দুই

আমি এই প্রথম কলিকাতায় আসিলাম। এতবড় জমকাল সহর পূৰ্ব্বে কখনও দেখি নাই। মনে ভাবিলাম, যদি এই প্রকাণ্ড গঙ্গার উপরে কাঠের সাঁকোর মাঝামাঝি, কিংবা ঐ যেখানে একরাশ মাস্তুল খাড়া করিয়া জাহাজগুলা দাঁড়াইয়া আছে, সেই বরাবর যদি একবার তলাইয়া যাই, তাহা হইলে আর কখনও বাড়ি ফিরিয়া যাইতে পারিব না। কলিকাতায় আমার একটুও ভাল লাগিল না। এত ভয়ে কি আর ভালবাসা হয়? কখনও যে হইবে—সে ভরসাও করিতে পারিলাম না।

কোথায় গেল আমাদের সেই নদীর ধার, সেই বাঁশঝাড়, মাঠের মধ্যে বেলগাছ, মিত্তিরদের বাগানের এক কোণের জামরুল গাছ, কিছুই নাই। শুধু বড় বড় বাড়ি, বড় বড় গাড়ি, ঘোড়া আর লোকজনে ঠেসাঠেসি পেযাপেষি, বড় বড় রাস্তা—বাড়ির পিছনে এমন একটি বাগান নাই যে, লুকাইয়া একছিলিম তামাক খাই। আমার কান্না আসিল। চোখের জল মুছিয়া মনে মনে বলিলাম, ভগবান জীবন দিয়েচেন—আহার তিনিই দেবেন। কলিকাতায় স্কুলে ভৰ্ত্তি হইয়াছি, ভাল করিয়া পড়াশুনা করি, কাজে কাজেই আমি আজকাল ভাল ছেলে। দেশে অবশ্যই আমার নাম জাহির হইয়া গিয়াছে—যাক সে-কথা।

আমরা আত্মীয় বন্ধু-বান্ধব মিলিয়া একটা মেস করিয়া আছি। আমাদের মেসে চারজন লোক। সেজদাদা, আমি, রামবাবু ও জগন্নাথবাবু। রামবাবু ও জগন্নাথবাবু সেজদাদার বন্ধু। এতদ্ভিন্ন একজন ভূত্য ও একজন পাচক ব্রাহ্মণ আছে। গদাধর আমাদের রসুয়ে ব্রাহ্মণ । সে আমা অপেক্ষা তিন-চারি বৎসরের বড় ছিল। অমন ভালমানুষ লোক আমি কখনও দেখি নাই। পাড়ার কোনও ছেলের সহিত আমার আলাপ ছিল না। সম্পূর্ণ বিভিন্ন প্রকৃতির লোক হইলেও সে আমার মস্ত বন্ধু হইয়া উঠিল। তাঁহাতে আমাতে যে কত গল্প হইত তার ঠিকানা ছিল না। তাহার বাড়ি মেদিনীপুর জেলার একটা গ্রামে। সেখানকার কথা, তাহার বাল্য-ইতিহাস ইত্যাদি শুনিতে আমার বড় ভাল লাগিত। সে-সব কথা আমি এতবার শুনিয়াছি যে, আমার বোধ হয় আমাকে সেখানে চোখ বাঁধিয়া ছাড়িয়া দিলেও সমস্ত স্থানটি স্বচ্ছদে ঘুরিয়া বেড়াইতে পারি। রবিবারে তাহার সহিত আমি গড়ের মাঠে বেড়াইতে আসিতাম। সন্ধ্যাবেলায় রান্নাঘরে বসিয়া খিল দিয়া দুইজনে বিন্তি খেলিতাম। ভাত খাইয়া তার ছোট হুঁকোটিতে দুইজনে তামুক খাইতাম। সব কাজ আমরা দুইজনে করিতাম। পাড়ার কাহারও সহিত আলাপ নাই; সঙ্গী, দোস্ত, ইয়ার, বন্ধু, মুচিপাড়ার ভূলো, কেলে, খোকা, খাদা সবই আমার সে; তাহার মুখে আমি কখনও উঁচু কথা শুনি নাই। মিছামিছি সবাই তাহাকে তিরস্কার করিত; আমার গা জ্বালা করিত, কিন্তু সে কোনও কথার উত্তয় দিত না—যেন যথার্থই দোষ করিয়াছে।

সকলকে আহার করাইয়া সে যখন রান্নাঘরের কোণে একটি ছোট থালায় খাইতে বসিত, তখন আমার শতকৰ্ম্ম থাকিলেও সেখানে উপস্থিত হইতাম। বেচারীর ভাগ্যে প্রায় কিছুই থাকিত না; এমন কি, ভাত পৰ্য্যন্ত কম পড়িত। কাহারো খাইবার সময় আমি থাকি নাই—খাইতে বসিয়া ভাত কম পড়ে, তরকারী কম পড়ে, মাছ কম পড়ে, আমি আগে কখনই দেখি নাই। আমার কেমন বোধ হইত।

ছেলেবেলায় ঠাকুরমা মধ্যে মধ্যে দুঃখ করিয়া বলিতেন, ছেলেটা আধপেটা খেয়ে খেয়ে শুকিয়ে দড়ি হয়ে গেছে—আর বাঁচবে না। আমি কিন্তু ঠাকুরমার ভরপেট কিছুতেই খাইতে পারিতাম না। শুকাইয়া যাই, আর দড়ি হইয়াই যাই, আমার আধপেটাই ভাল লাগিত। এখন কলিকাতায় আসিয়া বুঝিয়াছি, সে আধপেটায় এ আধপেটায় অনেক প্রভেদ। কেহ খাইতে না পাইলে যে চোখে জল আসিয়া পড়ে, আমি পূৰ্ব্বে কখনও অনুভব করি নাই। পূৰ্ব্বে কতবার ঠাকুর্দ্দার পাত্রে উচ্ছিষ্ট জল দিয়া তাঁহাকে আহার করিতে দিই নাই; ঠাকুরমার গায়ে সারমেয় সন্তান নিক্ষেপ করিয়া তাঁহার উপস্থিত কৰ্ম্ম হইতে তাঁহাকে বিরত করিয়াছি। তাঁহাদের আহার হয় নাই; কিন্তু চোখে কখনও জল আসে নাই। পিতামহপিতামহী আপনার লোক—গুরুজন, আমাকে স্নেহ করেন—তাঁহাদের জন্য কখনও দুঃখ হয় নাই; স্ব-ইচ্ছায় তাহাদিগকে অৰ্দ্ধভূক্ত, এমন কি, অভুক্ত রাখিয়া পরম সন্তোষ লাভ করিয়াছি। আর এই গদাধর কোথাকার কে—তাহার জন্য অনাহূত অশ্রু আপনি আসিয়া পড়ে।

কলিকাতায় আসিয়া যে আমার কি হইল তাহা ঠাওরাইতে পারি না। চোখে এত জলই বা কোথা হইতে আসে ভাবিয়া পাই না। আমাকে কেহ কাঁদিতে দেখে নাই। জিদ করিয়া আস্ত খেজুরের ছড়ি আমার পৃষ্ঠে ভগ্ন করিয়াও বাল্যকালে গুরুমহাশয় তাঁহার সাধ পূর্ণ করিতে পারেন নাই। ছেলেরা বলিত, সুকুমারের গা ঠিক পাথরের মত। আমি মনে মনে বলিতাম, গা পাথরের মত নয়—মন পাথরের মত। কচি খোকার মত কাঁদিয়া ফেলি না। বাস্তবিক, কাঁদিতে আমার লজ্জা বোধ হইত, এখনও হয়, কিন্তু সামলাইতে পারি না। লুকাইয়া কেহ কোথাও নাই দেখিয়া, চোরের চুরি করার মত—দুবার চক্ষু মুছিয়া ফেলি। স্কুলে পড়িতে যাই, একপাল লোক ভিক্ষা করিতেছে। কাহারও হাত নাই, পা নাই, কাহারও চক্ষু দুটি নাই, এমনই কত কি নাই ধরণের লোক দেখি, তাহা আর বলিতে পারি না। তিলক কাটিয়া খঞ্জনী হাতে লইয়া “জয় রাধে” বলিয়া ভিক্ষা করে, তাহাই জানি, এ-সব ভিখারী আবার কি রকমের? মনের দুঃখে মনে মনেই বলিতাম, ঠাকুর! এদের আমাদের দেশে পাঠিয়ে দাও। যাক পোড়া ভিখারীর কথা— আমার কথা বলি। চক্ষু অনেকটা সড়গড় হইলেও আমি একেবারে বিদ্যাসাগর হইতে পারিলাম না। মধ্যে মধ্যে আমাদের দেশের মা সরস্বতী যে কোথা হইতে আসিয়া আমার স্কন্ধদেশে ভর করিতেন, বলিতে পারি না। তাঁহার আজ্ঞাধীন হইয়া যে-সকল সৎকৰ্ম্ম করিয়া ফেলিতাম, তজ্জন্য এখনও আমার সে সরস্বতীর উপর ঘৃণা হইয়া আছে। বাসায় কাহার কি অনিষ্ট করিব, সৰ্ব্বদা খুঁজিয়া বেড়াইতাম। রামবাবু তিনঘণ্টা ধরিয়া তাঁহার দেশী কালাপেড়ে কাপড় কুঞ্চিত করিলেন; বিকালে বেড়াইতে যাইবেন। আমি অবসর বুঝিয়া কাপড়খানি খুলিয়া টানিয়া প্রায় সোজা করিয়া রাখিয়া দিলাম। তিনি বিকালে বস্ত্রখানির অবস্থা দেখিয়া বসিয়া পড়িলেন। আমার আর আমোদ ধরে না। জগন্নাথবাবুর অফিসের বেলা হইয়া গিয়াছে, তাড়াতাড়ি আহার করিতে বসিয়াছেন, একমুহূৰ্ত্ত বিলম্ব সহিতেছে না। আমি সময় বুঝিয়া তাঁহার চাপকানের বোতামগুলি সমস্ত কাটিয়া লইলাম। স্কুল যাইবার সময় একবার উঁকি মারিয়া দেখিয়া গেলাম, জগন্নাথবাবু ডাক ছাড়িয়া কাঁদিবার উপক্রম করিতেছেন। মনের আনন্দে আমি সমস্ত পথ হাসিতে হাসিতে চলিলাম। সন্ধ্যার সময় জগন্নাথবাবু অফিস হইতে ফিরিয়া বলিলেন, আমার চাপকানের বোতামগুলো গদা-বেটা চুরি করে বেচে ফেলেচে—বেটাকে তাড়িয়ে দাও। জগন্নাথবাবুর চাপকানের বিবরণে দাদা ও রামবাবু উভয়েই মুখ টিপিয়া হাসিলেন। সেজদাদা বলিলেন, কত রকমের চোর আছে, কিন্তু চাপকানের বোতাম চুরি করে বেচে ফেলতে কখনও শুনিনি। জগন্নাথবাবু এ-কথায় আরও ক্রুদ্ধ হইয়া বলিলেন, বেটা বোতামগুলো সকালে নিলে না, বিকালে নিলে না, রাত্রে নিলে না, ঠিক অফিস যাবার আগেই নিয়েচে। আজ দুৰ্গতির একশেষ করেচে, একটা কালো ছেড়া পিরান গায়ে দিয়ে আমার অফিস যেতে হয়েচে।

সকলেই হাসিলেন। জগন্নাথবাবুও হাসিলেন। কিন্তু আমি হাসিতে পারিলাম না। মনে ভয় হইল, পাছে গদাধরকে তাড়াইয়া দেওয়া হয়। সে যে নিৰ্ব্বোধ, হয়ত কোনও কথা বলিবে না, সমস্ত অপরাধ নিজের স্বন্ধে স্বেচ্ছায় তুলিয়া লইবে।

কে বোতাম লইয়াছে, সেজদাদা বুঝিয়াছিলেন। গরীব গদাধরের উপর কোনও জুলুম হইল না। কিন্তু আমিও সেই অবধি প্রতিজ্ঞ করিলাম, আর কখনও এমন কৰ্ম্ম করিয়া অন্যকে বিপন্ন করিব না।

এরূপ প্রতিজ্ঞ আমি পূৰ্ব্বে কখনও করি নাই, কখনও করিতাম কি না জানি না। শুধু গদাধর আমাকে একেবারে মাটি করিয়া দিয়াছে।

কি উপায়ে কাহার যে চরিত্র সংশোধিত হইয়া যায়, কেহই জানে না। গুরুমহাশয়ের, ঠাকুর্দ্দা মহাশয়ের, আরও অনেক মহাশয়ের কত চেষ্টাতেও আমি যে প্রতিজ্ঞা কখনও করি নাই, এক গদাধর ঠাকুরের মুখ মনে করিয়া আজ সেই প্রতিজ্ঞা করিয়া ফেলিলাম। এতদিনে প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ হইয়াছে কি-না জানি না; কিন্তু স্বেচ্ছায় কখনও ভঙ্গ করিয়াছি এমন মনে হয় না।

এখন আর একজন লোকের কথা বলি। সে আমাদের রামা চাকর। রামা জাতে কায়েত কি সদ্‌গোপ, এমনই কি একটা ছিল। বাড়ি কোথায়, শুনি নাই— এত হুঁশিয়ার চটপটে চাকর সর্ব্বদা দেখা যায় না। আর যদি কখনও দেখা হয়, ইচ্ছা আছে, তাহার বাড়ি কোথায় জিজ্ঞাসা করিয়া লইব।

সকল কৰ্ম্মে রামাকে চরকির মত ঘুরিয়া বেড়াইতে দেখিতাম। এই রামা কাপড় কাচিতেছে; তখনি দেখি সেজদাদা স্নানে বসিয়াছেন, সে গা রগড়াইয়া দিতেছে; পরক্ষণেই দেখি সে পান-সুপারি লইয়া মহা ব্যস্ত। এইরূপে সে সৰ্ব্বদাই ঘুরিয়া বেড়ায়। সেজদার “The favourite!” মস্ত লোক। আমি কিন্তু তাহাকে দেখিতে পারিতাম না। সে-বেটার জন্য আমি সেজদার নিকট প্রায়ই তিরস্কৃত হইতাম। বিশেষতঃ গদা বেচারীকে সে সৰ্ব্বদাই অপ্রস্তুত করিত। আমি তাহার উপর বড় চটা ছিলাম। কিন্তু হইলে কি হয়, সে সেজদার “The favourite!” আমাদের বাসার রামবাবুও তাহাকে দেখিতে পারিতেন না। তিনি বলিতেন, “The rogue!” তখন এ-কথাটার ব্যাখ্যা তিনি নিজে না করিতে পারিলেও আমরা দুজনে বিলক্ষণ বুঝিতাম, রাম “The rogue!” তাহার চটিবার আরও অনেক কারণ ছিল। প্রধান কারণ এই যে, সে নিজেকে রামবাবু বলিয়া পরিচিত করিত। সেজদাদাও সময়ে সময়ে রামবাবু বলিয়া ডাকিতেন। আমাদের রামবাবুর এ-সব ভাল লাগিত না। যাক বাজে কথা –

একদিন বিকালে সেজদাদা একটা ল্যাম্প ক্রয় করিয়া আনিলেন। বড় ভাল জিনিস, প্রায় পঞ্চাশ-যাট টাকা মূল্য। সকলে বেড়াইতে যাইলে আমি গদাধরকে ডাকিয়া আনিয়া সেটা দেখাইলাম। গদাধর সে-রকম আলো কখনও দেখে নাই। সে মহা আহ্লাদিত হইয়া সেটা দুই-চারিবার নাড়িয়া দেখিল; তাহার পর আপনার কৰ্ম্মে রন্ধনশালার প্রবেশ করিল। আমার কিন্তু কৌতুহল কিছুতেই থামিল না। কি করিয়া চিমনী খুলি! কি করিয়া ভিতরের কল দেখি! অনেক নাড়িয়া চাড়িয়া দেখিলাম, অনেকবার ঘুরাইবার চেষ্টা করিলাম, কিন্তু কিছুতেই খুলিল না। পরে দেখিলাম, নীচে একটা ইস্ক্রু আছে, অগত্য সেটা ঘুরাইলাম। কিছুক্ষণ ঘুরাইবার পর হঠাৎ একেবারে ল্যাম্পের আধখানা খসিয়া আসিল। তাড়াতাড়ি ভাল ধরিতে পারিলাম না, উপরের কাচগুলা টেবিল হইতে নীচে পড়িয়া একেবারে চুর্ণ হইয়া গেল।