দ্বিতীয় খণ্ড—প্রথম পরিচ্ছেদের আরম্ভে প্রথম সংস্করণে নিম্নলিখিত অংশটি ছিল—

সীতারামের হিন্দু সাম্রাজ্য সংস্থাপন করা হইল না; কেন না, তাহাতে তাঁহার আর মন নাই। মনের সমস্ত ভাগ হিন্দু সাম্রাজ্য যদি অধিকৃত করিত, তবে সীতারাম তাহা পারিতেন। কিন্তু শ্রী, প্রথমে হৃদয়ের তিলপরিমিত অংশ অধিকার করিয়া, এখন হৃদয়ের প্রায় সমস্ত ভাগই ব্যাপ্ত করিয়াছে। শ্রী যদি নিকটে থাকিত, অন্তঃপুরে রাজমহিষী হইয়া বাস করিত, রাজধর্ম্মের সহায়তা করিত, তবে প্রেয়সী মহিষীর যে স্থান প্রাপ্য, সীতারামের হৃদয়ে তাহার বেশী পাইবার সম্ভাবনা ছিল না। কিন্তু শ্রীর অদর্শনে বিপরীত ফল হইল। বিশেষ শ্রী পরিত্যক্তা, উদাসীনী। বোধ হয় ভিক্ষা বৃত্তি অবলম্বন করিয়া দিনপাত করিতেছে, নয়ত কষ্টে মরিয়া গিয়াছে, এই সকল চিন্তায় সে হৃদয়ে শ্রীর প্রাপ্য স্থান বড় বাড়িয়া গিয়াছিল। ক্রমে ক্রমে তিল তিল করিয়া, শ্রী সীতারামের সমস্ত হৃদয় অধিকৃত করিল। সুতরাং হিন্দু সাম্রাজ্য সংস্থাপনের বড় গোলযোগ। সুখ নাই, হিন্দু সাম্রাজ্য সংস্থাপনেও আর সুখ নাই।

হিন্দু সাম্রাজ্যের আর সেখানে স্থান নাই। শ্রীর অভাবে, সীতারামের মনে আর সুখ নাই, রাজ্যে কাজেই আর হিন্দু সাম্রাজ্য সংস্থাপন হয় না।

পৃ. ৬৭, পংক্তি ১১-১৫, “শেষে সীতারাম…মন্দ উপস্থিত হইল।” এই অংশের পরিবর্ত্তে ছিল—

তখন সীতারাম হিন্দু সাম্রাজ্যে জলাঞ্জলি দেওয়া স্থির করিলেন। একবার নিজে তীর্থে তীর্থে নগরে নগরে শ্রীর সন্ধান করিবেন। যদি শ্রীকে পান, ফিরিয়া আসিয়া রাজ্য করিবেন; না পান, সংসার পরিত্যাগ পূর্ব্বক বৈরাগ্য আশ্রয় করিবেন। সীতারাম বিবেচনা করিলেন, “যে রাজধর্ম্ম আমি রীতিমত পালন করিতে, চিত্তের অস্থৈর্য্যবশতঃ সক্ষম হইয়া উঠিতেছি না, তাহাতে আর লিপ্ত থাকা লোকের পীড়ন মাত্র। নন্দার গর্ভজ পুত্রকে রাজ্যে অভিষিক্ত করিয়া, নন্দা ও চন্দ্রচূড়ের হাতে রাজ্য সমর্পণ করিয়া আমি স্বয়ং সংসার ত্যাগ করিব।”

এ সকল কথা সীতারাম আপন মনেই রাখিলেন, মনের ভাব কাহারও কাছে ব্যক্ত করেন নাই। শ্রীর যে সন্ধান করিয়াছিলেন, তাহাও অতিশয় গোপনে এবং অপ্রকাশিত ভাবে। যাহারা শ্রীর সন্ধানে গিয়াছিল, তাহারা ভিন্ন আর কেহই জানিতে পারে নাই যে, শ্রীকে তাঁহার আজিও মনে আছে।

কেহ কিছু জানিতে না পারুক, তাঁহার মনের যে ভাবান্তর হইয়াছে, তাহা নন্দা ও রমা উভয়েই জানিতে পারিয়াছিল। নন্দা ভাব বুঝিয়া, কায়মনোবাক্যে ধৰ্ম্মতঃ মহিষীধর্ম্ম পালন করিয়া সীতারামের প্রফুল্লতা জন্মাইবার চেষ্টা করিত। অনেক সময়েই সফল হইত। কিন্তু রমা সকল সময়েই স্বামীর অনাস্থা ও অন্য মন দেখিয়া ক্ষুণ্ন ও বিমর্ষ থাকিত; সীতারামের তাহা বিশেষ অপ্রীতিকর হইত। রমা ভাবিত, “আর আমাকে ভাল বাসেন না কেন?” নন্দা ভাবিত, “তিনি ভাল বাসুন, না বাসুন, ঠাকুর করুন, আমার যেন কোন ত্রুটি না হয়। তাহা হইলেই আমার সুখ।”

শেষে সীতারাম, ভার্য্যাদ্বয় এবং চন্দ্রচূড় প্রভৃতি অমাত্যবর্গের নিকট প্রকাশ করিলেন যে, তিনি এ পর্য্যন্ত প্রকৃত রাজা হয়েন নাই; কেন না, দিল্লীর সম্রাট তাঁহাকে সনন্দ দেন নাই। সনন্দ পাইবার অভিলাষ হইয়াছে। সেই অভিপ্রায়ে তিনি অচিরে দিল্লী যাত্রা করিবেন।

সময়টা বড় অসময়। মহম্মদপুরে সীতারামের অধিকার নির্ব্বিঘ্নে সংস্থাপিত হইয়াছিল বটে। তোরাব খাঁ, রুষ্ট হইয়াও কোন বিরোধ উপস্থিত করে নাই। তাহার একটি বিশেষ কারণ ছিল। তখন বাঙ্গালার সুবেদার বিখ্যাত ব্রাহ্মণবংশজ পাপিষ্ঠ মুসলমান মুরশিদ কুলি খাঁ। তখনও বাঙ্গালা দিল্লীর  অধীন। তোরাব খাঁ দিল্লীর প্রেরিত লোক, সেইখানে তাঁর মুরব্বীর জোর। সুবেদারের সঙ্গে তাঁহার বড় বনিবনাও ছিল না। এখন তিনি যদি বলে ছলে সীতারামকে ধ্বংস করেন, তবে সুবেদার কি বলিবেন? সুবেদার বলিতে পারেন, এ বেচারা নিরপরাধী, কিস্তি কিস্তি বিনা ওজর আপত্তি খাজানা দাখিল করে, বকেয়া বাকির ঝঞ্ঝাট রাখে না—ইহার উপর অত্যাচার কেন? তখন মুরশিদ কুলি খাঁ তাঁহাকে লইয়া একটা গোলযোগ বাধাইতে পারেন। তাই, সুবেদারের অভিপ্রায় কি, জানিবার জন্য তোরাব খাঁ, তাঁহার নিকট সীতারামের বৃত্তান্ত সবিশেষ লিখিয়া পাঠাইলেন। মুরশিদ কুলি খাঁ অতি শঠ। তিনি বিবেচনা করিলেন যে, এই উপলক্ষে তোরাব খাঁকে পদচ্যুত করিবেন। যদি তোরাব সীতারামকে দমন করেন, তাহা হইলে, মুরশিদ বলিবেন, নিরপরাধীকে নষ্ট করিলে কেন? যদি তোরাব তাহাকে দমন না করেন, তবে বলিবেন, বিদ্রোহী কাফেরকে দণ্ডিত করিলে না কেন? অতএব তোরাব যাহা হয় একটা করুক, তিনি কোন উত্তর দিবেন না। মুরশিদ কুলি কোন উত্তর দিলেন না, তোরাবও কিছু করিলেন না।

কিন্তু বড় বেশী দিন এমন সুখে গেল না।

পৃ. ৬৭, পংক্তি ২৬, “অজ্ঞতা” কথাটির স্থলে “মূর্খতা” ছিল।

পৃ. ৬৮, পংক্তি ২২, এই পংক্তির শেষে ছিল— সীতারামকেও জানাইলেন। দুর্ভাগ্যক্রমে, এই সময়েই সীতারাম দিল্লী যাওয়ার প্রসঙ্গ উত্থাপন করিলেন।

পৃ. ৬৮, পংক্তি ২৩-২৪, “ইহার সকল উদ্যোগ…যাত্রা করিলেন।” এই অংশের পরিবর্ত্তে ছিল— অসময় হইলেও তীক্ষ্ণবুদ্ধি চন্দ্রচূড় তাহাতে অসম্মত হইলেন না। তিনি বলিলেন, “যুদ্ধে জয় পরাজয় ঈশ্বরের হাত। প্রাণপাত করিয়া যুদ্ধ করিলে ফৌজদারকে পরাজয় করিতে পারিবেন, ইহা না হয় ধরিয়া লইলাম। কিন্তু ফৌজদারকে পরাজয় করিলেই কি লেঠা মিটিল! ফৌজদার পরাভূত হইলে সুবাদার আছে; সুবাদার পরাভূত হইলে দিল্লীর বাদশাহ আছে। অতএব যুদ্ধটা বাধাই ভাল নহে। এমন কোন ভরসা নাই যে, আমরা মুরশিদাবাদের নবাব বা দিল্লীর বাদশাহকে পরাভূত করিতে পারিব। অতএব দিল্লীর বাদশাহের সনন্দ ইহার ব্যবস্থা। যদি দিল্লীর বাদশাহ আপনাকে এই পরগণার রাজ্য প্রদান করেন, ফৌজদার কি সুবেদার, কেহই আপনার রাজ্য আক্রমণ করিবে না। হিন্দুরাজ্য স্থাপন, এক দিন বা এক পুরুষের কাজ নহে। মোগল রাজ্য এক দিনে বা এক পুরুষে স্থাপন হয় নাই। এই পত্তন মাত্র, বাঙ্গালার সুবেদার বা দিল্লীর বাদশাহের সঙ্গে বিবাদ হইলে, সব ধ্বংস হইয়া যাইবে। অতএব এখন অতি সাবধানে চলিতে হইবে। দিল্লীর সনন্দ ব্যতীত ইহার আর উপায় দেখি না, তুমি আজি দিল্লী যাত্রা কর। সেখানে কিছু খরচ পত্র করিলেই কার্য্য সিদ্ধ হইবে; কেন না, এখন দিল্লীর আমীর ওমরাহ, কি বাদশাহ স্বয়ং, কিনিবার বেচিবার সামগ্রী। তোমার মত চতুর লোক অনায়াসে এ কাজ সিদ্ধ করিতে পারিবে। যদি ইতিমধ্যে মুসলমান মহম্মদপুর আক্রমণ করে, তবে মৃণ্ময় রক্ষা করিতে পারিবে, এমন ভরসা করি। মৃণ্ময় যুদ্ধে অতিশয় দক্ষ, এবং সাহসী। আর কেবল তাহার বলবীর্য্যের উপর নির্ভর করিতে তোমাকে বলি না। আমার এমন ভরসা আছে যে, যত দিন না তুমি ফিরিয়া আস, তত দিন আমি ফৌজদারকে স্তোকবাক্যে ভুলাইয়া রাখিতে পারিব। তুমি দুই চারি মাসের জন্য আমার উপর নির্ভর করিয়া নিশ্চিন্ত থাকিতে পার। আমি অনেক কৌশল জানি।”

এই সকল বাক্যে সীতারাম সন্তুষ্ট হইয়া সেই দিনই কিছু অর্থ এবং রক্ষকবর্গ সঙ্গে লইয়া দিল্লী যাত্রা করিলেন। নামে দিল্লী যাত্রা, কিন্তু কোথায় যাইবেন, তাহা সীতারাম ভিন্ন আর কেহই জানিত না।

পৃ. ৭৩, পংক্তি ২৩, এই পংক্তির শেষে ছিল— ছাদের উপর হইতে লাফাইয়া পড়িতে হইবে? না আগুন খাইতে হইবে?

পৃ. ৭৩, পংক্তি ২৪, “স্ত্রীলোক।” কথাটির পর ছিল— তার অপেক্ষাও কঠিন কাজ।

পৃ. ৭৪, পংক্তি ২৬, “রাখিয়েসে। এ কোন্?” এই কথা কয়টির স্থলে ছিল— রাখিয়াছি। এ কে?

পৃ. ৭৪, পংক্তি ২৮, “মরদ্ যাতে পার্‌বে না। হুকুম নেহি।” এই কথা কয়টির স্থলে ছিল— পুরুষ মানুষের যাইবার হুকুম নাই।

পৃ. ৮০, পংক্তি ১-২, “এই গ্রন্থে তাহার প্রমাণ আছে।” এই কথাগুলি ছিল না।

পৃ. ৮১, পংক্তি ১৮-১৯, “যে অপবিত্র,…মুরলার কথা শুনিয়া” এই কথাগুলি ছিল না।

পৃ. ৮২, পংক্তি ২৮, “অনেক দিন বাপ মা দেখি নাই।” এই কথাগুলির স্থলে ছিল— আমি জেতে কৈবর্ত্ত, বিবাহ আড়াইটা হইয়াছে, তাতে যদি তোমার আপত্তি না থাকে, তবে আমারও সাড়ে তিনটায় আপত্তি নাই।

পৃ. ৮৪, পংক্তি ১২, “না যাইব কেন?” এই কথাগুলির পূর্ব্বে ছিল— এখানে ওখানে ঘুরিয়া বেড়ানই আমার কাজ—আমার অন্য কাজ নাই;

পৃ. ৮৪, পংক্তি ১৪, “প্রিয় প্রাণহন্ত্রী” কথাটির স্থলে “পতিপ্রাণহস্ত্রী” ছিল।

পৃ. ৮৪, পংক্তি ২৭, “জয়ন্তী মনে মনে বড় খুসী হইল।” এই কথাগুলির পর ছিল— কথাগুলি শিষ্যার নিকট গুরুদক্ষিণার ন্যায় সাদরে গ্রহণ করিল। কিন্তু এখনও জয়স্তার কথা ফুরায় নাই।

পৃ. ৮৫, পংক্তি ১৭, “সন্ন্যাসিনী” কথাটির স্থলে “ভৈরবী বা বৈষ্ণবীর শিষ্যা” ছিল।

পৃ. ৮৫, পংক্তি ২৩-২৬, “যতক্ষণ এই কথোপকথন…ত্রিশূল মন্ত্রপুত।*” এই অংশটি ছিল না। ফলে নিম্নের পাদটীকাটিও ছিল না।

পৃ. ৮৫, পংক্তি ২৭, “দুই জনে ভৈরবীবেশ গ্রহণ করিল এবং” এই কথা কয়টি ছিল না।