পৃ. ৩৫, পংক্তি ৫, এই “চতুর্থ” পরিচ্ছেদটি প্রথম সংস্করণের “পঞ্চম” পরিচ্ছেদ।
পৃ. ৩৬, পংক্তি ১৩, এই পংক্তির শেষে ছিল— তিনি অতি প্রত্যূষে উঠিয়া যে পথে শ্রীকে নগর হইতে প্রান্তরে আসিতে হইবে, সেই পথে দাঁড়াইয়া ছিলেন। শ্রীকে দেখিয়া উপযাচক হইয়া তাহার সহায় হইয়াছিলেন। শ্রী তাঁহাকে চিনিত, তিনিও শ্রীকে চিনিতেন। সে পরিচয়ের কারণ পরে জানা যাইতে পারে।
পৃ. ৪৩, পংক্তি ১৪, এই “পঞ্চম” পরিচ্ছেদটি প্রথম সংস্করণের “ষষ্ঠ” পরিচ্ছেদ।
পৃ. ৪৪, পংক্তি ১০-১১, “করিলেন। গঙ্গারাম সীতারামের” এই কথা কয়টির পরিবর্ত্তে ছিল— করিয়া বলিলেন, “আমি এখন ফোজদারের কাছে যাইব—তুমি আমার সঙ্গে যাইবে?”
গঙ্গারাম সীতারামের কথা শুনিয়া না হউক,
পৃ. ৪৪, পংক্তি ১৩, “চন্দ্রচূড়…শ্রী এদিকে” এই পংক্তিটির পরিবর্ত্তে ছিল— এদিকে চন্দ্রচূড় ঠাকুর মুর্চ্ছিতা শ্রীকে “ঝাড় ফুঁক” করিতেছিলেন। যদি সভ্য ভাষায় বলিতে হয়, বল, মেস্মোরাইস্ করিতেছিলেন। পরে শ্রী, যে কারণেই হউক,
পৃ. ৪৪, পংক্তি ১৫, এই পংক্তির শেষে ছিল— তার পর কাহাকে কিছু না বলিয়া ধীরে ধীরে নগরাভিমুখে চলিয়া গেল।
সে কিছু দূর গেলে সীতারাম চন্দ্রচূড়কে বলিলেন, “আপনি ওঁর পিছু পিছু যান। ওঁর যাহাতে রক্ষা হয়, সে ব্যবস্থা করিবেন। আপনাকে বেশী বলিতে হইবে না।”
চন্দ্র। আর তুমি এখন কি করিবে?
সীতা। তাহা স্থির করি নাই। আপনি শ্যামপুরে গমন করুন। যদি জীবিত থাকি, সেইখানে আপনার সঙ্গে সাক্ষাৎ হইবে।
শুনিয়া চন্দ্রচূড় বিষণ্নমনে বিদায় গ্রহণ করিয়া, শ্রীর পশ্চাদ্বর্ত্তী হইলেন। গুরু শিষ্য পরস্পরকে ভাল চিনিতেন। সুতরাং চন্দ্রচূড় কোন কথা কহিতে পারিলেন না।
সকলেই চলিয়া গেল। মাঠে আর কেহ নাই। কেবল এক! সীতারাম—সেই বৃক্ষমূলে, যে ডালের উপর চণ্ডীমূর্ত্তি শ্রীদাঁড়াইয়া রণজয় করিয়াছিল, সেই ডাল ধরিয়া ভূতলে দাঁড়াইয়া সীতারাম একা। আমাদের সকলেরই কখনও কখনও এমন সময় উপস্থিত হয়, যখন এক মুহূর্ত্তের দ্বারা সমস্ত জীবন শাসিত হয়। সীতারামের তাই হইল। ভাবিতেছিলেন, এ কাণ্ড কি? কেন হইল? কে করিল? ভাল হইয়াছে কি? ইহার কারণ কি? উপায় কি? কিসের লক্ষণ?
যে দিকে সীতারাম মনশ্চক্ষু ফিরান, সেই দিকে দেখিতে পান, মুসলমানের অত্যাচার!
সুরাসুর মনে পড়িল। বৃত্র, সম্বর, ত্রিপুর, সুন্দ, উপসুন্দ, বলি, প্রহ্লাদ, বিরোচন—কে মারিল? কেন মারিল? কেনই বা হইল? কেনই মরিল?
তাহার পর রাক্ষস—মানুষ, ইহাদের কথা মনে পড়িল। রাবণ, কুম্ভকর্ণ, ইন্দ্রজিৎ, অলম্বুষ, হিড়িম্ব, বক, ঘটোৎকচ, দন্তবক্র, শিশুপাল, একলব্য, দুৰ্য্যোধন, কংস, জরাসন্ধ, কে মারিল? কেন মরিল? নহুষ কেন অজগর হইল?
শেষ মনে মনে স্থির হইল, সেই দুর্দ্দমনীয় মানসিক স্রোতের প্রক্ষিপ্ত সার এই পাইলেন—দেব। দেব—অর্থে ধৰ্ম্ম।
তখন একটা প্রকাণ্ড কাণ্ড সীতারামের মনের ভিতর উপস্থিত হইল। যেমন আলোক দেখিতে দেখিতে চোখ বুজিলে, তবু অন্ধকারের ভিতর একটু রাঙ্গা রাঙ্গা ছায়া দেখা যায়, প্রথমে মনে হয়, ভ্রম মাত্র, তার পর বুঝা যায় যে, ভ্রম নয়, সত্য আলোকের ছায়া—সীতারাম সেই রকম একটু রাঙ্গা ছায়া দেখিলেন মাত্র। তার পর, যেমন, বনস্থ ভূপতিত পত্ররাশি মধ্যে প্রথম যেন একটু খদ্যোতোন্মেষবৎ অগ্নি দেখা যায়, বড় ক্ষীণ বটে, কিন্তু তবু আলো, তেমনি আলো বলিয়া, সীতারামের বোধ হইল। হায়! হৃদয়ের ভিতর আলো কি মধুর! কি স্বর্গ! অথবা স্বর্গ ইহার কাছে কোন্ ছার! যে একবার, আপনার হৃদয়ে আলো দেখিয়াছে, সে আর ভুলে না! জগতের সার সুখ প্রতিভা। প্রতিভাই ঈশ্বরকে দেখায়।
জোনাকির মত তেমনি একটা আলোক, সীতারাম, আপনার হৃদয়মধ্যে দেখিলেন। যেমন বনতলস্থ শুষ্ক পত্ররাশিমধ্যে সেই খদ্যোতবৎ ক্ষুদ্র স্ফুলিঙ্গ, ক্রমে একটু একটু করিয়া বাড়ে, ক্রমে একটু একটু করিয়া জ্বলে, সীতারামও আপনার হৃদয়ে তাই দেখিলেন। দেখিলেন, ক্রমে অনেক শুষ্ক পত্র ধরিয়া গেল, ক্রমে সেই অন্ধকার বন আলো হইতে লাগিল। ক্রমে সে শ্যামল পল্লবরাশি শ্যামলতা হারাইয়া উজ্জ্বল হরিৎ প্রভা প্রতিহত করিতে লাগিল, — ফুলে, ফলে, পাতায়, লতায়, কাণ্ডে, দণ্ডে, উজ্জ্বল জ্বালা কাঁপিতে লাগিল। ক্রমে সব আলো— শেষ ঘোর দাবানল, সব অগ্নিময়, শত সূর্য্য-প্রকাশ! তখন সীতারাম বুঝিলেন, হৃদয়ের সে আলোটা কি। বুঝিলেন, হৃদয়ে সহসা যে প্রভাকর উদিত হইয়াছে, তাহার নাম—
ধর্ম্ম-রাজ্য-স্থাপন!
বুঝিলেন, এই সূর্য্যে সকল অন্ধকার মোচন করিবে।
সীতারাম বুঝিবামাত্র ক্ষিপ্তবৎ হইলেন। প্রতিভা কে হৃদয়ে ধারণ করিয়া, ধৈর্য্য রক্ষা করে! প্রথম উচ্ছ্বাসে তিনি বাহ্বাস্ফোটন করিয়া বলিলেন, “এই বাহু! ইহাতে কি বল নাই? কে এমন তরবারি ধরিতে পারে? কাহার বন্দুকের এমন লক্ষ্য! কাহার মুষ্টিতে এত জোর! এ রসনায় কি বাগ্দেবীর প্রসাদ নাই? কে লোকের এমন মন হরণ করিতে পারে। আমি কি কৌশল জানি না—”
সহসা যেন সীতারামের মাথায় বজ্রাঘাত হইল। হৃদয়ের আলো একেবারে নিবিয়া গেল! “এ কি বলিতেছি! আমি কি পাগল হইয়াছি! আমি কি করিতেছি! আমি কে! আমি কি! আমি ত একটি ক্ষুদ্র পিপীলিকা—সমুদ্র-তীরের একটি বালি! আমার এত দৰ্প! এই বুদ্ধিতে সাম্রাজ্যের কথা আমার মনে আসে! ধিক মনুষ্যের বুদ্ধিতে!”
তখন সীতারাম কায়মনোবাক্যে জগদীশ্বরে চিত্ত সমর্পণ করিলেন। অনন্ত, অব্যয়, নিখিল জগতের মূলীভূত, সর্ব্বজীবের প্রাণস্বরূপ, সর্ব্বকার্য্যের প্রবর্ত্তক, সর্ব্বকর্ম্মের ফলদাতা, সর্ব্বাদৃষ্টের নিয়ন্তা, তাঁহার শুদ্ধি, জ্যোতি, অনন্ত প্রকৃতি ধ্যান করিতে লাগিলেন। তখন বুঝিলেন, “তিনিই বল! তিনিই বাহুবল! তিনিই ধৰ্ম্ম! ধৰ্ম্মচ্যুত যে বাহু-বল, তাহা পরিণামে দুর্ব্বলতা। সীতারাম তখন বুঝিলেন,
ধৰ্ম্মই ধৰ্ম্ম-সাম্রাজ্য সংস্থাপনের উপায়।
সীতারামের হৃদয়, অতিশয় স্নিগ্ধ, সন্তুষ্ট ও শীতল হইল।
তখন প্রান্তর পানে চাহিয়া সীতারাম দেখিলেন, মাঠ অশ্বারোহী মুসলমান-সেনায় ভরিয়া গিয়াছে।