তরবারীর ধারাল বুক উম্মে আরারার ঘাড়ে রাখেন পুরোহিত। আবার উপরে তোলেন। পার্শ্বস্থিত নারী-পুরুষরা সেজদা থেকে উঠে আসন গেড়ে বসে ধীর অথচ জ্বালাময়ী কণ্ঠে কী যেন পাঠ করতে শুরু করে। তরবারী উঁচু করে দাঁড়িয়ে পুরোহিত। দু-একটি নিঃশ্বাসের বিলম্ব আর। তরবারী নীচে নামলো বলে। ঠিক এমন সময়ে একটি তীর এসে বিদ্ধ হয় পুরোহিতের বগলে। তরবারী ধরা হাতটা তার নীচে পড়ে যায়নি এখনও। একই সঙ্গে আরও তিনটি তীর এসে বিদ্ধ হয় পাঁজরে। চীৎকার জুড়ে দেয় মেয়েরা। জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ে হাবশী পুরুষরা। দেখতে না দেখতে আরও এক ঝাঁক তীর এসে আঘাত করে পুরোহিতের সহচরদের। ধরাশায়ী হয়ে পড়ে দু ব্যক্তি। এদিক-সেদিক দৌড়ে পালিয়ে যায় মেয়েরা। উম্মে আরারার বিন্দুমাত্র ভ্রূক্ষেপ নেই সেদিকে। দিব্যি মাথা নত করে বসে আছে সে।
দ্রুত দৌড়ে বেদীতে এসে পৌঁছে কমাণ্ডোরা। চবুতরায় উঠে তুলে নেয় উম্মে আরারাকে। নেশার ঘোরে প্রলাপ বকছে সে এখনও। এক জানবাজ নিজের গায়ের জামা খুলে পরিয়ে দেয় তাকে। উম্মে আরারাকে নিয়ে রওনা দেয় তারা।
হঠাৎ বার-তেরজন হাবশী বর্শা ও ঢাল নিয়ে ছুটে আসে একদিক থেকে। বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে সুলতান সালাহুদ্দীনের কমাণ্ডোরা। তীর-কামান ছিল তাদের চারজনের কাছে। তীর ছুঁড়ে তারা। অবশিষ্টরা লুকিয়ে থাকে এক জায়গায়। হাবশীরা নিকটে এলে পিছন দিক থেকে তাদের উপর হামলা চালায় লুকিয়ে থাকা কমাণ্ডোরা। এক তীরন্দাজ কমাণ্ডো কামানে সলিতাওয়ালা তীর স্থাপন করে। সলিতায় আগুন ধরিয়ে ছুঁড়ে মারে উপর দিকে। বেশ উপরে উঠে থেমে যখন তীরটি নীচে নামতে শুরু করে, তখন প্রজ্বলিত হয়ে উঠে তীরের মাথায়। জড়ানো সলিতার শিখা।
মেলার জাঁকজমক মন্দীভূত হয়নি এখনও। উৎসবে অংশগ্রহণকারীদের পাঁচশত লোক মেলাঙ্গন থেকে পৃথক হয়ে তাকিয়ে আছে পাহাড়ী ভূখণ্ডের প্রতি। বেশ দূরে শূন্যে একটি শিখা দেখতে পায় তারা। হঠাৎ প্রজ্বলিত হয়ে নীচে নামছে শিখাঁটি। তারা উট-ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে আছে। কমার আছে তাদের সঙ্গে। প্রথমে ধীরপায়ে এগিয়ে চলে তারা, যেন সন্দেহ না জাগে কারুর মনে। খানিক দূরে গিয়েই দ্রুতগতিতে ঘোড়া ছুটায়। মেলার লোকেরা মদ-জুয়া, উলঙ্গ নারীর নাচ-গান আর গণিকাদের নিয়ে এতই ব্যস্ত যে, তাদের দেবতাদের উপর কি প্রলয় ঘটে যাচ্ছে, তার খবরও নেই তাদের।
কমাণ্ডো বাহিনী এই আশঙ্কায় অগ্নি-তীর নিক্ষেপ করেছিল যে, হাবশীদের সংখ্যা বোধ হয় অনেক হবে। কিন্তু পাঁচশত সৈন্য অকুস্থলে পৌঁছে মাত্র চৌদ্দ-পনেরটি লাশ দেখতে পায়। তেরটি হাবশীদের আর দুটি তাদের দু কমাণ্ডোর। হাবশীদের বর্শার আঘাতে শাহাদাতবরণ করেছিল কমাণ্ডো দুজন।
ঘটনাস্থলে পৌঁছে চারদিকের খোঁজ-খবর নেয় সৈন্যরা। তারা পাথরের মুখমণ্ডলের নিকট ও পাতাল কক্ষে যায়। যা পেল কুড়িয়ে নেয় সব। তন্মধ্যে ছিল একটি ফুল। ফুলটি প্রাকৃতিক নয়— কৃত্রিম। কাপড় দিয়ে তৈরী করা হয়েছিল ফুলটি। নির্দেশনা মোতাবেক পাঁচশত সৈন্য জায়গাটি দখল করে অবস্থান নেয় সেখানে। আর উম্মে আরারাকে ঘোড়ার পিঠে তুলে কায়রো অভিমুখে রওনা হয় কমাণ্ডো বাহিনী।
ভোর বেলা।
মেলার রওনক শেষ হয়ে গেছে। রাতভর মদপান করে এখনও অচেতন পড়ে আছে বহু লোক। দোকানীরা যাওয়ার জন্য মালামাল গুটিয়ে নিচ্ছে। মেয়ে-বেপারীরাও যাচ্ছে চলে। মেলাঙ্গন থেকে বের হওয়ার জন্য মরুবাসীদের ভীড় পড়ে গেছে রাস্তায়।
আঙ্গুক গোত্রের লোকেরা-অধীর অপেক্ষায় প্রহর গুণছে কখন তাদের মাঝে বলী দেওয়া মেয়ের চুল বিতরণ করা হবে।
এ গোত্রের যারা দূর-দূরান্তের পল্লি অঞ্চলে বাস করে, তারা এক নাগাড়ে পাহাড়ী অঞ্চল থেকে দূরে দাঁড়িয়ে দেবপুরীর প্রতি তাকিয়ে আছে। বৃদ্ধ ও প্রবীণরা নবীনদের সান্ত্বনা দিচ্ছে, একটু অপেক্ষা কর, পুরোহিত এক্ষুনি চলে আসবেন, দেবতাদের সন্তুষ্টির সুসংবাদ প্রদান করবেন এবং আমাদের মাঝে চুল বিতরণ করবেন। কিন্তু দেবতাদের কোন পয়গাম যে আসবে না, তা কেউ জানে না।
দিন গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে। দেবতাদের কোন সংবাদ আসছে না। সংশয়ে পড়ে যায় এক শ্রেণীর যুবক। সব মিথ্যা বলে সন্দেহ জাগে তাদের মনে। কিন্তু কারুর এতটুকু সাহস নেই যে, ওখানে গিয়ে দেখে আসবে, পুরোহিত আসছেন না কেন।
○ ○ ○
‘ডাক্তারকে ডেকে আন। মেয়েটা নেশার ঘোরে এমন করছে।’ বললেন সুলতান সালাহুদ্দীন।
উম্মে আরারা সুলতান সালাহুদ্দীনের সামনে বসে আছে এবং বিড় বিড় করে বলছে— ‘আমি আঙ্গুকের মা। তুমি কে? তুমি তো দেবতা নও। আমার স্বামী কোথায়? আমার মাথাটা কেটে ফেল এবং দেবতাকে দিয়ে দাও; আমাকে আমার ছেলেদের জন্য উৎসর্গ কর।’
অনর্গল-বকে যাচ্ছে উম্মে আরারা। নেশার ঘোরে আচ্ছন্ন সে। মাথাটা দুলছে তার।
ডাক্তার আসেন। মেয়েটির অবস্থা দেখেই তিনি সব বুঝে ফেলেন। সামান্য ঔষধ খাইয়ে দেন। অল্পক্ষণের মধ্যেই তার চোখ দুটো বুজে আসে। বিছানায় শুইয়ে দেওয়া হল তাকে। গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে উম্মে আরারা।
ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ শুনলেন সালাহুদ্দীন। অভিযান চালিয়ে সেই পার্বত্য অঞ্চলে কী কী পাওয়া গেল, তাও শোনানো হল তাকে। সুলতান সালাহুদ্দীন নায়েব সালার আন-নাসের ও বাহাহুদ্দীন শাদ্দাদকে নির্দেশ দেন, পাঁচশত সৈন্য নিয়ে আপনারা এক্ষুনি রওনা হন। প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সঙ্গে নিন। মূর্তিটিকে ধুলায় মিশিয়ে দিন। জায়গাটিকে ঘেরাও করে রাখুন। আক্রমণ আসলে মোকাবেলা করবেন। এলাকার মানুষ যদি নতি স্বীকার করে, তাহলে তাদেরকে স্থানটি দেখিয়ে মমতার সাথে বুঝিয়ে দেবেন, এ ছিল স্রেফ প্রতারণা।
বাহাহুদ্দীন শাদ্দাদ তার ডায়রীতে লিখেছেন—
‘পাঁচশত সৈন্য নিয়ে আমরা ওখানে পৌঁছি। পূর্ব থেকে আমাদের যে বাহিনীটি ওখানে অবস্থান নিয়েছিল, তার কমাণ্ডার আমাদেরকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যায়। হাজার হাজার সুদানী কাফ্রী দূরে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের কেউ কেউ উট-ঘোড়ায় সওয়ার হাতে তাদের বর্শা, তরবারী ও কামান-ধনুক।
আমাদের সমুদয় সৈন্যকে আমরা সেই পার্বত্য অঞ্চলের চারদিকে এমনভাবে দাঁড় করিয়ে দেই যে, তাদের মুখ বাইরের দিকে। তারা তীর-ধনুক বর্শা নিয়ে প্রস্তুত দাঁড়িয়ে থাকে। আমরা রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের আশঙ্কা করছিলাম।
আমি আন-নাসেরের সঙ্গে ভেতরে প্রবেশ করি। মূর্তিটি দেখেই আমি বললাম, এত ফেরাউনদের প্রতিকৃতি।
আশে-পাশে পড়ে আছে হাবশীদের লাশ। আমরা পুরো এলাকা ঘুরে-ফিরে দেখি। দুটি পাহাড়ের মাঝে একটি জীর্ণ প্রাসাদ। ফেরআউনী আমলের একটি মনোরম প্রাসাদ এটি। দেওয়ালের গায়ে সে যুগের কিছু লিপি। আমাদের সন্দেহ রইল না, এখানে ফেরআউনেরই বাস ছিল।
দেওয়ালের মত খাড়া একটি পাহাড়ের পাদদেশে একটি ঝিল। ঝিলে অনেকগুলো কুমীর। পাহাড়ের কোল ঘেষে পাহাড়ের ভিতরে ঢুকে গেছে ঝিলের পানি। পানির উপর পাহাড়ের ছাদ। বড় ভয়ঙ্কর জায়গা। আমাদের দেখে সবগুলো কুমীর এসে পড়ে কুলে। চেয়ে চেয়ে আমাদের দেখতে থাকে।
আমি সৈনিকদের বললাম, হাবশীদের লাশগুলো ধরে ধরে ঝিলে নিক্ষেপ কর; ক্ষুধার্ত প্রাণীগুলোর ভাল আহার মিলবে। সৈনিকরা লাশগুলোকে টেনে-হেঁচড়ে ঝিলে নিক্ষেপ করে। কুমীরের সংখ্যা যে কত, তার হিসেব নেই। ফেলা মাত্র দেখলাম, লাশগুলো যেন দৌড়ে পাহাড়ের অভ্যন্তরে চলে গেল। সব শেষে এল পুরোহিতের লাশ। বহু মানুষকে সে কুমীরের মুখে নিক্ষেপ করেছিল। আর আজ সে নিজেই নিক্ষিপ্ত হল সেই কুমীরের মুখে।
দুজন সিপাহী চারটি সুদানী মেয়েকে ধরে আনে। তারা এক স্থানে লুকিয়ে ছিল। মেয়েগুলো বিবস্ত্র। কোমরে বাঁধা দুটি পাতা। একটি সামনে, অপরটি পিছনে। আমি ও নাসের অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে নিলাম। সৈনিকদের বললাম, জলদি এদের ঢাকো। সৈনিকরা তাদের পোশাক পরায়। এবার আমরা তাদের পাণে তাকালাম। মেয়েগুলো বেশ রূপসী। তারা কাঁদছে। ভয়ে থর্ থর্ করে কাঁপছে। তারা অভয় পেয়ে কথা বলে। খুলে বলে সেখানকার সব ইতিবৃত্ত। বড় লজ্জাকর সেসব ঘটনা। নারী জাতির এ অবমাননা কোন মুসলমানের সহ্য হওয়ার কথা নয়। আপন-পর, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে ইসলাম সব নারীকে সমান ইজ্জত করে। একজন মুসলমানের নিকট একজন মুসলিম নারীর যে মর্যাদা, একজন অমুসলিম নারীর মর্যাদা তার চেয়ে কোন অংশে কম নয়। যা হোক, মেয়েগুলোর বক্তব্যে আমরা বুঝলাম যে, তারা ফেরআউনদের খোদা বলে বিশ্বাস করে। তাদের গোত্রের মানুষ মানুষকে খোদা মানে।
স্থানটি বেশ মনোরম। সবুজ-শ্যামলিমায় ঘেরা সমগ্র এলাকা। ভেতরে পানির ঝরনা। এই ঝরনার পানি থেকেই ঝিলের উৎপত্তি। ঘন সন্নিবিষ্ট বৃক্ষরাজি ছায়া দিয়ে রেখেছে। কোন এক সৌখিন ফেরআউনের স্থানটি পসন্দ হয়ে গেলে একে সে বিনোদপুরি বানিয়েছিল। নিজের খোদায়িত্বের প্রমাণস্বরূপ তৈরী করেছিল এ মূর্তিটি। নির্মাণ করেছিল পাতাল-কক্ষ। বহুদিন আমোদ করে গেছে সে এখানে।
অবশেষে এক সময় দিন বদলে যায়। খসে পড়ে ফেরআউনদের ক্ষমতার নক্ষত্র। মিসরে আসে আরেক মিথ্যা ধর্ম। কেটে যায় কিছু দিন। সবশেষে জয় হয় সত্যের। লাইলাহা ইল্লাল্লাহর মুখরিত ধ্বনি শুনতে পায় মিসর। আল্লাহর সমীপে মাথা নত করে মিসরের মানুষ। কিন্তু সকলের চোখে ধুলো দিয়ে মিথ্যা তখনও টিকে থাকে এই পার্বত্য অঞ্চলে। আলহামদুলিল্লাহ, মহান আল্লাহর অপার কৃপায় আমরা মিথ্যার এই শেষ চিহ্নটুকুও মুছে ফেললাম। মূর্তিপূজাসহ জঘন্যতম কুসংস্কার থেকে এ ভূখণ্ডটিকে পবিত্র করলাম।
○ ○ ○
সৈন্যরা স্থানটিকে ঘিরে ফেলে। প্রস্তর-নির্মিত বেদীটি ভেঙ্গে চুরমার করে। চবুতরাটিও গুঁড়িয়ে দেয়। পাতাল-কক্ষটি ভরে দেয় ইট-পাথর দিয়ে। বাইরে হাজার হাজার হাবশী বিস্ময়াভিভূত দাঁড়িয়ে কাণ্ড দেখছে। ডেকে তাদেরকে ভিতরে নিয়ে দেখান হয়, এখানে কিছুই ছিল না। বলা হয়, ধর্ম-বিশ্বাসের নামে তোমাদের সাথে এতকাল শুধু প্রতারণাই করা হয়েছে। মেয়ে চারটিকে তাদের হাতে তুলে দেওয়া হল। মেয়েদের বাপ-ভাইরাও উপস্থিত ছিল সেখানে। আপন আপন কন্যা ও বোনকে নিয়ে যায় তারা। তাদেরকে বলা হল, এখানে একজন অসৎ লোক বাস করত। ধর্মের নামে নারীর ইজ্জত ও মানুষের জীবন নিয়ে তামাশা করত সে। এখন সে কুমীরের পেটে। এই হাজার হাজার হাবশীকে সমবেত করে তাদের উদ্দেশে কমাণ্ডার বক্তৃতা করেন তাদের ভাষায়। তারা সকলেই নীরব। তাদেরকে ইসলামের প্রতি আহ্বান করা হয়। এবারও তাদের মুখে কোন কথা নেই। কখনও কখনও মনে হচ্ছিল, রক্ত নেমে এসেছে তাদের চোখে। প্রতিশোধের আগুনে পুড়ে মরছে যেন তারা। অবশেষে হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করে বলা হয় যদি তোমাদের সত্য খোদাকে দেখার ইচ্ছে থাকে, তাহলে এস দেখিয়ে দিই। আর এখন তোমরা যে স্থানে বসে আছে, যদি তাকে মিথ্যা দেব-দেবীর আবাস মনে করে থাক, তাও বল; এই পাহাড়গুলোকেও আমরা ধুলোয় মিশিয়ে দিই। তার পরে তোমরা দেখবে কোন্ খোদা সত্য।
জ্ঞান ফিরে এসেছে উম্মে আরারার। মেয়েটি সুলতান সালাহুদ্দীনকে সে নিজের সব ঘটনা খুলে বলে। চৈতন্য ফিরে আসার পর এবার তার সব ঘটনাই মনে আসে। সে বলে, পুরোহিত দিন-রাত যখন-তখন তাকে উপভোগ করত। বারবার একটি ফুল শোকাত তার নাকে। বলী দেওয়ার কথাও পুরোহিত বলে রেখেছিল তাকে। কমাণ্ডো বাহিনী যথাসময়ে গিয়ে না পৌঁছুলে এখন তার মস্তক থাকত গর্তে আর দেহ থাকত কুমীরের পেটে। ভয়ে কাঁপতে লাগল মেয়েটি। চোখে অশ্রু নেমে আসে তার। সুলতান সালাহুদ্দীনের হাতে চুমো খেয়ে বলল, ‘আল্লাহ আমাকে আমার পাপের শাস্তি দিয়েছেন। আমি জীবনে বহু পাপ করেছি। আপনি আমাকে আশ্রয় দিন।’ মানসিকভাবে বড় বিধ্বস্ত উম্মে আরারা।
সিরিয়ার এক বিত্তশালী ব্যক্তির নাম উল্লেখ করে উম্মে আরারা জানায়, ‘আমি তার কন্যা। লোকটি মুসলমান। বিখ্যাত ব্যবসায়ী। সিরিয়ার আমীরদের সঙ্গে তার বন্ধুত্বের সম্পর্ক।’
তৎকালে আমীরগণ একটি শহর কিংবা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভূখণ্ড শাসন করত। কেন্দ্রীয় শাসনের অধীনে কাজ করত তারা। দশম শতাব্দীর পর এই আমীরগণ সম্পূর্ণরূপে বিলাসিতায় ডুবে যায়। বড় বড় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলে। তারা তাদের সঙ্গে ব্যবসা করত এবং সুদও গ্রহণ করত। সুন্দরী মেয়েদের দ্বারা পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে তাদের হেরেম। তারা নারী আর মদে আকণ্ঠ নিমজ্জিত হয়ে পড়ে।
উম্মে আরারাও এমনি এক ধনাঢ্য ব্যবসায়ীর কন্যা। বার-তের বছর বয়সেই সে পিতার সঙ্গে আমীরদের নাচ-গানের আসরে যোগ দিতে আরম্ভ করে। অসাধারণ সুন্দরী বলেই বোধ হয় পিতা শৈশব থেকেই তাকে আমীরদের কালচারে অভ্যস্ত করে তুলতে শুরু করেছিল।
উম্মে আরারাহ জানায়— ‘আমার বয়স যখন চৌদ্দ, তখনই আমীরগণ আমার প্রতি প্রলুব্ধ হয়ে ওঠে। দুজন আমীর আমাকে বহুমূল্যবান উপহারও দিয়েছিলেন। আমি নিজেকে পাপের হাতে তুলে দেই। ষোল বছর বয়সে পিতার অজান্তে গোপনে রক্ষিতা হয়ে যাই এক আমীরের। কিন্তু বাস করতাম নিজের ঘরে।’
বিত্তশালী পিতার কন্যা উম্মে আরারা। ঐশ্বর্যের মাঝে তার জন্ম, লালন-পালন ও যৌবন লাভ। লাজ-লজ্জার সঙ্গে কোন পরিচয় ছিল না তার। তিন বছরের মাথায় পিতার হাত থেকে বেরিয়ে যায় সে। স্বাধীন চিত্তে আরও দুজন আমীরের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে নেয়। বাকপটু রূপসী কন্যা হিসেবে উম্মে আরারার নাম এখন সকলের মুখে মুখে।
অবশেষে পিতা তার সঙ্গে সমঝোতা করেন। পিতার সহযোগিতায় তিনজন। আমীর তাকে নতুন এক প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করেন। ইসলামী সাম্রাজ্য ধ্বংসের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত এই তিন আমীর। উম্মে আরারার পিতাও এই ষড়যন্ত্রে জড়িত। খেলাফতের মূলোৎপাটন করার কাজে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে উম্মে আরারাকে। এক সময়ে এক খৃষ্টানও এসে যোগ দেয় এ প্রশিক্ষণে।
স্বাধীন শাসক হওয়ার স্বপ্ন দেখছিলেন এই আমীরগণ। এর জন্যে প্রয়োজন খৃষ্টানদের সহযোগিতা। নুরুদ্দীন জঙ্গী ও খেলাফতের মাঝে ভুল-বুঝাবুঝির কাজে ব্যবহার করা হয় উম্মে আরারাকে। এ অভিযানে তিন খৃষ্টান মেয়েকে যুক্ত করে একটি টিম গঠন করে ক্রুসেডাররা।
কঠোর প্রশিক্ষণ দিয়ে উম্মে আরারাকে, তারা উপহারস্বরূপ খলীফা আল-আজেদের খেদমতে প্রেরণ করে। তার দায়িত্ব, প্রথমত খলীফার অন্তরে সালাহুদ্দীন আইউবীর প্রতি বিদ্বেষ ও শত্রুতা সৃষ্টি করা এবং সাবেক সুদানী ফৌজের যে কজন অফিসার এখনও বাহিনীতে রয়ে গেছে, তাদেরকে খলীফার কাছে ভিড়িয়ে সুদানীদেরকে আরেকটি বিদ্রোহের প্রতি উৎসাহিত করা। দ্বিতীয়ত সুদানী ফৌজকে বিদ্রোহে নামিয়ে অস্ত্র ও নানাবিধ উপায়ে তাদেরকে সহযোগিতা করার জন্য খলীফাকে প্রস্তুত করা এবং সম্ভব হলে সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর একটি দলকে প্ররোচনা দিয়ে বিদ্রোহী বানিয়ে তাদেরকে সুদানীদের সঙ্গে যুক্ত করা। খলীফা আর কিছু করতে না পারলেও তাকে দিয়ে অন্তত এতটুকু করানো যে, নিজের নিরাপত্তা বাহিনীকে সুদানীদের হাতে অর্পণ করে নিজে সুলতান সালাহুদ্দীনের নিকট চলে যাবেন এবং তাকে বলবেন, আমার রক্ষী বাহিনী বিদ্রোহী হয়ে গেছে। সারকথা, সালাহুদ্দীন আইউবীর বিরুদ্ধে এমন একটি যুদ্ধক্ষেত্র প্রস্তুত করা, যা তাকে মিসর ছেড়ে পালাতে বাধ্য করে এবং বাকি জীবনটা তার একঘরে হয়ে কাটাতে হয়।
উম্মে আরারাহ সুলতান সালাহুদ্দীনকে জানায়, সম্ভ্রান্ত এক মুসলিম পরিবারে তার জন্ম হয়েছিল। কিন্তু পিতা তাকে ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহরই মূলোৎপাটনের প্রশিক্ষণ প্রদান করে এবং ইসলামী সাম্রাজ্যের আমীরগণ শত্রুর সঙ্গে যোগ দিয়ে তাকে আপন সাম্রাজ্যের পতনের কাজেই ব্যবহার করে।
রূপ-যৌবন, বুদ্ধিমত্তা, বিচক্ষণতা ও বাকচাতুর্যে অল্প কদিনে খলীফাকে নিজের মুঠোয় নিয়ে আসে উম্মে আরারা। সুলতান সালাহুদ্দীনের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলে সে খলীফাকে। রজবকেও জড়িত করে নেয় এ ষড়যন্ত্রে। আরও দুজন সামরিক কর্মকর্তাকে সঙ্গে নিয়ে সালাহুদ্দীনের বিরুদ্ধে মাঠে নামে রজব। ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে খলীফার নিরাপত্তা বাহিনীতে মিসরীদের বাদ দিয়ে সুদানীদের টেনে আনতে শুরু করে সে।
উম্মে আরারা খলীফার মহলে এসেছে দু-আড়াই মাস হল। এই স্বল্প সময়েই সে রাণী হয়ে গেছে মহলের। গোটা কসরে খেলাফত এখন ওঠে-বসে তারই ইঙ্গিতে।
উম্মে আরারা সুলতান সালাহুদ্দীনকে আরও জানায়, ‘খলীফা আপনাকে হত্যা করাতে চান। হাশীশীদের সঙ্গে যোগ দিয়ে হত্যার আয়োজন সম্পন্ন করেছে রজব।’
ইসলাম ও রাষ্ট্রদ্রোহী তৎপরতা এবং বিলাস-প্রিয়তায় বিরক্ত হয়ে সুলতান সালাহুদ্দীন খলীফার বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করে দিয়েছিলেন আগেই। এর মধ্যে কাকতালীয়ভাবে ঘটে গেল এসব ঘটনা। খলীফা যাদের দ্বারা সুলতান সালাহুদ্দীনকে কোণঠাঁসা করাতে চেয়েছিলেন, তাদেরই হাতে মহলের রাণী উম্মে আরারার অপহরণ এবং সালাহুদ্দীনের হাতে তার উদ্ধারের মধ্য দিয়ে দৈবাৎ ফাঁস হয়ে গেল অনেক তথ্য। অবশেষে সুলতান কর্তৃক সালাহুদ্দীনের হত্যার ষড়যন্ত্রের পরিকল্পনাও গোপন রইল না। উম্মে আরারার অপহরণকে কেন্দ্র করেই ইতিমধ্যে সুলতান সালাহুদ্দীন খলীফার নিরাপত্তা বাহিনী থেকে বদলি করে দিয়েছেন রজবকে। তার স্থলে প্রেরণ করেছেন নিজের বিশ্বস্ত এক নায়েব সালারকে। কিন্তু এসব ঘটনা সুলতান সালাহুদ্দীনের জন্য জন্ম দেয় নতুন এক বিপদ।
উম্মে আরারাকে নিজের আশ্রয়ে রাখলেন সুলতান। অনুতাপের আগুনে পুড়ে মরছে মেয়েটি। অতীত পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে চায় সে। ভয়াবহ এক বিপদে ফেলে আল্লাহ তার চোখ খুলে দিয়েছেন। ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে কী পদক্ষেপ নেবেন, ঠাণ্ডা মাথায় ভাবছেন সুলতান সালাহুদ্দীন।
ফেরআউনদের শেষ চিহ্ন ধুলোয় মিশিয়ে পরদিন আন-নাসের ও বাহাহুদ্দীন শাদ্দাদ ফিরে আসেন কায়রো।
○ ○ ○
আট দিন পর।
রাতের শেষ প্রহর। ঘুমিয়ে আছেন সুলতান সালাহুদ্দীন। চাকর এসে তাকে জাগিয়ে বলে, আন-নাসের, আলী বিন সুফিয়ান এবং আরও দুজন নায়েব এসেছেন। ধড়মড় করে উঠে বৈঠকখানায় ছুটে যান সুলতান। অভ্যাগতদের একজন এক টহল বাহিনীর কমাণ্ডার।
সুলতান সালাহুদ্দীনকে জানানো হল, প্রায় ছয় হাজার সুদানী সৈন্য মিসরের সীমান্ত অতিক্রম করে একস্থানে শিবির স্থাপন করেছে। তাদের মধ্যে আছে পদচ্যুত সুদানী বাহিনীর কিছু সদস্য এবং কাফ্রী গোত্রের বেশ কিছু লোক। এই কমাণ্ডার তথ্য জানার জন্য ছদ্মবেশে দুজন উষ্ট্রারোহীকে তাদের ছাউনিতে প্রেরণ করেছিল। প্রাপ্ত তথ্য মোতাবেক কায়রো আক্রমণ করা তাদের উদ্দেশ্য। নিজেদেরকে পর্যটক দাবি করে উষ্ট্রারোহীদ্বয় বাহিনীর কর্মকর্তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে সালাহুদ্দীন আইউবীর বিরুদ্ধে কথা বলে এবং এই বলে ফিরে আসে যে, এ অভিযানকে সফল করার জন্য প্রয়োজনে তারা সৈন্য দিয়ে তাদের সাহায্য করবে। প্রাপ্ত তথ্য মোতাবেক তারা এদিকওদিক থেকে আরও সৈন্য আগমনের অপেক্ষা করছে এবং আগামী কালই সেখান থেকে কায়রো অভিমুখে রওনা হবে।
সব শুনে সুলতান সালাহুদ্দীন আদেশ করলেন, ‘খলীফার নিরাপত্তা বাহিনীতে মাত্র পঞ্চাশজন সৈন্য আর একজন কমাণ্ডার রেখে অন্যদের ছাউনিতে ডেকে আন। খলীফা আপত্তি জানালে বলবে, এ আমার আদেশ।’
সুলতান সালাহুদ্দীন আলী বিন সুফিয়ানকে বললেন, ‘আপনার ব্রাঞ্চের সুদানী ভাষায় পারদর্শী এমন একশত লোককে সুদানী বিদ্রোহী বেশে এই কমাণ্ডারের সঙ্গে এক্ষুনি রওনা করিয়ে দিন।’ কমাণ্ডারের প্রতি দৃষ্টিপাত করে বললেন, ‘এ একশত লোক ঐ দু উষ্ট্রারোহীর সঙ্গে সুদানী বাহিনীতে গিয়ে যোগ দেবে। উষ্ট্রারোহী সান্ত্রী দুজন বলবে, প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী আমরা তোমাদের সাহায্য নিয়ে এসেছি। তাদেরকে বলে দেবে, যেন তারা বাহিনীর গতিবিধি সম্পর্কে আমাদের অবহিত করে এবং রাতে তাদের পশু ও রসদ কোথায় থাকে, তা চিহ্নিত করে রাখে।’ সুলতান সালাহুদ্দীন আন-নাসেরকে বললেন, ‘আপনি অতি দ্রুতগামী অশ্বারোহী, কমাণ্ডা বাহিনী এবং ক্ষুদ্র একটি মিনজানিক প্লাটুন প্রস্তুত করে রাখুন।’
‘আমি ভেবেছিলাম, সরাসরি আক্রমণ চালিয়ে শহর থেকে দূরে থাকতেই ওদের শেষ করে দেব।’ বললেন আন-নাসের।
‘না, মনে রেখো নাসের! দুশমনের সংখ্যা তোমাদের অপেক্ষা কম হলেও মুখোমুখি সংঘাত এড়িয়ে চলবে। রাতে কমাণ্ডো বাহিনী ব্যবহার করবে, দুশমনের উপর অতর্কিতে হামলা চালাবে। পার্শ্ব থেকে, পিছন থেকে আঘাত হেনে পালিয়ে যাবে। দুশমনের রসদ নষ্ট করবে, পশু ধ্বংস করবে। তাদের অস্থির করে রাখবে ও শত্রু বাহিনীতে বিশৃংখলা সৃষ্টি করবে। তাদের সামনে অগ্রসর হওয়ার সুযোগ দেবে না। ডানে-বাঁয়ে ছত্রভঙ্গ হয়ে যেতে বাধ্য করবে। মুখোমুখি সংঘাতে লিপ্ত হতে হলে মনে রাখবে, রণাঙ্গন মরুভূমি। সর্বপ্রথম পানির উৎস দখল করবে। সূর্য এবং বায়ুকে তাদের প্রতিকূলে রাখবে। তাদের মধ্যে অস্থিরতা সৃষ্টি করে নিজের যুৎসই জায়গায় নিয়ে যাবে। মনে রাখবে, সুদানীদের কায়রো পর্যন্ত পৌঁছার কিংবা আমাদের সৈন্যদেরকে মুখোমুখি লড়াইয়ে জড়িয়ে ফেলার স্বপ্ন আমি পূরণ হতে দেব না।’
সুলতান সালাহুদ্দীন আলী বিন সুফিয়ানকে বললেন, ‘যে একশত সৈন্যকে সুদানী বাহিনীর সঙ্গে যোগ দিতে পাঠাবে, তাদের বলে দেবে যেন তারা ছাউনিতে গুজব ছড়ায়, ছয়-সাত দিনের মধ্যে সালাহুদ্দীন আইউবী ফিলিস্তীন আক্রমণ করতে যাচ্ছেন। কাজেই আমাদের ক’টা দিন অপেক্ষা করে তার অনুপস্থিতির সময়টাতে কায়রো আক্রমণ করতে হবে।’
এমনি বেশ কিছু আদেশ-নির্দেশনা দিয়ে সুলতান সালাহুদ্দীন বললেন, ‘আজ আমি কায়রো থাকব না।’ কায়রো থেকে বেশ দূরের একটি জায়গার নাম বললেন তিনি। সেখানে তিনি দুশমনের কাছাকাছি তার হেডকোয়ার্টার রাখতে চান; যাতে সরাসরি নিজে যুদ্ধের তত্ত্বাবধান করতে পারেন।
বৈঠকখানায়ই ফজর নামায আদায় করেন সকলে। সুলতান সালাহুদ্দীনের পরিকল্পনা মোতাবেক কর্মতৎপরতা শুরু হয়ে যায়। প্রস্তুতির জন্য সুলতান নিজ কক্ষে চলে যান।
সুদানীদের সৈন্যসংখ্যা বৃদ্ধি পেতে চলেছে। ইতিপূর্বে তাদের একটি বিদ্রোহ শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়েছিল দু বছর হল। আবার বিদ্রোহ করার জন্য প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছিল তখন থেকেই। সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়ে রেখেছিল খৃষ্টানরা। বিপুলসংখ্যক গুপ্তচর ছড়িয়ে দিয়েছিল তারা মিসরে। একদিন যে সুদানীরা কায়রো আক্রমণ করবে, তা ছিল সুনিশ্চিত। কিন্তু তা এত তাড়াতাড়ি, এমন আচম্বিত হয়ে যাবে, তা ভাবেননি সুলতান সালাহুদ্দীন। হাবশী গোত্রের উপর সুলতান সালাহুদ্দীনের সামরিক অভিযানে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিল সুদানীরা। তারই প্রতিশোধ নেওয়ার উদ্দেশ্যে তার এই আকস্মিক সেনা অভিযান। হাবশীদের উপর সালাহুদ্দীনের সামরিক অভিযানের পর পাঁচ-সাত দিনের মধ্যেই তারা সেনা সমাবেশ ঘটায় এবং কায়রো আক্রমণের জন্য রওনা হয়।
দু উষ্ট্রারোহীর সঙ্গে একশত সশস্ত্র মুসলিম সেনা যখন সুদানী বাহিনীতে যোগ দেয়, সুদানীরা তখন মিসর সীমান্ত থেকে বেশ ভিতরে পৌঁছে গিয়ে ছাউনী ফেলেছে। সুলতান সালাহুদ্দীন রাতে শহর ত্যাগ করে এমন স্থানে চলে যান, যেখান থেকে সুদানীদের গতিবিধির খবর নেওয়া ছিল নিতান্ত সহজ। সুদানী বাহিনীতে অনুপ্রবেশকারী সালাহুদ্দীনের সেনারা কর্মকর্তাদের জানায়, সুলতান সালাহুদ্দীন কয়েকদিনের মধ্যে ফিলিস্তীন আক্রমণ করতে যাচ্ছেন। এ সংবাদ শুনে সুদানী সেনা কর্মকর্তারা উফুল্ল হয়ে ওঠে। সালাহুদ্দীনের অনুপস্থিতির সময়টিতেই তারা কায়রো অভিযান পরিচালিত করবে বলে স্থির করে। ফলে এ ছাউনী আরও দু দিন বহাল রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। পরদিন রাত থেকে সুলতান সালাহুদ্দীনের নিকট তাদের খবরা-খবর আসতে শুরু করে।
তারও পরের রাতে সুলতান সালাহুদ্দীন পাঁচটি মিজানিক, বেশ কিছু অগ্নিগোলা ও অগ্নিতীর দিয়ে পঞ্চাশজন অশ্বারোহী প্রেরণ করেন।
মধ্য রাত। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন সুদানী বাহিনী। এমন সময়ে তাদের রসদ-ডিপোতে অগ্নিগোলা নিক্ষিপ্ত হতে শুরু করে। পরক্ষণেই ছুটে আসতে শুরু করে অগ্নিতীর। ভয়ঙ্কর অগ্নিশিখায় আলোকিত হয়ে ওঠে মধ্য রাতের নিঝুম শূন্য আকাশ। আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে সুদানী বাহিনীতে। সঙ্গে সঙ্গে মিনজানিকগুলোকে সেখান থেকে পিছনে সরিয়ে নিয়ে যায় সালাহুদ্দীনের সেনারা। পঞ্চাশজন অশ্বারোহী তিন-চারটি খণ্ডে বিভক্ত হয়ে দ্রুত ঘোড়া ছুটায় এবং সুদানী বাহিনীর ডান ও বাম পার্শ্বের সৈন্যদের পায়ে পিষে এবং বর্শা দ্বারা দমাদম আঘাত হেনে চোখের পলকে উধাও হয়ে যায়। খাদ্য-সম্ভারে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে আর আতঙ্কিত উট-ঘোড়াগুলো দিগ্বিদিক ছুটাছুটি করছে। সুলতান সালাহুদ্দীনের সৈন্যরা এ ছাউনীতে আরও একবার হামলা চালায় এবং বৃষ্টির মত তীর নিক্ষেপ করে হাওয়া হয়ে যায়।
পরদিন সংবাদ পাওয়া গেল, আগুনে পুড়ে, ঘোড়া ও উটের পদতলে পিষ্ট হয়ে ও সুলতান সালাহুদ্দীনের কমাণ্ডা বাহিনীর অতর্কিত আক্রমণে অন্তত চারশত সুদানী সৈন্য নিহত হয়েছে। সমুদয় খাদ্যসম্ভার ও তীরের ডিপো পুড়ে ভস্ম হয়ে গেছে।
অবশেষে সুদানী সৈন্যরা ছাউনী তুলে সেখান থেকে চলে যায় এবং রাতে এমন এক স্থানে শিবির স্থাপন করে, যার আশে-পাশে উঁচু উঁচু মাটির টিলা। কমাণ্ডো হামলার আশঙ্কা নেই এখানে। এবার টহল বাহিনী ছাউনীর চারপাশে অনেক দূর পর্যন্ত পাহারা দিতে শুরু করে। কিন্তু তারপরও আক্রমণের হাত থেকে রক্ষা পেল না। তারা ঠিক আগের রাতের মত আক্রমণের শিকার হয়। দুজন প্রহরীকে কাবু করে খুন করে ফেলে সুলতান সালাহুদ্দীনের কমাণ্ডোরা। টিলার উপর থেকে অগ্নিতীর ছুঁড়তে শুরু করে তীরন্দাজ বাহিনী। ভোরের আলো ফোঁটার পূর্ব পর্যন্ত এ হামলা চালিয়ে তারা উধাও হয়ে যায়। আক্রমণকারীরা কোত্থেকে এল, কোথায়ই বা গেল কিছুই বুঝতে পারল না সুদানী বাহিনী। এ হামলায় তারা গত রাত অপেক্ষা বেশী ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়।
সন্ধ্যার পর আলী বিন সুফিয়ান সুলতান সালাহুদ্দীনকে গুপ্তচর মারফত প্রাপ্ত রিপোর্ট সম্পর্কে অবহিত করেন। তিনি জানান, ‘সুদানী বাহিনী আমাদের কমাণ্ডো বাহিনীর অবস্থান সম্পর্কে অবগত হয়ে এ্যাকশন নেওয়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। এ পরিকল্পনা মোতাবেক তারা আগামী কালই অভিযান পরিচালনা করবে।’ সুলতান সালাহুদ্দীন একটি রিজার্ভ ফোর্স আটকে রেখেছিলেন নিজের কাছে। গত দু রাতের অভিযানে অংশ নেয়নি তারা। তিনি জানতেন, দু একটি অপারেশনের পর দুশমন সতর্ক হয়ে যাবে। পর দিন তিনি সুদানী বাহিনীর ডানে ও বাঁয়ে চারশত করে পদাতিক বাহিনী প্রেরণ করেন। তাদেরকে বলে দেন, যেন তারা সুদানী বাহিনী থেকে আধা মাইল দূর দিয়ে সম্মুখে অগ্রসর হতে থাকে। সুদানীরা যখন দেখল, শত্রু বাহিনীর দুটি দল রণসাজে তাদের পার্শ্ব দিয়ে এগিয়ে চলছে, তখন তারা সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে এবং শত্রুবাহিনী পিছন অথবা পার্শ্ব থেকে আক্রমণ করতে পারে, এ আশঙ্কায় দু পার্শ্বের সৈন্যদেরকে দুদিকে ছড়িয়ে দেয় এবং সুলতান সালাহুদ্দীনের এ দু পদাতিক বাহিনীর মোকাবেলার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করেন।
সুলতান সালাহুদ্দীনের নির্দেশনা মোতাবেক তারা সামনে এগিয়ে চলে। ধোঁকায় পড়ে যায় সুদানীরা। ঠিক এমন সময়ে আচমকা পাঁচশত অশ্বারোহী টিলার আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে সুদানী বাহিনীর মধ্যস্থলে হামলা করে বসে। অশ্বারোহীদের এ আকস্মিক তীব্র আক্রমণে প্রলয় সৃষ্টি হয়ে যায় সমগ্র বাহিনীতে। পার্শ্ব থেকে তীরন্দাজ বাহিনী বৃষ্টির মত তীর ছুঁড়তে শুরু করে তাদের প্রতি। এভাবে সুলতান সালাহুদ্দীনের মাত্র তেরশত সৈন্য অন্তত ছয় হাজার শত্রুসেনাকে ক্ষণিকের মধ্যে বিপর্যস্ত করে তোলে। সু-কৌশলে গ্যাড়াকলে আটকিয়ে এমন শোচনীয়ভাবে তাদের পরাজিত করে যে, মিসরের মরুপ্রান্তর তাদের লাশে পরিপূর্ণ হয়ে যায়। জীবনে রক্ষা পাওয়া সুদানীদের দু চারজন পালিয়ে যেতে সক্ষম হলেও বেশীর ভাগই বন্দী হয় সালাহুদ্দীন বাহিনীর হাতে।
এ ছিল সুদানীদের দ্বিতীয় বিদ্রোহ, যাকে তাদেরই রক্তে ডুবিয়ে নিঃশেষ করে দিয়েছিলেন সুলতান সালাহুদ্দীন।
বন্দীদের জিজ্ঞাসাবাদ করে তথ্য সংগ্রহ করেন সুলতান। গ্রেফতারকৃত সুদানী সব কমাণ্ডার এবং বিদ্রোহের ষড়যন্ত্রে জড়িত সকল কর্মকর্তা ও সিপাহীদের তিনি কারাগারে প্রেরণ করেন। জিজ্ঞাসাবাদে নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত লোকদের নাম-পরিচয়ও পেয়ে যান সুলতান সালাহুদ্দীন। তিনি তাদের মৃত্যুদণ্ড প্রদান করেন। রজব এবং তার মত আরও যেসব সালার এই রাষ্ট্রদ্রোহী কর্মতৎপরতায় জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেল, তাদেরকে আজীবনের জন্য জেলখানার অন্ধকার প্রকোষ্ঠে নিক্ষেপ করা হল। এ ষড়যন্ত্র এমন কতিপয় কর্মকর্তার সম্পৃক্ততার তথ্যও পাওয়া গেল, যাদেরকে সুলতান সালাহুদ্দীনের একান্ত অনুগত ও বিশ্বস্ত মনে করা হত। এ তথ্য পেয়ে সুলতান সালাহুদ্দীন স্তম্ভিত হয়ে যান। তিনি তাঁর নির্ভরযোগ্য সালার ও অন্যান্য কর্মকর্তাদের জানিয়ে দেন, এ পরিস্থিতিতে মিসরের প্রতিরক্ষা এবং সালতানাতের অস্তিত্ব সুদৃঢ় করার জন্য এখনই আমাদের সুদান দখল করা একান্ত আবশ্যক।
সুলতান সালাহুদ্দীন খলীফা আল-আজেদের নিরাপত্তা বাহিনীকে প্রত্যাহার করে নেন। খেলাফতের মসনদ থেকে খলীফাকে অপসারণ ঘোষণা দেন, এখন থেকে মিসর সরাসরি বাগদাদের খেলাফতের অধীনে পরিচালিত হবে। খেলাফতের একমাত্র মসনদ থাকবে বাগদাদে।
সুলতান সালাহুদ্দীন আটজন রক্ষীর সঙ্গে উম্মে আরারাকে নুরুদ্দীন জঙ্গীর নিকট পাঠিয়ে দেন।