উম্মে আরারাকে ঘোড়ায় তুলে নিয়ে হাবশী দুজন চলে যায় অনেক দূর। এখন আর কারও পশ্চাদ্ধাবনের আশঙ্কা নেই। ঘোড়া থামায় তারা। মেয়েটি পুনরায় মুক্ত হওয়ার জন্য ছটফট করতে শুরু করে। হাবশীরা তাকে বলে, ‘এই তড়পানি তোমার অনর্থক। আমরা তোমাকে ছেড়ে দিলেও এখন আর এ বালুকাময় প্রান্তর অতিক্রম করে তুমি করে খেলাফতে জীবিত যেতে পারবে না।’ তারা মেয়েটিকে এই বলে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করে যে, ‘আমরা তোমাকে অপমান করতে চাই না।’ বাস্তবিক, যদি তাদের উদ্দেশ্য খারাপ হত, তাহলে এতক্ষণে তারা মেয়েটির সঙ্গে হায়েনার মত আচরণ করত। কিন্তু তারা তেমন কিছুই করেনি। এমন একটি চিন্তাকর্ষক সুন্দরী মেয়ে যে তাদের হাতের মুঠোয়, সে অনুভূতিই যেন নেই তাদের। তাদের যে দুজন লোক মারা পড়েছে, তার একজন মৃত্যুর আগে উম্মে আরারার সামনে হাটু গেড়ে বসে করজোরে নিবেদন করেছিল, পালাবার চেষ্টা করে যেন সে নিজেকে কষ্টে না ফেলে। মেয়েটি তাদের জিজ্ঞেস করল, ‘তোমরা আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছ?’ জবাবে তারা বলল, ‘আমরা তোমাকে আসমানের দেবতার রাণী বানানোর জন্য নিয়ে যাচ্ছি।’

তারা মেয়েটির চোখে পট্টি বেঁধে ঘোড়ায় বসায়। মেয়েটি পালাবার চেষ্টা ত্যাগ করে। এ চেষ্টা যে বৃথা, তা বুঝে ফেলে সে।

ছুটে চলে ঘোড়া। এক হাবশীর সামনে ঘোড়ায় বসে ফোঁপাতে থাকে উম্মে আরারা। দীর্ঘক্ষণ চলার পর শীতল বায়ুর পরশে সে বুঝতে পারে রাত হয়ে গেছে। আরও কিছুক্ষণ চলার পর এক স্থানে থেমে যায় ঘোড়া। একটানা পথ চলায় পরিশ্রান্ত হয়ে পড়ে মেয়েটি। সমস্ত শরীর ভেঙ্গে আসে যেন তার। ভয়ে অকেজো হয়ে গেছে তার মস্তিষ্ক।

ঘোড়া থামতেই আশে-পাশে তিন-চারজন পুরুষ আর জনতিনেক মেয়ের মিশ্র স্বর শুনতে পায় মেয়েটি। অবোধ্য এক ভাষায় কথা বলছে তারা। অপহরণকারী হাবশীরা পথে তার সঙ্গে কথা বলেছে আরবী ভাষায়। কিন্তু তাদের বাচনভঙ্গি আরবী নয়।

চোখের পট্টি খোলা হয়নি উম্মে আরারার। সে অনুভব করে, একজন তাকে তুলে একটি নরম বস্তুর উপর বসিয়ে দেয়। বস্তুটি পালকি। উপরে উঠে যায় পালকিটি। শুরু হয় তার নতুন আরেক সফর। পালকি কাঁধে করে এগিয়ে চলে বেহারা। তার সঙ্গে দফের মৃদু-মধুর গুঞ্জরণ কানে আসতে শুরু করে তার। গান গাইতে শুরু করে মেয়েরা। গানের শব্দগুলো বুঝতে পারছে না মেয়েটি। কিন্তু গানের সুর-লয়ে জাদুর ক্রিয়া। তাতে উম্মে আরারার ভয়ের মাত্রা বেড়ে যায় আরও। এই ভয়ের মাঝে এমনও প্রতিক্রিয়া হতে শুরু করে, যেন নেশা বা আচ্ছন্নতা চেপে ধরছে তাকে। রাতের হীম বায়ু সে আচ্ছন্নতায় এক প্রকার মধুরতা সৃষ্টি করে চলেছে। উম্মে আরারার একবার ইচ্ছা জাগে, পালকি থেকে লাফিয়ে পড়ে পালাবার চেষ্টা করি আর ওরা আমাকে মেরে ফেলুক। কিন্তু পরক্ষণেই সে ভাবে, না, আমি যাদের কব্জায় আটকা পড়েছি, তারা মানুষ নয় অন্য কোন শক্তি। স্বেচ্ছায় আমার কিছুই করা চলবে না।

উম্মে আরারা টের পায়, বেহারারা একের পর এক সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠছে। উঠছে তো উঠছেই। অন্তত ত্রিশটি সিঁড়ি অতিক্রম করে এবার তারা সমতল জায়গায় চলতে শুরু করে। কয়েক পা এগিয়েই থেমে যায় পাকি। পালকিটি নামিয়ে রাখা হয় নীচে। উম্মে আরারার চোখ থেকে পট্টি খুলে দুচোখে হাত রাখে একজন। কিছুক্ষণ পর চোখের উপর থেকে হাতের আঙ্গুল সরতে শুরু করে এক এক করে। চোখে আলো দেখতে শুরু করে মেয়েটি। ধীরে ধীরে চোখ থেকে সরে যায় হাত।

চোখ ঘুরিয়ে এদিকওদিক তাকায় উম্মে আরারা। হাজার হাজার বছরের পুরনো একটি প্রাসাদে দাঁড়িয়ে আছে সে। একদিকে প্রশস্থ একটি হল। তাতে বিছিয়ে রাখা ফরশ আলোয় ঝল্‌মল্ করছে। দেওয়ালের সঙ্গে স্থানে স্থানে দাঁড়িয়ে আছে কতগুলো দণ্ড। প্রদীপ জ্বলছে সেগুলোর মাথায়। এক প্রকার সুঘ্রাণ নাকে আসে তার, যার সৌরভ সম্পূর্ণ নতুন মনে হল তার কাছে। দফের মৃদু শব্দ আর নারী কণ্ঠের গানের আওয়াজ কানে আসে উম্মে আরারার। এই বাদ্য-শব্দ আর গানের লয়-তাল অপূর্ব এক গুঞ্জরণ সৃষ্টি করে চলেছে হলময়।

সম্মুখে তাকায় উম্মে আরারা। একটি চবুতরা চোখে পড়ে। চবুতরায় পাথর-নির্মিত একটি মূর্তির মুখমণ্ডল ও মাথা। চিবুকের নীচে সামান্য একটু গ্রীবা। এই পাথরের মুখমণ্ডলটি দীর্ঘকায় একজন মানুষের চেয়েও দেড়-দু ফুট উঁচু। মুখটা খোলা, যা এতই চওড়া যে, একজন মানুষ একটুখানি ঝুঁকে অনায়াসে তাতে ঢুকে পড়তে পারে। ধবধবে সাদা দাঁতও আছে মুখে। দেখতে মনে হচ্ছে, খিলখিল করে হাসছে মুখমণ্ডলটি। উভয় কান থেকে তার বেরিয়ে এসেছে দুটি দণ্ড। প্রদীপ জ্বলছে সেগুলোর মাথায়। হাত দুয়েক করে চওড়া চোখ দুটো তার অকস্মাৎ জ্বলজ্বল করে ওঠে। আলো বিচ্ছুরিত হতে শুরু করে তা থেকে। পাল্টে যায় মেয়েদের গানের লয়। তীব্র হয়ে ওঠে দফের বাজনা। আলোকিত হয়ে ওঠে পাথরের অভ্যন্তর। ধপধপে সাদা চোগা পরিহিত দুজন মানুষ ঝুঁকে বেরিয়ে আসে মুখের ভেতর থেকে। লোক দুটির গায়ের রঙ কালো। মাথায় বাঁধা লম্বা লম্বা রঙ-বেরঙের পাখির পালক। মুখের অভ্যন্তর থেকে বাইরে এসেই একজন ডান দিকে একজন বাঁ দিকে দাঁড়িয়ে যায়।

পরক্ষণেই মুখের ভেতর থেকে আত্মপ্রকাশ করে আরেকজন মানুষ। ঝুঁকে বাইরে বেরিয়ে আসে সেও। বয়সে খানিকটা বৃদ্ধ মনে হল তাকে। পরনে লাল বর্ণের চোগা, মাথায় মুকুট। দু কাঁধে কুণ্ডলী পাকিয়ে ফনা তুলে বসে আছে মিশমিশে কালো দুটি সাপ। সাপ দুটো কৃত্রিম। ভয়ে গা শিউরে উঠে উম্মে আরারার। নির্জীব নির্বাক দাঁড়িয়ে থাকে সে।

এ লোকটি অত্র গোত্রের ধর্মগুরু বা পুরোহিত। চবুতরার সিঁড়ি বেয়ে নীচে নেমে আসেন তিনি। ধীরে ধীরে উম্মে আরারার নিকটে এসে মেয়েটির সামনে হাটু গেড়ে বসে তার দুটি হাত নিজের দুহাতে নিয়ে চুমো খান। আরবী ভাষায় মেয়েটিকে বলেন, ‘তুমিই সেই ভাগ্যবতী মেয়ে, আমার দেবতা যাকে পছন্দ করেছেন। আমি তোমাকে মোবারকবাদ দিচ্ছি।’

চৈতন্য ফিরে পায় উম্মে আরারা। কাঁদ কাঁদ কণ্ঠে বলে, ‘আমি কোন দেবতা মানি না। তোমাদের যদি দেবতায় বিশ্বাস থাকে, তো আমি তাদের দোহাই দিয়ে বলছি, আমাকে ছেড়ে দাও। তোমরা আমাকে এখানে কেন আনলে?’

‘এখানে যেই আসে, প্রথম প্রথম একথাই বলে। কিন্তু পরে যখন চোখের সামনে এ পবিত্র ভূখণ্ডের মাহাত্ম্য খুলে যায়, তখন বলে— আমি এখানে চিরদিন থাকতে চাই। আমি জানি, তুমি মুসলমানদের খলীফার প্রেমাস্পদ। কিন্তু যিনি পছন্দ করেছেন, দুনিয়ার সব খলীফা আর আকাশের ফেরেশতাকুল তাকে সেজদা করে। তুমি জান্নাতে এসে গেছ।’

পুরোহিত চোগার পকেট থেকে একটি ফুল বের করে। উম্মে আরারার নাকের কাছে ধরে ফুলটি। উম্মে আরারাহ হেরেমের রাজকন্যা। এমনসব আতর-সুগন্ধি ব্যবহার সে করেছে, রাজকন্যারা ব্যতীত কেউ যার কল্পনাও করতে পারে না। কিন্তু এ ফুলের সৌরভ তার কাছে নিতান্তই অভিনব বলে মনে হল। এ ফুলের সৌরভ হৃদয় ভেদ করে যায় উম্মে আরারার। সঙ্গে সঙ্গে ভাবনার রঙও পাল্টে যায় তার। পুরোহিত বললেন— ‘এটি দেবতার উপহার।’ মেয়েটির নাক থেকে ফুলটি সরিয়ে নেন পুরোহিত।

ধীরে ধীরে ডান হাতটা আগে বাড়ায় উম্মে আরারা। পুরোহিতের ফুল-ধরা হাতটা টেনে আনে নিজের কাছে। নাকের কাছে নিয়ে ফুল শুঁকে আবেশমাখা কণ্ঠে বলে— ‘কি মন ভুলানো উপহার! দেবেন এটি আমায়?’

‘তুমি কি দেবতার এ উপহার গ্রহণ করেছ?’ জিজ্ঞেস করেন পুরোহিত। ঠোঁটে তার হাসি।

‘হ্যাঁ, দেবতার এ উপহার আমি কবুল করে নিয়েছি।’ বলে উম্মে আরারাহ পুনরায় ফুলটি নাকের কাছে ধরে। নিজের চোখ দুটো বন্ধ করে ফেলে, যেন ফুলের সৌরভে বিমোহিত হয়ে পড়েছে সে।

‘দেবতাও তোমায় কবুল করে নিয়েছেন।’ বললেন পুরোহিত। তারপর জিজ্ঞেস করলেন— ‘এতক্ষণ তুমি কোথায় ছিলে?’

ভাবনায় পড়ে যায় মেয়েটি। যেন কিছু স্মরণ করার চেষ্টা করছে সে। খানিক পর মাথা দুলিয়ে বলে— ‘আমি এখানেই তো আছি। — না, না আমি অন্য এক জায়গায় ছিলাম— ধুত্তুরি ছাই! মনেই পড়ছে না, কোথায় ছিলাম।’

‘এখানে তোমাকে কে নিয়ে এসেছে?’

‘কেউ নয়। আমি নিজেই এসেছি?’

‘কেন, তুমি ঘোড়ায় চড়ে আসোনি?’

‘না, আমি উড়ে এসেছি।’

‘কেন, পথে মরুভূমি, পাহাড়-জঙ্গল, বিরাণভূমি দেখনি?’

‘দেখিনি মানে! কত সবুজের সমারোহ আর কত রঙ-বেরঙের ফুল দেখেছি!’ শিশুর ন্যায় আপুত কণ্ঠে জবাব দেয় মেয়েটি।

‘তোমার চোখে কেউ পট্টি বাঁধেনি?’

‘পট্টি? কই না তো! আমার চোখ তো খোলাই ছিল! কত সুন্দর সুন্দর মন ভুলানো পাখি দেখেছি আমি!’

উচ্চশব্দে কি যেন বললেন পুরোহিত। উম্মে আরারার পিছন দিক থেকে ধেয়ে আসে চারটি মেয়ে। এসেই পরনের পোশাক খুলে বিবস্ত্র করে ফেলে উম্মে আরারাকে। উম্মে আরারাহ হেসে জিজ্ঞেস করে— ‘দেবতা এ অবস্থায় আমাকে পছন্দ করবেন?’ পুরোহিত বললেন— ‘না, তোমাকে দেবতার পছন্দের পোশাক পরানো হবে।’ মেয়েরা উম্মে আরারার কাঁধের উপর চাদরের মত দীর্ঘ একটি কাপড় ঝুলিয়ে দেয়। কাঁধ থেকে পা পর্যন্ত লম্বিত চাদরে আপাদমস্তক আবৃত হয়ে যায় তার। চাদরের পাড়ে কতগুলো রঙ্গিন রশির টুকরো বাঁধা। দুই পাড় একত্র করে বেঁধে দেয় মেয়েরা। চমৎকার এক চোগায় পরিণত হয় চাদরটি। উম্মে আরারার মাথার চুল রেশমের মত কোমল। একটি মেয়ে চুলগুলো আঁচড়িয়ে পিঠের উপর ছড়িয়ে দেয়। আরও বেড়ে যায় উম্মে আরারার রূপ।

পুরোহিত হাসিমুখে তাকায় উম্মে আরারার প্রতি। পাথর-নির্মিত ভয়ঙ্কর মুখমণ্ডলটির প্রতি হাঁটা দেন তিনি। দুটি মেয়ে উম্মে আরারারকে নিয়ে পুরোহিতের পেছনে পেছনে এগিয়ে যায়। রাজকন্যার মত হাঁটছে উম্মে আরারাহ। আশে-পাশে দৃষ্টি নেই তার। রাজকীয় ভঙ্গিমায় চলছে সে। পুরোহিতের অনুসরণে মেয়ে দুটোর হাত ধরে চবুতরার সিঁড়িতে উঠতে শুরু করে। পাথরের পাহাড়সম মুখমণ্ডলের গহ্বরে ঢুকে পড়ে পুরোহিত। উম্মে আরারাও তিনটি সিঁড়ি অতিক্রম করে ঝুঁকে ঢুকে পড়ে মুখের অভ্যন্তরে। মেয়ে দুটো দাঁড়িয়ে থাকে বাইরে। উম্মে আরারার হাত ছেড়ে দেয় তারা; ধরে পুরোহিত নিজে। মুখের অভ্যন্তরটা যথেষ্ট প্রশস্থ, অনায়াসে সোজা হয়ে হাঁটতে পারছে মেয়েটি। কণ্ঠনালী থেকে নীচে নেমে গেছে কয়েকটি সিঁড়ি। এই সিঁড়ি বেয়ে নীচে নামে দুজন।

আবার একটি কক্ষ। কক্ষটি তেমন প্রশস্থ নয়। বেশ কটি প্রদীপ জ্বলছে। এখানেও ফুলের সৌরভ। কক্ষের ছাদ তেমন উঁচু নয়। দেওয়াল ও ছাদ গাছের পাতা ও ফুল দিয়ে ঢাকা। ফরাশের উপর নরম ঘাস। ঘাসের উপর ফুল ছিটানো। এক কোণে মনোরম একটি পিপা ও একটি পেয়ালা। পিপা কাৎ করে দুটি পেয়ালা ভর্তি করেন পুরোহিত। একটি উম্মে আরারার হাতে ধরিয়ে দেন আর অপরটি রাখেন নিজের হাতে। ঠোঁটের সঙ্গে লাগিয়ে পেয়ালা খালি করে ফেলেন দুজনে।

‘দেবতা কখন আসবেন?’ জিজ্ঞেস করে উম্মে আরারা।

‘এখনও তুমি তাকে চিনতে পারনি? তোমার সামনে কে দাঁড়িয়ে আছেন?’ বললেন পুরোহিত।

পুরোহিতের পায়ে লুটিয়ে পড়ে উম্মে আরারা। বলে, ‘হ্যাঁ, এবার আমি দেবতাকে চিনতে পেরেছি। তুমি কি সে নও, যাকে আমি উপরে দেখেছিলাম? আমাকে তুমি কবুল করেছ?’

‘হ্যাঁ, আজ থেকে তুমি আমার দুলহান।’ বললেন পুরোহিত।

○             ○             ○

‘আমি আপনাকে আর কিছু জানাতে পারছি না। আমার আব্বা আমাকে বলেছিলেন, পুরোহিত মেয়েটিকে একটি ফুল শোকান, যার সৌরভ তাকে ভুলিয়ে দেয়, সে কে ছিল, কোথা থেকে এসেছে এবং কিভাবে তাকে এখানে আনা হয়েছে। স্বেচ্ছায় সে পুরোহিতের দাসীতে পরিণত হয়ে যায়। জগতের যত্তোসব বিশ্রী বস্তু সুশ্রী হয়ে দেখা দেয় তার চোখের সামনে। পুরোহিত তাকে পাতাল কক্ষে নিজের সঙ্গে রাখেন তিন রাত।’

খলীফার নিরাপত্তা বাহিনী থেকে নিয়ে আসা পাঁচ হাবশীর একজন আলী বিন সুফিয়ানের সামনে ব্যক্ত করছিল উপরোক্ত তথ্যগুলো। যে গোত্রের চার সিপাহী উম্মে আরারাকে অপহরণ করেছিল, এই পাঁচজনও সে গোত্রের লোক। যেহেতু অল্প কদিন পর তাদের মেলা বসছে আর এরা পাঁচজন সে মেলায় অংশ নেওয়ার উদ্দেশ্যে ছুটিতে যাচ্ছে, তাই আলী বিন সুফিয়ান ধরে নিলেন, হেরেমের মেয়ে অপহরণের বিষয়টি তাদের জানা থাকতে পারে। সেমতে খলীফার নিরাপত্তা বাহিনী থেকে সঙ্গে করে নিয়ে এসে আলী বিন সুফিয়ান এদের জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেন। প্রথমে পাঁচজনই বলে, তারা এ ব্যাপারে কিছুই জানে না। আলী বিন সুফিয়ান তাদের আশ্বস্ত করেন, সত্য কথা বললে তাদের কোন শাস্তি দেওয়া হবে না। তবু তারা অজ্ঞতার কথাই প্রকাশ করতে থাকে। হায়েনা চরিত্র আর রক্ত-পিয়াসী বলে প্রসিদ্ধ এ গোত্রটি। সাজা-শাস্তির ভয়-ডর নেই তাদের মনে। আলী বিন সুফিয়ানের ধৃত পাঁচজনও বেশ সাহসিকতার সঙ্গে অস্বীকার করে চলে। অগত্যা আলী বিন সুফিয়ান ঐসব পদ্ধতি প্রয়োগ করতে বাধ্য হন, যা পাথরকেও মোমের মত গলিয়ে দেয়।

আলী বিন সুফিয়ান আলাদা আলাদাভাবে পঁচজনকে এমন স্থানে নিয়ে যান, যেখানকার আত্মচীৎকার বাইরের কেউ শুনতে পায় না। বিরামহীন অত্যাচার-নির্যাতনে কোন আসামী মরে গেলেও জানতে পারে না কেউ।

এই পাঁচ সুদানী বড় কঠিন-হৃদয়ের মানুষ বলে মনে হল আলী বিন সুফিয়ানের কাছে। তারা রাতভর কঠোর নির্যাতন সইতে থাকে। আর আলী বিন সুফিয়ানও রাত জেগে তাদের মুখ খোলানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু কোন স্বীকারোক্তি আদায় করা যাচ্ছে না তাদের মুখ থেকে। অবশেষে সর্বশেষ কঠোর পন্থাটি অবলম্বন করলেন আলী।

কঠোর নির্যাতনের মুখে শেষ রাতে মধ্য বয়সী এক হাবশী আলী বিন সুফিয়ানকে বলে— ‘আমি সবকিছু জানি। কিন্তু বলছি না দেবতার ভয়ে। বললে দেবতা আমাকে নির্মমভাবে মেরে ফেলবে।’

‘এর চেয়ে নির্দয় শাস্তি আর কী হতে পারে, যা আমি তোমাদের দিচ্ছি? তোমার দেবতা যদি সত্য হয়ে থাকে, তাহলে তোমাকে এই নির্যাতনের যাঁতাকল থেকে বের করিয়ে নেয় না কেন? মৃত্যুকেই যদি তোমরা ভয় করে থাক, তাহলে মৃত্যু এখানেও আছে। তোমরা কথা বল। আমার হাতে এমন দেবতা আছে, যিনি তোমাদেরকে তোমাদের দেবতার কবল থেকে রক্ষা করবেন।’ বললেন আলী বিন সুফিয়ান।

আলী বিন সুফিয়ানের কঠোর শাস্তির মুখে বেশ কবার জ্ঞান হারিয়ে ফেলে লোকটি। দেবতা নয়— বার বার মৃত্যু এসে চোখের সামনে হাজির হয় তার। আলী বিন সুফিয়ান তার মুখ খোলাতে সক্ষম হন। প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করে নির্যাতন থেকে মুক্তি দিয়ে পানাহার করিয়ে আরামে শুইয়ে দেন তাকে।

সে স্বীকার করে, উম্মে আরারাকে তারই গোত্রের চার ব্যক্তি অপহরণ করে নিয়ে গেছে। তারা খলীফার নিরাপত্তা বাহিনীর সিপাহী। তারা আগেই ছুটিতে গিয়েছিল। পরিকল্পনা সম্পন্ন করে যাওয়ার সময় আমাদের অপহরণের রাত-ক্ষণ বলে গিয়েছিল। সে রাতে পাহারায় ডিউটি ছিল আমাদের পাঁচজনের। প্রধান ফটক দিয়ে তাদের দুজনকে ভেতরে ঢুকতে দেওয়ার সুযোগ আমরাই করে দিয়েছিলাম। আমরা তাদের অপহরণ ও পলায়নে সার্বিক সহযোগিতা দিয়েছি।

হাবশী জানায়, ‘মেয়েটিকে দেবতার বেদীতে বলী দেওয়া হবে। প্রতি তিন বছর পর পর আমাদের গোত্রে চারদিন ব্যাপী একটি উৎসব মেলা অনুষ্ঠিত হয়। এই মেলার শেষ দিন মেয়েটির বলীপর্ব সম্পন্ন হওয়ার কথা। আমাদের নিয়ম, বলীর মেয়ে ভিনদেশী, শ্বেতাঙ্গী, উচ্চ বংশের এবং চোখ ধাঁধানো রূপসী হতে হয়।’

‘তার মানে প্রতি তিন বছর পর পর তোমার গোত্র বাইরে থেকে একটি করে রূপসী মেয়ে অপহরণ করে নিয়ে আসে।’ বললেন আলী বিন সুফিয়ান।

‘না, এটা ভুল প্রচারণা। তিন বছর পর পর মেলা বসে। আর মেয়ে বলী হয় প্রতি পাঁচ মেলার পর। তবে মানুষ এটাই জানে যে, প্রতি তিন বছর পর মেয়ে বলী হয়।’ জবাব দেয় হাবশী।

কোন্ স্থানে মেয়ে বলী হয়, হাবশী তাও জানায়। যে জায়গায় মেলা বসে, তার থেকে এক-দেড় মাইল দূরে একটি পাহাড়ী এলাকা। এ এলাকায় দেবতারা বাস করে বলে জনশ্রুতি আছে এবং তাদের সেবার জন্য নিয়োজিত আছে অসংখ্য জিন-পরী। এ এলাকায় ফেরআউনী আমলের একটি জীর্ণ প্রাসাদ আছে। আছে একটি ঝিল, যাতে বাস করে ছোট-বড় অনেক কুমীর।

গোত্রের কেউ গুরুতর অপরাধ করলে তাকে পুরোহিতের হাতে তুলে দেওয়া হয়। পুরোহিত তাকে জীবন্ত ঝিলে নিক্ষেপ করেন। কুমীররা অপরাধীকে খেয়ে ফেলে।

সেই প্রাসাদেই বাস করেন পুরোহিত। প্রাসাদের এক স্থানে পাথর-নির্মিত বৃহদাকার একটি মুখ ও মাথা আছে। এরই অভ্যন্তরে বাস করেন দেবতা। প্রতি পনের বছরের শেষ দিনগুলিতে বাইরে থেকে একটি মেয়ে অপহরণ করে এনে তুলে দেওয়া হয় পুরোহিতের হাতে। পুরোহিত মেয়েটিকে একটি ফুল শোকান। সেই ফুলের সৌরভে বিমোহিত হয়ে মেয়েটি ভুলে যায় সে কে ছিল, কোথা থেকে এসেছে এবং তাকে কে এনেছে। ফুলের সাথে এক প্রকার নেশাকর ঘ্রাণ। মিশিয়ে দেওয়া হয়, যার প্রভাবে মেয়েটি পুরোহিতকে দেবতা এবং নিজের স্বামী ভাবতে শুরু করে। ওখানকার পুঁতিগন্ধময় বস্তুও তার চোখে আকর্ষণীয় বলে মনে হয়।

পনের বছর পূর্ণ হওয়ার পথে। এই অল্প কদিন পরই মেয়েটিকে বলী দেওয়া হবে। আমরা নয়জন লোক মিসরের ফৌজে ভর্তি হয়েছিলাম। নির্ভীক এবং জংলী হওয়ার কারণে আমাদেরকে খলীফার নিরাপত্তা কর্মী হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। দুমাস আগে হেরেমের এই মেয়েটি আমাদের চোখে পড়ে। আমরা এমন রূপসী নারী জীবনে কখনও দেখিনি। আমরা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি, একেই অপহরণ করে নিয়ে এবার বলীর জন্য পুরোহিতের হাতে তুলে দেব। আমাদের এক সঙ্গী— যে গতকাল সান্ত্রীর হাতে মারা গেল— এলাকায় গিয়ে গোত্রের মোড়লকে বলে এসেছিল, এবার বলীর জন্য আমরা মেয়ে এনে দেব। মেয়েটিকে আমরাই অপহরণ করে নিয়ে গেছি।’ বলল হাবশী।

○             ○             ○

রিপোর্ট শুনে ভাবনার সমুদ্রে ডুবে যান সালাহুদ্দীন আইউবী। আলী বিন সুফিয়ান তার নির্দেশের অপেক্ষায় দণ্ডায়মান। সুলতান সালাহুদ্দীন ম্যাপ দেখলেন। বললেন— ‘জায়গা যদি এটিই হয়, তাহলে স্থান তো আমাদের নাগালের বাইরে। শহরের প্রবীণ লোকদের নিকট থেকে তুমি যে তথ্য নিয়েছ, তাতে প্রমাণিত হয়, ফেরআউনের পতনের পর শত শত বছর অতিবাহিত হলেও ফেরআউনী কালচার এখনও বহাল আছে। মুসলমান হিসেবে আমাদের কর্তব্য, বেশী দূরে যেতে না পারলেও এই নিকট প্রতিবেশী সমাজ থেকে অন্তত কুফর-শিরকের অবসান ঘটাতে হবে। কি জানি, এ পর্যন্ত কত বাবা-মায়ের নিষ্পাপ কন্যা ওদের হাতে বলীর শিকার হয়েছে! কত মেয়ে অপহৃতা হয়ে বিক্রি হয়েছে এ মেলায়! দেবতার বিশ্বাসেরই মূলোৎপাটন করতে হবে। দেবতার নাম ভাঙ্গিয়ে মেয়ে অপহরণ করিয়ে অপকর্ম আর আমোদ-ফুর্তিতে মেতে ওঠে তথাকথিত ধর্মগুরুরা। এই বর্বরতার অবসান ঘটাতে হবে।

গুপ্তচর মারফত আমি জানতে পেরেছি, আমাদের ফৌজের কয়েকজন কমাণ্ডার এবং মিসরের কিছুসংখ্যক ধনাঢ্য ব্যক্তি এ মেলায় অংশ নেয় এবং মেয়ে ক্রয় করে কিংবা নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য মেয়েদের ভাড়া আনে। বরখাস্তকৃত সুদানী সৈন্যদের বিপুল সংখ্যক লোকও এ মেলায় অংশ নিয়ে থাকে। কাজেই আমি মনে করি, আমাদের ফৌজ এবং বেসামরিক লোকদের ও প্রাক্তন সুদানী ফৌজদের সঙ্গে একত্রিত হওয়া ও একত্রে উৎসব করা ঠিক নয়। এ যৌথ বিনোদন জাতির জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর প্রমাণিত হতে পারে। আর বলীর শিকার হওয়ার আগে আগেই মেয়েটিকে উদ্ধার করে খলীফার সামনে এজন্যে পেশ করা প্রয়োজন, যাতে প্রমাণিত হয় যে, খলীফা আপনার উপর অপহরণের যে অপবাদ দিয়েছেন, তা কত ভিত্তিহীন।’ বললেন আলী বিন সুফিয়ান।

‘আমার এর বিন্দুমাত্র পরোয়া নেই আলী! আমার দৃষ্টি আমার ব্যক্তিসত্ত্বার উপর নয়। আমাকে যে যত তুচ্ছই ভাবুক, আমি ইসলামের মর্যাদা ও সমুন্নতির কথা ভুলতে পারি না। আমি নিজে কি আর ছাই! কথাটা তুমি মনে রেখো আলী! নিজের ব্যক্তিসত্ত্বা থেকে দৃষ্টি সরিয়ে সালতানাতের কর্তৃত্ব রক্ষা, দেশের উন্নতি ও ইসলামের প্রসার-প্রতিষ্ঠার কাজে নিজেকে কোরবান করে দাও। ইসলামের মর্যাদা রক্ষা করার দায়িত্ব ছিল খলীফার। কিন্তু কালক্রমে খলীফা এখন হয়ে পড়েছেন আত্মকেন্দ্রিক, প্রবৃত্তির দাস। আজ আমাদের খেলাফত ফোক্‌লা ও দুর্বল। আমাদের এই দুর্বলতাকে কাজে লাগাচ্ছে খৃষ্টানরা। সফলতার সঙ্গে যদি তুমি নিজের কর্তব্য পালন করতে চাও, তাহলে আত্মকেন্দ্রীকতা পরিহার করে চলতে হবে। খলীফা আমার প্রতি যে অপবাদ আরোপ করেছেন, বড় কষ্টে আমি তা বরদাশত করেছি। ইচ্ছে করলে আমি এর উপযুক্ত জবাব দিতে পারতাম। কিন্তু তখন আমি ব্যক্তিকেন্দ্রিক রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়তাম। আমার তো আশঙ্কা হচ্ছে, ক’দিন পর আমার আশপাশের লোকেরাই ব্যক্তিকেন্দ্রিক রাজনীতি, আত্মপ্রিয়তা ও ক্ষমতার মোহে আচ্ছন্ন হয়ে পড়বে।’ বললেন সুলতান সালাহুদ্দীন।

‘গোস্তাখীর জন্য ক্ষমা চাই, মোহতারাম আমীর! বলী হওয়ার আগেই যদি আপনি মেয়েটিকে উদ্ধার করাতে চান, তাহলে আদেশ করুন। সময় বেশী নেই। পরশু থেকে মেলা শুরু হচ্ছে।’ বললেন আলী বিন সুফিয়ান।

সেনাবাহিনীতে ফরমান জারি করে দিন, এ মেলায় কারও অংশ নেওয়ার অনুমতি নেই। বলেই নায়েব সালারকে ডেকে সুলতান বললেন— ‘এ নির্দেশ যে অমান্য করবে, পদমর্যাদা যাই হোক, তাকে জনসমক্ষে পঞ্চাশ বেত্রাঘাত করা হবে। এক্ষুনি এ নির্দেশ সেনাবাহিনীকে জানিয়ে দিন।’

পরিকল্পনা শুরু হয়ে যায়। সুলতান সালাহুদ্দীন সংশ্লিষ্ট অফিসারদের ডেকে পাঠান। ঘোষণা দেন, এই জঘন্য কুসংস্কারের আড্ডা আমাদের ভাজতে হবে। স্থানটি ফেরআউনী কালচারের শেষ নিদর্শন বলে মনে হয়। সরাসরি সেনা অভিযানের প্রস্তাব আসে। কিন্তু সে প্রস্তাব এই বলে প্রত্যাখ্যান করা হয় যে, একে গোত্রের মানুষ সরাসরি আক্রমণ মনে করবে। সংঘর্ষ বাধবে। মেলায় অংশ নেওয়া নিরীহ মানুষ ও নারী-শিশু মারা যাবে। স্বীকারোক্তি প্রদানকারী সুদানী হাবশীকে রাহবার হিসেবে সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার এবং যে স্থানে মেয়ে বলী দেওয়া হয়, সেখানে অতর্কিতে কমাণ্ডে আক্রমণ পরিচালনার প্রস্তাব আসে। সুলতান সালাহুদ্দীন হাবশীকে নিয়ে যাওয়া ভাল মনে করলেন না। তিনি তাকে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না।

সুলতান সালাহুদ্দীনের নির্দেশে আগেই একটি দুর্ধর্ষ কমাণ্ডে বাহিনী গঠন করে রাখা হয়েছিল। দীর্ঘদিন যাবত প্রশিক্ষণ দিয়ে অভিজ্ঞরূপে গড়ে তোলা হয়েছে। তাদের। একটি সুইসাইড স্কোয়াডও আছে তাদের সঙ্গে। ঈমানদীপ্ত এই স্কোয়াড এততাই চেতনা-সমৃদ্ধ যে, কোন অভিযান থেকে জীবিত ফিরে না আসতে পারাকে তারা গৌরবের বিষয় মনে করে।

নায়েব সালার আন-নাসের ও আলী বিন সুফিয়ানের পরামর্শে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, যে স্থানে পুরোহিত বাস করেন এবং মেয়ে বলী হয়, সেই দুর্গম পাহাড়ী এলাকায় মাত্র বারজন কমাণ্ডো সেনা ঢুকে পড়বে। হাবশীর দেওয়া তথ্য মোতাবেক বলীর রাতে মেলা বেশ জমে ওঠে। কারণ, এটি মেলার শেষ দিন। গোত্রের লোকদের ছাড়া মেয়ে বলির ঘটনা আর কেউ জানে না। জানলেও এই বলি কোথায় হয়, বলতে পারে না কেউ।

এসব তথ্যের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হল, পাঁচশত মিসরী সৈন্য অস্ত্র-সজ্জিত হয়ে দর্শক হিসেবে এদিন মেলায় ঢুকে পড়বে। তাদের দুশ জনের কাছে থাকবে তীর-ধনুক। সে যুগে সঙ্গে এসব অস্ত্র রাখা ছিল স্বাভাবিক ব্যাপার। এসবের উপর কোন পাবন্দি ছিল না। কমাণ্ডো সদস্যদের বলির স্থানটি স্পষ্টরূপে চিহ্নিত করে দেওয়া হবে। তারা সরাসরি আক্রমণ করবে না। তারা কমাণ্ডো স্টাইলে পাহাড়ে ঢুকে পড়বে। অতর্কিতে প্রহরীদের হত্যা করে পৌঁছে যাবে আসল জায়গায়। মেয়েটিকে যখন বলির জন্য বেদীতে নিয়ে আসা হবে, হামলা করবে তখন। অন্যথায় তারা আক্রান্ত হয়ে মেয়েটিকে পাতাল কক্ষে গুম কিংবা খুন করে ফেলতে পারে।

তথ্য পাওয়া গেছে, মধ্যরাতের পূর্ণ চন্দ্রালোকে বলীপর্ব সম্পন্ন করা হয়। পাঁচশত সিপাহীকে এ সময়ের পূর্বে বলীর স্থান সংলগ্ন পাহাড়ের আশে-পাশে পৌঁছে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। তাদের জানিয়ে দেওয়া হয়, কমাণ্ডো সেনারা যদি প্রতিপক্ষের ঘেরাওয়ে পড়ে যায় কিংবা অভিযান ব্যর্থ হয়ে পড়ে, তাহলে তারা একটি সলিতাওয়ালা অগ্নিতীর উপর দিকে নিক্ষেপ করবে। এ তীরের শিখা দেখে তারা হামলা চালাবে।

নির্বাচন করে নেওয়া হয় চারজন জানবাজ। দু বছর আগে নুরুদ্দীন জঙ্গী সুলতান সালাহুদ্দীনের সাহাযার্থে যে বাহিনী প্রেরণ করেছিলেন, তাদের থেকে নেওয়া হয় বাছা বাছা পাঁচশত সৈন্য। এরা এসেছিল আরব থেকে। এদের উপর মিসর ও সুদানের রাজনীতি এবং তাদের ভ্রান্ত আকীদা-বিশ্বাসের কোন প্রভাব ছিল না। ইসলাম পরিপন্থী আকীদার বিরুদ্ধে ছিল তারা উচ্চকণ্ঠ। কুসংস্কার নির্মূলে ছিল তারা বদ্ধপরিকর। তাদেরকে ধারণা দেওয়া হয়, তারা এক ভ্রান্ত বিশ্বাসের বিরুদ্ধে লড়াই করতে যাচ্ছে এবং নিজেদের তুলনায় অধিক সৈন্যের মোকাবেলা করতে হতে পারে। লড়াই হতে পারে রক্তক্ষয়ী। আবার এমনও হতে পারে যে, তাদের সামনে দাঁড়াতেই পারবে না কেউ, যুদ্ধ ছাড়াই অভিযান সফল হয়ে যাবে। তাদেরকে পরিকল্পনা বুঝিয়ে দেওয়া হয়। সেখানকার পরিবেশ-পরিস্থিতি সম্পর্কে সম্যক ধারণা দেওয়া হয়। পাহাড়ে আরোহণ, মরুভূমিতে দৌড়ানো এবং উটের মত দীর্ঘ সময় পিপাসায় অতিবাহিত করেও অকাতর লড়াই চালিয়ে যাওয়ার প্রশিক্ষণ আছে তাদের পূর্ব থেকেই।

বলীর রাত আসতে আর ছয় দিন বাকী। কমাণ্ডো বাহিনী ও পাঁচশত সৈন্যকে মহড়া দেওয়া হয় তিনদিন তিনরাত। চতুর্থ দিন কমাণ্ডোদের উটে চড়িয়ে রওনা করানো হয়। উটের মধ্যম গতিতে গন্তব্যে পৌঁছতে সময় লাগবে একদিন একরাত। উট চালকদের নির্দেশ দেওয়া হয়, তারা কমাণ্ডোদের পাহাড়ী অঞ্চল থেকে দূরে কোথাও নামিয়ে দিয়ে ফিরে আসবে।

পাঁচশত সৈন্যের বাহিনীটি মেলার দর্শক বেশে দুজন দুজন চারজন চারজন করে লরি ও উটে চড়ে মেলার দিকে রওনা হয়। তাদের কমাণ্ডারও একই বেশে তাদের সঙ্গে রওনা হয়েছে। তাদের পশুগুলো থাকবে তাদের সঙ্গে।

○             ○             ○

মেলার শেষ রাত।

আকাশের ঝলমলে চাঁদ পূর্ণতা লাভ করতে আর অল্প বাকি। স্বচ্ছ কাঁচের মত পরিষ্কার মরুর পরিবেশ। মেলায় বিপুল দর্শকের ভীড়। পিনপতনের স্থান নেই যেন কোথাও। একধারে অর্ধনগ্ন মেয়েরা নাচছে-গাইছে। সুন্দরী মেয়েদের দেদারছে বেচা-কেনা চলছে এক জায়গায়। বেশী ভীড় সেখানেই। একটি মঞ্চ পাতা আছে সেখানে। একটি করে মেয়ে আনা হয় মঞ্চে। চারদিক থেকে খুটিয়ে খুটিয়ে দেখে ক্রেতা। মুখ হা করিয়ে দাঁত দেখে। নেড়ে চেড়ে দেখে মাথার চুল। দেহের কোমলতা-কঠোরতাও পরখ করা হয়। তারপর শুরু হয় দর-দাম নিয়ে আলোচনা। অবশেষে বেচা-কেনা। জুয়ার আসরও আছে মেলায়। আছে মদের আড়া। মেলার চার ধারে বহিরাগত দর্শকদের থাকার আয়োজন।

উৎসবে যোগদানকারী লোকদের ধর্ম ও চরিত্রের কোন বালাই নেই। আদর্শিক অনুশাসন থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত তারা। মেলাঙ্গন থেকে খানিক দূরের পাহাড়ী অঞ্চলের কোন এক নিভৃত ভূখণ্ডে যে সুন্দরী নারী বলির আয়োজন চলছে, তাদের তা অজানা। একজন মানুষ যে সেখানে দেবতা হয়ে বসে আছে, তাও তারা জানে না। তারা শুধু এতটুকুই জানে, পাহাড়-বেষ্টিত এ এলাকাটি তাদের দেবতাদের আবাস। জিন-ভূত পাহারা দেয় তাদের। সেখানে যাওয়ার কল্পনাও করতে পারে না কোন মানুষ।

তাদের এও জানা নেই যে, আল্লাহ্‌র পাঁচশত সৈনিক তাদের মাঝে ঘুরে বেড়াচ্ছে এবং বারজন রক্ত-মাংসের মানুষ তাদের দেবতাদের রাজত্বের সীমানায় ঢুকে পড়েছে। পাহাড়ের অভ্যন্তরে কিভাবে প্রবেশ করতে হবে, সালাহুদ্দীন আইউবীর চার জানবাজকে আগেই তা বলে দেওয়া হয়েছিল। কঠোর পাহারার কারণে তারা সে পথে ঢুকতে পারেনি। অন্য এক দুর্গম পথ দিয়ে ঢুকতে হয়েছে তাদের। তাদের বলা হয়েছিল, পাহাড়ের আশেপাশে কোন মানুষ থাকবে না। কিন্তু এসে তারা দেখতে পায়, মানুষ আছে। তার মানে ধৃত হাবশীর দেওয়া তথ্য ভুল। পাহাড়টি দৈর্ঘ্য-প্রস্থে এক বর্গমাইলের বেশী নয়। অতি সাবধানে বিক্ষিপ্তভাবে এগিয়ে যায় তারা।

হঠাৎ একটি গাছের তলায় স্পন্দনশীল একটি ছায়ামূর্তি চোখে পড়ে এক কমাণ্ডোর। সঙ্গে সঙ্গে হাটু গেড়ে বসে পড়ে সে। অতি সন্তর্পণে হামাগুড়ি দিয়ে পিছনে চলে যায় ছায়াটির। নিকটে গিয়েই ঝাঁপিয়ে পড়ে তার উপর। দু বাহু দ্বারা ঘাড় ঝাঁপটে খঞ্জরের আগা ঠেকিয়ে ধরে তার বুকে। জিজ্ঞেস করে, ‘বল, এখানে কি করছিস্ তুই? আর কে আছে তোর সাথে?’

ছায়া মূর্তিটি একজন হাবশী লোক। কমাণ্ডো কথা বলছে আরবীতে। হাবশী আরবী বুঝে না। এমন সময়ে এসে পড়ে আরেক কমাণ্ডো। সেও খঞ্জর তাক করে ধরে হাবশীর বুকে। ইঙ্গিতে প্রশ্ন করে তারা হাবশীকে। হাবশীও ইঙ্গিতে জবাব দেয়। তার জবাবে সন্দেহ হয়, এখানে কঠোর পাহারা আছে। দুই কমাণ্ডো ধমনি কেটে দেয় হাবশীর। মাটিতে পড়ে যায় সে। আরও সতর্কতার সাথে সম্মুখে এগিয়ে চলে তারা। গহীন জঙ্গল। সামনে একটি পাহাড়। চাঁদ উঠে এসেছে আরও উপরে। ঘন পাহাড়ের ভেতরটা গাছ-গাছালিতে ঘোর অন্ধকার। তারা পাহাড় বেয়ে উপরে উঠতে শুরু করে।

পাহাড়ের অভ্যন্তরে— যেস্থানে মেয়েটিকে পুরোহিতের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে— চলছে আরেক তৎপরতা। পাথরের মুখের সামনে চবুতরায় একটি জাজিম বিছানো। তার উপর বিশাল এক কৃপাণ। নিকটেই বড় একটি পেয়ালা। জাজিমে ছড়িয়ে আছে কতগুলো ফুল। পার্শ্বে একস্থানে আগুন জ্বলছে। চবুতরার চারদিকে জ্বলছে কতগুলো প্রদীপ। ঘোরাফেরা করছে চারটি মেয়ে। পরণে তাদের দুটি করে গাছের চওড়া পাতা। বাকি শরীর নগ্ন। আছে চারজন হাবশী। কাঁধ থেকে পায়ের গোড়ালী পর্যন্ত তাদের সাদা চাদর দিয়ে আবৃত।

উম্মে আরারা পাতাল কক্ষে পুরাহিতের সঙ্গে উপবিষ্ট। তার এলচুলে বিলি কেটে খেলছেন পুরোহিত। মেয়েটি আচ্ছন্ন কণ্ঠে বলছে— ‘আমি আঙ্গুকের মা। তুমি আঙ্গুকের পিতা। আমার সন্তানরা মিসর ও সুদানের রাজা হবে। তাদেরকে আমার রক্ত পান করিয়ে দাও। আমার লম্বা লম্বা সোনালী চুলগুলো তাদের ঘরে রেখে দাও। তুমি আমার থেকে দূরে সরে গেলে কেন? এস, আমার কাছে এস।’

পুরোহিত তেলের মত একটি পদার্থ মালিশ করতে শুরু করে উম্মে আরারার গায়ে।

‘আঙ্গুক’ এ গোত্রটির নাম। মদের নেশা একটি আরব মেয়েকে এই গোত্রের মা বানিয়ে দিয়েছে। বলীর জন্য প্রস্তুত হয়ে আছে সে। পুরোহিত সম্পন্ন করছে তার নিয়ম-নীতির শেষ পর্ব।

পদে পদে হোঁচট-ধাক্কা খেতে খেতে চড়াই বেয়ে উপরে উঠছে বারজন কমাণ্ডো সৈন্য। দুর্গম পথ অতিক্রম করতে হচ্ছে তাদের। পাহাড়ের বেশীর ভাগ ঝোঁপ-ঝাড়, কাঁটাল। আকাশের পূর্ণ চাঁদ এখন মাথার উপর। আস্তে আস্তে গাছ-গাছালির ফাঁক দিয়ে চাঁদের আলোকরশ্মি চোখে পড়তে শুরু করে। সেই কিরণে তারা একস্থানে একজন হাবশীকে দাঁড়িয়ে আছে দেখতে পায়। তার এক হাতে একটি বর্শা। অপর হাতে ঢাল। লোকটি দেব-জগতের পাহারাদার। নীরবে মেরে ফেলতে হবে তাকেও। কিন্তু লোকটি যেখানে দাঁড়িয়ে আছে, সেখানে পিছন দিক থেকে হামলা করার সুযোগ নেই। সামনাসামনি মোকাবেলা করাও ঠিক হবে না। তাই ঝোঁপের মধ্যে নীরবে বসে পড়ে এক কমাণ্ডো। লোকটির ঠিক সম্মুখে একটি পাথর ছুঁড়ে মারে আরেকজন। চমকে ওঠে হাবশী। পাথরটি কোত্থেকে এল দেখার জন্য এগিয়ে আসে এদিকে। ঝোঁপের মধ্যে লুকিয়ে থাকা কমাণ্ডোর ঠিক সামনে এসে পৌঁছামাত্র ঘাড়টা তার এসে পড়ে কমাণ্ডোর দু বাহুর মাঝে। সঙ্গে সঙ্গে একটি খঞ্জর বিদ্ধ হয় তার বুকে। প্রহরীকে খুন করে বারজনের কমাণ্ডো বাহিনী খানিকটা বিলম্ব করে সেখানে। পরক্ষণেই এগিয়ে যায় অতি সাবধানে। পা টিপে টিপে অগ্রসর হয় সামনের দিকে।

বলীর জন্য প্রস্তুত হয়ে আছে উম্মে আরারা। তাকে শেষবারের মত বুকে জড়িয়ে ধরেন পুরোহিত। হাতে ধরে সিঁড়ি বেয়ে হাঁটা দেন তিনি। বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা চার হাবশী পুরুষ ও মেয়েরা পাথরের মুখ ও মস্তকে আলোর ঝলক দেখতে পায়। মুখের সামনে সেজদায় লুটিয়ে পড়ে তারা। মুখে কি এক মন্ত্র পাঠ করতে করতে পাথরের মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসেন পুরোহিত। উম্মে আরারা তার সঙ্গে।

উম্মে আরারাকে জাজিমের উপর নিয়ে যান পুরোহিত। হাবশী পুরুষ ও মেয়েরা দাঁড়িয়ে আছে তার চারদিকে। উম্মে আরারা আরবীতে বলে— ‘আমি আঙ্গুকের ছেলে ও মেয়েদের জন্য গলা কাটাচ্ছি। আমি তাদের পাপের প্রায়শ্চিত্ত্ব করছি। আর বিলম্ব না করে এবার আমার গলা কেটে দাও। আমার মাথাটা রেখে দাও আঙ্গুকের দেবতার পায়ে। এই মাথার উপর মিসর ও সুদানের মুকুট রাখবেন দেবতা।’

চার হাবশী পুরুষ ও মেয়েরা সেজদায় লুটিয়ে পড়ে পুনর্বার। উম্মে আরারাকে জাজিমের উপর আসন গেড়ে বসিয়ে মাথাটা নত করে দেন পুরোহিত। ঘাড় বরাবর সুতীক্ষ্ম ধারাল কৃপাণ উত্তোলন করেন তিনি।

সকলের সামনে হাঁটছে যে কমাণ্ডো, থেমে যায় সে। হাতের ইশারায় থামতে বলে পিছনের সঙ্গীদের। পাহাড়ের চূড়া থেকে চবুতরা ও পাথরের মাথা দেখতে পায় তারা। চবুতরার উপরে নতমুখে আসন গেড়ে বসে আছে একটি মেয়ে। ধবধবে জোৎস্নালোক। বেশ কটি প্রদীপ ও বড় বড় মশালের আলোয় দিবালোকের ন্যায় উজ্জ্বল করে রেখেছে স্থানটা। মেয়েটির কাছে দণ্ডায়মান লোকটির হাতে কৃপাণ। মেয়েটি সম্পূর্ণ উলঙ্গ। তার দেহের রঙই বলছে, সে হাবশীদের গোত্রের মেয়ে নয়।

কমাণ্ডো সেনারা এখনও বেশ দূরে এবং পাহাড়ের চূড়ায় তাদের অবস্থান। সেখান থেকে তীর ছুঁড়লে ব্যর্থ হওয়ার আশঙ্কা প্রবল। আবার সেখান থেকে নীচে নেমে আসাও অসাধ্য। নীচের দিকে কোন ঢালু নেই। সামনে খাড়া দেওয়াল।

কমাণ্ডোরা বুঝে ফেলে মেয়েটিকে বলীর জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে। ধারাল তরবারীর আঘাত তার মস্তক দ্বি-খণ্ডিত করল বলে। হাতে সময় এতই কম যে, উড়ে গিয়ে বলীর স্থলে পৌঁছুতে না পারলে রক্ষা করা যাবে না তাকে। চূড়া থেকে নীচে তাকিয়ে তারা একটি ঝিল দেখতে পায়। এই সেই ঝিল, যেখানে বাস করে অসংখ্য কুমীর।

ডান দিকে খানিকটা ঢালু পথ। তাও প্রায় খাড়া দেওয়ালেরই মত। ঝোঁপ-জঙ্গল এবং গাছ-পালাও আছে এখানে। সেটি অবলম্বন করে একে অপরের হাত ধরে ঢালু বেয়ে নামতে শুরু করে তারা। পিছনের কমাণ্ডো হঠাৎ দেখতে পায়, সামনের চূড়ায় দাঁড়িয়ে আছে এক হাবশী। তার এক হাতে ঢাল, অপর হাতে বর্শা। নিক্ষেপের জন্য তীরের মত তাক করে রেখেছে বর্শাটি। কমাণ্ডোদের উপর চাঁদের আলো পড়ছে না। নিশ্চিত কিছু বুঝে উঠতে পারেনি হাবশী এখনও। ধনুকে তীর জুড়ে দেয় পিছনের কমাণ্ডো ছুটে যায় তীর। রাতের নিস্তব্ধতায় তীরের শাঁ শাঁ শব্দ কানে বাজে সকলের। হাবশীর ধমনিতে গিয়ে বিদ্ধ হয় তীরটি। মাটিতে পড়ে গিয়ে গড়িয়ে পড়তে শুরু করে সে। ঢালু বেয়ে নীচে নেমে আসে কমান্তোরা।

○             ○             ○