ত করিয়া এই দাঙ্গা উপস্থিত করিয়াছে সন্দেহ নাই, তাহারাও ধৃত হইল। এইরূপে অনেক লোকে ধৃত হইল। এক জন মাত্র স্ত্রীলোককে ধরিবার আদেশ ছিল যে গাছে চড়িয়া “মার! মার!” শব্দে হুকুম দিয়াছিল, তাহাকে। একের স্থানে শত জনে শত জন স্ত্রীলোককে ধরিয়া আনিল। কেহ শুনিয়াছিল সে বিধবা, অতএব সে বিধবা দেখিয়াই ধরিল, কেহ শুনিয়াছিল সে সুন্দরী, সে সুন্দরী দেখিয়াই ধৃত করিল। কেহ শুনিয়াছিল, সে যুবতী; এজন্য অনেক যুবতী এককালে বন্ধন ও পূজা প্রাপ্ত হইল। কেহ কেহ শুনিয়াছিল যে, বৃক্ষবিহারিণী মুক্তকুন্তলা ছিল; অতএব স্ত্রীলোকের এলোচুল দেখিলেই তাহাদের হুজুরে আনিয়া সিপাহীরা হাজির করিতে লাগিল।

এইরূপে ফৌজদারী কারাগার স্ত্রীপুরুষে পরিপূর্ণ হইয়া উঠিল— আর ধরে না। তখন সে দিনের মত কারাগার বন্ধ হইল। সে দিন কয়েদীরা বন্ধ রহিল— তাহাদের নিস্‌বতে পর দিন যাহা হয় হুকুম হইবে। সীতারামও এই সঙ্গে আবদ্ধ রহিলেন।

সীতারামকে অনেকেই চিনিত। ইচ্ছা করিলে তিনি ফৌজদারের সঙ্গে সাক্ষাতের উপায় করিতে পারিতেন, অথবা যাহাতে সামান্য ব্যক্তিদের সঙ্গে একত্রে গাদাগাদি করিয়া থাকিতে না হয়, সে বন্দোবস্ত করিয়া লইতে পারিতেন। তিনি সে চেষ্টা কিছুই করিলেন না। তাঁহাকে চিনে, এমন লোকের সঙ্গে সাক্ষাৎ হইলে, ইঙ্গিতে তাঁহাকে চিনিতে নিষেধ করিলেন। তিনি মনে মনে এই ভাবিতেছিলেন, “আমি যদি ইহাদিগকে ছাড়িয়া যাই, তবে ইহাদিগের মুক্তির কোন উপায় হইবে না।”

রাত্রি উপস্থিত। কারাগারের একটি মাত্র দ্বার, প্রহরীরা সেই দ্বার বাহির হইতে রুদ্ধ করিয়া প্রহরায় নিযুক্ত রহিল।

কেহ কিছু খাইতে পায় নাই। সন্ধ্যার পর যে যেখানে পাইল, কাপড় পাতিয়া শুইতে লাগিল। সীতারাম তখন সকলের কাছে কাছে গিয়া বলিতে লাগিলেন, “তোমরা কেহ ঘুমাইও না, ঘুমাইলে রক্ষা নাই।”

সকলে সভয়ে শুনিল। কথাটা কেহ বুঝিতে পারিল না। কাহারও কিছু জিজ্ঞাসা করিতে সাহস হইল না। কিন্তু কেহ ঘুমাইল না। পেটে ক্ষুধা—মনে ভয়; নিদ্রার সম্ভাবনা বড় অল্প। একবার প্রহর বাজিয়া গেল—ঝিঝিট-খাম্বাঙ্গে নবতওয়ালা একটু মধুরালাপ করিয়া, আহারাদির অন্বেষণে নবতখানা হইতে নামিল। তখন সীতারাম এক স্থানে, কতকগুলি কয়েদীর খেদোক্তি শুনিতেছিলেন। তাহাদের কথা সমাপ্ত হইলে সীতারাম বলিলেন, “ভাই, অত কাঁদা কাটার দরকার কি? আমরা মনে করিলেই ত বাহির হইয়া যাইতে পারি।”

এক জন বলিল, “কেমন করিয়া যাইব?”

সীতারাম বলিলেন, “কেন? দ্বার ভাঙ্গিব।”

আর ব্যক্তি বলিল, “তুমি কি পাগল?”

সীতারাম বলিলেন, “কেন বাপু! এখানে আমরা কত লোক আছি মনে কর?”

একজন বলিল, “তা জন শ পাঁচ ছয় হইবে। তাতে কি হলো?”

সীতারাম বলিলেন, “পাঁচ শ লোকে একটা দরওয়াজা ভাঙ্গিতে পারি না?”

সকলে হাসিতে লাগিল। একজন বলিল, “দরওয়াজা যে লোহার?”

সীতা। মানুষ কি মিছরির? না কাদার?

আর এক জন বলিল, “লোহার কপাট কি হাত দিয়া ভাঙ্গিব? না দাঁত দিয়া কাঁটিব? না নখ দিয়া ছিঁড়িব?”

সকলে হাসিল।

সীতারাম বলিলেন, “কেন, পাঁচ শ লোকের লাথিতে এক জোড়া কপাট কি ভাঙ্গে না? হোক না কেন লোহা—এক হয়ে কাজ করিলে, লোহার কথা দূরে থাক, পাহাড়ও ভাঙ্গা যায়, সমুদ্রও বাধা যায়। কাঠবিড়ালীতে সমুদ্র বাঁধার কথা শুন নাই?”

তখন এক জন বলিল, “লোকটা বলিতেছে মন্দ নয়। তা ভাই, না হয় যেন লোহার কপাটও ভাঙ্গিলাম—বাহিরে যে সিপাহী?”

সীতারাম। তাহারা কয় জন?

সে ব্যক্তি বলিল, “দুই জন চারি জন থাকিতে পারে।”

সীতারাম। এই পাঁচ শ লোকে আর দুই চারি জন সিপাহী মারিতে পারিব না?

অপর এক জন কহিলেন, “তাদের যে হাতিয়ার আছে? আমরা আঁচড়ে কামড়ে কি করিব?”

সীতারাম বলিলেন, “তখন আমি তোমাদিগকে হাতিয়ার দিব।”

“তুমি হাতিয়ার কোথা পাইবে?”

“আমি সীতারাম রায়।”

শুনিয়া, যাহারা সীতারামের সঙ্গে তর্ক বিতর্ক করিতেছিল, তাহারা একটু কুণ্ঠিত হইয়া সরিয়া বসিল। এক জন বলিল, “বুঝিলাম, আমাদের উদ্ধারের জন্যই আপনি ইহার ভিতর প্রবেশ করিয়াছেন। আপনি যাহা বলিবেন, আমি তাহাই করিব।”

যে কয় জনের সঙ্গে সীতারাম কথোপকথন করিতেছিলেন, সকলেরই এই মত হইল। সীতারাম তখন আর এক স্থানে গিয়া বসিলেন, সেই রকম করিয়া তাহাদের সঙ্গে কথা কহিলেন, সেই রকম করিয়া তাহাদিগকে বশীভূত করিলেন; তাহারাও যথাসাধ্য সাহায্যে উদ্যত, এবং উত্তেজিত হইল। এইরূপে সীতারাম ক্রমে ক্রমে, অসাধারণ বুদ্ধি, অসাধারণ কৌশল, অসাধারণ বাগ্মিতার গুণে সেই বহুসংখ্যক বন্দিবৃন্দকে একমত, উৎসাহিত এবং প্রাণপাতে পর্য্যন্ত সম্মত করিলেন।

তখন সীতারাম সেই সমস্ত বন্দিবর্গকে দাঁড়াইতে বলিলেন। তাহারা দাঁড়াইল। তখন সীতারাম তাহাদিগকে শ্রেণীবদ্ধ করিয়া সাজাইতে লাগিলেন। দ্বারের সম্মুখে প্রথম সারি, তার পর আর এক সারি— এইরূপ বরাবর। প্রতি শ্রেণীমধ্যস্থ ব্যক্তিদিগকে তিন তিন জন করিয়া আবার বিভাগ করিলেন। আবার সেই তিন জনকে এমত করিয়া দাঁড় করাইলেন যে, দুই জনের মধ্য দিয়া এক জন মনুষ্য যাইতে পারে— তাহাতে এইরূপ ফল দাঁড়াইল যে, অনায়াসে পলক মধ্যে কোন তিন ব্যক্তির পিছনের সারি হইতে তিন জন আগু হইয়া পলক মধ্যে তাহাদের স্থান লইতে পারে—ঠেলাঠেলি হয় না।

এই সকল বন্দোবস্ত করিতে করিতে আবার প্রহর বাজিল। “দগড়া নগড়া গড়াগড়ি” বলিয়া দামামা কি বলিতে লাগিল। তার সঙ্গে মধুর বেহাগ রাগিণী যামিনীকে গভীরা, মূর্ত্তিমতী, ভয়ঙ্করী করিয়া তুলিল। তখন সীতারাম বুঝিলেন, উত্তম সময়, পাহারার সিপাহী ভিন্ন অন্য সিপাহী সকল ঘুমাইয়াছে—কর্ত্তৃপক্ষেরা নিদ্রিত। তখন সীতারাম দ্বারের সমীপস্থ তিন জনকে বলিলেন, “তোমরা তিন জন প্রথমে দ্বারে লাথি মার। গায়ে যত জোর আছে, তত জোরে তিন বার মাত্র লাথি মারিবে। তার পর পিছে সরিয়া দাঁড়াইবে। কিন্তু দেখিও, তিনখানা পা, যেন একেবারেই কপাটের উপর পড়ে; অগ্রপশ্চাৎ হইলে সকল বৃথা। একেবারে তিন জন লাথি মারিবার স্থান এ কপাটে আছে—তাই মাপ করিয়া তিন তিন জন করিয়া সাজাইয়াছি। মুখে বলিও—লছমী-নারায়েণকি জয়!

বন্দীরা বুঝিল। “লছমী-নারায়েণকি জয়!” বলিয়া, তিন জনে ঠিক এক তালে, প্রাণপণ শক্তিতে, সেই লোহার কপাটে পদাঘাত করিল।

বাহিরে চারি জন সিপাহী পাহারায় ঢুলিতেছিল, বজ্রের মত শব্দ সহসা তাহাদের কর্ণে প্রবেশ করাতে তাহারা চমকিয়া উঠিল। কোথায় কিসের শব্দ তাহা বুঝিতে না পারিয়া, এদিক্ ওদিক্‌ চাহিতে লাগিল। এ দিকে প্রথম তিন জন সরিয়া পিছনে গিয়াছে; আর তিন জন আসিয়া পলক মধ্যে তাহাদের স্থান লইয়া সেই এক তালে তিন বার কপাটে পদাঘাত করিল। লোহার কপাটের তাহাতে কি হইবে? কিন্তু বড় ঝঞ্ঝনা বাজিতে লাগিল। এক জন সিপাহী বলিল, “কিয়া রে?”

কিন্তু ভিতর হইতে “লছমী-নারায়েণকি জয়!” ভিন্ন অন্য কোন উত্তর হইল না। দ্বিতীয় সিপাহী বলিল, “শালা লোগ কেওয়াড়ি তোড়নে মাঙ্গ্‌তা হৈ।”

তৃতীয় সিপাহী। আরে তোড়্‌নে দেও। বাঙ্গালী লোহেকি কেওয়াড়ি তোড়েগা!

চতুর্থ সিপাহী। কেওয়াড়ি খোলকে দো চার থাপ্পড় লাগা দেঙ্গে?

প্রথম সিপাহী। আরে যানে দেও। আপহিসে বহু লোগ ঠণ্ডা হো যায়েগা।

এ সকল কথা বন্দীরাও বড় শুনিতে পাইল না। কেন না, এখন, বড় ঝড়ের সময়ে যেমন বজ্রাঘাত থামে না, তাহার যেমন উপর্য্যুপরি শব্দ থামে না, সেইরূপ শব্দে এখন লোহার কপাটের উপর পদাঘাত বৃষ্টি হইতেছিল—আর কিছুই শোনা যায় না। কয়েদীরা মাতিয়া উঠিয়াছিল—কিন্তু সীতারাম তাহাদিগকে ধৈর্য্যবিশিষ্ট করিয়া, যাহার যে নিদ্দিষ্ট স্থান, তাহাকে সেইখানে স্থির রাখিতে লাগিলেন। ফাটকের ভিতর কিছুমাত্র গোলযোগ বা বিশৃঙ্খলা ছিল না।

সিপাহীরা প্রথমে রঙ্গ দেখিতেছিল। মনে করিতেছিল যে, কয়েদীরা কৌতুক করিতেছে, এখনই নিবৃত্ত হইবে। ক্রমে দেখিল যে, সে গতিক নহে—ক্রমে কয়েদীদিগের বল বাড়িতে লাগিল। তখন তাহারা কয়েদীদিগকে শাসিত করা নিতান্তই প্রয়োজন বোধ করিল। তিন জনে পরামর্শ এই করিল যে, তাহারা কপাট খুলিয়া ভিতরে প্রবেশ করিয়া, কয়েদীদিগকে ভাল রকম প্রহার করিয়া নিরস্ত করিবে। তিন জনের মত হইল, কিন্তু এক জনের হইল না। আলিয়ার খাঁ সকলের প্রাচীন—দাড়ি একেবারে শণের মত। সে বলিল, “বাবা! যদি সত্য সত্যই কয়েদী ক্ষেপিয়া থাকে, তবে আমরা চারি জনে কি তাহাদের থামাইতে পারিব? বরং দ্বার খোলা পাইলে, তাহারা আমাদের চারি জনকে পিষিয়া ফেলিয়া পিল পিল করিয়া পলাইয়া যাইবে। তখন আমরা কি করিব? বরং জমাদ্দারকে খবর দেওয়া যাক্।

দ্বিতীয় সিপাহী। কেন জমাদ্দারকে খবর দিবারই তবে প্রয়োজন কি? সত্য সত্য উহারা কপাট ভাঙ্গিতে পারিবে, সে শঙ্কা ত আর করিতেছি না। তবে বড় দিক করিতেছে—তার জন্য জমাদ্দারকে দিক করিয়া কি হইবে? আজ থাক, কাল প্রাতে উহাদিগের উচিত সাজা হইবে।

কিছুক্ষণ সিপাহীরা এই মতাবলম্বী হইয়া নিরস্ত হইল। কয়েদীদিগের দ্বার ভঙ্গের উদ্যম দেখিয়া নানাবিধ হাস্য পরিহাস করিতে লাগিল। বলিতে লাগিল, “বাঙ্গালী লোহার কপাট ভাঙ্গিবে, আর বানরে সঙ্গীত গায়িবে, সমান কথা।”

লোহা সহজে ভাঙ্গে না বটে, কিন্তু দেয়াল ফাটিতে পারে। লোহার চৌকাট দেয়ালের ভিতর গাঁথা ছিল। দুই চারি দণ্ড পরে আলিয়ার খাঁ জ্যোৎস্নার আলোকে সভয়ে দেখিল, অবিরত সবল পদাঘাতের তাড়নে দেয়াল ফাটিয়া উঠিয়াছে। তখন সে বলিল, “আর দেখ কি? জমাদ্দারজিকে সম্বাদ দাও। এইবার কপাট পড়িবে।”

এক জন সিপাহী জমাদ্দারকে খবর দিতে শীঘ্র গেল। আর তিন জন হাঁ করিয়া কপাট পানে চাহিয়া রহিল।

দেখিল, ক্রমে দেয়াল বেশী বেশী ফাটিতে লাগিল। তার পর, দেয়ালটা ফাঁপিয়া উঠিল—ভিতরে চৌকাট ঢক্‌ ঢক্ করিয়া নড়িতে লাগিল—ঝন্ ঝন্ শব্দ বড় বাড়িয়া উঠিল। লাথির জোর আরও বাড়িতে লাগিল—বজ্রাঘাতের উপর বজ্রাঘাতের মত শব্দ হইতে লাগিল—শেষ, চতুর্দ্দিক্ প্রতিধ্বনিত করিয়া সেই লোহার কপাট, চৌকাট সমেত, দেয়াল ভাঙ্গিয়া মাটিতে পড়িয়া গেল। লক্ষ্মীনারায়ণ জিউর জয় শব্দে গগন বিদীর্ণ হইল।

নির্ব্বোধ হিন্দুস্থানীরা, হাঁ করিয়া দাঁড়াইয়া দেখিতেছিল, সরিয়া দাঁড়াইতে ভুলিয়া গিয়াছিল। যখন কপাট পড়িতেছে দেখিল, তখন দৌড়াইয়া পলাইতে লাগিল। দুই জন বাচিল, কিন্তু এক জনের পায়ের উপর কপাট পড়ায় সে ভগ্নপদ হইয়া ভূতলে পড়িয়া গেল। এ দিকে কপাট পড়িবামাত্র ভিতর হইতে, বাঁধ ভাঙ্গিলে জলপ্রবাহের মত বন্দি-স্রোত পতিত কপাটের উপর দিয়া হরিধ্বনি করিতে করিতে পতিত প্রহরীকে পদতলে পিষিয়া, গভীর গর্জ্জনে ছুটিল। সর্ব্বাগ্রে সীতারাম বাহির হইয়া আহত প্রহরীর ঢাল সড়কী তরবারি কাড়িয়া লইয়া আর দুই জনকে যমদূতের ন্যায় আক্রমণ করিলেন। তাঁহার তখনকার ভীষণ মূৰ্ত্তি দেখিয়া ও তাঁহার দারুণ প্রহারে আহত হইয়া প্রহরিদ্বয় উর্দ্ধশ্বাসে পলায়ন করিল। জমাদ্দার সাহেব তখনও আসিয়া পৌঁছেন নাই।

বন্দিগণ হরিধ্বনি করিতে করিতে ছুটিতে লাগিল—সীতারাম অসি হস্তে স্থির হইয়া এক স্থানে দাঁড়াইয়া তাহাদিগের পৃষ্ঠ রক্ষা করিতে লাগিলেন। সকলেই বাহির হইয়া গেলে, সীতারাম আবার একবার কারাগারের ভিতর প্রবেশ করিলেন। তাঁহার স্মরণ হইল যে, এক কোণে এক জন বন্দীকে মুড়ি দিয়া পড়িয়া থাকিতে দেখিয়াছিলেন। সে একবারও উঠে নাই বা কোন সাড়া দেয় নাই। সীতারাম মনে করিয়াছিলেন, সে পীড়িত। এখন তাঁহার মনে হইল, সে হয় ত বিনা সাহায্যে উঠিতে পারে নাই বা বাহির হইতে পারে নাই। সে বাহির হইয়াছে কি না, দেখিবার জন্য সীতারাম কারাগৃহ মধ্যে পুনঃপ্রবেশ করিলেন। দেখিলেন, সে তেমনি ভাবে সেই কোণে সর্ব্বাঙ্গ আবৃত করিয়া শুইয়া আছে।

সীতারাম ডাকিয়া বলিলেন, “ওগো! সবাই বাহির হইল, তুমি শুইয়া কেন?

যে শুইয়াছিল, সে বলিল, “কি করিব?”

এ ত স্ত্রীলোকের গলা। চেনা গলা বলিয়াই সীতারামের বোধ হইল। তিনি আগ্রহ সহকারে জিজ্ঞাসা কারলেন, “তুমি কে গো?”

সে বলিল, “আমি শ্রী।”