ঐতিহাসিক ভূমিকা

বঙ্কিম স্বয়ং বলিয়াছেন, “সীতারাম ঐতিহাসিক ব্যক্তি। এই গ্রন্থে সীতারামের ঐতিহাসিকতা কিছুই রক্ষা করা হয় নাই । গ্রন্থের উদ্দেশ্য ঐতিহাসিকতা নহে” (‘সীতারামে’র বিজ্ঞাপন)। আবার, “দুর্গেশনন্দিনী বা চন্দ্রশেখর বা সীতারামকে ঐতিহাসিক উপন্যাস বলা যাইতে পারে না” (‘রাজসিংহে’র বিজ্ঞাপন)।

কিন্তু বঙ্গদেশের সত্য ইতিহাস পড়িবার পর বঙ্কিমের এই অস্বীকার-বাণী গ্রহণ করা যাইতে পারে না। আমরা দেখিতে পাই যে, তাঁহার ‘সীতারাম’ উপন্যাস হইলেও প্রকৃতপক্ষে ইহা একখানি ঐতিহাসিক উপন্যাস, এবং তিনি এই গ্রন্থে ঐতিহাসিক উপন্যাসের লক্ষণগুলি ‘দুর্গেশনন্দিনী’ ও ‘চন্দ্রশেখর’ হইতে অনেক অধিক পরিমাণে রক্ষা করিয়াছেন; এই গ্রন্থখানি ইউরোপীয় সাহিত্যে রচিত হইলে সেখানকার গুণিগণ ইহাকে ঐতিহাসিক উপন্যাসের শ্রেণীতে নিঃসন্দেহ স্থান দিতেন; তাহার কারণ, পরিষৎ-সংস্করণের ‘আনন্দমঠে’র ভূমিকাতে আমি বিস্তারিত বিচার করিয়াছি। অর্থাৎ, বঙ্কিমচন্দ্র সীতারাম নামক রাজার জীবনের ঘটনাগুলির ও সেই যুগের বাঙ্গলার অবস্থার যে বিবরণ দিয়াছেন, তাহা অধিকাংশ একেবারে সত্য; ইহার কোন স্থানেই ঐতিহাসিক সত্যের প্রচণ্ড অপলাপ করেন নাই; ইতিহাসে পরিচিত কোন বিখ্যাত সাধুকে উপন্যাসের পাতায় ঠগ বলিয়া অঙ্কিত করিলে যে দূষিত কল্পনা হইত, সীতারামে কোথায়ও তাহা হয় নাই। এর উপর, সেই যুগে প্রজা ও শাসকের সম্বন্ধ, দেশের দশা, যুদ্ধ-বিগ্রহ-প্রণালী বঙ্কিম অক্ষরে অক্ষরে সত্য করিয়া আঁকিয়াছেন, অর্থাৎ এই উপন্যাসখানির দৃশ্যপট একেবারে সত্য। এই দুটি কথা এখানে প্রমাণ করিব।

বঙ্কিমের ‘সীতারাম’ ১৮৮৭ খ্রীষ্টাব্দে প্রথম ছাপা হয়। তাহার পর ইহার ঐতিহাসিক সত্যাসত্যতা লইয়া অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়, রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ও অন্যান্য কয়েক জন লেখক আলোচনা করিয়াছেন। কিন্তু ১৯২২ খ্রীষ্টাব্দে সতীশচন্দ্র মিত্রের ‘যশোহর-খুলনার ইতিহাস’ দ্বিতীয় খণ্ড প্রকাশিত হইবার ফলে ঐ সব পুরাতন তর্কবিতর্কের নিরসন হইয়াছে, এবং সীতারামের প্রকৃত বিবরণ সম্পূর্ণ ও বিস্তৃতভাবে জানা গিয়াছে। সে যুগের পারসী সরকারী কাগজ এবং ফরাসী কুঠিয়াল সাহেবদের চিঠি হইতে ঐ সময়কার দেশের ইতিহাস অতি বিশদ ও বিশুদ্ধ ভাবে জানা যায়। আমি এই দিকেই সতীশচন্দ্রের গ্রন্থের উপর কতকগুলি তথ্য যোগ করিয়া দিব। রাজা সীতারামের কার্য্যকলাপ সম্বন্ধে বেশী কিছু পাই নাই।1
সমসাময়িক সাক্ষীর কাহিনী ও স্থানীয় প্রবাদ অবলম্বনে ঐতিহাসিক সীতারামের জীবনী নীচে লিখিত হইল।

সীতারামের প্রকৃত জীবনী

১৮৬১-১৮৬৩ এই তিন বৎসর বঙ্কিম, খুলনা জেলায় ডেপুটী কলেক্টর ছিলেন, এবং ঐ জেলার মাগুরা বিভাগের সবডিভিসনাল অফিসর নিযুক্ত থাকেন। ঐ অঞ্চলে মাগুরা শহর হইতে ১৩ মাইল দক্ষিণ-পূর্বে সীতারামের রাজধানী মহম্মদপুর এখন গ্রাম মাত্র, কিন্তু তাঁহার রাজবাড়ী, মন্দির, দুর্গ-প্রাকার, পরিখা প্রভৃতির অগণ্য ভগ্নাবশেষ জঙ্গলে ঢাকা পড়িয়া আছে। স্থানীয় প্রবাদ এইরূপ যে, “রাইচরণ মুখোপাধ্যায় নামক একজন গল্পরসিক কর্ম্মকুশল ব্যক্তির সন্ধান পাইয়া, বঙ্কিম তাঁহার নিকট হইতে অনেক গল্পগুজব শুনিয়া লন। কেহ কেহ বলেন, রাইচরণ বাবু ২/৩ মাস বঙ্কিমচন্দ্রের বেতনভুক্ হইয়া মাগুরায় থাকেন ও তাঁহাকে সময়মত গল্প শুনাইতেন” (সতীশচন্দ্র, ২য় খণ্ড, ৫১৪ পৃ)। সীতারামের মৃত্যুর দেড় শত বৎসর পরেও তাঁহার বাসস্থানে তাঁহার নিজের এবং লোকজনের বংশধরদের মধ্যে প্রচলিত কাহিনী সীতারামের নিজ জীবনের বিবরণের একমাত্র উপাদান। তাহার উপর বঙ্গদেশের ইতিহাস কয়েক পৃষ্ঠা মাত্র ষ্টুয়ার্ট (তস্য পিতা রিয়াজ-উস্-সলাতীন, তস্য পিতা সলিমুল্লার তারিখ-ই-বংগালা) হইতে লইয়া বঙ্কিম নিজ কাহিনী পূর্ণ করিয়াছেন।

সীতারাম উত্তর-রাঢ়ীয় কায়স্থ। এই বংশে শ্রীরামদাস, বাঙ্গলার সুবাদার রাজা মানসিংহের অধীনে রাজস্ব-সেরেস্তায় চাকরি করিয়া খাস-বিশ্বাস উপাধি লাভ করেন। তাঁহার পৌত্র উদয়নারায়ণ ভূষণার মুসলমান ফৌজদারের2 —অর্থাৎ একাধারে ডিস্ট্রীক্ট ম্যাজিষ্ট্রেট ও স্থানীয় সৈন্যাধ্যক্ষের সজোয়াল্ অর্থাৎ প্রধান তহসিলদার ও কার্য্যাধ্যক্ষ নিযুক্ত হইয়া ভূষণায় আসেন। ইনিই সীতারামের পিতা। ভূষণা মুঘলযুগে জেলার শাসন-কেন্দ্র ছিল; কারণ, বঙ্গবিজয়ের পূর্ব হইতে আকবর জাহাঙ্গীরের সময় পর্যন্ত প্রবল-পরাক্রান্ত এক হিন্দু-রাজবংশের রাজধানী এখানে ছিল। বর্তমান মাগুরা শহর হইতে ভূষণা ১৬ মাইল পূর্বে।

উদয়নারায়ণ মহম্মদপুরের পার্শ্ববর্ত্তী শ্যামনগরে একটি জোত বন্দোবস্ত করিয়া লন এবং মধুমতী নদীর অপর পারে হরিহরনগরে নিজ বাসস্থান নির্ম্মাণ করিয়া, ঢাকা হইতে সেখানে পরিবার লইয়া আসেন, খ্রীঃ ১৬৭০এর কাছাকাছি; তখন সীতারাম ১০/১২ বৎসরের বালক।

যৌবনকালে সীতারাম অশ্বারোহণে, অস্ত্রচালনায় ও মৃগয়ায় দক্ষ হন এবং রাজস্ব বিভাগের কায়স্থ আমলার উপযোগী ফারসী ভাষা এবং বৈষ্ণবের প্রিয় সংস্কৃত ভাষাও অভ্যাস করেন। প্রথমতঃ নবাবের অধীনে রাজস্ব আদায় ও হিসাবের কাজ করিবার সময় তিনি মফঃস্বলের দলবদ্ধ ডাকাত এবং বিদ্রোহী পাঠান জমিদারদের দমন করিবার শর্ত্তে প্রকাণ্ড নল্‌দী পরগণা (বর্তমান নড়াইল, মাগুরার ঠিক দক্ষিণে সংলগ্ন) বাঙ্গলার সুবাদারের নিকট হইতে নিজনামে বন্দোবস্ত করিয়া লন। আমলার পুত্র এইরূপে তালুকদার হইলেন, ক্রমে জমিদার হইবেন, রাজা হইবেন, অবশেষে বিদ্রোহী সামস্ত হইবেন; তাহার আয়োজন আরম্ভ হইল।

বিশাল নল্‌দী পরগণা হাতে আসার ফলে সীতারামের আয় ও লোকবল দ্রুত বাড়িয়া উঠিতে লাগিল ৷ প্রথমে তাঁহার দুই জন বড় বন্ধু জুটিল; একজন রঘুরাম (পক্ষান্তরে রামরূপ) ঘোষ, দক্ষিণরাঢ়ীয় কায়স্থ, বীর ও পালোয়ান, মেনাহাতী এই ডাক নামে খ্যাত সেনাপতি হইলেন। অপর জন মুনিরাম রায়, বঙ্গজ কায়স্থ, উকীল (মন্ত্রণাদাতা অর্থাৎ ফরেন সেক্রেটারী) হইলেন। তাঁহার দেওয়ান যদুনাথ গাঙ্গুলী (উপাধি মজুমদার) বোধ হয় বঙ্কিমের চন্দ্রচূড় হইবেন। তাঁহার সেনা-বিভাগে যোগ দিল—বখ্‌তাওর্ খাঁ (ভূতপূর্ব ডাকাতের সর্দ্দার), আমল্ বেগ মুঘল্, হিন্দু নিম্নজাতীয় রূপচাঁদ ঢালী এবং ফকিরা মাছ-কাটা অর্থাৎ নমঃশূদ্র নিকারী। তাহার উপর, লোকমুখে এখনও সীতারামের সেনাপতিদের মধ্যে মোচ্‌ড়া সিংহ, গাবুরডলন (ডাক নাম) প্রভৃতি প্রসিদ্ধ। ক্রমে নবাব সরকার হইতে আরও অনেক তালুক বন্দোবস্ত করিয়া লইয়া, আয় অত্যন্ত বৃদ্ধি করিলেন, অসংখ্য বীর ও ভাগ্যান্বেষী সৈন্য আসিয়া তাঁহার দলে যোগ দিল; সীতারাম বিদ্রোহ দমন ও খাজনা আদায়ের নামে সেই অঞ্চলের সব ছোট বড় জমিদারদের পদানত অথবা তাঁহাদের জমিদারী লুঠ করিয়া বেড়াইতে লাগিলেন। বঙ্গের সুবাদার ঐ সব অরাজক অঞ্চলে শান্তি স্থাপনের সংবাদ এবং মাঝে মাঝে কিছু কিছু খাজনা পাইয়া সন্তুষ্ট থাকিতেন; কারণ, ১৬৮৯-১৬৯৭ পর্য্যন্ত বাঙ্গলার সুবাদার ছিলেন শান্তিপ্রিয়, গ্রন্থকীট, নিশ্চল, বৃদ্ধ নবাব ইব্রাহিম খাঁ; তাঁহার শাসনের কথা পরে বলিব।

সীতারাম নবাব-দরবারে নিজ উকীল (অর্থাৎ দূত) দ্বারা সুবাদারকে সন্তুষ্ট করিয়া তাঁহার সুপারিশে দিল্লীর দরবার হইতে ‘রাজা’ উপাধি ও জমিদারী ফর্মান3 আনিয়া মহাগৌরবে স্বদেশে রাজত্ব করিতে লাগিলেন। এবং এই নূতন পদমর্য্যাদার উপযুক্ত এক রাজধানী স্থাপন করিলেন। তাঁহার পৈতৃক পুরাতন কাচারী সূর্য্যকুণ্ডগ্রাম এবং পৈতৃক বাসস্থান হরিহরনগর, এই দুটির মধ্যস্থলে বাগ জানি গ্রামে নূতন রাজধানী গড়িলেন, তাহার নাম দিলেন মহম্মদপুর। মধুমতী নদীর পশ্চিমে যেখানে ঐ নদী একটা হেয়ার-পিনের মত পূর্ব্ব দিকে বাঁকিয়া চলিতেছে, সেই বাঁকের মুখের কাছে মহম্মদপুর; আর মহম্মদপুর হইতে ক্রমাগত উত্তর-পূর্বদিকে আট দশ মাইল চলিলে মধুমতী ও পরে বারাসিয়া, এই দুই নদী পার হইয়া ভূষণা সহর,—সে যুগে ঐ জেলার শাসনকেন্দ্র, সভ্যতা ও শিল্পের আবাস, এবং বহু পণ্ডিত ও সাধু লোকের বসতিস্থল।

বিজ্ঞ শ্রমী ঐতিহাসিক সতীশচন্দ্র মিত্র এই স্থান-নির্ব্বাচনের প্রশংসা করিয়াছেন। “মহম্মদপুরের অবস্থান অতি সুন্দর। উহার তিন দিকে বিল, এক দিকে নদী, মধ্যস্থানে উচ্চ স্থল। ভূষণার দিকে অর্থাৎ প্রধানতঃ যে দিক্ হইতে শত্রু আসিবার সম্ভাবনা, সেই পূর্বদিকেই নদী। কৃত্রিম পরিখা দ্বারা দক্ষিণ দিক্ দুষ্প্রবেশ্য করা যায়। অপর দুই দিকে দূরবিস্তৃত বিল, কিছুই করিবার আবশ্যক নাই…এই স্থানে একটি ভগ্ন মন্দিরে সীতারামের [বংশের] ভাগ্যদেবতা লক্ষ্মীনারায়ণ শিলা আবিষ্কৃত হন [তাঁহার পিতা উদয়নারায়ণ কর্ত্তৃক]। সীতারাম এখানে একটি মৃণ্ময় দুর্গ, কয়েকটি সুপ্রশস্ত জলাশয়, সুন্দর সুন্দর মন্দির ও আবাস-গৃহ নিৰ্ম্মাণ করেন” (৫৪০-৫৪৪ পৃ)।

এইখানকার তিনটি মন্দিরের ফলক অথবা ফলকের লিপির নকল পাওয়া গিয়াছে, তাহার সময় ১৬৯৯, ১৭০৩ এবং ১৭০৪ খ্রীষ্টাব্দ এবং সবগুলিই সীতারামের নামে। বহুদুর-বিস্তৃত প্রাচীরের চিহ্ন, কতকগুলি মাটির ঢিবি এখনও নীরবে দাঁড়াইয়া আছে।

ক্রমে চারি দিকে রাজ্য বিস্তার করিয়া সীতারাম অবশেষে ১৭১২ খ্রীষ্টাব্দে ভূষণার ফৌজদার সৈয়দ আবুতুরাব্‌কে অকস্মাৎ আক্রমণে হত্যা করেন, এবং ভূষণা দখল করিয়া ফেলেন। সতীশচন্দ্র মিত্র দেখাইয়াছেন যে, চরম উন্নতির সময় সীতারামের রাজ্য পদ্মার উত্তরে কিছু দূর হইতে সুন্দরবনের তটভূমি পর্য্যন্ত বিস্তৃত ছিল; উত্তর সীমা পাবনা, দক্ষিণ সীমা ভৈরব নদ; পূর্বে মধুমতীর ওপারে তেলিহাটী পরগণার শেষ, পশ্চিমে মামুদশাহী পরগণা পর্য্যন্ত। “সীতারামের জমিদারীর রাজস্ব ৭০ লক্ষ টাকার কম নহে” (৫৬৪ পৃ)। এ কথা আমার নিকট অসম্ভব বোধ হয়; কারণ, ১৭০৭ খ্রীষ্টাব্দে মুর্শিদ কুলী খাঁর সুশাসন ও সৎ বন্দোবস্তের ফলেও সমগ্র বাঙ্গলা সুবার সরকারী খাজনা ১৩১ লক্ষের উপর উঠে নাই।

আবুতুরাবের হত্যার সংবাদ পাইয়া মুর্শিদ কুলী খাঁ সীতারামকে দমন করিবার জন্য উঠিয়া পড়িয়া লাগিলেন। তিনি নিজ আত্মীয় বখ্‌শ আলী খাঁকে ভূষণার নূতন ফৌজদার-পদ দিয়া সৈন্য সহ আক্রমণ করিতে পাঠাইলেন, এবং পার্শ্ববর্ত্তী সব জমিদারদের হুকুম দিলেন, সীতারামের বিরুদ্ধে এই অভিযানের সাহায্য করিতে। সীতারামের তখন দুরদৃষ্ট— তিনি বিলাসে মগ্ন, সেনাপতি মেনাহাতী অতর্কিতভাবে স্নানের সময় নিহত হইলেন; আর দুর্গ রক্ষা করা হইল না, রাজধানীর মধ্যে চারি দিকে ছত্রভঙ্গ আরম্ভ হইল। সীতারামের বহু পরিবারের মধ্যে অনেকেই (তাঁহার কয়েকজন স্ত্রী ও সন্তান) আগেই মহম্মদপুর হইতে বাহিরে পলাইয়া গেলেন, ১৭১৪ সনে তাঁহাদের কয়জন কলিকাতায় ধরা পড়েন। সীতারামের পরাজয়ে শত্রুপক্ষের দক্ষিণ হস্ত ছিলেন রামজীবন আম্‌লা, বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ, নাটোর-রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা, এবং সীতারামকে বন্দী করিয়া মুর্শিদাবাদে লইয়া যান রামজীবনের ভৃত্য দয়ারাম রায়, দীঘাপতিয়া রাজবংশের আদিপুরুষ। তাঁহার বিশাল রাজ্য ছিন্নভিন্ন হইয়া নলডাঙ্গা, নড়াইল, নাটোর, দীঘাপতিয়া প্রভৃতির জমিদারী গঠন করিল। মুর্শিদাবাদে সীতারামের নৃশংস প্রাণদণ্ডের বিবরণ সলিমুল্লার তারিখ-ই-বংগালাতে এবং পরে ষ্টুয়ার্টের ইতিহাসে পাওয়া যায়। তাঁহার পরাজয়ের তারিখ ফেব্রুয়ারি ১৭১৪, এবং মৃত্যুর সময় বোধ হয় সেই বৎসরের অক্টোবর মাস (সতীশ, ২য় খণ্ড, ৫৮৯-৬০০ পৃ)।

তখনকার দেশের দশা

তেইশ বৎসর কাল মহা প্রতাপে বঙ্গদেশ শাসন করিয়া নবাব শায়েস্তা খাঁ ১৬৮৮ খ্রীষ্টাব্দের বর্ষাশেষে পদত্যাগ করিয়া আগ্রায় ফিরিয়া গেলেন। তাঁহার ক্ষমতায় দেশময় শাস্তি, ধনবৃদ্ধি, রাজ্যবৃদ্ধি ও সভ্যতার বিকাশ হইতেছিল। পরবৎসরের মাঝামাঝি নূতন সুবাদার হইয়া আসিলেন ইব্রাহিম খাঁ; ইনি পরম ধার্মিক, বৃদ্ধ, সর্বদা বই পড়িতে ও পণ্ডিতদের সঙ্গে আলোচনা করিতে ভাল বাসিতেন; যুদ্ধবিগ্রহ বা চারি দিকে সজাগ দৃষ্টি রাখা তাঁহার প্রকৃতির বিরোধী। অথচ ইনি বড় ন্যায়পরায়ণ, কোমলহৃদয় শাসক ছিলেন। ইংরাজ বণিকেরা তাঁহাকে “the most famously just good nabob” বলিয়া প্রশংসা করিয়াছেন। পারসিক ইতিহাসে লিখিত আছে যে, তিনি একটি পিঁপড়ার প্রতিও অত্যাচার হইতে দিতেন না। তাঁহার চেষ্টায় বাঙ্গলার চাষ-বাস ও বাণিজ্য বেশ বাড়িতে থাকিল। কিন্তু বাহির হইতে এক রাজনৈতিক ঝড় আসিয়া তাঁহার গুণগুলিকে দোষে পরিণত করিল, বাঙ্গলায় অরাজকতা আনিয়া দিল।

ঠিক এই ১৬৮৯ খ্রীষ্টাব্দের প্রথমেই বাদশাহ আওরংজীবের গৌরব ও সৌভাগ্য চরমে উঠিয়াছিল; তিনি ইহার পূর্বের তিন বৎসরে দাক্ষিণাত্যের শেষ তিনটি স্বাধীন রাজ্য ধ্বংস করেন—বিজাপুর ও গোলকুণ্ডার সুলতান দুই জনকে বন্দী করিয়া এবং মারাঠারাজ শম্ভুজীকে হত্যা করিয়া; মুঘল সাম্রাজ্য নামতঃ আহিমাচল-কুমারিকা পর্য্যন্ত বিস্তৃত হইল। কিন্তু ঠিক ইহার পরেই তাঁহার পতন আরম্ভ হইল। দক্ষিণে মারাঠারা, উত্তরে জাঠ ও রাজপুতেরা ক্ষেপিয়া উঠিল, শাসন ছত্রভঙ্গ হইল, সাম্রাজ্য জুড়িয়া বিপ্লব ও অরাজকতা ছড়াইয়া পড়িল। মারাঠা জনসঙ্ঘ সাম্রাজ্যতন্ত্রকে বিধ্বস্ত করিয়া দিল, তাহাদের হাতে কত বড় বড় মুঘল সেনাপতি পরাস্ত, বন্দী অথবা নিহত হইতে লাগিলেন, আলিমৰ্দ্দান খাঁ, ইসমাইল খাঁ মকা, কাসিম খাঁ, হিম্মৎ খাঁ, রুহুল্লা খাঁ, রুস্তম খাঁ, আর কত নাম করিব? বিশেষতঃ ধন্নাজী যাদব ও শান্তাঙ্গী ঘোরপড়ে নামক দুই জন অদম্য মারাঠা অশ্বপতি সেনানায়ক মুঘল-সৈন্যদের নাস্তানাবুদ করিয়া দিল। এই দুই জনের এমন খ্যাতি হইল যে, মুঘল-সৈন্যেরা ঘোড়াকে জলাশয়ে লইয়া গেলে পর ঘোড়া যদি ভড়কাইত বা জল পান না করিত, তখন তাহাকে বলিত, “কি রে! তুই বুঝি জলে ধন্না যাদবের মুখ দেখতে পাচ্ছিস?” আর, বাদশাহের সর্ব্বোচ্চ সেনানায়ক ফিরোজ জঙ্গ (নিজামবংশের প্রতিষ্ঠাতা) “যখন শুনিতেন যে, শান্তাজী তাঁহার ৮/৯ ক্রোশের মধ্যে আসিয়াছে, অমনি তাঁহার মুখ ভয়ে পাণ্ডুবর্ণ হইয়া যাইত, এবং শান্তাকে আক্রমণ করিতে যাইতেছি, এই মিথ্যা ঘোষণা করিয়া দিয়া শিবির তুলিয়া সেখান হইতে অন্য পথ দিয়া দূরে পলাইয়া যাইতেন” (ডফ ii 406 n., খাফি খাঁ ii 446)। উত্তর-ভারতে জাঠশক্তির অভ্যুদয় হইল, তাহারা আগ্রায় ও আগ্রার চারি দিকে লুঠিয়া বেড়াইতে লাগিল, তাহাদের বাধা দিবার কেহ রহিল না। রাজপুতানায় যে এই সময় ত্রিশবর্ষব্যাপী আগুন জ্বলিতে থাকিল, তাহা ‘রাজসিংহে’র ভূমিকায় দেখাইয়াছি।

বাদশাহের এই সব নিগ্রহ ও অক্ষমতার সত্য সংবাদ সুদূর প্রান্ত বঙ্গদেশে পৌঁছিতে পৌঁছিতে আরও পল্লবিত হইল। অমনি জমিদারগণ খাজনা দেওয়া বন্ধ করিল, দক্ষিণবঙ্গ ও উড়িষ্যার অসংখ্য ছোট ছোট পাঠানবংশ মাথা খাড়া করিল, সাধারণ ডাকাতেরা দল বাঁধিয়া পথে গ্রামে লুঠিতে লাগিল। শেষে প্রকাশ্য বিদ্রোহ দেখা দিল; শোভাসিংহ ও রহিম আফগানের বিদ্রোহ—বৰ্দ্ধমান-চন্দ্রকোনা হইতে রাজমহল পর্য্যন্ত ছড়াইল, ১৬৯৬-১৬৯৮ সন। [জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘স্বপ্নময়ী’ নাটক সম্পূর্ণ কাল্পনিক নহে।]

১৬৯০-১৬৯৭ আট বৎসর এইরূপ বিপ্লব চলিল। তাহার পর ১৬৯৮ সনে নূতন সুবাদার শাহজাদা আজীম-উদ্দীন ঐ বিদ্রোহ দমন করিলেন। রহিম যুদ্ধে হত এবং শোভাসিংহ অপঘাতে মৃত হইল। এবং ১৭০০ সনের শেষে অসাধারণ দক্ষ ও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ নূতন দেওয়ান মুর্শিদ কুলী খাঁ বাঙ্গলায় পৌঁছিয়া দেশে কতকটা শান্তি ও সুব্যবস্থা স্থাপন করিতে পারিলেন। কিন্তু তাহাতে প্রজাদের কোন লাভ হইল না। সুদূর দাক্ষিণাত্যে অতিবৃদ্ধ বাদশাহ নিজে মারাঠা অক্ষৌহিণী কর্ত্তৃক অনবরত ঘেরা, উত্তরভারতের কোন সুবায় সৈন্য ও কামান পাঠাইয়া সাহায্য করা তাঁহার পক্ষে অসম্ভব; বরং তিনি এই দশ-বারো বৎসর ক্রমাগত হিন্দুস্থান হইতে নূতন-ভর্ত্তি সৈন্য ও আগ্রার কোষাগার হইতে পূর্ব্বপুরুষদের সঞ্চিত ধনরত্ন চাহিয়া আনাইয়া তাহা প্রায় নিঃশেষ করিয়া দিলেন। সুতরাং বাঙ্গলায় স্থানীয় বিদ্রোহ বেশী বিস্তৃত হইলে তাহা দমন করা সুবাদারের অসাধ্য ছিল। শোভাসিংহ ও রহিম খাঁর পতনের পর বাঙ্গলার কেন্দ্রীয় অংশে শান্তি স্থাপিত হইলেও দূর দূর সীমান্তে—যেমন তটভূমি খুলনা জেলায় — বিদ্রোহ চলিতে লাগিল; সেখানে কে যায়?

বাদশাহ এখন ৮৪ বৎসরেরও অধিক বয়স্ক, বৃদ্ধ এবং পঙ্গু; রাজপুত্রগণ তাঁহার আসন্ন মৃত্যুর কথা ভাবিয়া তাঁহার দেহান্তে সিংহাসন লইয়া যে যুদ্ধ বাধিবে, তাহার জন্য প্রস্তুত হইতে লাগিলেন। আজীম-উদ্দীনের একমাত্র লক্ষ্য হইল—বাঙ্গলার মত বিখ্যাত স্বর্ণখনি হইতে দুই হাতে টাকা সংগ্রহ করিয়া পিতামহের মৃত্যুর পর সিংহাসন পাইবার পথ আর সব প্রতিদ্বন্দ্বী অপেক্ষা তাঁহার পক্ষে অধিক সুগম করা। ১৭০৭ সনে আওরঙ্গজীবের মৃত্যুর পর যখন আজীম বাঙ্গলা-বিহার ছাড়িয়া আগ্রার দিকে গেলেন, তখন তিনি তিন কোটি টাকা সঙ্গে লইয়া যান, এরূপ লোকে বলে। চন্দননগরের ফরাসী কুঠিয়াল সাহেবেরা এই গূঢ় অভিসন্ধির এবং দেশের দশার সঠিক চিত্র তাঁহাদের রিপোর্টে প্যারিস নগরীতে কর্তাদের নিকট পাঠান; ১৬৯৯ হইতে ১৭০৩ পৰ্য্যন্ত তাঁহাদের চিঠি হইতে কিছু কিছু অনুবাদ করিয়া দিতেছি (Kaoppelin, La Compagnie Indes Orientales et F. Martin, pp. 340, 461, 624 ):—

“শাহজাদা আজীম্‌উদ্দীন [ভুল বানান Massowdy] বিদ্রোহীদের দমন করিবার পর প্রাচ্য দেশের প্রথা অনুসারে, লোকদের রীতিমত শোষণ করা ছাড়া আর কিছুতেই মন দিলেন না; সব কর্ম্মচারিগণ তাঁহার দৃষ্টান্ত অনুসরণ করিতে বাধ্য হইল।…আওরংজীবের অতিবাৰ্দ্ধক্য এবং তাঁহার উত্তরাধিকার লইয়া আসন্ন প্রশ্নের ফলে সমস্ত রাজ্যময় অরাজকতা বাড়িয়া গেল। ভারপ্রাপ্ত কর্ম্মচারীরা এই সুযোগে অর্থ সংগ্রহ করিতে লাগিল এবং অত্যধিক জোরে আদায় ও অবিচার দ্বারা প্রজাদের দলিত করা ছাড়া আর কিছুই খুঁজিল না। আমাদের [ইষ্ট ইণ্ডিয়া] কোম্পানীও ইহা হইতে রেহাই পাইল না। শাহজাদা আজীম এবং বাদশাহ কর্ত্তৃক অসামান্য ক্ষমতা-যুক্ত হইয়া বঙ্গে প্রেরিত নূতন দেওয়ান (মুর্শিদ কুলি খাঁ) নিজেই ঘৃণিত লুণ্ঠনের দৃষ্টান্ত দেখাইলেন এবং প্রজাদের শোষণ করিবার কোন পন্থা হইতেই নিবৃত্ত থাকিলেন না।…সমস্ত প্রদেশটি ক্রমাগত গরীব হইতে লাগিল, টাকা অধিক হইতে অধিকতর দুষ্প্রাপ্য হইল, শিল্পবাণিজ্যে মন্দা ধরিল। বঙ্গদেশে ব্যবসা করা প্রায় অসম্ভব হইয়া দাড়াইল।”

ঠিক এই অশান্তি ও অত্যাচারের মধ্যে সীতারামের উত্থান। সুতরাং তাঁহার কাছে অনেক সঙ্গী সহায়ক আসিয়া জুটিল, অনেক পিষ্ট লোক তাঁহার নবপ্রতিষ্ঠিত রাজ্যে আশ্রয় লইল ৷ ১৬৯৯ হইতে ১৭১২ পর্য্যন্ত সীতারাম অবাধে রাজ্য বিস্তার ও নিষ্কণ্টক রাজসুখ ভোগ করিলেন। কিন্তু ১৭১৩ সনে ফর্‌রুখ্‌সিয়র্ দিল্লীর বাদশাহ হইবার পর মুর্শিদ কুলী খাঁ বাঙ্গলার সুবাদার4 হইয়া আসিলেন। তিনি ইহার পূর্ব্বে বঙ্গ ও উড়িষ্যার দেওয়ান এবং প্রায় সমস্ত বাঙ্গলা ও উড়িষ্যার ফৌজদার মাত্র এবং শেষে উড়িষ্যার সুবাদার ছিলেন। এখন হইতে নামতঃ এবং কাৰ্য্যতঃ এই দুই প্রদেশে সৰ্ব্বেসর্বা হইলেন। ঠিক তাহার পরের শীতকালেই সীতারামের ধ্বংস সাধন করিলেন (ফেব্রুয়ারি ১৭১৪)।

হিন্দুদের অবস্থা

বাদশাহ আওরংজীবের দীর্ঘ রাজত্বের ঠিক মাঝামাঝি, যখন বড় বড় হিন্দু সামন্ত রাজারা সকলে মরিয়া গেলেন, অমনি তাঁহার ধর্মান্ধতা প্রকাশ্যে দেখা দিল, এবং তিনি যতই বৃদ্ধ হইতে লাগিলেন, তাঁহার গোঁড়ামি ও ভিন্ন ধর্ম্মের প্রতি অসহিষ্ণুতা চরমে উঠিল। কি হিন্দু, কি শিয়া, কি বোরা সম্প্রদায়, সকলকেই রাজশাসনের যন্ত্র দিয়া উৎখাত করিতে লাগিলেন। তাঁহার প্রাদেশিক কর্ম্মচারীরা ইস্‌লামের ধর্ম্মবিধি (শরা’)কে অক্ষরে অক্ষরে প্রজাদের উপর চালাইতে বাধ্য হইল। ইহার অনেক দৃষ্টান্ত, মূল দলিলের নাম ও পৃষ্ঠা সহিত আমার ইংরাজী ‘হিষ্ট্রী অব্ আওরংজীবে’র ৩য় খণ্ডের ৩৪ অধ্যায়ে সবিস্তারে দিয়াছি। বাঙ্গলাদেশেও অমুসলমানদের শরা’-অনুযায়ী নির্যাতন ও আদালতে পার্থক্যমূলক ব্যবহার, অর্থাৎ আইনের জোরে অবিচার হইত, তাহার দৃষ্টান্ত আছে। ইস্‌লামি ধর্ম্মশাস্ত্রের প্রতিনিধি বলিয়া কাজীর পদ এবং ক্ষমতা প্রাদেশিক শাসনকর্ত্তা সুবাদারের উপর উঠিত।

খাফি খাঁ লিখিতেছেন,—“বাদশাহ রাজ্যের কাজে এবং ছোট বড় সব বিষয়ে কাজীদের এত প্রভুত্ব দিলেন যে, তাহা বড় বড় ওমরা এবং মন্ত্রীদেরও ঈর্ষার বিষয় হইল। … একদিন দাক্ষিণাত্যের সংবাদ-লেখকদের পত্র হইতে বাদশাহ জানিতে পারিলেন যে, শিবাজী বিদ্রোহী হইয়া খুব গণ্ডগোল করিতেছেন, এবং তাঁহাকে দমন করিবার জন্য সেনাপতি মহাবৎ খাঁকে পাঠাইবার প্রস্তাব হইল। বাদশাহ মহাবৎ খাঁর দিকে মুখ ফিরাইয়া বলিলেন যে, ‘এই কাফিরবাচ্চা অসীম বাড়াবাড়ি আরম্ভ করিয়াছে, উহাকে সমূল উৎপাটন করা আবশ্যক।’ মহাবৎ খাঁ উত্তর দিলেন, ‘সৈন্য প্রেরণ দরকার কি? কাজীর একটা ঘোষণা পাঠাইয়া দিলেই কাজ সিদ্ধ হইবে।’ বাদশাহ অসন্তুষ্ট হইলেন, এবং পরে গোপনে জাফর খাঁকে বলিলেন, ‘মহাবৎ খাঁকে বুঝাইয়া দিও যে, এরূপ লঘু কথা প্রকাশ্য দরবারে যেন না কহে।’ [মূল পারসিক, ii. 216-217.]

বাঙ্গলাদেশে সেই সময়ে এই শ্রেণীর একটি ঘটনা ঘটে, তাহা সলিমুল্লা ও ঘুলাম হুসেন সালিম নিজ নিজ ইতিহাসে লিখিয়া গিয়াছেন :—

একজন ফকির চূনাখালীর তালুকদার বৃন্দাবনের নিকট ভিক্ষা চাওয়ায় তিনি বিরক্ত হইয়া উহাকে বাড়ী হইতে বাহির করিয়া দেন। ফকির কতকগুলি ইট কুড়াইয়া আনিয়া তাহা সাজাইয়া বৃন্দাবনের বাড়ী হইতে বাহিরে যাইবার পথ বন্ধ করিয়া একটি ছোট দেওয়াল খাড়া করিল এবং উহাকে মসজিদ নাম দিল। যখনই বৃন্দাবন ঐ পথে চলিতেন, ফকির উচ্চস্বরে আজান পড়িত। বৃন্দাবন উত্যক্ত হইয়া একদিন কয়েকখান ইট ফেলাইয়া দিলেন এবং ফকিরকে গালি দিয়া তাড়াইয়া দিলেন। ফকির গিয়া মুর্শিদ কুলীর নিকট নালিশ করিল। বিচারক কাজী মুহম্মদ শরফ্ উলেমাদের লইয়া আলোচনা করিয়া বৃন্দাবনের প্রাণদণ্ডাজ্ঞা দিলেন। মুর্শিদ কুলী এই হত্যায়, অনিচ্ছুক হইয়া কাজীকে জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘এই বেচারা হিন্দুকে বাঁচাইবার জন্য ধর্ম্ম-আইনের কড়া বিধি এড়াইবার কোন উপায় আছে কি?’ কাজী উত্তর দিলেন, ‘হাঁ, আছে। উহার প্রাণ লইতে ততক্ষণ দেরি হইতে পারে, যতক্ষণে উহার প্রাণভিক্ষার্থী বন্ধুকে আগে মারিয়া ফেলা হইবে। তাহার পর উহাকে বধ করা নিশ্চিত।’ মুশিদ কুলী খাঁর সব চেষ্টা বিফল হইল; এমন কি, সুবাদার শাহজাদা আজীম-উদ্দীনের অনুরোধ পর্য্যন্ত বাদশাহ গ্রাহ্য করিলেন না।…তিনি শাহজাদার পত্রের উত্তরে লিখিয়া পাঠাইলেন, —

‘কাজী শরফ্

খোদাকি তরফ্।’

[তারিখ-ই-বংগালা, মুর্শিদ কুলী খাঁ অধ্যায়ের ঠিক শেষে; রিয়াজ-উস-সালাতীন, মূল ২৮৫-২৮৬ পৃ]।

বাদশাহ এই মুহম্মদ শরফ্‌কে নিজে বাছিয়া লইয়া বাঙ্গলার কাজী নিযুক্ত করিয়া পাঠান এবং মুর্শিদ কুলী সব মোকদ্দমায় এই কাজীর মত [ফতোওয়া] অনুসারে কাজ করিতেন। কুরাণে [নবম সূরা, ২৯ শ্লোক] লেখা আছে, “যাহারা সত্য-ধৰ্ম্ম অর্থাৎ ইসলাম্ গ্রহণ করে না, তাহাদের সঙ্গে যুদ্ধ করিবে, যতক্ষণ না তাহারা হীনভাবে (ওহম্ সাঘিরূণ) হাত দিয়া জজিয়া কর দেয়।” এজন্য আওরংজীব হুকুম দিলেন যে, কোন হিন্দু ঐ টেক্সের টাকা বাহক দিয়া পাঠাইয়া দিলে তাহা গ্রহণ করা হইবে না, সে নিজে আসিয়া দাড়াইয়া থাকিয়া মাথা নীচু করিয়া নিজ হাতে টাকাগুলি তহসিলদারের হাতে দিবে। তাঁহার অনেক চিঠি পাওয়া গিয়াছে, যাহাতে তিনি এই নিয়ম পালনে অবহেলা করার জন্য মুসলমান কর্ম্মচারীদের ধমকাইয়াছিলেন।

যখন বাদশাহের পৌত্র আজীম-উদ্দীন বাঙ্গলা দেশের শাসন-কৰ্ত্তা, সেই ১৭০০ খ্রীষ্টাব্দে কিরূপ সদা-সজাগ গভর্ণমেন্টের চেষ্টায় হিন্দু-মন্দির ধ্বংস করা হইত, তাহা এক সরকারী পত্র হইতে পরিষ্কার বুঝা যায়। পত্রখানি বাদশাহের আজ্ঞায় মীর মুহম্মদ আমান নামক বাঙ্গলা-সুবার সংবাদ-লেখক (সওয়ানে-নিগার)কে ভর্ৎসনা করিয়া লেখা হইয়াছিল; ইহা শেখ মুহম্মদ ফাজিলের পুত্র মুহম্মদ জাফর-সঙ্কলিত ‘ইন্‌শা-ই-আজীব্’ নামক হস্তলিপির নবম পাতায় আছে। অনুবাদ;—

“এই সময় বাঙ্গলা দেশের [গুপ্ত-] সংবাদ হইতে বাদশাহ জানিতে পারিলেন যে, প্রয়াগদাস ও মথুরামল নামক দুইজন গুজরাটী ব্রাহ্মণ মখ্‌সুসাবাদ অঞ্চলে লালজী নামক একটি প্রস্তরমূর্ত্তি গড়াইয়া, মন্দিরে স্থাপন করিয়া আঁধার-হৃদয়ে অন্যান্য বহু বদমাশ জনতার সহযোগে তাহাকে পূজা করিতেছে এবং প্রত্যহ নিকট ও দূর হইতে অনেক লোক আসিয়া ভিড় করিয়া এই ঘৃণিত কার্য্যে প্রশ্রয় দিতেছে। আমাদের ধার্ম্মিক বাদশাহের সমস্ত আগ্রহ ইসলামধৰ্ম্ম প্রচলনে এবং হেয় কাফিরদের রীতিনীতি দূর করিতে নিযুক্ত, যাহার জন্য এই ভারত সাম্রাজ্যের কথা দূরে থাক্, এমন কি, ইরাণ ও তুরাণ, রুশ ও খোরাসান, যেখানেই মূৰ্ত্তিপূজা দেখা দেয়, যত দিন পর্য্যন্ত সেখান হইতে সেই অপ-ধৰ্ম্ম ও মিথ্যাবিশ্বাসের সুত্র সম্পুর্ণ দূর না হয়, তত দিন তিনি সে দিকে স্বয়ং সৈন্য চালনা করিতে বিরত থাকিবেন না। অতএব বিশ্বপ্রভু জগৎ-মান্য সম্রাট্ এই আজ্ঞা পাঠাইতেছেন যে, শাহজাদা মুঃ আজীম্‌ এই অপদার্থ দলকে সাজা দিয়া, ঐ ঘৃণিত পুত্তলিকা ভাঙ্গিয়া ফেলুন এবং ঐ স্থানে একটি উচ্চ মসজিদ নির্ম্মাণ করুন এবং নিয়ম করিয়া দিন যে, দলে দলে আলোকিত হৃদয় মুসলমানগণ ঐখানে অদ্বিতীয় ঈশ্বরের আরাধনায় নিযুক্ত থাকিবে।

কিন্তু এটা অত্যন্ত আশ্চর্যের বিষয় যে, আপনি শাহজাদার সরকারী সংবাদ-লেখক-[সওয়ানে-নিগার-]পদে প্রতিষ্ঠিত থাকা সত্ত্বেও আপনার সংবাদের রিপোর্টে ঠিক সময়ে এই ঘটনার উল্লেখ করেন নাই, অথচ বাহিরের এক লোক ইহা বাদশাহকে জানাইয়াছে! বাদশাহ বার বার মির্জা ইয়ার আলি বেগ [ডাক ও গুপ্তচর বিভাগের প্রধান অধ্যক্ষ]কে বলিলেন,— ‘এর ভাই মির্জা লাহোরী নিজ কাজ ভালরূপে না করায় আমার কোপে পড়িয়াছিল, অথচ এ (বাঙ্গলার সওয়ানে-নিগার) সম্রাটের রাগকে ভয় করে না; ইহাকে নিশ্চয়ই শাস্তি দিতে হইবে। অতএব, আপনার উচিত যে, ভবিষ্যতে প্রত্যেক ঘটনাই তৎক্ষণাৎ ভাল করিয়া লিখিয়া আপনার সংবাদ-চিঠির অন্তর্গত করিবেন।” পত্রলেখকের নাম মীর মুলতালী। [তখনও মখ্‌সুসাবাদের নাম মুরশিদাবাদ করা হয় নাই এবং দ্বিতীয় নামের সৃষ্টিকর্ত্তা তখনও কার্ তলব্ খাঁ নামে পরিচিত, মুরশিদ কুলী খাঁ উপাধি পান নাই ৷]

সুতরাং গঙ্গারামের লঘু অপরাধে জীবন্ত সমাধির হুকুম সে যুগের বাঙ্গলার ঐতিহাসিক সত্যের অনুযায়ী; এটি বঙ্কিমের কল্পনা-প্রস্তুত অসম্ভব ঘটনা নহে। এই অবিচারী ধর্ম্মান্ধ সম্রাটের বিরুদ্ধে প্রজাপুঞ্জের স্বাভাবিক ন্যায্য প্রতিক্রিয়া রাজপুত, শিখ, মারাঠা ও জাঠদের মধ্যে যাহা তখন ঘটে, তাহা ভারত-ইতিহাস হইতে সকলেই জানেন। বাঙ্গলায় তাহাই উপন্যাসছলে বঙ্কিম আঁকিয়াছেন।

সীতারাম-চরিত্র

তবে সীতারামের পতন হইল কেন? যশোহর-খুলনার ইতিহাসের জন্মভূমিভক্ত গবেষক সতীশচন্দ্র মিত্র স্বীকার করিয়াছেন যে, রাজা হইবার পর সীতারাম বড় বিলাসী ও ইন্দ্রিয়-পরায়ণ হইয়া পড়েন, এরূপ কথা সেই অঞ্চলে এখনও প্রচলিত। রাজা-নবাবরা আরাম ও নেশায় মত্ত থাকিবে, রংমহালে যুবতিশত-বৃতং হইয়া অহোরাত্র লীলা করিবে, এটা আর আশ্চর্য্য কথা কি? কিন্তু এইখানেই বঙ্কিম তাঁহার কবি-প্রতিভার পরিচয় দিয়াছেন, এই তুচ্ছ নিত্যনৈমিত্তিক ভোগ-বিলাসের অন্তরে একটি গূঢ় কারণ নিহিত করিয়া ইহাকে সাধারণ বাস্তব জগৎ হইতে অনেক দূরে, অনেক উর্দ্ধে আনিয়াছেন। তাঁহার সীতারাম রায় প্রথমে আমাদের কাছে দেখা দেন—অনন্যসামান্য মহাপ্রাণ উদ্যোগী পুরুষসিংহ-রূপে। তাহার পর ঘটনার ঘাতপ্রতিঘাতে তাঁহার চরিত্রের অভিব্যক্তি হইয়া ক্ৰমে গভীর অবনতিতে আসিয়া পড়েন,—যদিও জীবনের শেষ মুহূর্ত্তে তাঁহার বীরত্ব মনুষ্যত্ব আবার দপ করিয়া জ্বলিয়া উঠিল। নায়কের এই চরিত্র-পরিবর্ত্তনই ‘সীতারাম’ উপন্যাসকে শেক্ষপীয়রের ‘ম্যাকবেথে’র মত শ্রেষ্ঠ বিয়োগান্ত নাটক করিয়া তুলিয়াছে। এই দুই কাব্যেই আমরা দেখি, কেমন করিয়া ধীরে ধীরে, প্রায় অদৃশ্য গতিতে বাহ্য ঘটনার আঘাতে অর্থাৎ স্বাভাবিক কারণে, একজন দেব-চরিত্র বীর অবশেষে দানব হইয়া উঠেন। ‘আনন্দমঠ’ ও ‘দেবীচৌধুরাণী’তে চরিত্রের ক্রমবিকাশ উপরের দিকে, ক্রমে মহৎ হইতে মহত্তর হইতেছে, —যেমন বৌদ্ধ-গল্পে এক একজন বোধিসত্ত্ব মানুষ হইয়া জন্মিলেও ক্রমে আত্মসংযম, স্বার্থত্যাগ এবং সুবুদ্ধির ফলে উচ্চ হইতে উচ্চতর জন্মের ভিতর দিয়া অবশেষে চরম স্তরে পৌঁছিয়া একজন সম্পূর্ণ বুদ্ধ হইয়া নিৰ্ব্বাণ লাভ করেন। সীতারামের হৃদয়ের গতি ঠিক ইহার বিপরীত দিকে। আর একটি উপমা দিই—শেক্ষপীয়রের ‘জুলিয়াস সিজার’ নাটকের এণ্টনি কি বীর দক্ষ কর্মকুশল যোদ্ধা! আর সেই লোকটিই ‘এণ্টনি এও ক্লিওপ্যাট্রা’ নাটকে উদ্যোগহীন ইন্দ্রিয়পরায়ণ কামিনীর দাস হইয়া প্রাণ দিলেন।

আমাদের এই উপন্যাসখানির আরম্ভে আমরা সীতারামের পরিচয় পাই—এক অসাধারণ সত্যব্রতী, স্বার্থত্যাগী, পরহিতপরায়ণ, তীক্ষ্ণবুদ্ধি, দ্রুতসিদ্ধান্তে অভ্যস্ত কর্ম্মবীর, যেন ঈশ্বর তাঁহাকে জননেতা হইবার জন্যই সৃষ্টি করিয়াছেন। ক্রমে তিনি বাড়িয়া উঠিলেন, পার্থিব সফলতার চরমে পৌঁছিলেন, আর তার পরই তাঁহার চরিত্রে পতন আরম্ভ হইল। ইহার কারণ, কাম বা সৌন্দর্যপিপাসা নহে। যদি তাহাই হইত, তবে তাঁহার রাণী রমা বা অন্য কোন মোমের পুতুল সে তৃষ্ণা মিটাইতে পারিত। কিন্তু এই গণনেতা, এই কর্ম্মবীর সফলতার শিখরে দাঁড়াইয়া দেখিলেন যে, নিজে নিঃসঙ্গ, একেলা; তাঁহার জীবনের ধ্যেয় কাজটি সুসম্পন্ন করিবার জন্য চাহিলেন একজন হৃদয়সঙ্গিনী (যাহার ইংরাজী অনুবাদ soul-mate, এবং কালিদাসী অনুবাদ—গৃহিণী সচিবঃ সখী মিথঃ)। বঙ্কিমের ভাষায়ই বলি—“কিন্তু সহ-ধর্মিণী কই? যে তাঁহার উচ্চ আশায় আশাবতী, হৃদয়ের আকাঙ্ক্ষার ভাগিনী, কঠিন কার্য্যের সহায়, সঙ্কটে মন্ত্রী, বিপদে সাহসদায়িনী, জয়ে আনন্দময়ী, কই?” ( সীতারাম, ১ম খণ্ড, ১০ম পরিচ্ছেদ)।

ঠিক এই অভাবের ফলে গল্পের এই স্থলে বিষবৃক্ষের বীজ অজ্ঞাতসারে বপন করা হইল, গল্পের অবশিষ্ট অংশের ভিতর দিয়া তাহাই ক্রমে স্বাভাবিক বৃদ্ধি পাইয়া, অঙ্কুরিত, পল্লবিত, ফলপ্রসূ হইয়া সীতারাম, মহম্মদপুর, ভূষণারাজ্য, সকলকে বিনষ্ট করিল, নিষ্ঠুর কালস্রোতে অর্থাৎ অদৃষ্টশক্তিতে এ সব ভাসিয়া গেল।

গ্রীক অলঙ্কার-লেখকেরা বলেন যে, বিয়োগান্ত নাটকের উদ্দেশ্য—করুণা ও লোমহর্ষণ-ভাব উদ্রেক করিয়া দর্শকের হৃদয় গলিত, ধৌত, মার্জ্জিত করিয়া দেওয়া। সুতরাং— ‘সীতারাম’ নিঃসন্দেহ গদ্য ট্রাজেডী।

আলোচনার উপসংহার

The proper place of historical novels is not [among histories, but among literature.] The shortcomings of the historical novel proper, particularly the historical novel in our own time, which tends more and more to appropriate the authentic figures of the past and to have less and less to do with imaginary characters. On the whole the greater the use the historical novelist makes of invented people and incidents the better are his chances of producing what is called a work of art. “What might have been is not the same as what was,” [Dr. Gooch], and fiction, therefore, however conscientious and erudite, could never provide a substitute for genuine historical study. However, it is because of a certain inadequacy in history,—the dead carrying most of their secrets with them to the grave and our knowledge [of past ages] thus remaining eternally—incomplete—that Dr. Gooch championed the case of the historical novel.

Again and again Dr. Gooch illustrated how much the historical novel has contributed to the understanding of history.

Millions have gathered from the historical novel & knowledge of history which they would not have acquired by any other means. Finally, “historical fiction has played an active part in reviving and sustaining the sentiment of nationality, which for good or evil has changed the face of Europe in the nineteenth and twentieth centuries.” (Times, Lit. Sup, 30 June 1945, p. 307)

“ইতিহাস এবং উপন্যাস এক বস্তু নহে। ঐতিহাসিক উপন্যাসের প্রকৃত স্থান সাহিত্যের শ্রেণীতে, ইতিহাসের শ্রেণীতে নহে।…আজকাল ইউরোপে যে সব ঐতিহাসিক উপন্যাস লেখা হইতেছে, তাহার প্রধান দোষ এই যে, তাহার মধ্যে অতীত কালের সত্য ব্যক্তি এবং ঘটনার ভাগ অতিমাত্রায় বাড়িয়া চলিয়াছে এবং গ্রন্থকারের কল্পনায় প্রস্তুত চরিত্র কমিয়া যাইতেছে। লেখক যতই বেশী পরিমাণে নিজ কল্পনায় সৃষ্ট চরিত্র ও ঘটনা রঙ্গমঞ্চে নামাইবেন, ততই তাঁহার একখানা সাহিত্যগ্রন্থ, একটি প্রকৃত কলার বস্তু রচনা করিবার সুযোগ বাড়িবে।

“রয়াল হিষ্টরিকাল সোসাইটীর সম্মুখে জুন মাসের শেষ সপ্তাহে বক্তৃতা করিবার সময়, অধ্যাপক গুচ বলিয়াছেন, ‘যাহা হইলেও হইতে পারিত, তাহা এবং সত্যই সংঘটিত ব্যাপার, এক জিনিষ নহে।’ অতএব ঐতিহাসিক উপন্যাস যতই যত্নে লিখিত ও পণ্ডিতোচিত তথ্যে পূর্ণ হউক না কেন, তাহা আসল ইতিহাস পাঠের স্থান কখনই লইতে পারে না। তথাপি, ঐতিহাসিক উপন্যাসের একটা সার্থকতা আছে; তাহার কারণ, সত্য ইতিহাসের মধ্যে একটা কি-যেন অভাব বোধ হয়; অর্থাৎ অতীত যুগের মৃত নায়ক নায়িকাগণ তাঁহাদের জীবনের প্রায় সব গোপনীয় ব্যাপারগুলি সঙ্গে লইয়া তিরোধান করিয়াছেন, এবং আধুনিকেরা অতীত যুগকে চিরদিনই শুধু ভাঙ্গা ভাঙ্গা রকমে চিনিতে পারে। পাঠক-হৃদয়ের এই শূন্য স্থান ঐতিহাসিক উপন্যাস পূর্ণ করে। অধ্যাপক গুচ বহু দৃষ্টান্ত দিয়া দেখাইয়াছেন, ঐতিহাসিক উপন্যাস, আমাদের ইতিহাস বুঝিতে কত বেশি সাহায্য করিয়াছে। লক্ষ লক্ষ পাঠক ঐতিহাসিক উপন্যাস হইতে ইতিহাসের যে জ্ঞান লাভ করিয়াছে, তাহা অন্য কোন উপায়ে পাইতে পারিত না । অবশেষে তিনি বলেন— ‘ঐতিহাসিক উপন্যাস সাধারণের হৃদয়ে জাতীয়তাবোধ জাগাইতে এবং সজীব রাখিতে অতি ক্রিয়াশীল শক্তির কাজ করিয়াছে; আর এই জাতীয়তা-বোধই ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীতে ইউরোপের রূপ বদলাইয়া দিয়াছে।”

বঙ্গীয় সাহিত্য-পরিষদের প্রকাশিত বঙ্কিম-গ্রন্থাবলীর এক একটি ঐতিহাসিক উপন্যাসের যে ভূমিকা লিখিয়া দিয়াছি, তাহাতে যে সকল সিদ্ধান্তে পৌঁছান গিয়াছে, তাহারই আশ্চর্য্য সমর্থন পাওয়া গেল বিলাতের বিখ্যাত ‘টাইম্‌স্‌’ পত্রিকার নবীনতম সংখ্যার সম্পাদকীয় প্রবন্ধে, যাহার সারাংশ উপরে উদ্ধৃত হইল। বাঙ্গালী পাঠক দেখিবেন যে, বঙ্কিম নিজেই এই সাহিত্যিক নীতি অনুসরণ করিয়াছেন এবং তাঁহার ঐতিহাসিক উপন্যাসগুলি বিলাতের অতি আধুনিক মনীষিগণের সিদ্ধান্ত অক্ষরে অক্ষরে সত্য বলিয়া প্রমাণ করিতেছে।

শ্রীযদুনাথ সরকার

সূত্রনির্দেশ ও টীকা

  1. ইংরাজদের মাদ্রাজ কুঠীর কার্য্যনির্বাহক-সমিতির কার্য্য-বিবরণ-গ্রন্থ হইতে জানা যায় যে, সেই হেড অফিসে ভিজাগাপটম হইতে যে পত্রগুলি পৌঁছে, তাহাতে সীতারাম, ‘সম্-বিয়ারেড’ (সুবিয়া রেড্‌ডী?) ও অন্যান্য সামস্ত রাজাদের সম্রাটের ফৌজদারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হইবার উল্লেখ আছে। ঐ সব উল্লেখ উক্ত গ্রন্থে লিপিবদ্ধ হয় ডিসেম্বর ১৬৮৯ ও ১৬৯৪। ইনি আমাদের সীতারাম হইতে পারেন না। Fort St. George, Diary and Consultation Book; also Public Dispatches to England, vol. 5.
  2. ফৌজদার কলেক্টর নহেন, রাজস্ব আদায় তাঁহার হাতে ছিল না; জেলার রাজস্ব তহসিলদারেরা সুবার সদরে পাঠাইত।
  3. স্থানীয় প্রবাদ যে, সীতারাম স্বয়ং দিল্লী যান এবং সেখানে রাজমন্ত্রীদের টাকায় ও প্রতিশ্রুতিতে হস্তগত করিয়া এই উপাধি ও ফর্ম্মান লাভ করেন। কিন্তু তখন বাদশাহ ও তাঁহার সব বড় মন্ত্রীরা দাক্ষিণাত্যে, দিল্লী একটি প্রদেশ মাত্র হইয়াছিল। করদ রাজাদের বাদশাহী ফৰ্ম্মান দেওয়া হইত, জমিদারদের শুধু পরওয়ানা এবং তাহাও উজীরের মোহর-যুক্ত।
  4. বাঙ্গলায় ঠিক আসল সুবাদার নহেন, নায়েব নাজিম্ অর্থাৎ কোন অনুপস্থিত শাহজাদা অথবা আমিরের প্রতিনিধিরূপে, কিন্তু পূর্ণ ক্ষমতার সহিত।