» » দ্বাদশ পরিচ্ছেদ : অঙ্কুর

বর্ণাকার

দিন কয় মধ্যে, ক্রমে ক্রমে নগেন্দ্রের সকল চরিত্র পরিবর্তিত হইতে লাগিল। নির্মল আকাশে মেঘ দেখা দিল–নিদাঘকালের প্রদোষাকাশের মত, অকস্মাৎ সে চরিত্র মেঘাবৃত হইতে লাগিল। দেখিয়া সূর্যমুখী গোপনে আপনার অঞ্চলে চক্ষু মুছিলেন।

সূর্যমুখী ভাবিলেন, “আমি কমলের কথা শুনিব। স্বামীর চিত্তপ্রতি কেন অবিশ্বাসিনী হইব? তাঁহার চিত্ত অচলপর্বত–আমিই ভ্রান্ত বোধ হয়। তাঁহার কোন ব্যামোহ হইয়া থাকিবে।” সূর্যমুখী বালির বাঁধ বাঁধিল।

বাড়ীতে একটি ছোট রকম ডাক্তার ছিল। সূর্যমুখী গৃহিণী। অন্তরালে থাকিয়া সকলের সঙ্গেই কথা কহিতেন। বারেণ্ডার পাশে এক চিক থাকিত; চিকের পশ্চাতে সূর্যমুখী থাকিতেন। বারেণ্ডায় সম্বোধিত ব্যক্তি থাকিত, মধ্যে এক দাসী থাকিত; তাহার মুখে সূর্যমুখী কথা কহিতেন। এইরূপে সূর্যমুখী ডাক্তারের সঙ্গে কথা কহিতেন। সূর্যমুখী তাহাকে ডাকাইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “বাবুর অসুখ হইয়াছে, ঔষধ দাও না কেন?”

ডাক্তার। কি অসুখ, তাহা ত আমি জানি না। আমি ত অসুখের কোন কথা শুনি নাই।

সূ। বাবু কিছু বলেন নাই?

ডা। না–কি অসুখ?

সূ। কি অসুখ, তাহা তুমি ডাক্তার, তুমি জান না –আমি জানি?

ডাক্তার সুতরাং অপ্রতিভ হইল। “আমি গিয়া জিজ্ঞাসা করিতেছি,” এই বলিয়া ডাক্তার প্রস্থানের উদ্যোগ করিতেছিল, সূর্যমুখী তাহাকে ফিরাইলেন, বলিলেন, “বাবুকে কিছু জিজ্ঞাসা করিও না–ঔষধ দাও।”

ডাক্তার ভাবিল, মন্দ চিকিৎসা নহে। “যে আজ্ঞা, ঔষধের ভাবনা কি,” বলিয়া ডাক্তার পলায়ন করিল। পরে ডিস্পেন্সরিতে গিয়া একটু সোডা, একটু পোর্ট ওয়াইন, একটু সিরপফেরিমিউরেটিস, একটু মাথা মুণ্ড মিশাইয়া, শিশি পুরিয়া, টিকিট মারিয়া প্রত্যহ দুই বার সেবনের ব্যবস্থা লিখিয়া দিল। সূর্যমুখী ঔষধ খাওয়াইতে গেলেন; নগেন্দ্র শিশি হাতে লইয়া পড়িয় দেখিয়া বিড়ালকে ছুঁড়িয়া মারিলেন–বিড়াল পলাইয়া গেল–ঔষধ তাহার ল্যাজ দিয়া গড়িয়া পড়িতে পড়িতে গেল।

সূর্যমুখী বলিলেন “ঔষধ না খাও–তোমার কি অসুখ, আমাকে বল।”

নগেন্দ্র বিরক্ত হইয়া বলিলেন, “কি অসুখ?”

সূর্যমুখী বলিলেন, “তোমার শরীর দেখ দেখি কি হইয়াছে?” এই বলিয়া সূর্যমুখী একখানি দর্পণ আনিয়া নিকটে ধরিলেন। নগেন্দ্র তাঁহার হাত হইতে দর্পণ লইয়া দূরে নিক্ষিপ্ত করিলেন। দর্পণ চূর্ণ হইয়া গেল।

সূর্যমুখীর চক্ষু দিয়া জল পড়িল। দেখিয়া নগেন্দ্র চক্ষু রক্তবর্ণ করিয়া উঠিয়া গেলেন। বহির্বাটী গিয়া একজন ভৃত্যকে বিনাপরাধে প্রহার করিলেন। সে প্রহার সূর্যমুখীর অঙ্গে বাজিল।

ইতিপূর্বে নগেন্দ্র অত্যন্ত শীতলস্বভাব ছিলেন। এখন কথায় কথায় রাগ।

শুধু রাগ নয়। একদিন, রাত্রে আহারের সময় অতীত হইয়া গেল, তথাপি নগেন্দ্র অন্তঃপুরে আসিলেন না। সূর্যমুখী প্রতীক্ষা করিয়া বসিয়া আছেন। অনেক রাত্রি হইল। অনেক রাত্রে নগেন্দ্র আসিলেন ; সূর্যমুখী দেখিয়া বিস্মিত হইলেন। নগেন্দ্রের মুখ আরক্ত, চক্ষু আরক্ত নগেন্দ্র মদ্যপান করিয়াছেন। নগেন্দ্র কখন মদ্যপান করিতেন না। দেখিয়া সূর্যমুখী বিস্মিতা হইলেন।

সেই অবধি প্রত্যহ এইরূপ হইতে লাগিল। একদিন সূর্যমুখী, নগেন্দ্রের দুইটি চরণে হাত দিয়া গলদশ্রু কোনরূপে রুদ্ধ করিয়া, অনেক অনুনয় করিলেন ; বলিলেন, “কেবল আমার অনুরোধে ইহা ত্যাগ কর।” নগেন্দ্র জিজ্ঞাসা করিলেন, কি দোষ?”

জিজ্ঞাসার ভাবেই উত্তর নিবারণ হইল। তথাপি সূর্যমুখী উত্তর করিলেন, “দোষ কি, তাহা ত আমি জানি না। তুমি যাহা জান না, তাহা আমিও জানি না। কেবল আমার অনুরোধ।”

নগেন্দ্র প্রত্যুত্তর করিলেন, “সূর্যমুখী, আমি মাতাল, মাতালকে শ্রদ্ধা হয়, আমাকে শ্রদ্ধা করিও। নচেৎ আবশ্যক করে না।”

সূর্যমুখী ঘরের বাহিরে গেলেন। ভৃত্যের প্রহার পর্যন্ত নগেন্দ্রের সম্মুখে আর চক্ষের জল ফেলিবেন না, প্রতিজ্ঞা করিয়াছিলেন।

দেওয়ানজী বলিয়া পাঠাইয়াছিলেন, “মা ঠাকুরাণীকে বলিও–বিষয় গেল, আর থাকে না।”

“কেন?”

“বাবু কিছু দেখেন না। সদর মফস্বলের আমলারা যাহা ইচ্ছা তাহা করিতেছে। কর্তার অমনোযোগে আমাকে কেহ মানে না।” শুনিয়া সূর্যমুখী বলিলেন, “যাঁহার বিষয়, তিনি রাখেন, থাকিবে। না হয়, গেল গেলই।”

ইতিপূর্বে নগেন্দ্র সকলই স্বয়ং তত্ত্বাবধান করিতেন।

একদিন তিন চারি হাজার প্রজা নগেন্দ্রের কাছারির দরওয়াজায় জোড়হাত করিয়া আসিয়া দাঁড়াইল। “দোহাই হুজুর–নায়েব গোমস্তার দৌরাত্ম্যে আর বাঁচি না। সর্বস্ব কাড়িয়া লইল। আপনি না রাখিলে কে রাখে?”

নগেন্দ্র হুকুম দিলেন, “সব হাঁকায় দাও।”

ইতিপূর্বেই তাঁহার একজন গোমস্তা একজন প্রজাকে মারিয়া একটা টাকা লইয়াছিল। নগেন্দ্র গোমস্তার বেতন হইতে দশটি টাকা লইয়া প্রজাকে দিয়াছিলেন।

হরদেব ঘোষাল নগেন্দ্রকে লিখিলেন, “তোমার কি হইয়াছে? তুমি কি করিতেছ? আমি কিছু ভাবিয়া পাই না। তোমার পত্র ত পাইই না। যদি পাই, ত সে ছত্র দুই, তাহার মানে মাথা মুণ্ড, কিছুই নাই। তাতে কোন কথাই থাকে না। তুমি কি আমার উপর রাগ করিয়াছ? ত বল না কেন? মোকদ্দমা হারিয়াছ? তাই বা বল না কেন? আর কিছু বল না বল, শারীরিক ভাল আছ কি না বল।”

নগেন্দ্র উত্তর লিখিলেন, “আমার উপর রাগ করিও না–আমি অধঃপাতে যাইতেছি|”

হরদেব বড় বিজ্ঞ। পত্র পড়িয়া মনে করিলেন, “কি এ? অর্থচিন্তা? বন্ধুবিচ্ছেদ? দেবেন্দ্র দত্ত? না, এ প্রেম?”

কমলমণি সূর্যমুখীর আর একখানি পত্র পাইলেন। তাহার শেষ এই “একবার এসো! কমলমণি! ভগিনি! তুমি বই আর আমার সুহৃদ কেহ নাই। একবার এসো!”

Leave a Reply