» » দ্বিতীয় খণ্ড : সন্ধ্যা-জয়ন্তী

বর্ণাকার

পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ

কামানের বন্দুকের হুড়্‌মুড়্ দুড়্‌মুড়্‌ শুনিয়া গঙ্গারাম মনে ভাবিল—এ আবার কি? লড়াই কে করে? সেই ডাকিনী নয় ত? তিনি কি দেবতা? গঙ্গারাম এক জন জমাদ্দারকে দেখিতে পাঠাইলেন। জমাদ্দার নিষ্ক্রান্ত হইল। সে দিন, সেই প্রথম ফটক খোলা হইল।

জমাদ্দার ফিরিয়া গিয়া নিবেদন করিল, “মুসলমান লড়াই করিতেছে।”

গঙ্গারাম বিরক্ত হইয়া বলিল, “তা ত জানি। কার সঙ্গে মুসলমান লড়াই করিতেছে?”

জমাদ্দার বলিল, “কারও সঙ্গে নহে।”

গঙ্গারাম হাসিল, “তাও কি হয় মূর্খ! তোপ কার?”

জমাদ্দার। হুজুর, তোপ কারও না।

গঙ্গারাম বড় রাগ করিল। বলিল, “তোপের আওয়াজ শুনিতেছিস না?”

জমাদ্দার। তা শুনিতেছি।

গঙ্গারাম। তবে? সে তোপ কে দাগিতেছে?

জমা। তাহা দেখিতে পাই নাই।

গঙ্গা। চোখ কোথা ছিল?

জমা। সঙ্গে।

গঙ্গা। তবে তোপ দেখিতে পাও নাই কেন?

জমা। তোপ দেখিয়াছি—ঘাটের তোপ।

গঙ্গা। বটে! কে আওয়াজ করিতেছে?

জমা। গাছের ডাল।

গঙ্গা। তুই কি ক্ষেপিয়াছিস? গাছের ডালে তোপ দাগে?

জমা। সেখানে আর কাহাকে দেখিতে পাইলাম না—কেবল কতকগুলা গাছের ডাল তোপ ঢাকিয়া নুঙিয়া পড়িয়া আছে দেখিলাম।

গঙ্গা। তবে কেহ ডাল নোঙাইয়া বাঁধিয়া তাহার আশ্রয়ে তোপ দাগিতেছে। সে বুদ্ধিমান সন্দেহ নাই। সিপাহীরা তাহাকে লক্ষ্য করিতে পারিবে না, কিন্তু সে পাতার আড়াল হইতে তাহাদের লক্ষ্য করিবে। ডালের ভিতর কে আছে, তা দেখে এলি না কেন?

জমা। সেখানে কি যাওয়া যায়?

গঙ্গা। কেন?

জমা। সেখানে বৃষ্টির ধারার মত গুলি পড়িতেছে।

গঙ্গা। গুলিতে এত ভয় ত এ কাজে এসেছিলি কেন?

তখন গঙ্গারাম অনুচরকে হুকুম দিল যে, জমাদ্দারের পাগড়ি পোষাক কাপড় সব কাড়িয়া লয়। যুদ্ধের সম্ভাবনা দেখিয়া মৃণ্ময় বাছা বাছা জনকত হিন্দুস্থানীকে নিযুক্ত করিয়াছিলেন, এবং দুর্গরক্ষার জন্য তাহাদের রাখিয়া গিয়াছিলেন। গঙ্গারাম তাহাদিগের মধ্যে চারি জনকে আদেশ করিল, “যেখানে ঘাটের উপর তোপ আছে, সেইখানে যাও। যে কামান ছাড়িতেছে, তাহাকে ধরিয়া আন।”

সেই চারি জন সিপাহী যখন তোপের কাছে আসিল, তখন যুদ্ধ শেষ হইয়াছে, হতাবশিষ্ট মুসলমানেরা বাহিয়া পলাইয়া যাইতেছে। সিপাহীরা গাছের ডালের ভিতর গিয়া দেখিল—তোপের কাছে এক জন মানুষ মরিয়া পড়িয়া আছে—আর এক জন জীবিত, পলিতা হাতে করিয়া বসিয়া আছে। সে খুব জোওয়ান, ধুতি মালকোঁচা মারা, মাথায় মুখে গালচাল্লা বাঁধা; সর্ব্বাঙ্গে বারুদে আর ছাইয়ে কালো হইয়া আছে। চারি জন আসিয়া তাহাকে ধরিল। বলিল, “তোম কোন হো রে?”

সে বলিল, “কেন বাপু!”

“তোম্ কাহে হিঁয়া বৈঠ বৈঠকের তোপ ছোড়তে হো?”

“কেন বাপু, তাতে কি দোষ হয়েছে? মুসলমানের সঙ্গে তোমরা মিলেছ?”

“আরে মুসলমান আনেসে হম্‌লোক আভি হাঁকায় দেতে—তোম্ কাহেকো দিক্ কিয়ে হো? চল্ হুজুরমে যানে হোগা।”

“কার কাছে যাব?”

“কোতোয়াল সাহেবকি হুকুমসে তোম্‌কো উন্‌কা পাশ লে যাঙ্গে।”

“আচ্ছা যাই। আগে নেড়েরা বিদায় হোক। যতক্ষণ ওদের মধ্যে এক জনকে ও পারে দেখা যাইবে, ততক্ষণ তোরা কি, তোদের কোতোয়াল এলে উঠিব না। ততক্ষণ দেখ দেখি, যে মানুষটা মরিয়া আছে, ও কে চিনিতে পারিস কি না?”

সিপাহীরা দেখিয়া বলিল, “হাঁ, হামলোক ত ইস্কো পহচান্‌‍তে হেঁ। য়ে ত হমারা গোলন্দাজ পিয়ারীলাল হৈঁ—য়ে কাঁহাসে আয়া?”

“তবে আগে ওকে গড়ের ভিতর নিয়ে যা—আমি যাচ্ছি।”

সিপাহীরা পরস্পর বলাবলি করিতে লাগিল, “য়ে আদ‍‍মি ত আচ্ছা বোলতা‍ হৈ। যো তোপ্‌কাদ পাশ রহেগা, ওসিকো লে যানেগো হুকুম হৈ। এই মুরদার তোপ্‌কা পাশ হৈ—উসকো আলবৎ লে যানে হোগা।”

কিন্তু মড়া—হিন্দু সিপাহীরা ছুঁইবে না। তখন পরামর্শ করিয়া একজন সিপাহী ডোম ডাকিতে লাগিল—আর তিন জন তাহার প্রতীক্ষা করিতে লাগিল।

এ দিকে কালি বারুদ মাখা পুরুষ, ক্রমে ক্রমে দেখিলেন যে, মুসলমান সিপাহীরা সব তীরে গিয়া উঠিল। তখন তিনি সিপাহীদিগকে বলিলেন, “চল বাবা, তোমাদের কোতোয়াল সাহেবকে সেলাম করি গিয়া চল।” সিপাহীরা সে ব্যক্তিকে ধরিয়া লইয়া চলিল।

সেই সমবেত সজ্জিত দুর্গরক্ষক সৈন্যমণ্ডলীমধ্যে যেখানে ভীত নাগরিকগণ পিপীলিকাশ্রেণীবৎ সারি দিয়া দাঁড়াইয়া আছে—সেইখানে সিপাহীরা সেই কালিমাখা বারুদমাখা পুরুষকে আনিয়া খাড়া করিল।

তখন সহসা জয়ধ্বনিতে আকাশ পুরিয়া উঠিল। সেই সমবেত সৈনিক ও নাগরিকমণ্ডলী, একেবারে সহস্র কণ্ঠে গর্জ্জন করিল, “জয় মহারাজের জয়।”

“জয় মহারাজাধিরাজকি জয়।”

“জয় শ্রীসীতারাম রায় রাজা বাহাদুরকি জয়।”

“জয় লক্ষ্মীনারায়ণজীকি জয়।”

চন্দ্রচূড় দ্রুত আসিয়া বারুদমাখা মহাপুরুষকে আলিঙ্গন করিলেন; বারুদমাখা পুরুষও তাঁহার পদধূলি গ্রহণ করিলেন। চন্দ্রচূড় বলিলেন, “সমর দেখিয়া আমি জানিয়াছি, তুমি আসিয়াছ। মনুষ্যলোকে তুমি ভিন্ন এ অব্যর্থ সন্ধান আর কাহারও নাই। এখন অন্য কথার আগে গঙ্গারামকে বাঁধিয়া আনিতে আজ্ঞা দাও।”

সীতারাম সেই আজ্ঞা দিলেন। গঙ্গারাম সীতারামকে দেখিয়া সরিয়া পড়িতেছিল, কিন্তু শীঘ্র ধৃত হইয়া সীতারামের আজ্ঞাক্রমে কারাবদ্ধ হইল।