পৃ. ৩৪, প. ২৪-২৭, “আমরা আজিকার…কিছুক্ষণ পরে” ইহার পরিবর্ত্তে ছিল— সীতারাম একখানি ভাল বাড়ী তাঁহাকে থাকিতে দিয়াছিলেন।
পৃ. ৩৫, প. ১-৪, “কথাবার্ত্তার ফল…পাঠাইয়া দিলেন।” ইহার পরিবর্ত্তে ছিল— চন্দ্রচূড়ের কাছে লুকাইবার যোগ্য সীতারামের কোন কথাই ছিল না।শ্রীর কাছে আর রমার কাছে যে দুইটি প্রতিজ্ঞা করিয়াছিলেন, সীতারাম তাহা সবিস্তারে নিবেদিত হইলেন। বলিলেন, “এই উভয় সঙ্কটে কি প্রকারে মঙ্গল হইবে, আমি বুঝিতে পারিতেছি না। নারায়ণ মাত্র ভরসা। মারামারি কাটাকাটিতে আমার কিছুমাত্র প্রবৃত্তি নাই। আমি সেই জন্যই মৃণ্ময়কে সরাইয়াছি। কিন্তু স্তুতি মিনতিতেও কাৰ্য্যসিদ্ধি হইবে, এমন ভরসা করি না। যাই হৌক, প্রাণপাত করিয়াও আমি এ কাজ উদ্ধার করিতে রাজি আছি। যদি সিদ্ধি না হয়, তবে পাপ শাস্তির জন্য কাল প্রাতে তীর্থযাত্রা করিব। তাই আপনাকে প্রণাম করিতে আসিয়াছি।”
চন্দ্রচূড়। আমি সর্ব্বদাই আশীর্ব্বাদ করিয়া থাকি, এখনও করিতেছি, মঙ্গল হইবে। সম্প্রতি এই রাত্রেই কি তুমি কাজির নিকট যাইবে?
সীতা। না। কাল উপযুক্ত সময়ে কাজির নিকট উপস্থিত হইব।
চন্দ্রচূড় তর্কালঙ্কার, সহজ লোক নহেন। তিনি মনে মনে ভাবিতেছিলেন, “বাবাজি একটু গোলে পড়িয়াছেন, দেখিতেছি। যুদ্ধ বিগ্রহে যে ইচ্ছা নাই, সে কথাটা মনকে চোক্-ঠারাই বোধ হইতেছে। সেই রুক্মিণী বেটীই যত নষ্টের গোড়া। তা বেটী মনে করে কি, রুক্মিণী আছে, নারদ নাই! জাত নেড়ে, বাপু বাছার কি কাজ! নারায়ণ কি নেড়ের দমন করিবেন না? কত কাল আর হিন্দু এ অত্যাচার সহ্য করিবে? একবার দেখি না, সীতারামের বাহুতে বল কত? বৃথাই কি নারায়ণকে তুলসী দিই?”
এইরূপ ভাবিতে ভাবিতে তর্কালঙ্কার বলিলেন, “তুমি তীর্থযাত্রা করিবে, এবং পরিবারবর্গকে গঙ্গাস্নানে পাঠাইবে শুনিয়া, আমি বড় বিপন্ন হইলাম।
সীতা। কি? আজ্ঞা করুন।
চন্দ্র। আমি তোমাদের মঙ্গলার্থ কোন যজ্ঞের সঙ্কল্প করিয়াছি। তাহাতে এক সহস্র রৌপ্যের প্রয়োজন। তাই বা আমায় দিবে কে? উদ্যোগই বা করিয়া দেয় কে?
সীতা। টাকা এখনই আনাইয়া দিতেছি। আর উদ্যোগের জন্য কাহাকে চাই?
চন্দ্ৰ। যজ্ঞের যে সকল আয়োজন করিতে হইবে, জীবন ভাণ্ডারী তাহাতে বড় সুপটু। জীবন ভাণ্ডারীকেও আনাইয়া দাও। আমার এই তল্লিদার ভৃত্য রামসেবক বড় গুণবান্ আর বিশ্বাসী। তার হস্তে খাজাঞ্চিকে পত্র পাঠাইয়া দাও, টাকা ও জীবন ভাণ্ডারীকে আনিবে।
সীতারাম তখন একটু কলাপাতে বাঁকারির কলমে খাজাঞ্চির উপর এক হাজার টাকা ও জীবন ভাণ্ডারীর জন্য চিঠি পাঠাইলেন। রামসেবক তাহা লইয়া গেল। চন্দ্রচূড় তর্কালঙ্কার তখন সীতারামকে বলিলেন, “এক্ষণে তুমি গমন কর। আমি আশীর্ব্বাদ করিতেছি, মঙ্গল হইবে।”
তখন সীতারাম গুরুদেবকে প্রণাম করিয়া প্রস্থান করিলেন। এদিকে অনতিবিলম্বে জীবন ভাণ্ডারী সহস্র রৌপ্য লইয়া আসিয়া তর্কালঙ্কার মহাশয়কে প্রদান করিল। তর্কালঙ্কার বলিলেন, “কেমন জীবন! এ সহরে তোমার মুনিবের যে যে প্রজা, যে যে খাতক আছে, সকলের বাড়ী চেন ত?”
জীবন। আজ্ঞা হাঁ, সব চিনি।
চন্দ্র। আজ রাত্রে সব আমায় দেখাইয়া দিতে পারিবে ত?
জীবন। আজ্ঞা হাঁ, চলুন না। কিন্তু আপনি এত রাত্রে সে সব চাঁড়াল বাগ্দীর বাড়ী গিয়া কি করিবেন?
চন্দ্র। বেটা, তোর সে কথায় কাজ কি? তোর মুনিব আমার কথায় কথা কয় না,—তুই বকিস্! আমি যা বলিব, তাই করিবি, কথা কহিবি না।
জীবন। যে আজ্ঞা, চলুন। এ টাকা কোথায় রাখিব?
চন্দ্র। টাকা সঙ্গে নিয়ে চল। আমি যা করিব, তা যদি কাহারও সাক্ষাতে প্রকাশ করিস্, তবে তোর শূল-বেদনা ধরিবে—আর তুই শিয়ালের কামড়ে মরিবি।
এখন জীবন ভাণ্ডারী শূল-বেদনা এবং শৃগাল, এ উভয়কেই বড় ভয় করিত—সুতরাং সে ব্রহ্মশাপ-ভয়ে আর দ্বিরুক্তি করিল না। চন্দ্রচূড় তর্কালঙ্কার তখন পূজার ঘর হইতে এক আজলা প্ৰসাদী ফুল নামাবলীতে লইয়া জীবন ভাণ্ডারী ও সহস্র রৌপ্য সহায় হইয়া বাহির হইলেন। কিয়দ্দর গিয়া জীবন ভাণ্ডারী একটা বাড়ী দেখাইয়া দিয়া বলিল, “এই এক জন।”
চন্দ্র। এর নাম কি?
জীবন। এর নাম যুধিষ্ঠির মণ্ডল।
চন্দ্র। ডাক তাকে।
তখন জীবন ভাণ্ডারী “মণ্ডলের পো! মণ্ডলের পো!” বলিয়া যুধিষ্ঠিরকে ডাকিল। যুধিষ্ঠির বলিল, “কে গা?”
চন্দ্রচূড় বলিলেন, “কাল গঙ্গারাম দাসের জীয়ন্তে কবর হইবে শুনিয়াছ?”
যুধিষ্ঠির। শুনিয়াছি।
চন্দ্র। দেখিতে যাইবে?
যুধিষ্ঠির। নেড়ের দৌরাত্ম্য, কি হবে ঠাকুর, দেখে?
চন্দ্র। দেখিতে যাইও। লক্ষ্মীনারায়ণজীউর হুকুম। এই হুকুম নাও।
এই বলিয়া তর্কালঙ্কার ঠাকুর একটি প্রসাদী ফুল নামাবলী হইতে লইয়া যুধিষ্ঠিরের হাতে দিলেন। যুধিষ্ঠির তাহা মাথায় ঠেকাইয়া বলিল, “যে আজ্ঞে। যাইব।”
চন্দ্র। তোমার হাতিয়ার আছে?
যুধি। আজ্ঞে, এক রকম আছে। মুনিবের কাজে মধ্যে মধ্যে ঢাল শড়কী ধরিতে হয়।
চন্দ্ৰ। লইয়া যাইও। লক্ষ্মীনারায়ণজীউর হুকুম। এই হুকুম লও।
এই বলিয়া চন্দ্রচূড় তর্কালঙ্কার জীবন ভাণ্ডারীর থলিয়া হইতে একটি টাকা লইয়া যুধিষ্ঠিরকে দিলেন। যুধিষ্ঠির টাকা লইয়া— মাথায় ঠেকাইয়া বলিল, “যে আজ্ঞে, অবশ্য লইয়া যাইব। কিন্তু একটা কথা বলিতেছিলাম কি—একা যাব?”
চন্দ্ৰ। কাকে নিয়ে যেতে চাও?
যুধি। এই পেসাদ মণ্ডল জোয়ানটাও খুব, খেলোয়াড়ও ভাল—সে গেলে হইত।
তখন চন্দ্রচূড় আরও কতকগুলি প্রসাদী ফুল ও টাকা যুধিষ্ঠিরের হাতে দিলেন। বলিলেন, “যত লোক পার, লইয়া যাইও।”
এই বলিয়া চন্দ্রচূড় ঠাকুর সেখান হইতে জীবন ভাণ্ডারীর সঙ্গে গৃহান্তরে গমন করিলেন। সেখানে ঐরূপ টাকা ও ফুল বিতরণ করিলেন। এইরূপে সহস্র মুদ্রা বিতরণ করিয়া রাত্রিশেষে গৃহে ফিরিয়া আসিলেন। শ্রীতে রমাতে সে রাত্রে এমনই আগুন জ্বালাইয়া তুলিয়াছিল।