বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
সীতারাম
পাঠভেদ
১২৯১ সালের শ্রাবণ মাস হইতে ১২৯৩ সালের মাঘ মাস পর্য্যন্ত ‘প্রচারে’ ধারাবাহিক ভাবে ‘সীতারাম’ প্রকাশিত হয়, মধ্যে কয়েক মাস বন্ধ ছিল। ১২৯৩ সালে ইহা প্রথম পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয়। ‘প্রচারে’ প্রকাশিত ‘সীতারামে’র সহিত প্রথম সংস্করণ পুস্তকের পার্থক্য খুব বেশী নয়, কয়েকটি অনুচ্ছেদ পরিত্যক্ত হইয়াছে এবং কয়েকটি শব্দ পরিবর্ত্তিত হইয়াছে মাত্র। ‘সীতারামে’র দ্বিতীয় সংস্করণ ১৮৮৮ খ্রীষ্টাব্দে (১২৯৫ সালে) বাহির হয়, এই সংস্করণে বিশেষ পরিবর্ত্তন সাধিত হইয়াছিল, প্রথম সংস্করণের বহু পরিচ্ছেদ ও বহু অনুচ্ছেদ বাদ দেওয়া হয়। ১৮৯৪ সনের মে মাসে ‘সীতাবামে’র তৃতীয় সংস্করণ বাহির হয়, বঙ্কিমচন্দ্রের মৃত্যুর কয়েক দিন পরেই। বঙ্কিমচন্দ্রের জীবিতকালেই ইহা মুদ্রিত হইয়াছিল, সুতরাং এই সংস্করণের পাঠই মূল পাঠ হইয়াছে। প্রথম সংস্করণের পুস্তকের পৃষ্ঠা সংখ্যা ছিল ৪১৯, তৃতীয় সংস্করণে পৃষ্ঠা সংখ্যা হয় ৩২২। প্রথম ও তৃতীয় সংস্করণের পাঠভেদ নিম্নে দেওয়া হইল।1
পৃষ্ঠা ২৯, পংক্তি ৬, “তখন সেই ভূষণায়…বাস করিতেন।” ইহার পরিবর্ত্তে ছিল— তখন সেই ভূষণা অতিশয় সম্বৃদ্ধিশালিনী নগরী ছিল। একজন ফৌজদার সেখানে বাস করিতেন।
পৃ. ৩৩, পংক্তি ১-৪, “ভিখারির পক্ষে… চলিয়া গেল।” ইহার পরিবর্ত্তে ছিল— শ্রী একটু মাথা তুলিয়া, একটু ঘোম্টা কম করিয়া লজ্জায় বড় জড়সড় হইয়া কোন রকমে কিছু বলিল। কিন্তু কথাগুলি এত অস্ফুট যে, ভাণ্ডারী তাহার কিছু শুনিতে পাইল না। ভাণ্ডারী তখন, পাঁচকড়ির মাকে জিজ্ঞাসা করিল, “কি বলে? কিছুই ত শুনিতে পাই না।” তখন পাঁচকড়ির মা কথা বুঝাইয়া দিল। সে বলিল, “উনি বলিতেছেন যে, আমি তোমার হাতে যা দিতেছি, তাহা তোমার মুনিবের হাতে দিও। তিনি যা বলেন আমাকে আসিয়া বলিও। আমি এইখানে আছি।”
এই বলিয়া ঐ কাঁকালের কাপড় হইতে একটা মোহর বাহির করিল। সেই মোহর পাঁচকড়ির মা ভাণ্ডারীর হাতে দিল। ভাণ্ডারী লইয়া প্রস্থান করিল। যাইতে যাইতে জীবন দরজার প্রদীপে সেই মোহরটি একবার দেখিল। দেখিল, একটা সোনার আকব্বরী মোহর। কিন্তু তাহাতে একটা ত্রিশূলের দাগ আছে। ভাণ্ডারী মহাশয় স্থির করিলেন, “এ বেটী ত ভিখারী নয়—এই ত আমার মুনিবকে ভিক্ষা দিতে আসিয়াছে। প্রভু আমার ধনবান্, তাঁর মোহরে দরকার কি? এটা জীবন ভাণ্ডারীর পেটারার মধ্যে প্রবেশ করিলেই শোভা পায়। তবে কি না, যে ত্রিশূলের দাগ দেখিতেছি, এ ধরা পড়া বড় বিচিত্র নহে। ও সব মতিগতি আমার মত দুঃখী প্রাণীর ভাল না—যার ধন তার কাছে পৌঁছাইয়া দেওয়াই ভাল।” এইরূপ বিবেচনা করিয়া জীবন ভাণ্ডারী লোভ সম্বরণপূর্ব্বক যেখানে প্রভু গদির উপর বসিয়া আলবোলায় সুগন্ধি তামাকু টানিতেছিলেন, সেইখানে মোহর পৌঁছাইয়া দিল। এবং সবিশেষ বৃত্তান্ত নিবেদিত হইল।
জীবন ভাণ্ডারীর মুনিব অতি সুপুরুষ। ত্রিশ বৎসরের যুবা, অতি বলিষ্ঠ গঠন, রূপে কার্ত্তিকেয়। তিনি মোহরটি লইয়া দুই চারি বার আলোতে ধরিয়া ভাল করিয়া নিরীক্ষণ করিলেন। শেষ দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করিয়া বলিলেন, “দুর্গে! এ কি এ!”
ভাণ্ডারী বলিল, “কি বলিব?”
প্রভু বলিলেন, “যে তোকে মোহর দিয়েছে, তাকে এইখানে ডেকে নিয়ে আয়। সঙ্গে কেহ আছে?”
ভাণ্ডারী মহাশয় তরকারীর কথাটা একেবারে গোপন করিবার মানসে বলিলেন, “এক জন মেছুনি আছে।”
প্রভু। সে যেন আসে না, তুইও পৌঁছাইয়া দিয়াই চলিয়া যাইবি।
শুনিয়া ভাণ্ডারী বেগে প্রস্থান করিল। এবং অচিরাৎ শ্রীকে পৌঁছাইয়া দিয়া চলিয়া গেল।
পৃ. ৩৩ পংক্তি ৬-৯, “তুমি কে?…সীতারাম রায়।” ইহার পরিবর্ত্তে ছিল—আমি সীতারাম রায়—তুমি কে? তোমার মুখে ঘোম্টা—কথা কহিতেছ না, আমি চিনিব কি প্রকারে?
পৃ. ৩৩, পংক্তি ১১, “এত সুন্দরী!” কথা দুইটি ছিল না।
পৃ. ৩৩, পংক্তি ১২, “শ্রী বলিল…লাগিল।” এই কথাগুলির পরিবর্ত্তে ছিল—শুনিয়া শ্রী কাঁদিয়া উঠিল।
পৃ. ৩৪, পংক্তি ১৫-১৬, “একবার আবার…অন্য কথা।” এই কথাগুলি ছিল না।