এক

অন্নপ্রাশনের সময় যখন আমাদের নামকরণ হয়, তখন আমি ঠিক হইয়া উঠিতে পারি নাই বলিয়াই হৌক, আর ঠাকুর্দ্দা মহাশয়ের জ্যোতিষ-শাস্ত্রে বিশেষ দখল না থাকাতেই হৌক, আমি ‘সুকুমার’। অধিক দিন নহে, ঠিক দুই-চারি বৎসরে ঠাকুর্দ্দা মহাশয় বুঝিলেন যে, নামটার আমার সহিত তেমন মিশ খায় না। এবার বার-তের বৎসর পরের কথা বলি। অবশ্য আমার আত্ম-পরিচয়ের কথা কেউ ভাল বুঝিতে পারিবে না—তবুও—

দেখুন, পাড়াগাঁয়ে আমাদের বাড়ি। সেখানে আমি ছেলেবেলা হইতেই আছি। পিতা মহাশয় পশ্চিমাঞ্চলে চাকুরি করিতেন। আমি বড় একটা সেখানে যাইতাম না। ঠাকুরমার নিকট দেশেই থাকিতাম। বাটীতে আমার উপদ্রবের সীমা ছিল না। এক কথায় একটি ক্ষুদ্র রাবণ ছিলাম। বৃদ্ধ ঠাকুৰ্দ্দা যখন বলিতেন, তুই হলি কি? কারও কথা শুনিস্‌নে। এইবার তোর বাপকে চিঠি লিখব। আমি অল্প হাসিয়া বলিতাম, ঠাকুর্দ্দা, সে দিন-কাল আর নেই, বাপের বাপকে আমি ভয় করিনে। ঠাকুরমা কাছে থাকিলে আর ভয় কি? ঠাকুর্দ্দাকে তিনিই বলিতেন, কেমন উত্তর দিয়েচে—আর লাগবে?

ঠাকুর্দ্দা মহাশয় যদি বড় বিরক্ত হইয়া আমার পিতাকে পত্র লিখিতেন, আমি তখনই তাঁর আফিমের কৌটা লুকাইয়া ফেলিতাম। পরে পত্ৰখানি না ছিঁড়িয়া ফেলিলে আর কৌটা বাহির করিতাম না। এইসব উপদ্রবের ভয়ে বিশেষতঃ মৌতাত সম্বন্ধে বিভ্ৰাট ঘটে দেখিয়া তিনি আমাকে আর কিছু বলিতেন না। আমিও বেশ ছিলাম।

হইলে কি হয়? সকল সুখেরই একটা সীমা নির্দ্দিষ্ট আছে। আমারও তাহাই হইল। ঠাকৰ্দ্দার খুড়তুত ভাই গোবিন্দবাবু বরাবর এলাহাবাদে চাকুরি করিতেন; এখন পেনসন লইয়া তিনি দেশে আসিলেন। তাঁহার পৌত্র শ্ৰীযুক্ত রজনীনাথ বি. এ. পাশ করিয়া তাঁহার সহিত ফিরিয়া আসিলেন। আমি তাঁকে সেজদাদা বলি। পূৰ্ব্বে আমার সহিত তাঁহার বিশেষ জানা-শুনা ছিল না। তিনি বড় একটা এ অঞ্চলে আসিতেন না; বিশেষতঃ তাঁদের আলাদা বাড়ি; আসিলেও আমার খোঁজ লইতেন না। কখনও দেখা হইলে—কি রে কেমন আছিস্? কি পড়িস্? এই পৰ্য্যন্ত।

এবার তিনি জাঁকিয়া আসিয়া দেশে বসিলেন। কাজে কাজেই আমার বিশেষ খোঁজ হইল। দুই-চারি দিবসের আলাপেই তিনি আমাকে এরূপ বশীভূত করিয়া ফেলিলেন যে, তাঁহাকে দেখিলেই আমার ভয় হইত, মুখ শুকাইয়া যাইত, বুক ধড়াস্ ধড়াস্ করিত—যেন কত দোষই করিয়াছি, কত শাস্তি পাইব। আর যথার্থ আমি তখন প্রায়ই দোষী থাকিতাম। সৰ্ব্বদা একটা না একটা অন্যায় করা আমার চাই। দুই-চারটি অকৰ্ম্ম, দুই-চারিবার উপদ্রব করা আমার নিত্যকৰ্ম্ম। ভয় করিলেও আমি দাদাকে বড় ভালবাসিতাম। ভাই ভাইকে যে এত ভালবাসিতে পারে, পূৰ্ব্বে আমি তাহা জানিতাম না। তিনিও আমাকে বড় ভালবাসিতেন। তাঁর কাছেও কত দোষ করিয়াছি, কিন্তু কিছু বলিতেন না; আর বলিলেও মনে করিতাম, সেজদাদা ত, একটু পরে তার কিছুই মনে থাকিবে না।

ইচ্ছা করিলে হয়ত তিনি আমার চরিত্র সংশোধন করিতে পারিতেন, কিন্তু কিছুই করিলেন না। তাঁর দেশে আসাতে আমি পূৰ্ব্বের মত স্বাধীন নয় বটে, কিন্তু তথাপি যাহা আছি, বেশ আছি।

রোজ ঠাকুৰ্দ্দার এক পয়সার তামাক খাইয়া ফেলি। বুড়ো বেচারী আমার ভয়ে খাটের খুরোর পাশে, তক্তাপোশের পেটের সিন্দুকে, চালার বাতায়, যেখানে তামাক রাখিতেন, আমি খুঁজিয়া খুঁজিয়া সবটুকু টানিয়া আনিয়া খাইয়া ফেলিতাম। খাইদাই ঘুড়ি ওড়াই, বেশ আছি। কোন জঞ্জাল নাই; পড়া-শুনা একরকম ছাড়িয়াই দিয়াছি। পাখী মারিতাম, কাঠবিড়াল মারিয়া পোড়াইয়া খাইতাম, বনে বনে গৰ্ত্তে গৰ্ত্তে খরগোস খুঁজিয়া বেড়াইতাম, কোনও ভাবনা ছিল না।

বাবা বক্সারে চাকুরি করিতেন। সে-স্থান হইতে আমাকে দেখিতেও আসিতেন না, মারিতেও আসিতেন না। ঠাকুরমা ও ঠাকুর্দ্দার হাল পূৰ্ব্বেই বিবৃত করিয়াছি। সুতরাং এক কথায় আমি বেশ ছিলাম।

একদিন দুপুরবেলা বাড়ি আসিয়া ঠাকুরমার নিকট শুনিলাম, আমাকে সেজদার সহিত কলিকাতায় থাকিয়া পড়া-শুনা করিতে হইবে। আহারাদি সমাপ্ত করিয়া একছিলিম তামাক হাতে করিয়া আসিয়া ঠাকুর্দ্দাকে বলিলাম, আমাকে কলকাতায় যেতে হবে? ঠাকুর্দ্দা বলিলেন, হ্যাঁ। আমি পূৰ্ব্ব হইতেই ভাবিয়া রাখিরাছিলাম, এ-সকল ঠাকুর্দ্দার চালাকি। বলিলাম, যদি যেতে হয় আজই যাব। ঠাকুর্দ্দা হাসিয়া বলিলেন, সে জন্য চিন্তা কি দাদা? রজনী আজই কলকাতায় যাবে। বাসা ঠিক হয়ে গেছে, আজই যেতে হবে। আমি অগ্নিশৰ্ম্মা হইয়া উঠিলাম। একে সেদিন ঠাকুর্দ্দার তামাক খুঁজিয়া পাই নাই—যে একছিলিম পাইয়াছিলাম, তাহাতে আমার একটানও হইবে না—তাহার উপর আবার এই কথা। ঠকিয়া গিয়াছি; নিজে নিমন্ত্রণ লইয়া আর ফিরান যায় না। কাজেই সেদিন আমাকে কলিকাতায় যাইতে হইল। যাইবার সময় ঠাকুর্দ্দাকে প্রণাম করিয়া মনে মনে বলিলাম, হরি কালই যেন তোমার শ্রাদ্ধে বাড়ি ফিরে আসি। তারপর আমাকে কে কলকাতায় পাঠায় দেখে নেবো।