» » তৃতীয় পরিচ্ছেদ : শ্বশুরবাড়ী যাওয়ার সুখ

এমনও কি কখনও হয়? এত বিপদ, এত দুঃখ কাহারও কখনও ঘটিয়াছে? কোথায় প্রথম স্বামিসন্দর্শনে যাইতেছিলাম—সর্বাঙ্গে রত্নালঙ্কার পরিয়া, কত সাধে চুল বাঁধিয়া, সাধের সাজা পানে অকলুষিত ওষ্ঠাধর রঞ্জিত করিয়া, সুগন্ধে এই কৌমারপ্রফুল্ল দেহ আমোদিত করিয়া এই পাদপদ্মে উপহার দিব, তাই ভাবিতে ভাবিতে যাইতেছিলাম—অকস্মাৎ তাহাতে এ কি বজ্রাঘাত! সর্বালঙ্কার কাড়িয়া লইয়াছে—লউক; জীর্ণ মলিন দুর্গন্ধ বস্ত্র পরাইয়াছে—পরাক; বাঘ-ভালুকের মুখে সমর্পণ করিয়া গিয়াছে,–যাক; ক্ষুধাতৃষ্ণায় প্রাণ যাইতেছে—তা যাক—প্রাণ আর চাহি না, এখন গেলেই ভাল; কিন্তু যদি প্রাণ না যায়, যদি বাঁচি তবে কোথায় যাইব? আর ত তাঁকে দেখা হইল না—বাপ-মাকেও বুঝি দেখিতে পাইব না! কাঁদিলে ত কান্না ফুরায় না।

তাই কাঁদিব না বলিয়া স্থির করিতেছিলাম। চক্ষুর জল কিছুতেই থামিতেছিল না, তবু চেষ্টা করিতেছিলাম—এমন সময়ে দূরে কি একটা বিকট গর্জন হইল। মনে করিলাম, বাঘ। মনে একটু আহ্লাদ হইল। বাঘে খাইলে সকল জ্বালা জুড়ায়। হাড় গোড় ভাঙ্গিয়া, রক্ত শুষিয়া খাইবে, ভাবিলাম তাও সহ্য করিব; শরীরের কষ্ট বৈ ত না। মরিতে পাইব, সেই পরম সুখ। অতএব কান্না বন্ধ করিয়া, একটু প্রফুল্ল হইয়া, স্থিরভাবে রহিলাম, বাঘের প্রতীক্ষা করিতে লাগিলাম। পাতার যতবার ঘস ঘস শব্দ হয়, ততবার মনে করি, ঐ সর্বদুঃখহর প্রাণস্নিগ্ধকর বাঘ আসিতেছে। তখন মনে হইল—যেখানে বড় ঝোপজঙ্গল, সেইখানে সাপ থাকিতে পারে। সাপের ঘাড়ে পা দিবার আশায় সেই জঙ্গলের ভিতর প্রবেশ করিলাম, তাহার ভিতরে কত বেড়াইলাম। হায়! মনুষ্য দেখিলে সকলেই পলায়—বনমধ্যে কত সর সর ঝট পট শব্দ শুনিলাম, কিন্তু সাপের ঘাড়ে ত পা পড়িল না; আমার পায়ে অনেক কাঁটা ফুটিল, অনেক বিছুটি লাগিল, কিন্তু কৈ? সাপে ত কামড়াইল না। আবার হতাশ হইয়া ফরিয়া আসিলাম, ক্ষুধা তৃষ্ণায় ক্লান্ত হইয়াছিলাম— আর বেড়াইতে পারিলাম না। একটা পরিষ্কার স্থান দেখিয়া বসিলাম। সহসা সম্মুখে এক ভল্লুক উপস্থিত হইল—মনে করিলাম, ভালুকের হাতেই মরিব। ভালুকটাকে তাড়া করিয়া মারিতে গেলাম। কিন্তু হায়! ভালুকটা আমায় কিছু বলিল না। সে গিয়া এক বৃক্ষের উপর উঠিল। বৃক্ষের উপর হইতে কিছু পরে ঝন করিয়া সহস্র মক্ষিকার শব্দ হইল। বুঝিলাম, এই বৃক্ষে মৌচাক আছে, ভালুক জানিত; মধু লুটিবার লোভে আমাকে ত্যাগ করিল।

শেষ রাত্রিতে একটু নিদ্রা আসিল—বসিয়া বসিয়া গাছে হেলান দিয়া আমি ঘুমাইয়া পড়িলাম।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *