অষ্টম পরিচ্ছেদ
চন্দ্রচূড় তর্কালঙ্কার শ্রীকে লইয়া নির্ব্বিঘ্নে নগরমধ্যে প্রবেশ করিলেন। প্রবেশ করিয়া তাহাকে লইয়া এক নিভৃত ক্ষুদ্র বাটিকা মধ্যে গমন করিলেন, বলিলেন, “আইস বাছা! এখানে বড় জাগ্রত কালী আছেন, প্রণাম করিয়া যাই। তিনি মঙ্গল করিবেন।”
গৃহমধ্যে প্রবেশ করিয়া শ্রী দেখিলেন, গৃহ বড় নিভৃত, তাহার এক ঘরে এক কালীমূর্ত্তি, ফুল বিল্বপত্রে অর্দ্ধেক ঢাকা পড়িয়া আছেন। গৃহে কেহ নাই, কেবল এক অশীতিপর বৃদ্ধা ব্রাহ্মণী। তিনিই দেবীর অধিকারিণী। চন্দ্রচূড়কে দেখিয়া বৃদ্ধা বলিল, “তর্ক বাবা যে গো?”
চন্দ্ৰ। কেমন মা? মার পূজা চলিতেছে কেমন?
অশীতিপর বৃদ্ধার শ্রবণেন্দ্রিয় বড় তীক্ষ্ণ নহে। সে শুনিল, “তোমার বোনপো আছে কেমন উত্তরে বলিল, “আজও জ্বর সারে নাই, তার উপর পেটের ব্যামো, মা কালী রক্ষা করিলে হয়।” চন্দ্রচূড় এইরূপ দুই চারিটা কথাবার্ত্তা বৃদ্ধার সঙ্গে কহিবাতে শ্ৰী বুঝিল—বুড়ী ঘোর কালা। চন্দ্রচূড় তখন শ্রীকে বলিলেন, “এই বৃদ্ধা ব্রাহ্মণীর ঘরে তুমি আজ কাল থাক। তার পর গঙ্গারাম সুস্থির হইলে, আমি তোমাকে তাহার কাছে লইয়া যাইব। তোমার নিজ বাড়ীতে এখন একা থাকিবে কি প্রকারে? বিশেষ মুসলমানের ভয়।”
শ্রী। ঠাকুর! মুসলমানের এ দৌরাত্ম্য কত কাল আর থাকিবে? শাস্ত্রে কি কিছু নাই? হিন্দুর গায়ে বল হইলেই হইল। এই ত এখনই দেখিলেন?
চন্দ্র। কিছু না, মা। এ শাস্ত্রের কথা নয় মা।
শ্রী। ঠাকুর! হিন্দুর গায়ে বলের কি অভাব? বলিতে বলিতে শ্রী, দৃপ্তা সিংহীর মত ফুলিয়া উঠিল।
চন্দ্ৰ। যা দেখিলাম মা, সে তোমারই বল— এমন কি আবার হইবে?
দৃপ্তা সিংহী লজ্জায় মুখ অবনত করিল। আবার মুখ তুলিয়া বলিল, “হিন্দুর গায়ে বলের এত অভাব কেন? কত লোকের বলের গল্প শুনি।”
তীক্ষ্ণবুদ্ধি চন্দ্রচূড় শ্রীর অলক্ষ্যে, শ্রীর আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করিলেন, মনে মনে বলিলেন, “বেশ বাছা, বেশ! আমার মনের মত মেয়ে তুমি। আমিও সেই কথাটা ভাবিতেছিলাম।” প্রকাশ্যে বলিলেন, “হিন্দুর মধ্যে বলবান্ কি নাই? আছে বৈ কি। কিন্তু তাহারা মুসলমানের মুখ চায়। এই দেখ সীতারাম—সীতারাম না পারে কি? কিন্তু সীতারাম রাজভক্ত—বাদশাহের অনুগৃহীত— অকারণে রাজদ্রোহী হইবে না। কাজেই কে ধর্ম্ম রক্ষা করে?”
শ্রী। কারণ কি নাই?
জিজ্ঞাসা করিয়া শ্রী আবার লজ্জায় মুখ নামাইল। বলিল, “আমি অবলা— আপনাকে কেন এত জিজ্ঞাসা করিতেছি, জানি না, আমার মার শোকে ভাইয়ের দুঃখে মন কেমন হইয়া গিয়াছে— তাই আমার জ্ঞান বুদ্ধি নাই।”
চন্দ্রচূড় সে কৈফিয়ৎটা কানেও না তুলিয়া, বলিলেন, “কারণ ত ঘটে নাই। ঘটিলে কি হইবে বলিতে পারি না। সীতারাম যত দিন মুসলমানের দ্বারা অত্যাচার প্রাপ্ত না হয়েন, বোধ হয় তত দিন তিনি রাজদ্রোহ-পাপে সম্মত হইবেন না।”
শ্রী অনেকক্ষণ নীরবে ভাবিতে লাগিল। চাতক পক্ষী যেমন মেঘের প্রতি চাহিয়া থাকে, ততক্ষণ চন্দ্রচূড় তাহার মুখ প্রতি সেইরূপ করিয়া চাহিয়া রহিলেন। শ্রী বহুক্ষণ অন্যমনা হইয়া ভাবিতেছে, সংজ্ঞালক্ষণ নাই দেখিয়া, শেষে চন্দ্রচূড় জিজ্ঞাসা করিলেন, “মা! তবে তুমি এক্ষণে এখানে বাস কর, আমি এখন যাই।”
শ্রী কোন উত্তর করিল না—কথা তাহার কানে গিয়াছে, এমনও বোধ হইল না। চন্দ্রচূড় অপেক্ষা করিতে লাগিলেন—প্রতিভা কখন ফুটে, কখন নিবে, কখন স্থির, কখন আন্দোলিত, চন্দ্রচূড় তাহাকে চিনিতেন, অতএব ফলাকাঙ্ক্ষায় নীরবে শ্রীর মুখ প্রতি চাহিয়া রহিলেন। শেষ দেখিলেন, শ্রী সুস্থিরা, প্রফুল্লমুখী, ভাস্বর-কটাক্ষবিশিষ্টা হইল। তখন বুঝিলেন, এবার মেঘ বারিবর্ষণ করিবে— চাতকের তৃষা ভাঙ্গিবে।
শ্রী অল্প ঘোমটা টানিয়া, অল্প সলজ্জ হাসি হাসিয়া বলিল, “ঠাকুর! এখন কি একবার সে মাঠে যাওয়া যায় না?”
চন্দ্র। কেন? সেখানে এখন বিশেষ ভয়—চারি দিকে ফৌজ বেড়াইতেছে।
শ্রী। আমি সেখানে একটা কোন বিশেষ সামগ্রী হারাইয়া আসিয়াছি— আমার না গেলেই নয়। আপনি না হয় এইখানে থাকুন, আমি একা যাইতেছি। কিন্তু আপনি আসিলে ভাল হইত।
চন্দ্র। যে সাহস তোমার আছে, সে সাহস কি আমার নাই? চল, তোমার সঙ্গে যাইব। তখন, শ্রী আগে আগে, চন্দ্রচূড় পিছে পিছে সেই মাঠে চলিলেন। সেখানে অনেক অশ্বারোহী পদাতিক বিদ্রোহীর অনুসন্ধানে ফিরিতেছিল—এক জন আসিয়া চন্দ্রচূড়কে ধরিল। জিজ্ঞাসা করিল, “তোম্ কোন্ হো?”
চন্দ্র। এই ত দেখিতেছ—ভট্টাচাৰ্য ব্রাহ্মণ। যজমানের বাড়ী পার্ব্বণের শ্রাদ্ধ—তাই গ্রামান্তরে যাইতেছি। কি করিতে হইবে বল—করি।
সিপাহী। আচ্ছা, তোম্ যাও—তোম্কো ছোড়্ দেতেহেঁ। যেহি আবরৎ1 তোমারা কোন্ লাগ্তী?
চন্দ্র। না বাপু—ও আমার কেহ হয় না।
এই বলিয়া চন্দ্রচূড় শ্রীর নিকট হইতে সরিয়া দাঁড়াইলেন, জানেন, এখন শ্রীর বুদ্ধিতে চলিতে হইবে। তখন সিপাহী শ্রীকে জিজ্ঞাসা করিল, “তোম্ কোন্ হো? বোল্কে ঘর যাও। হম্লোগোঁকো হুকুম নেহি হৈ কে আবরৎকে পকড়েঁ। স্রেফ্ এক বেওয়াকো হম্লোগ্ ঢুণ্ড্তে হেঁ।”
শ্রী। যে ঐ গাছের উপর দাঁড়াইয়া তোমাদের দুর্দশা করিয়াছিল?
সিপাহী। হাঁ—হাঁ—চন্দী বক্সী নাম হৈ।
শ্রী। চণ্ডী নাম নয়। চণ্ডী নাম হউক—আর যাই নাম হউক—আমিই সেই হতভাগিনী।
সিপাহী। (শিহরিয়া) কিয়া!!!
শ্রী। আমিই সেই হতভাগিনী।
সি। তোবা!! বেসা মৎ বোলো মায়ি! তোম্ ঘর্ যাও।
শ্রী। তোমার কল্যাণ হউক—আমি ঘরে চলিলাম।
এমন সময়ে, আর একজন সিপাহী সেখানে আসিয়া উপস্থিত হইল। বলিল, “আরে আবরৎকো পকড়্তে হো কাহে?”
প্রথম সিপাহী দেখিল বিপদ্। যদি দ্বিতীয় সিপাহীর সঙ্গে স্ত্রীলোকটার কথাবার্ত্তা হয়, আর স্ত্রীলোকও যদি স্বীকার করে, তবে সিপাহী বিপন্ন হইবার সম্ভাবনা—প্রধান বিদ্রোহিণীকে ছাড়িয়া দেওয়ার অভিযোগ তাহার নামে হওয়া বিচিত্র নহে। অতএব সেই দয়ার্দ্র সিপাহী অগত্যা বলিল, “যেস্কি তোম ঢুণ্ড্তে সো যেহি হোতী হৈ।”
দ্বিতীয় সিপাহী। আল্লা আক্বর! চলো, চলো, বস্কী হুজুরমে লে চলো—হম্ দোনোকে বখ্সাস্ মিল যায়েগা।
প্রথম সিপাহী। ভাই! তোম্ লে যাও! হমারা কুছ কাম হৈ।
দ্বিতীয় সিপাহী এ কথা শুনিয়া বড় আনন্দিত হইল—শ্রীর ঘাড়ে ধাক্কা দিয়া লইয়া চলিল। প্রথম সিপাহী বড় বিষণ্ণ বদনে দাঁড়াইয়া রহিল। দুই জনের নাম দুইটা বলা যাক— প্রথমের নাম, খয়ের আলি—দ্বিতীয়, পীর বক্স।
সিপাহীর কাছে ঘাড় ধাক্কা খাইয়া শ্রী মৃদু হাসিল। তখন সে ডাকিয়া, চন্দ্রচূড়কে বলিল, “ঠাকুর! যদি আমার স্বামীকে চেনেন, তবে বলিবেন, আমার উদ্ধার তাঁহার কাজ।”
শুনিয়া চন্দ্রচূড়ের চক্ষে দর দর ধারা পড়িতে লাগিল। চন্দ্রচূড় কাঁদিতে কাঁদিতে বলিলেন, “মা, তুমিই ধন্যা।”