ইন্দিরা

‘ইন্দিরা’ বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কুশলী হাতে নির্মিত শ্রেষ্ঠ চরিত্রগুলোর একটি নয়। তারপরও এই উপন্যাসের বিশেষত্ব কী? এই রচনাকে বাংলাসাহিত্যের ছোটগল্প রচনার প্রথম সফল প্রচেষ্টার একটি হিসেবে দেখা হয়। প্রকাশিত হয়েছিল ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকায়। লেখকের নিজের সম্পাদিত কাগজে।Continue Reading

প্রথম পরিচ্ছেদ : আমি শ্বশুরবাড়ী যাইব

অনেক দিনের পর আমি শ্বশুরবাড়ী যাইতেছিলাম। আমি ঊনিশ বৎসরে পড়িয়াছিলাম, তথাপি এ পর্যন্ত শ্বশুরের ঘর করি নাই। তাহার কারণ, আমার পিতা ধনী, শ্বশুর দরিদ্র। বিবাহের কিছু দিন পরেই শ্বশুর আমাকে লইতে লোক পাঠাইয়াছিলেন, কিন্তু পিতাContinue Reading

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ : শ্বশুরবাড়ী চলিলাম

ভগিনীর এই আশীর্বাদ লইয়া আমি শ্বশুরবাড়ী যাইতেছিলাম। আমার শ্বশুরবাড়ী মনোহরপুর। আমার পিত্রালয়ে মহেশপুর। উভয় গ্রামের মধ্যে দশ ক্রোশ পথ, সুতরাং প্রাতে আহার করিয়া যাত্রা করিয়াছিলাম, পৌঁছিতে পাঁচ সাত দণ্ড রাত্রি হইবে, জানিতাম। তাই চক্ষে একটুContinue Reading

তৃতীয় পরিচ্ছেদ : শ্বশুরবাড়ী যাওয়ার সুখ

এমনও কি কখনও হয়? এত বিপদ, এত দুঃখ কাহারও কখনও ঘটিয়াছে? কোথায় প্রথম স্বামিসন্দর্শনে যাইতেছিলাম—সর্বাঙ্গে রত্নালঙ্কার পরিয়া, কত সাধে চুল বাঁধিয়া, সাধের সাজা পানে অকলুষিত ওষ্ঠাধর রঞ্জিত করিয়া, সুগন্ধে এই কৌমারপ্রফুল্ল দেহ আমোদিত করিয়া এইContinue Reading

চতুর্থ পরিচ্ছেদ : এখন যাই কোথায়?

যখন আমার ঘুম ভাঙ্গিল, তখন কাক কোকিল ডাকিতেছে—বাঁশের পাতার ভিতর দিয়া টুক‍‍রা টুক‍‍রা রৌদ্র আসিয়া পৃথিবীকে মণিমুক্তায় সাজাইয়াছে। আলোতে প্রথমেই দেখিলাম, আমার হাতে কিছু নাই, দস্যুরা প্রকোষ্ঠলঙ্কার সকল কাড়িয়া বিধবা সাজাইয়াছে। বাঁ হাতে এক টুক‍‍রাContinue Reading

পঞ্চম পরিচ্ছেদ : বাজিয়ে যাব মল

আমি গঙ্গা কখনও দেখি নাই। এখন গঙ্গা দেখিয়া, আহ্লাদে প্রাণ ভরিয়া গেল। আমার এত দুঃখ, মুহূর্ত জন্য সব ভুলিলাম। গঙ্গার প্রশস্ত হৃদয়! তাহাতে ছোট ছোট ঢেউ—ছোট ঢেউর উপর রৌদ্রের চিকিমিকি—যতদূর চক্ষু যায়, ততদূর জল জ্বলিতেContinue Reading

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ : সুবো

কৃষ্ণদাস বাবু কলিকাতায় কালীঘাটে পূজা দিতে আসিয়াছিলেন। ভবানীপুরে বাসা করিলেন। আমাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “তোমার খুড়ার বাড়ী কোথায়? কলিকাতায় না ভবানীপুরে?” তাহা আমি জানিতাম না। জিজ্ঞাসা করিলেন, “কলিকাতায় কোন্ জায়গায় তাঁহার বাসা?” তাহা আমি কিছুই জানিতামContinue Reading

সপ্তম পরিচ্ছেদ : কালির বোতল

মা—সুভাষিণীর শাশুড়ী। তাঁহাকে বশ করিতে হইবে—সুতরাং গিয়াই তাঁহাকে প্রণাম করিয়া পায়ের ধূলা লইলাম, তার পর এক নজর দেখিয়া লইলাম, মানুষটা কি রকম। তিনি তখন ছাদের উপর অন্ধকারে, একটা পাটী পাতিয়া, তাকিয়া মাথায় দিয়া শুইয়া পড়িয়াContinue Reading

অষ্টম পরিচ্ছেদ : বিবি পাণ্ডব

পরদিন রাঁধিলাম। সুভাষিণী দেখাইয়া দিতে আসিয়াছিল, আমি ইচ্ছা করিয়া সেই সময়ে লঙ্কা ফোড়ন দিলাম—সে কাশিতে কাশিতে উঠিয়া গেল, বলিল, “মরণ আর কি!” রান্না হইলে বালকবালিকারা প্রথমে খাইল।সুভাষিণী ছেলে অন্ন-ব্যঞ্জন বড় খায় না, কিন্তু সুভাষিণীর পাঁচContinue Reading

নবম পরিচ্ছেদ : পাকাচুলের সুখ দুঃখ

আমি আশ্রয় পাইলাম। আর একটি অমূল্য রত্ন পাইলাম—একটি হিতৈষিণী সখী। দেখিতে লাগিলাম যে, সুভাষিণী আমাকে আন্তরিক ভালবাসিতে লাগিল–আপনার ভগিনীর সঙ্গে যেমন ব্যবহার করিতে হয়, আমার সঙ্গে তেমনই ব্যবহার করিত। তাঁর শাসনে দাস-দাসীরাও আমাকে অমান্য করিতContinue Reading

দশম পরিচ্ছেদ : আশার প্রদীপ

সেইদিন বৈকালে সুভাষিণী আমার হাত ধরিয়া টানিয়া লইয়া গিয়া নিভৃতে বসাইল। বলিল, “বেহান! তুমি সেই কালাদীঘির ডাকাতির গল্পটি বলিবে বলিয়াছিলে—আজিও বল নাই। আজ বল না—শুনি।” আমি অনেক্ষণ ভাবিলাম। শেষ বলিলাম, “সে আমারই হতভাগ্যের কথা। আমারContinue Reading

একাদশ পরিচ্ছেদ : একটা চোরা চাহনি

এক দিবস প্রাতে উঠিয়া দেখিলাম, কিছু ঘটার আয়োজন। রমণ বাবু উকীল। তাঁহার একজন মোয়াক্কেল ছিল। দুই দিন ধরিয়া শুনিতেছিলাম, তিনি কলিকাতায় আসিয়াছেন। রমণ বাবু ও তাঁহার পিতা সর্বদা তাঁহার বাড়ীতে যাতায়াত করিতেছিলেন। তাঁহার পিতা যাতায়াতContinue Reading

দ্বাদশ পরিচ্ছেদ : হারাণীর হাসিবন্ধ

এখন হইতে এই ইতিবৃত্তমধ্যে পাঁচ শত বার আমার স্বামীর নাম করা আবশ্যক হইবে। এখন তোমরা পাঁচজন রসিকা মেয়ে একত্র কমিটীতে বসিয়া পরামর্শ করিয়া বলিয়া দাও, আমি কোন্ শব্দ ব্যবহার করিয়া তাঁহার নাম করিব? পাঁচ শতContinue Reading

ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ : আমাকে একজামিন দিতে হইল

সন্ধ্যার পর আমার স্বামী কাগজপত্র লইয়া রমণ বাবুর কাছে আসিলেন। সংবাদ পাইয়া, আমি আর একবার হারাণীর হাতে পায়ে ধরিলাম। হারাণী সেই কথাই বলে, “বৌদিদি যদি বারণ না করে, তবে পারি। তবে জানিব, এতে দোষ নাই।”Continue Reading

চতুর্দ্দশ পরিচ্ছেদ : আমার প্রাণত্যাগের প্রতিজ্ঞা

আমি হারাণীকে সতর্ক করিয়া দিয়া আপনার শয়নগৃহে গেলাম। বাবুদের আহারাদি হইয়া গিয়াছে। এমন সময়ে একটা বড় গণ্ডগোল পড়িয়া গেল। কেহ ডাকে পাখা, কেহ ডাকে জল, কেহ ডাকে ঔষধ, কেহ ডাকে ডাক্তার। এইরূপ হুলস্থূল। হারাণী হাসিতেContinue Reading

পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ : কুলের বাহির

তখন সে চিন্তিত ভাব আমার দূর হইল। ইতিপূর্বেই বুঝিতে পারিয়াছিলাম যে, তিনি আমার বশীভূত হইয়াছেন। মনে মনে কহিলাম, যদি গণ্ডারের খড়্গ-প্রয়োগে পাপ না থাকে, যদি হস্তীর দন্ত-প্রয়োগে পাপ না থাকে, যদি ব্যাঘ্রের নখব্যবহারে পাপ নাContinue Reading

ষোড়শ পরিচ্ছেদ : খুন করিয়া ফাঁসি গেলাম

পুরুষকে দগ্ধ করিবার যে কোন উপায় বিধাতা স্ত্রীলোককে দিয়াছেন, সেই সকল উপায়ই অবলম্বন করিয়া আমি অষ্টাহ স্বামীকে জ্বালাতন করিলাম। আমি স্ত্রীলোক—কেমন করিয়া মুখ ফুটিয়া সে সকল কথা বলিব। আমি যদি আগুন জ্বালিতে না জানিতাম, তবেContinue Reading

সপ্তদশ পরিচ্ছেদ : ফাঁসির পর মোকদ্দমার তদারক

আমরা কলিকাতায় দিনকত সুখে-স্বচ্ছন্দে রহিলাম। তার পর দেখিলাম, স্বামী একদিন একখানা চিঠি হাতে করিয়া অত্যন্ত বিষণ্ণভাবে রহিয়াছেন। জিজ্ঞাসা করিলাম, “এত বিমর্ষ কেন?” তিনি বলিলেন, “বাড়ী হইতে চিঠি আসিয়াছে। বাড়ী যাইতে হইবে।” আমি হঠাৎ বলিয়া ফেলিলাম,Continue Reading

অষ্টাদশ পরিচ্ছেদ : ভারি জুয়াচুরির বন্দোবস্ত

সেদিন, দিবারাত্রি, আমার স্বামী, অন্যমনে ভাবিতে লাগিলেন। আমার সঙ্গে কথাবার্তা কহিলেন না—আমাকে দেখিলেই আমার মুখ পানে চাহিয়া থাকিতেন। তাঁহার অপেক্ষা আমার চিন্তার বিষয় বেশী; কিন্তু তাঁকে চিন্তিত দেখিয়া, আমার প্রাণের ভিতর বড় যন্ত্রণা হইতে লাগিল।Continue Reading

ঊনবিংশ পরিচ্ছেদ : বিদ্যাধরী

দেখিলাম, এক্ষণে অনায়াসে আত্মপরিচয় দিতে পারি। আমার স্বামীর নিজ মুখ হইতে আমার পরিচয় ব্যক্ত হইয়াছে। কিন্তু কিছুমাত্র সন্দেহ থাকিতে, আমি পরিচয় দিব না, স্থির করিয়াছিলাম। তাই বলিলাম, “এখন আত্মপরিচয় দিব। কামরূপে আমার অধিষ্ঠান। আমি আদ্যাশক্তিরContinue Reading