আমি গঙ্গা কখনও দেখি নাই। এখন গঙ্গা দেখিয়া, আহ্লাদে প্রাণ ভরিয়া গেল। আমার এত দুঃখ, মুহূর্ত জন্য সব ভুলিলাম। গঙ্গার প্রশস্ত হৃদয়! তাহাতে ছোট ছোট ঢেউ—ছোট ঢেউর উপর রৌদ্রের চিকিমিকি—যতদূর চক্ষু যায়, ততদূর জল জ্বলিতে জ্বলিতে ছুটিয়াছে—তীরে কুঞ্জের মত সাজান বৃক্ষের অনন্ত শ্রেণী; জলে কত রকমের কত নৌকা; জলের উপর দাঁড়ের শব্দ, দাঁড়ী মাঝির শব্দ, জলের উপর কোলাহল, তীরে ঘাটে ঘাটে কোলাহল; কতরকমের লোক, কতরকমে স্নান করিতেছে। আবার কোথাও সাদা মেঘের মত অসীম সৈকতভূমি-তাতে কত প্রকারের পক্ষী কত শব্দ করিতেছে। গঙ্গা যথার্থ পুণ্যময়ী। অতৃপ্ত নয়নে কয়দিন দেখিতে দেখিতে আসিলাম।
যেদিন কলিকাতায় পৌঁছিব, তাহার পূর্বদিন, সন্ধ্যার কিছু পূর্বে জোয়ার আসিল। নৌকা আর গেল না। একখানা ভদ্র গ্রামের একটা বাঁধা ঘাটের নিকট আমাদের নৌকা লাগাইয়া রাখিল। কত সুন্দর জিনিস দেখিলাম; জেলেরা মোচার খোলার মত ডিঙ্গীতে মাছ ধরিতেছে, দেখিলাম। ব্রাহ্মণ পণ্ডিত ঘাটের রাণায় বসিয়া শাস্ত্রীয় বিচার করিতেছেন, দেখিলাম। কত সুন্দরী, বেশভূষা করিয়া জল লইতে আসিল। কেহ জল ফেলে কেহ কলসী পুরে, কেহ আবার ঢালে, আবার পুরে, আর হাসে, গল্প করে, আবার ফেলে, আবার কলসী ভরে। দেখিয়া আমার প্রাচীন গীতটি মনে পড়িল,
সেইদিন সেইখানে দুইটি মেয়ে দেখিয়াছিলাম, তাহাদের কখন ভুলিব না। মেয়ে দুইটির বয়স সাত আট বৎসর। দেখিতে বেশ, তবে পরম সুন্দরীও নয়। কিন্তু সাজিয়াছিল ভাল। কাণে দুল, হাতে আর গলায় একখানা গহনা। ফুল দিয়া খোঁপা বেড়িয়াছে। রঙ্গ করা, শিউলীফুলে ছোবান, দুইখানি কালাপেড়ে কাপড় পরিয়াছে। পায়ে চারিগাছি করিয়া মল আছে। কাঁকালে ছোট ছোট দুইটি কলসী আছে। তাহারা ঘাটের রাণায় নামিবার সময়ে জোয়ারের জলের একটা গান গায়িতে গায়িতে নামিল। গানটি মনে আছে, মিষ্ট লাগিয়াছিল, তাই এখানে লিখিলাম। একজন এক এক পদ গায়, আর একজন দ্বিতীয় পদ গায়। তাহাদের নাম শুনিলাম, অমলা আর নির্মলা। প্রথমে গায়িল—
অমলা
ধানের ক্ষেতে,
ঢেউ উঠেছে,
বাঁশ তলাতে জল।
আয় আয় সই,
জল আনিগে,
জল আনিগে চল॥
নির্মলা
ঘাটটি জুড়ে,
গাছটি বেড়ে
ফুটল ফুলের দল।
আয় আয় সই,
জল আনিগে,
জল আনিগে চল॥
অমলা
বিনোদ বেশে
মুচ্কে হেসে,
খুলব হাসির কল।
কলসী ধ’রে,
গরব ক’রে
বাজিয়ে যাব মল।
আয় আয় সই,
জল আনিগে,
জল আনিগে চল॥
নির্মলা
গহনা গায়ে,
আলতািগ পায়ে,
কল্কাদার আঁচল।
ঢিমে চালে,
তালে তালে
বাজিয়ে যাব মল।
আয় আয় সই,
জল আনিগে,
জল আনিগে চল॥
অমলা
যত ছেলে,
খেলা ফেলে,
ফিরচে দলে দল।
কত বুড়ী,
জুজুবুড়ী
ধরবে কত জল,
আমরা মুচকে হেসে,
বিনোদ বেশে
বাজিয়ে যাব মল।
আমরা বাজিয়ে যাব মল,
সই বাজিয়ে যাব মল॥
দুই জনে
আয় আয় সই,
জল আনিগে,
জল আনিগে চল।
বালিকাসিঞ্চিতরসে, এ জীবন কিছু শীতল হইল। আমি মনোযোগপূর্বক এই গান শুনিতেছি, দেখিয়া বসুজ মহাশয়ের সহধর্মিণী আমাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “ও ছাই গান আবার হাঁ করিয়া শুনচ কেন?” আমি বলিলাম “ক্ষতি কি?”
বসুজপত্নী। ছুঁড়ীদের মরণ আর কি? মল বাজানর আবার গান!
আমি। ষোল বছরের মেয়ের মুখে ভাল শুনাইত না বটে, সাত বছরের মেয়ের মুখে বেশ শুনায়। জোয়ান মিন্য়সের হাতের চড়চাপড় জিনিস ভাল নহে বটে, কিন্তু তিন বছরের ছেলের হাতের চড় চাপড় বড় মিষ্ট।
বসুজপত্নী আর কিছু না বলিয়া ভারি হইয়া বসিয়া রহিলেন। আমি ভাবিতে লাগিলাম। ভাবিলাম, এ প্রভেদ কেন হয়? এক জিনিস দুই রকম লাগে কেন? যে দান দরিদ্রকে দিলে পুণ্য হয়, তাহা বড়মানুষকে দিলে খোষামোদ বলিয়া গণ্য হয় কেন? যে ক্ষমা পরমধর্ম, দুষ্কৃতকারীর প্রতি প্রযুক্ত হইলে, তাহা মহাপাপ কেন? সত্য সত্যই কেহ স্ত্রীকে বনে দিয়া আসিলে লোকে তাহাকে মহাপাপী বলে; কিন্তু রামচন্দ্র সীতাকে বনে দিয়াছিলেন, তাঁহাকে কেহ মহাপাপী বলে না কেন?
ঠিক করিলাম, অবস্থাভেদে এসকল হয়।কথাটা আমার মনে রহিল।আমি হইার পর একদিন যে নির্লজ্জ কাজের কথা বলিব, তাহা এই কথা মনে করিয়া করিয়াছিলাম।তাই এ গানটা এখানে লিখিলাম।
নৌকাপথে কলিকাতা আসিতে দূর হইতে কলিকাতা দেখিয়া, বিস্মিত ও ভীত হইলাম। অট্টালিকার পর অট্টালিকা, বাড়ীর গায়ে বাড়ী, বাড়ীর পিঠে বাড়ী, তার পিঠে বাড়ী, অট্টালিকার সমুদ্র—তাহার অন্ত নাই, সংখ্যা নাই, সীমা নাই। জাহাজের মাস্তুলের অরণ্য দেখিয়া জ্ঞান বুদ্ধি বিপর্যস্ত হইয়া গেল। নৌকার অসংখ্য, অনন্ত শ্রেণী দেখিয়া মনে হইল, এত নৌকা মানুষে গড়িল কি প্রকারে?[১] নিকটে আসিয়া দেখিলাম, তীরবর্তী রাজপথে গাড়ি পাল্কী পিঁপড়ের সারির মত চলিয়াছে—যাহারা হাঁটিয়া যাইতেছে, তাহাদের সংখ্যার ত কথাই নাই। তখন মনে হইল, ইহার ভিতর খুড়াকে খুঁজিয়া বাহির করিব কিপ্রকারে? নদীসৈকতের বালুকারাশির ভিতর হইতে, চেনা বালুকাকণাটি খুঁজিয়া বাহির করিব কিপ্রকারে?