সন্ধ্যার পর।

আলী বিন সুফিয়ান, বাহাহুদ্দীন শাদ্দাদ এবং উপদেষ্টামণ্ডলীর নিকট থেকে দিনের রিপোর্ট শুনছেন সালাহুদ্দীন আইউবী। আলী বিন সুফিয়ান ছদ্মবেশে শহরময় গুপ্তচর ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। নামাযের পর ঘুরে ঘুরে তারা সর্বসাধারণের প্রতিক্রিয়া সংগ্রহ করে। আলী বিন সুফিয়ান সালাহুদ্দীনকে জানান, এমন কোন সংবাদ পাওয়া যায়নি যে, কেউ স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে বলেছে, আজ খুতবায় খলীফার নাম নেওয়া হয়নি। জনগণের মুখ থেকে কথা নেওয়ার জন্য এক গোয়েন্দা কয়েক স্থানে এমনও বলেছে, জামে মসজিদের খতীব আজ জুমার খুতবায় খলীফার নাম উচ্চারণ করেননি; কাজটা বোধ হয় তিনি ভাল করলেন না। প্রত্যুত্তরে অনেকে এমন ভাব প্রকাশ করেছে, যেন খুতবায় আজ খলীফার নাম উচ্চারণ করা হল কিনা, তা তারা বলতেই পারে না। যেন খলীফার নাম উল্লেখ করা না করা তাদের নিকট তেমন কোন ঘটনাই নয়। বেশ কজন মানুষ এমনও প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে, এতে কী আর আসে যায়! খলীফা আল্লাহ-রাসূল তো আর নন! এসব রিপোর্টে সুলতান সালাহুদ্দীন আশ্বস্ত হন যে, তাকে জনগণের যে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার আশঙ্কা দেখানো হয়েছিল, বাস্তবে কোথাও তার প্রতিফলন ঘটেনি।

সে বৈঠকেই সুলতান সালাহুদ্দীন নুরুদ্দীন জঙ্গীর নামে পয়গাম লিখেন। তাতে তিনি লিখেন— ‘জুমার খুতবা থেকে আমি খলীফার নাম তুলে দিয়েছি। জনসাধারণের পক্ষ থেকে অনুকূল প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেছে। আপনিও খুতবা থেকে কেন্দ্রীয় খেলাফতের আলোচনা তুলে দিন।’

এ মর্মে দীর্ঘ এক পত্র লিখে সুলতান সালাহুদ্দীন নির্দেশ জারি করেন, আগামীকাল সকাল সকাল দূতকে রওনা করাও। তারপর আলী বিন সুফিয়ানকে বললেন, ‘খলীফার মহলে গুপ্তচরদের আরও সতর্ক থাকতে বলুন। সেখানে সামান্যতম সন্দেহজনক আচরণ দেখা মাত্র যেন সঙ্গে সঙ্গে তারা আমাদেরকে অবহিত করে।’

○             ○             ○

সুলতান সালাহুদ্দীন রজবকে ভাল করেই জানতেন। তিনি জানতেন, রজব খলীফার আজ্ঞাবহ নায়েব সালার। তাই তিনি আলী বিন সুফিয়ানকে বললেন, ‘রজবের পিছনে একজন লোক সর্বক্ষণ ছায়ার মত লাগিয়ে রাখুন।’

রাতের বেলা। রজব মহলে নেই। সুলতান সালাহুদ্দীনকে হত্যা করার আয়োজন সম্পন্ন করতে বাইরে চলে গেছে সে। হাসান ইবনে সাব্বাহর হাশীশীদের সঙ্গে যোগসাজশ করে এ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করবে রজব।

আমোদে মেতে উঠেছেন খলীফা। প্রতিদিনকার ন্যায় আজও তিনি বহির্জগত সম্পর্কে উদাসীন। উম্মে আরারার যাদুময়ী রূপে—দেহে মাতোয়ারা তিনি। জুমার খুতবা থেকে নাম উঠে যাওয়ার সংবাদ এ যাবত কেউ তাকে দেয়নি। সালাহুদ্দীন আইউবীকে হত্যা করার প্রস্তুতি চলছে, সে আনন্দেই তিনি আত্মহারা।

তাড়াতাড়ি ঘুম পাড়ানোর জন্য উম্মে আরারাহ অতিরিক্ত মদ পান করায় তাকে। মদের সঙ্গে নিদ্রাজনক পাউডারও খাইয়ে দেয়। বৃদ্ধের জ্বালাতন থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্য সব সময় এ প্রক্রিয়া অবলম্বন করে থাকে উম্মে আরারাহ। বৃদ্ধকে শুইয়ে দিয়ে, বাতি নিভিয়ে কক্ষ থেকে বেরিয়ে যায় মেয়েটি। হাঁটা দেয় নিজের কক্ষের প্রতি। রাতে চুপিসারে এ কক্ষেই তার কাছে আসা-যাওয়া করে রজব।

উম্মে আরারাহ কক্ষে প্রবেশ করছে। তার এক পা কক্ষের ভিতরে, এক পা বাইরে। এমন সময় পিছন থেকে কে একজন একটি কম্বল ছুঁড়ে মারে তার গায়ে। মুখ থেকে তার একটি শব্দ বের হতে না হতেই দৌড়ে এসে লোকটি আরেকখণ্ড কাপড় দ্বারা বেঁধে ফেলে তার মুখ। মেয়েটিকে কাঁধে তুলে নিয়ে হাঁটা দেয় লোকটি।

তারা ছিল দুজন। মহলের আঁকা-বাঁকা গোপন পথ সবই যেন তাদের চেনা। অন্ধকার সিঁড়িতে নেমে পড়ে তারা। উপরে লম্বা রশি বেঁধে রেখেছিল আগেই। সেই রশি ধরে ধরে ঘোর অন্ধকারে চোরা পথ বেয়ে মেয়েটিকে কাঁধে করে নেমে পড়ে একজন। অপরজন হাঁটছে তার পিছনে। মহল থেকে নেমে অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে যায় দুটি লোক।

দূরে দাঁড়িয়ে আছে চারটি ঘোড়া। ঘোড়াগুলোর নিকটে সতর্ক বসে আছে আরও দুজন লোক। আঁধার চিরে সঙ্গীদের আসতে দেখে তারা। আরও দেখে, কাঁধে করে কম্বল পেঁচানো কি যেন নিয়ে আসছে একজন।

চারটি ঘোড়ায় চড়ে বসে চার সঙ্গী। একজন মেয়েটিকে কম্বল মোড়ানো অবস্থায়ই নিজের সামনে বসিয়ে দেয়। একজন বলে ঘোড়াগুলোকে এখনই দ্রুত ছুটানো যাবে না। ঘোড়ার পায়ের আওয়াজে প্রহরীরা সতর্ক হয়ে যাবে। ধীরে ধীরে এগুতে শুরু করে চারটি ঘোড়া। বেরিয়ে যায় শহর থেকে।

○             ○             ○

‘এটি সালাহুদ্দীন আইউবীরই কাজ।’

‘মিসরের গভর্নর ছাড়া এ দুঃসাহস আর কেউ দেখাতে পারে না।’

‘তিনি ছাড়া এ-কাজ আর করতেই বা পারে কে?’

উম্মে আরারাহ অপহরণের খবর ছড়িয়ে পড়ে রাজমহলে। সকলের মুখে একই কথা, সালাহুদ্দীন আইউবী ছাড়া আর কেউ এ-কাজ করাতে পারে না।

ফিরে এসেছে রজব। মহলের সর্বত্র তন্ন তন্ন করে খোঁজ নেয় সে। রক্ষী বাহিনীর সদস্যদের গালাগাল করছে কমাণ্ডারগণ। স্বয়ং কমাণ্ডারগণ সিপাহীদের ন্যায় থর্‌ থর্ করে কাঁপছে।

মহলের একটি মেয়ে অপহরণ মামুলী ঘটনা নয়। তাও আবার সেই মেয়ে, খলীফা যাকে মহলের হীরক মনে করেন।

মহলের পিছনের গোপন পথে একটি রশি ঝুলছে দেখা গেল। মাটিতে পায়ের ছাপ, যা একটু দূরে গিয়ে ঘোড়ার খুরের চিহ্নে মিলিয়ে গেছে। এতে প্রমাণ পাওয়া গেল, মেয়েটিকে রশি বেয়ে নীচে নামানো হয়েছে। কেউ কেউ এমন সন্দেহও ব্যক্ত করেছে যে, মেয়েটি হয়ত স্বেচ্ছায় কারও সঙ্গে বেরিয়ে গেছে। খলীফা উড়িয়ে দেন এ সংশয়। বলেন, ‘অসম্ভব, উম্মে আরারাহ স্বেচ্ছায় কারও হাত ধরে উধাও হতে পারে না। সে আমাকে প্রাণ দিয়ে ভালবাসত।’

‘এ সালাহুদ্দীন আইউবীর কাজ। কসরে খেলাফতের সকলের মুখে এই একই কথা, সালাহুদ্দীন ছাড়া এ কাজ করার সাহস আর কেউ করতে পারে না।’ খলীফার উদ্দেশে বলল রজব।

কথাটা রজবই সকলের কানে দিয়েছিল। উম্মে আরারার নিখোঁজ হওয়ার সংবাদ শোনামাত্র সে মহলময় ঘুরে ঘুরে প্রত্যেকের নিকট মেয়েটির ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করেছিল আর বলেছিল, ‘সুলতান সালাহুদ্দীনই এ-কাজ করেছে।’ রজবের উস্কানিতে মহলের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের নিয়ে সাধারণ কর্মচারীদের পর্যন্ত সকলে এই একই কথা আওড়াতে শুরু করে। আর যখন কথাটা খলীফার কানে দেওয়া হল, তখন তিনি একটুও ভাববার প্রয়োজনবোধ করলেন না, এ অভিযোগ ভিত্তিহীন হতে পারে। তাকে আগেই জানানো হয়েছিল, সুলতান সালাহুদ্দীন নারী-লোলুপ পুরুষ। তিনি মহলের মেয়েদের নিয়ে নিয়ে নষ্ট করছেন। তাই সঙ্গে সঙ্গে খলীফা দূতকে ডেকে পাঠান। দূত আসলে তাকে তিনি বললেন, ‘মিসরের গভর্নরের নিকট যাও। গিয়ে বল, যেন গোপনে তিনি মেয়েটিকে ফিরিয়ে দিয়ে যান। তাহলে আমি এর প্রতিশোধ নেব না।’

○             ○             ○

খলীফা আল-আজেদ যখন দূতকে এ পয়গাম প্রদান করছিলেন, ঠিক তখন কায়রো থেকে দশ মাইল দূরে তিনজন উষ্ট্রারোহী ধীরে ধীরে এগিয়ে চলছিল শহর অভিমুখে। এরা মিসরী ফৌজের টহলসেনা। তারা ডিউটি শেষ করে শহরে ফিরছিল। তাদের সম্মুখে মাটি ও পাথরের বিস্তীর্ণ পাহাড়ী অঞ্চল। তারা একটি উপত্যকা দিয়ে অতিক্রম করছিল।

হঠাৎ নারীকণ্ঠের এক আর্তচীৎকার ভেসে আসে তাদের কানে। সাথে পুরুষালী কণ্ঠও শুনতে পায়। তারা পরিষ্কার বুঝতে পারে, কোন এক হতভাগী নারীর উপর নির্যাতন চলছে। দাঁড়িয়ে যায় তারা। উটের পিঠ থেকে নীচে নামে একজন। একজন টিলার উপরে উঠে চীৎকার-ধ্বনির দিক অনুসরণ করে উত্তীর্ণ হয়ে নীরবে দাঁড়িয়ে যায়। দেখে, টিলার অপর প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে চারটি ঘোড়া। চারজন মানুষও আছে সেখানে। সকলে সুদানী হাবশী। দৌড়ে পালাবার চেষ্টা করছে অপরূপ এক যুবতী। এক হাবশী ধরে ফেলে তাকে। দু বাহু দিয়ে জড়িয়ে ধরে তুলে আনে মেয়েটিকে। সঙ্গীদের মধ্যখানে দাঁড় করিয়ে তার সামনে হাটু গেড়ে বসে পড়ে লোকটি। দু হাত নিজের বুকে চেপে ধরে বলে— ‘তুমি পবিত্র মেয়ে। অযথা নিজেকে কষ্টে ফেলে আমাদের গোনাহগার কর না। অন্যথায় দেবতাদের রোষানল আমাদের পুড়ে ছারখার করে দেবে কিংবা পাথরে পরিণত করবে।’

‘আমি মুসলিম! আমি তোমাদের দেবতাদের অভিসম্পাত করি। আমাকে ছেড়ে দাও। অন্যথায় আমি খলীফার কুকুর দিয়ে তোমাদের টুকরো টুকরো করাব।’ চীৎকার করে বলল মেয়েটি।

‘তোমার মালিকানা এখন খলীফার হাতে নয়। আকাশের বিজলী, সাপের বিষ আর সিংহের শক্তি যে দেবতার হাতে, তোমার মালিক এখন তিনি। তিনি তোমাকে পছন্দ করে ফেলেছেন। এখন যেই তোমাকে রক্ষা করার চেষ্টা করবে, মরুভূমির তপ্ত বালুকারাশি তাকেই ভস্ম করে ফেলবে।’ বলল একজন।

হাবশীদের একজন আরেকজনকে বলল— ‘আমি তোমাকে বলেছিলাম, এখানে থেমো না। কিন্তু তোমার কিনা বিশ্রাম নেওয়ার প্রয়োজন। ওকে বাঁধা অবস্থায় লাগাতার এগিয়ে চললে সন্ধ্যার আগে আগেই আমরা গন্তব্যে পৌঁছে যেতে পারতাম।’

‘কেন, ঘোড়াগুলো পরিশ্রান্ত হয়ে পড়েছে দেখতে পাচ্ছ না? তাছাড়া সারাটা রাত গেল আমরা এক তিল ঘুমুতে পারিনি। আমাদেরও তো একটু বিশ্রামের প্রয়োজন আছে। যাক, চল, একে আবার বেঁধে রওনা হই।’ বলল দ্বিতীয়জন।

উম্মে আরারাকে ঝাঁপটে ধরে রাখে একজন। হঠাৎ পিছন দিক থেকে একটি তীর এসে বিদ্ধ হয় তার পিঠে। উম্মে আরারাকে জড়িয়ে ধরা হাত শিথিল হয়ে আসে তার। ঝাঁপটা দিয়ে বন্ধন-মুক্ত হয়ে পালাতে উদ্ধত হয় মেয়েটি। সঙ্গে সঙ্গে আরেকজন ঝাঁপটে ধরে টেনে ঘোড়ার আড়ালে নিয়ে যায় তাকে। শাঁ করে ছুটে আসে আরেকটি তীর। বিদ্ধ হয় অপর একজনের ঘাড়ে। ছট্‌ফট্‌ করে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে সেও। উম্মে আরারাকে ঝাঁপটে ধরে রাখা লোকটি ঘোড়ার বাগ ধরে উম্মে আরারাহ এবং ঘোড়াটিকে নিয়ে নেমে পড়ে নিম্নভূমিতে। চার হাবশীর অপরজনও দৌড়ে নেমে পড়ে নীচে।

উষ্ট্রারোহী সাথীদের যে লোকটি টিলার উপরে উঠে দাঁড়িয়েছিল, সেই নিক্ষেপ করে তীর দুটি। সে জানায়, ‘দেবতার কথা শুনে প্রথমে আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু পরে যখন শুনলাম, মেয়েটি বলছে, আমি মুসলমান; তোমাদের দেবতাকে আমি অভিসম্পাত করি; তখন আমার ঈমান জেগে উঠে। মেয়েটি যখন খলীফার নাম উল্লেখ করে, তখন আমি বুঝলাম, এ তো হেরেমের মেয়ে। তা ছাড়া মেয়েটির পোশাক-পরিচ্ছদ ও গঠন-আকৃতিতে পরিষ্কার বুঝা গেল, এ কোন সাধারণ মেয়ে নয়। নিশ্চয় মেয়েটিকে অপহরণ করা হয়েছে এবং সুদান নিয়ে গিয়ে তাকে বিক্রি করে ফেলা হবে। সান্ত্রীর জানা ছিল, অল্প ক’দিন পর সুদানী হাবশীদের মেলা বসছে। সুন্দরী মেয়েদের বেচা-কেনা হয় সে মেলায়।

সুলতান সালাহুদ্দীন সেনাবাহিনীকে নির্দেশ দিয়ে রেখেছিলেন, যেন তারা নারীর ইজ্জতের হেফাজত করে। একজন নারীর সম্ভ্রম রক্ষা করতে প্রয়োজনে এক ডজন মানুষ হত্যা করার অনুমতিও দেওয়া ছিল তাদের। এ বিষয়গুলোকে সামনে রেখে সান্ত্রী সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, যে করে থোক মেয়েটিকে উদ্ধার করতেই হবে। দুটি তীর নিক্ষেপ করে দু হাবশীকে খুন করে ফেলে সে।

মেয়েটিকে নিয়ে পালিয়ে যায় দুই হাবশী। সান্ত্রীর তীরের আঘাতে নিহত দুজনের ঘোড়া দুটোও নিয়ে যায় তারা। ফেলে যায় শুধু দুটি লাশ।

সান্ত্রীদের সকলেই উষ্ট্রারোহী। একটি ঘোড়াও নেই তাদের কাছে। উটে চড়ে অশ্বারোহীদের ধাওয়া করা বৃথা। অগত্যা লাশ দুটো উটের পিঠে তুলে নিয়ে কায়রো অভিমুখে রওনা হয় তারা।

অপহৃতা মেয়েটি কে এবং লাশ দুটো কাদের, তা অনুমান করতে সক্ষম হয়েছিল সান্ত্রীরা। তাই হেরেমের একটি মেয়েকে কারা অপহরণ করল, তার প্রমাণের জন্য লাশ দুটো নিয়ে যাওয়া আবশ্যক মনে করে তারা।

○             ○             ○

কক্ষে অস্থিরচিত্তে পায়চারী করছেন সুলতান সালাহুদ্দীন। রাগে-ক্ষোভে আত্মনিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছেন যেন তিনি। তার নায়েব-উপদেষ্টাবৃন্দও কক্ষে উপস্থিত। নতমুখে বসে আছেন সবাই।

সুলতান সালাহুদ্দীন বরাবরই সহনশীল মানুষ। নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রেখেই কাজ করেন তিনি। তিনি কখনও আবেগপ্রবণ হন না। রাগের মাথায় কিছু বলেনও না, করেনও না। যত প্রতিকূল পরিস্থিতিরই শিকার হন না কেন, সর্বাবস্থায় ঠাণ্ডা মাথায় কাজ করাই তার অভ্যাস। প্রবল থেকে প্রবলতর রাগও তিনি হজম করে ফেলেন। এমন কঠিন পরিস্থিতিতেও ধৈর্যের পরীক্ষায় তিনি উত্তীর্ণ হয়েছেন, যে পরিস্থিতিতে প্রবল প্রতাপশালী যোদ্ধাও অস্ত্র সমর্পণ করতে বাধ্য হয়। শত্রুর বেষ্টনীতে অবরুদ্ধ হয়েও ঠাণ্ডা মাথায় তিনি লড়াই করেছেন। এমন কঠিন পরিস্থিতিতেও যুদ্ধ চালিয়ে গেছেন, যখন বাহিনীসহ তিনি শত্রুর হাতে অবরুদ্ধ, সাহস হারিয়ে ফেলেছে তার সৈন্যরা, খাবার নেই, পানি নেই। সৈন্যদের তুনীরে একটি তীরও নেই। তার বাহিনী অপেক্ষা করছে, কখন তিনি আত্মসমর্পণ করে তাদের এ কষ্ট থেকে মুক্তি দেবেন, তাদের জীবন রক্ষা করবেন। কিন্তু সুলতান সালাহুদ্দীন নিজের সাহস অটুট রেখে শুধু লড়াইই অব্যাহত রাখেননি, তার সৈন্যদের মধ্যেও নবজীবন সৃষ্টি করতে সমর্থ হয়েছিলেন।

কিন্তু আজ তিনি আত্মনিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছেন। রাগে-ক্ষোভে দু চোখ থেকে আগুন ঠিকরে পড়ছে যেন তার। চেহারায় ক্ষোভ ও যন্ত্রণার ছাপ। ফলে কথা বলার সাহস পাচ্ছে না কেউ। মাথা নুইয়ে কপালে হাত ঠেকিয়ে নীরবে বসে আছে সকলে।

‘এই আজই আমি প্রথমবার আত্মনিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেললাম।’ পায়চারী করতে করতে বললেন সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী।

‘খলীফার এ ‘পয়গাম’কে মস্তিষ্ক থেকে ঝেড়ে ফেলা কি সম্ভব নয়?’ সাহস সঞ্চয় করে জিজ্ঞেস করলেন নায়েব সালার আন-নাসের।

‘আমি সে চেষ্টাই করছি। কিন্তু অভিযোগের ধরণটা দেখ। আমি কিনা খলীফার হেরেমের একটি মেয়েকে অপহরণ করিয়েছি। আল্লাহ আমাকে ক্ষমা করুন। আমাকে অপমান করতে লোকটা কোন পন্থাই বাদ রাখল না। সবশেষে কিনা আমার নামে হেরেমের মেয়ে অপহরণ করানোর অপবাদ! ‘পয়গাম’— বরং হুশিয়ারী পাঠালেন দূতের মুখে। তা না করে তিনি আমাকে ডেকে নিয়ে সরাসরি কথা বলতেন।’ বললেন সুলতান সালাহুদ্দীন।

‘তারপরও আপনাকে আমি পরামর্শ দেব, আপনি মাথা ঠাণ্ডা করুন, মনের উত্তেজনা দূর করুন।’ বললেন বাহাহুদ্দীন শাদ্দাদ।

সুলতান সালাহুদ্দীন বললেন— ‘আচ্ছা, সত্যিই কি হেরেমের কোন মেয়ে অপহৃত হয়েছে? আমার তো মনে হচ্ছে, সংবাদটা মিথ্যে। এতক্ষণে হয়ত খলীফা জেনে ফেলেছেন, আমি জুমার খোতবা থেকে তার নাম তুলে দিয়েছি। তারই প্রতিশোধ স্বরূপ বোধ হয় তিনি আমার উপর অপবাদ আরোপ করেছেন যে, আমি তার হেরেমের একটি মেয়েকে অপহরণ করিয়েছি।’ ঈসা এলাহকারীকে উদ্দেশ করে সুলতান বললেন— ‘আজই আপনি মিসরের সব মসজিদে এই নির্দেশনামা জারি করে দিন, আগামীতে যেন কোন ইমাম জুমার খুতবায় খলীফার নাম উল্লেখ না করেন।’

‘আপনি খলীফার নিকট চলে যান; তার সঙ্গে কথা বলুন। তাকে বলুন, খলীফা জাতির মর্যাদার প্রতীক বটে, কিন্তু আঁর আদেশ-নিষেধ এখন অচল। বিশেষত যখন সারাদেশে যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করছে, তখন তো খলীফার আইন মান্য করার জন্য কেউই প্রস্তুত নয়। শক্রর আশঙ্কা বাইরে থেকে যেমন, ভিতর থেকেও তেমনি। আমি তো আপনাকে এদ্দুর পরামর্শও দেব যে, আপনি খলীফার রক্ষী বাহিনীর সংখ্যা কমিয়ে দিন। সুদানী হাবশীদের বাদ দিয়ে মিসরী সৈন্য নিয়োগ করুন এবং খলীফার মহলের বরাদ্দ হ্রাস করুন। এসব পদক্ষেপের পরিণাম আমার জানা আছে। পরিস্থিতির মোকাবেলা আমাদের করতেই হবে। তবু আল্লাহর উপর ভরসা রেখে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে।’ আন-নাসের বললেন।

‘আল্লাহ এ অপমান থেকেও আমাকে রক্ষা করবেন।’ বললেন সুলতান।

এমন সময় কক্ষে প্রবেশ করে দারোয়ান। আলোচনা বন্ধ করে সকলে তাকায় তার প্রতি। সালাম দিয়ে বলে— ‘মরুভূমির টহল বাহিনীর কমাণ্ডার এসেছেন। সঙ্গে তার তিনজন সিপাহী। তিনি দু জন সুদানীর লাশ নিয়ে এসেছেন।’

দারোয়ানের এই আকস্মিক প্রবেশে বিরক্তি বোধ করে সকলে। কারণ, সুলতান সালাহুদ্দীন তখন অতীব গুরুত্বপূর্ণ কথা বলছিলেন। দারোয়ানের অনুপ্রবেশে ছেদ পড়ে সেই আলোচনায়। কিন্তু সুলতান সালাহুদ্দীন দারোয়ানকে বললেন— ‘তাকে ভেতরে পাঠিয়ে দাও। সুলতান সালাহুদ্দীন আগেই দারোয়ানকে বলে রেখেছিলেন, কেউ তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসলে যেন সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে অবহিত করা হয়। রাতে ঘুম থেকে জাগানোর প্রয়োজন হলেও অশংকোচে যেন তাকে জাগিয়ে তোলে।’

ভেতরে প্রবেশ করে কমাণ্ডার। ধুলো-মলিন তার চেহারা। দেখে পরিশ্রান্ত মনে হল তাকে। সুলতান সালাহুদ্দীন তাকে বসতে বলে দারওয়ানকে বললেন, ‘এর আহারের ব্যবস্থা কর।’ কমাণ্ডার জানালেন, একটি অপহৃতা মেয়েকে উদ্ধার করার জন্য আমরা চারজন সুদানী হাবশীর দুজনকে তীরের আঘাতে হত্যা করেছি। অপর দুজন মেয়েটিকে নিয়ে পালিয়ে গেছে। নিহত দুজনের লাশ আমরা সঙ্গে করে নিয়ে এসেছি। কমাণ্ডার আরও জানায়, মেয়েটি যাযাবর কিংবা সাধারণ ঘরানার কন্যা নয়। দেখে তাকে রাজকন্যা বলে মনে হল। কথা প্রসঙ্গে নিজেকে খলীফার মালিকানাধীন বলে দাবি করতেও শুনেছি।

‘মনে হয় আল্লাহ আমার সাহায্যে এগিয়ে এসেছেন।’ বলেই বসা থেকে উঠে সুলতান কক্ষ থেকে বের হয়ে যান। কক্ষে উপবিষ্ট সকলে তার পিছনে পিছনে বেরিয়ে আসেন।

কক্ষের বাইরে মাটিতে পড়ে আছে দুটি লাশ। একটি উপুড় হয়ে। পিঠে বিদ্ধ একটি তীর। অপর লাশের ঘাড়ে একটি তীর গাঁথা। পার্শ্বে দাঁড়িয়ে আছে তিনজন সিপাহী। মিসরের গভর্নর সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীকে এই প্রথমবার দেখল তারা। পরিচয় পেয়ে সালাম করে পিছনে সরে যায়। সুলতান সালাহুদ্দীন তাদের সালামের জবাব দেন এবং হাত মিলিয়ে বলেন, ‘এ শিকার তোমরা কোথা থেকে মেরে আনলে?’ যে সান্ত্রী টিলায় দাঁড়িয়ে তীর ছুঁড়ে এদেরকে হত্যা করেছিল, সে সুলতান সালাহুদ্দীনকে পুরো ঘটনার বিবরণ দেয়।

উপদেষ্টাদের প্রতি তাকিয়ে সুলতান সালাহুদ্দীন বললেন— ‘আমার মনে হয়, মেয়েটি খলীফার সেই রক্ষিতাই হবে। আপনারা কী বলেন?’

‘আমারও তাই মনে হয়। এদের খঞ্জরগুলো দেখুন’ —বলেই আলী বিন সুফিয়ান নিহতদের খঞ্জর দুটো সালাহুদ্দীনকে দেখান। সান্ত্রী যখন সুলতানকে ঘটনার বিবরণ দিচ্ছিল, তখন আলী বিন সুফিয়ান লাশ দুটোর সুরতহাল পর্যবেক্ষণ করছিলেন। পরনে সুদানের কাবায়েলী পোশাক। পোশাকের ভেতরে কটিবন্ধ, যাতে বাঁধা আছে একটি করে খঞ্জর। এগুলো খলীফার নিরাপত্তা বাহিনীর বিশেষ ধরনের খঞ্জর। খঞ্জরের হাতলে কসরে খেলাফতের মোহর অঙ্কিত।

আলী বিন সুফিয়ান বললেন— ‘এরা যদি খঞ্জরগুলো চুরি করে না থাকে, তাহলে এরা কসরে খেলাফতের নিরাপত্তা বাহিনীর সিপাহী। আপাতত আমরা এ সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি যে, আমাদের সান্ত্রীরা যে মেয়ের ঘটনা জানাল, সে হেরেমেরই অপহৃতা মেয়ে, যার অপহরণকারীরা খলীফার নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য।’

‘লাশগুলো তুলে খলীফার কাছে নিয়ে চল।’ বললেন সুলতান সালাহুদ্দীন।

‘আগে নিশ্চিত হওয়া দরকার, এরা প্রকৃতই খলীফার নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য কিনা।’ বলেই আলী বিন সুফিয়ান সেখান থেকে চলে যান।

বেশীক্ষণ অতিবাহিত হয়নি। কসরে খেলাফতের এক কমাণ্ডার এসে পড়ে আলী বিন সুফিয়ানের সঙ্গে। লাশ দুটো দেখান হল তাকে। দেখেই সে লাশ দুটো চিনে ফেলে এবং বলে— ‘এরা তো খলীফার নিরাপত্তা বাহিনীর সিপাহী। গত তিনদিন ধরে এরা ছুটিতে ছিল। সাত দিনের ছুটি নিয়েছিল।’

‘আরও কোন সিপাহী ছুটিতে আছে কি?’ জিজ্ঞেস করেন সালাহুদ্দীন।

‘আছে আরও দুজন।’

‘তারা কি এদের সাথে এক সঙ্গে ছুটি নিয়েছিল?’

‘হ্যাঁ, চারজন একত্রেই ছুটি নিয়েছিল।’

জবাব দিয়ে কমাণ্ডার আরও এমনি এক তথ্য প্রকাশ করে, যা চমকিত করে তোলে সকলকে। কমাণ্ডার বলে— ‘এরা সুদানের এমন একটি গোত্রের লোক, যারা রক্তপায়ী বলে খ্যাত। ফেরআউনী আমলের কিছু জঘন্য প্রথা এখনও তাদের সমাজে প্রচলিত। প্রতি তিন বছর অন্তর তারা একটি উৎসব পালন করে। উৎসব হয় মেলার মত। তিন দিন তিন রাত চলে এই মেলা। দিনগুলো তারা এমনভাবে ঠিক করে, যাতে চতুর্থ রাতে পূর্ণিমা থাকে। এ গোত্রের বাইরের অনেক লোকও মেলায় অংশ নেয়। তারা আসে শুধু আমোদ করার জন্য। সুন্দরী যুবতী মেয়েদের বেচা-কেনার জন্য রীতিমত হাট বসে মেলায়। এই মেলা বসার অন্তত একমাস পূর্ব থেকে পার্শ্ববর্তী এলাকা, বরং কায়রোতে পর্যন্ত যাদের ঘরে যুবতী মেয়ে আছে, তারা সতর্ক হয়ে যায়। কেউ মেয়েদেরকে ঘর থেকে বের হতে দেয় না। যাযাবর পরিবারগুলো পর্যন্ত এ সময়ে এ এলাকা থেকে অনেক দূরে চলে যায়। এই একমাস চতুর্দিকে মেয়ে অপহরণ হয় আর এ মেলায় বিক্রি হয়। চার সুদানী ফৌজও এ মেলা উপলক্ষ্যে ছুটিতে গিয়েছিল। আর মাত্র তিনদিন পর মেলা শুরু হচ্ছে।’

‘আচ্ছা, তাদের ব্যাপারে কি একথা বলা যায় যে, তারাই খলীফার হেরেমের মেয়েটিকে অহপরণ করেছে?’ জিজ্ঞেস করলেন আলী বিন সুফিয়ান।

‘একথা আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি না। আমি শুধু এতটুকু বলতে পারি, এ দিনগুলোতে উক্ত গোত্রের লোকেরা জীবনের ঝুঁকি নিয়েও মেয়ে অপহরণ করার চেষ্টা করে। তারা এতই রক্তপায়ী যে, যদি কোন মেয়ের অভিভাবক মেলায় গিয়ে নিজ কন্যার সন্ধান পায় এবং তাকে ফিরিয়ে আনতে চায়, তবে নির্ঘাত তাকে জীবন হারাতে হয়। মেয়েদের খদ্দেরদের মধ্যে মিসরের আমীর-উজীর-হাকীমও থাকেন। মেলায় এমন একটি অস্থায়ী পতিতালয় স্থাপন করা হয়, যেখানে সর্বক্ষণ মদ-জুয়া আর নারী নিয়ে আমোদ চলে। এ উৎসব-অনুষ্ঠানের শেষ রাতটি হয় অত্যন্ত রহস্যময়। কোন একটি গোপন স্থানে একটি অস্বাভাবিক সুন্দরী যুবতী মেয়েকে বলী দেওয়া হয়। কোন্ স্থানে কিভাবে এই নারী-বলী হয়, তা নির্দিষ্ট ক’জন ছাড়া আর কেউ বলতে পারে না। হাবশীদের এক ধর্মগুরু— যাকে তারা খোদা বলেও বিশ্বাস করে— এ কাজ সম্পাদন করে। তার সঙ্গে থাকে স্বল্পসংখ্যক পুরুষ আর চার-পাঁচটি মেয়ে। বলী দেওয়া মেয়ের কর্তিত মাথা ও রক্ত প্রদর্শন করা হয় সর্বসাধারণকে। কর্তিত মস্তক দেখে গোত্রের মানুষ মাতালের ন্যায় নাচতে-গাইতে ও মদপান করতে শুরু করে।’

○             ○             ○

অপহরণ ঘটনার তথ্য উদ্ধার করার জন্য খলীফা নিরাপত্তা বাহিনীর উপর প্রবল চাপ সৃষ্টি করেন। তথ্য বের করার জন্য সেই ভোর থেকে সমগ্র বাহিনীকে প্রখর রোদে দাঁড় করিয়ে রাখেন তিনি। কমাণ্ডারদের পর্যন্ত এক তিল দানা-পানি মুখে দিতে দেননি সারা দিন। রজব বার বার আসছে আর ঘোষণা করছে— ‘মহলের নিরাপত্তা বাহিনীর সহযোগিতা ছাড়া মেয়ে অপহরণ করা যেতে পারে না। যেই এ অপহরণে সাহায্য করেছে, সামনে এসে হাজির হও। অন্যথায় সকলকে এভাবে ক্ষুৎপিপাসায় মেরে ফেলা হবে। যদি মেয়েটি স্বেচ্ছায়ও পালিয়ে গিয়ে থাকে, তাহলেও তো কেউ না কেউ দেখে থাকবে নিশ্চয়। বল, কে তার অপহরণে সাহায্য করেছ!’ কিন্তু না, এতসব হুমকি-ধমকিতে কোনই ক্রিয়া হচ্ছে না। সকলের মুখে একই কথা, ‘এ ব্যাপারে আমি কিছুই জানি না, আমি নির্দোষ।’

খলীফা রজবকে এক পা দাঁড়াতে দিচ্ছেন না। তাকে তিনি বলেছিলেন— ‘উম্মে আরারার জন্য আমার আফসোস নেই। আমার পেরেশানীর কারণ হল, যে বা যারা এত কড়া নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে মহলের একটি মেয়েকে অপহরণ করে নিয়ে যেতে পারে, তারা আমাকে অনায়াসে হত্যাও তো করতে পারে! তুমি বলেছিলে, এ ঘটনা সালাহুদ্দীন ঘটিয়েছে; আমি তার প্রমাণ চাই।’

কিন্তু রজব প্রমাণ দেবে কোত্থেকে? প্রখর রৌদ্রে দাঁড়িয়ে থাকা নিরাপত্তা বাহিনীর নিকট আবার ছুটে যায় সে। রাগে পাগলের মত হয়ে গেছে লোকটি। সৈন্যদের উদ্দেশে পূর্বের বলা কথাগুলোর পুনরাবৃত্তি করতে শুরু করে। ঠিক এ সময়ে মহলের দরজায় দণ্ডায়মান সান্ত্রীরা দরজা খুলে দেয় এবং চেঁচিয়ে উঠে বলে— ‘ঐ তো আমীরে মেসের আসছেন।’

প্রধান ফটকে প্রবেশ করে সুলতান সালাহুদ্দীনের অশ্ব। সামনে তার দুজন রক্ষীর ঘোড়া। আটজন আরোহী পিছনে। একজন ডানে আর একজন বয়ে। সকলের পিছনে সুলতান সালাহুদ্দীনের একজন উপদেষ্টা আর গোয়েন্দা প্রধান আলী বিন সুফিয়ান।

সুলতান সালাহুদ্দীনের এই বহরের পেছনে চার চাকাবিশিষ্ট একটি গাড়ী। দুটি ঘোড়া টেনে এনেছে গাড়ীটি। গাড়ীতে পড়ে আছে দুটি লাশ। একটি চীৎ হয়ে আর অপরটি উপুড় হয়ে। লাশ দুটির গায়ে বিদ্ধ দুটি তীর। লাশের সঙ্গে আছে তিনজন সিপাহী।

সংবাদ পেয়ে বাইরে বেরিয়ে আসেন খলীফা। সুলতান সালাহুদ্দীন ও তাঁর সঙ্গীগণ নেমে পড়েন ঘোড়া থেকে। সুলতান খলীফাকে যথাযোগ্য মর্যাদার সাথে সালাম করেন, মোসাফাহা করেন ও হাতে চুমো খান। তারপর কোন ভূমিকা ছাড়াই বলে ওঠেন—

‘আপনার হেরেমের মেয়েকে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য আপনি পয়গাম পাঠিয়েছেন। সে পয়গাম আমি পেয়েছি। আমি আপনার দুই নিরাপত্তা কর্মীর লাশ নিয়ে এসেছি। এই লাশ দুটোই আমাকে নির্দোষ প্রমাণিত করবে। আর হুজুরের খেদমতে আমি এই আরজি পেশ করার আবশ্যক মনে করছি যে, সালাহুদ্দীন আইউবী আপনার ফৌজের সিপাহী নয়। আপনি যে খেলাফতের প্রতিনিধিত্ব করছেন, সালাহুদ্দীন সে খেলাফতেরই প্রেরিত গভর্নর।’

সালাহুদ্দীন আইউবীর ভাব-গতিক বুঝে ফেলেন খলীফা। পাপের ভারে কুঁকিয়ে ওঠে এই ফাতেমী খলীফার হৃদয়। সুলতান সালাহুদ্দীনের প্রভাব আর মহান ব্যক্তিত্বের সামনে দাঁড়িয়ে প্রত্যুত্তর করার সৎ সাহস নেই তার। সুলতানের কাঁধে হাত রেখে বললেন— ‘আমি তোমাকে আপন পুত্র অপেক্ষা অধিক স্নেহ করি। ভেতরে এসে বস সালাহুদ্দীন!’

‘আমি এখনও একজন আসামী। এক্ষুনি আমার প্রমাণ দিতে হবে, হেরেমের মেয়ে অপহরণে আমার কোন হাত নেই। আল্লাহ আমাকে সাহায্য করেছেন, তিনি দুটি লাশ প্রেরণ করেছেন। এই দুটো লাশ কথা বলবে না ঠিক, কিন্তু তাদের নীরবতা, তাদের গায়ে বিদ্ধ হয়ে থাকা তীরই সাক্ষ্য দেবে, সালাহুদ্দীন কসরে খেলাফতে সংঘটিত এ অপরাধের সাথে জড়িত নয়। নিজেকে নির্দোষ প্রমাণিত না করা পর্যন্ত আমি ভেতরে যাব না, আসুন। বলেই সালাহুদ্দীন আইউবী লাশের গাড়ীর দিকে হাঁটা দেন। খলীফাও তার পিছনে পিছনে রওনা হন।

খানিক দূরে দাঁড়িয়ে আছে চার থেকে সাড়ে চার শত নিরাপত্তা বাহিনী। সুলতান সালাহুদ্দীন গাড়ীর লাশ দুটো উঠিয়ে তাদের কাছে নিয়ে রাখেন এবং উচ্চকণ্ঠে বলেন— ‘আট আটজন করে সিপাহী সামনে এগিয়ে এস এবং লাশ দুটো দেখে বল, এরা কারা?’

প্রথমে আসে কমাণ্ডার ও প্লাটুন দায়িত্বশীলগণ। লাশ দুটো দেখেই তারা নাম উল্লেখ করে বলে— ‘এরা তো আমাদের বাহিনীর সিপাহী ছিল।’ তারপর আসে অপর আটজন। তারাও লাশ সনাক্ত করে বলে, ‘এরা আমাদের সহকর্মী সিপাহী।’ এভাবে আটজন আটজন করে সকল কমাণ্ডার-সিপাহী এসে দেখে লাশ দুটোর পরিচয় প্রদান করে।

‘সালাহুদ্দীন! আমি মেনে নিলাম, এ দুটো লাশ কসরে খেলাফতের দুই নিরাপত্তা কর্মীর। কিন্তু আমি শুনতে চাই, এদের হত্যা করল কে?’ বললেন খলীফা।

টহল বাহিনীর যে সান্ত্রী এদের হত্যা করেছিল, সালাহুদ্দীন আইউবী তাকে সামনে ডেকে এনে বললেন, ‘সমবেত মজলিসে তোমার কাহিনী পুনর্ব্যক্ত কর।’

ঘটনাটি আনুপুংখ বিবৃত করে শোনায় সান্ত্রী। তার বক্তব্য শেষ হলে সুলতান সালাহুদ্দীন খলীফাকে বললেন— ‘অপহরণ করে আপনার মেয়েটিকে আমার নিকট নিয়ে যাওয়া হয়নি— নিয়ে যাওয়া হয়েছে তাকে সুদানী হাবশীদের মেলায় বিক্রি করার জন্য। প্রথা অনুযায়ী হাবশীরা তারা বলীও দিতে পারে।’

লজ্জায় ও দুঃখে অধোবদন হয়ে ওঠেন খলীফা। তিনি সুলতান সালাহুদ্দীনকে বললেন, ‘বসুন, ভেতরে আসুন।’ কিন্তু ভেতরে যেতে অস্বীকার করলেন সালাহুদ্দীন। বললেন, ‘আমি মেয়েটিকে জীবিত হোক, মৃত হোক উদ্ধার করে এনে আপনার খেদমতে হাজির হব। তবে আপনি মনে রাখবেন, হেরেমের এমন একটি মেয়ের অপহরণ— যে এসেছিল উপহারস্বরূপ এবং যে আপনার বিবাহিত স্ত্রী নয়— রক্ষিতা আমার কাছে বিন্দু বরাবর গুরুত্ব রাখে না। আল্লাহ আমাকে এর চেয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব অর্পণ করেছেন।’

‘আমার পেরেশানীর কারণ এই নয় যে, হেরেমের একটি মেয়ে অপহৃত হয়ে গেছে। পেরেশানীর আসল কারণ, যদি এভাবে নারী অপহরণ চলতে থাকে, তাহলে দেশের আইন-শৃংখলার পরিণতি কী হবে!’ বললেন খলীফা।

‘আর আমি পেরেশান এই ভেবে যে, খোদ ইসলামী সাম্রাজ্যই অপহৃত হয়ে যাচ্ছে। যা হোক, আপনি এত অস্থির হবেন না। আমার গোয়েন্দা বিভাগ মেয়েটিকে উদ্ধার করে আনার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাবে।’ বললেন সুলতান সালাহুদ্দীন।

খলীফা সুলতান সালাহুদ্দীনকে খানিকটা আড়ালে নিয়ে গেলেন এবং বললেন, ‘সালাহুদ্দীন! বেশ কিছুদিন ধরে আমি দেখছি, তুমি আমাকে এড়িয়ে চলছ। তোমার পিতা নাজমুদ্দীন আইউবকে আমি অনেক শ্রদ্ধা করি। কিন্তু তোমার মনে আমার প্রতি সামান্যতম শ্রদ্ধাবোধও নেই দেখছি। তাছাড়াও এই আজই আমি জানতে পারলাম, কায়রোর কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের খতীব আমীরুল ওলামা জুমার খোতবা থেকে আমার নাম তুলে দেওয়ার মত গোস্তাখী করেছে। কাজটা সে তোমার ইন্ধনে করেনি তো?’

‘আমার ইন্ধনে নয়— সরাসরি আমার নির্দেশে তিনি খোতবা থেকে আপনার নাম তুলে দিয়েছেন। শুধু আপনার নামই নয়, আপনার পরে যারা খেলাফতের মসনদে আসীন হবেন এবং তাদেরও পরে যারা আসবেন, সকলের নামই আমি খোতবা থেকে তুলে দিয়েছি।’ বলিষ্ঠ কণ্ঠে বললেন সুলতান সালাহুদ্দীন।

‘এ নির্দেশ কি ফাতেমী খেলাফতকে দুর্বল করার জন্য জারি করা হল? আমার তো সন্দেহ হচ্ছে, ফাতেমী খেলাফতকে উৎখাত করে আব্বাসীয় খেলাফত প্রতিষ্ঠার ষড়যন্ত্র চলছে।’ বললেন খলীফা।

‘হুজুর বেশ বৃদ্ধ হয়ে গেছেন। তাছাড়া মদপানের ফলে মস্তিষ্কও দুর্বল হয়ে গেছে। তাই কথাগুলো আপনার প্রলাপের মত শোনা যাচ্ছে ……।’ বললেন সুলতান সালাহুদ্দীন। তারপর খানিক চিন্তা করে বললেন, ‘আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, কাল থেকে আপনার নিরাপত্তা বাহিনীতে রদবদল হবে। রজবকে প্রত্যাহার করে নিয়ে আমি তার স্থলে নতুন কমাণ্ডার দেব।’

‘কিন্তু রজবকে যে আমি এখানে রাখতে চাই।’ বললেন খলীফা।

‘হুজুরের সমীপে আমার বিনীত নিবেদন, সামরিক কর্মকাণ্ডে আপনি হস্তক্ষেপ করতে চেষ্টা করবেন না।’ বলেই সুলতান সালাহুদ্দীন আলী বিন সুফিয়ানের প্রতি মনোযোগী হন। আলী বিন সুফিয়ান তখন পাঁচজন হাবশী রক্ষীসেনা নিয়ে এদিকে আসছিলেন।

‘এরা পাঁচজন ঐ গ্রোত্রের লোক। আমি নিরাপত্তা বাহিনীকে উদ্দেশ করে বললাম, ঐ গোত্রের কেউ এখানে থাকলে বেরিয়ে এস। সারি থেকে বেরিয়ে আসে এরা পাঁচজন। কমাণ্ডার বলল, এরা আগামী পরশু থেকে ছুটিতে যাচ্ছে। আমি এদেরকে সঙ্গে করে নিয়ে যাচ্ছি। মেয়েটির অপহরণে এদের হাত থাকতে পারে।’ বললেন আলী বিন সুফিয়ান।

সালাহুদ্দীন আইউবী রজবকে ডেকে বললেন, ‘আগামীকাল এখানে অন্য কমাণ্ডার আসছে। আপনি আমার নিকট চলে আসবেন। আমি আপনাকে মিনজানীকের দায়িত্ব দিতে চাই।’

শুনে ফ্যাকাশে হয়ে যায় রজবের চেহারা।

○             ○             ○