কোরেল
তিন
কোরেল গ্রামে প্রতি বৎসর অতি সমারোহের সহিত ঘোড়দৌড় হইত। আজি সেই উপলক্ষে প্রান্তস্থিত মাঠে বহু জনসমাগম হইয়াছিল।
মেরি ধীরে ধীরে লিওর পশ্চাতে আসিয়া দাঁড়াইল। লিও তখনও অত্যন্ত মনোযোগের সহিত পুস্তক লিখিতেছিল, তাই দেখিতে পাইল না। মেরি কহিল, ‘আমি আসিয়াছি, ফিরিয়া দেখ।’
লিও ফিরিয়া দেখিয়া কহিল, ‘ইস—এত সাজিয়াছ কেন?’
মেরিও হাসিয়া ফেলিল; কহিল, ‘সাজিয়াছি কেন শুনিবে?’
‘বল।’
আজ ঘোড়দৌড় হইবে। যে জয়ী হইবে, সে আজ আমাকেই ফুলের মালা দিবে।’
তবে ত তোমার আজ বড় সম্মান! তাই এত সাজসজ্জা!’
মেরি প্রীতি-প্রফুল্ল নেত্রে কিছুক্ষণ লিওর মুখপানে চাহিয়া রহিল, তাহার পর পরম স্নেহে দুই হস্তে তাহার গ্রীবা বেষ্টন করিয়া মুখের কাছে মুখ রাখিয়া বলিল, ‘শুধু তাই নয়। তুমি আমার কাছে থাকিবে। তোমার পাশে দাঁড়াইয়া পাছে নিতান্ত কুৎসিত দেখিতে হই, সেই ভয়ে এত সাজিয়াছি,—মণিমুক্তায় রূপ বাড়ে ত?’
সম্মুখস্থিত মুকুরে দুটি মুখ ততক্ষণ দুটি পরিস্ফুট গোলাপ ফুলের মত ফুটিয়া উঠিয়াছিল, লিও তাহা দেখাইয়া বলিল, ‘ঐ দেখ।’
মেরি অতৃপ্ত নয়নে কিছুক্ষণ ঐ দুটি ছবির পানে চাহিয়া রহিল। তাহার বোধ হইল সেও বড় সুন্দরী। আজ তাহার প্রথম মনে হইল সৌন্দর্যের আশ্রয়ে দাঁড়াইলে কুৎসিত দেখিতে হয় না, বরং যাহা সৎ তাহাকে জড়াইয়া থাকিলে দোষটুকুও চাপা পড়িয়া যায়।আবেশে চক্ষু মুদ্রিত করিয়া মেরি ধীরে ধীরে কহিল, ‘আমি যেন চাঁদের কলঙ্ক—তবু আমার কত শোভা!’
মেরি শিহরিয়া উঠিল।লিও তাহা অনুভব করিল, তাই তাহার মুখখানি আরও কাছে টানিয়া লইয়া বলিল, ‘চাহিয়া দেখ,—তুমি আমার কলঙ্ক নহ—তুমি আমার শোভা! তুমি চাঁদের পূর্ণবিকশিত, উজ্জ্বল কৌমুদী!’
চক্ষু চাহিতে মেরির কিন্তু সাহস হইল না। কতক্ষণ হয়ত এইভাবে কাটিত, কিন্তু এই সময় অদূরস্থিত গির্জার ঘড়িতে ঢং করিয়া একটা বাজিল। মেরি চমকিয়া উঠিয়া দাঁড়াইয়া ব্যস্ত হইয়া কহিল, ‘সময় হইয়াছে—চল!’
‘আমার যাওয়া একেবারে অসম্ভব।’
‘কেন?’
‘এই পুস্তক পাঁচ দিনের মধ্যে শেষ করিয়া পাঠাইব বলিয়া চুক্তি করিয়াছি,—চুক্তিভঙ্গ হইলে বড় লজ্জায় পড়িব।’
মেরি রাগ করিয়া বলিল, ‘তা বলিয়া আমি তোমাকে প্রাণপাত করিয়া পরিশ্রম করিতে কিছুতেই দিব না।’
লিওর মুখে ম্লান ছায়া পড়িল; পিতৃঋণ স্মরণ করিয়া বলিল, ‘আমার অদৃষ্ট! কি করিব মেরি, পরিশ্রম করিতেই হইবে।’
মেরি তাহার মনের কথা বুঝিল, তাই আরো রাগ হইল। বলিল, ‘তোমার পুস্তক আমাকে বিক্রয় করিও—আমি দ্বিগুন মূল্য দিব।’
লিওর তাহাতে সন্দেহ ছিল না; হাসিয়া বলিল, ‘কিন্তু কি করিবে?’
মেরি নিজ গলদেশের বহুমূল্য মুক্তামালা দেখাইয়া বলিল, ‘এই মালা ছিন্ন করিয়া ফেলিব,—যতগুলি মুক্তা, যে কয়খানি হীরক আছে সবগুলি দিয়া পুস্তকখানি বাঁধাইয়া সোনার কৌটায় করিয়া মাথার শিয়রে তুলিয়া রাখিব,—তারপর—তারপর—‘
লিও বলিল, ‘তারপর কি?’
মেরি সলজ্জ হাস্যে রক্তিমাভ মুখখানি ঈষৎ নত করিয়া বলিল, ‘তারপর যেদিন রাত্রে খুব বড় চাঁদ উঠিবে, আর তাহার কিরণগুলি তোমার নিদ্রিত মুখের উপর খেলা করিতে থাকিবে, সেই দিন—‘
‘সেই দিন কি?’
‘সেই দিন খুব উচ্চকণ্ঠে পাপিয়া ডাকিতে থাকিবে, তোমার কিন্তু কিছুতেই ঘুম ভাঙ্গিবে না, আমি তখন তোমার কানের কাছে বসিয়া’—মেরি হাসিয়া ফেলিল।
লিও বলিল,—‘আমার কানের কাছে বসিয়া পুস্তকটিতে যতগুলি কথা আছে, সবগুলি পড়িয়া ফেলিবে, না?’
মেরি মাথা নাড়িয়া বলিল, ‘হুঁ।’
‘আমি তাহা হইলে জাগিয়া এমনি করিয়া তোমার মুখচুম্বন করিব।’
তাহার পর দুইজনেই হাসিয়া উঠিল।
ঘড়িতে দেড়টা বাজিয়াছে—লিও তাহা দেখিয়া বলিল, ‘ঢের হইয়াছে—এইবার যাও—।’
মেরি জাঁকিয়া বসিল; বলিল, ‘আমার শরীর খারাপ হইয়াছে—আজ যাইব না।’
‘তা কি হয়? কথা দিয়াছ, না যাইলে চলিবে কেন? কত লোক তোমার জন্য অপেক্ষা করিয়া আছে।’
মেরি নিতান্ত অবাধ্যের মত কহিল, ‘চুক্তিভঙ্গ হইলে তোমার মত আমার বিশেষ লজ্জাবোধ হয় না—আমি যাইব না।’
‘ছিঃ—যাও।অবাধ্য হইও না।’
‘তবে তুমিও চল।’
‘ক্ষমতায় থাকিলে নিশ্চয় যাইতাম।’
‘ক্ষমতায় আছে—চল।’
‘ক্ষমতায় নাই—যাওয়া অসম্ভব।’
মেরি উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল,’তবে আমি আর এখানে আসিব না।’
লিও হাসিয়া বলিল, ‘আমি জানি তুমি নিশ্চয় আসিবে।’
মেরি রাগ করিয়া বলিল, ‘আমি না আসিলে তোমার হয়ত খাইবার অযত্ন হইবে। পোড়াপ্রাণে যে এটা সহ্য করতে পারি না, না হইলে নিশ্চয় দুই-এক দিন চুপ করিয়া ঘরের কোণে বসিয়া থাকিতাম।’
‘এ ক্ষমতাটুকু যদি নাই, তবে রাগ করিলে চলিবে কেন?’
কথাটার সত্যতা সম্বন্ধে মেরির অণুমাত্র সন্দেহ ছিল না, তাই ক্ষুণ্ণ অন্তঃকরণে গাড়িতে বসিয়া ভাবিল—সে ছেলেবেলার পড়িয়াছিল যে, উদরের উপর নাকি একদিন হাত-পাগুলা বড় চটিয়া গিয়াছিল—কিন্তু ফল বিশেষ তৃপ্তিজনক হয় নাই।
মেরি তাই রাগ করিতে পারিল না।