সেই দিন প্রদোষকালে উদ্যানমধ্যস্থ বাপীতটে বসিয়া কুন্দনন্দিনী। এই দীর্ঘিকা অতি সুবিস্তৃতা; তাহার জল অতি পরিষ্কার এবং সর্বদা নীলপ্রভ। পাঠকের স্মরণ থাকিতে পারে, এই পুষ্করিণীর পশ্চাতে পুষ্পোদ্যান। পুষ্পোদ্যানমধ্যে এক শ্বেতপ্রস্তররচিত লতামণ্ডপ ছিল। সেই লতামণ্ডপের সম্মুখেই পুষ্করিণীতে অবতরণ করিবার সোপান। সোপান প্রস্তরবৎ ইষ্টকে নির্মিত, অতি প্রশস্ত এবং পরিষ্কার। তাহার দুই ধারে, দুইটি বহুকালের বড় বকুল গাছ। সেই বকুলের তলায়, সোপানের উপরে কুন্দনন্দিনী, অন্ধকার প্রদোষে একাকিনী বসিয়া স্বচ্ছ সরোবরহৃদয়ে প্রতিফলিত নক্ষত্রাদিসহিত আকাশপ্রতিবিম্ব নিরীক্ষণ করিতেছিলেন। কোথাও কতকগুলি লাল ফুল অন্ধকারে অস্পষ্ট লক্ষ্য হইতেছিল। দীর্ঘিকার অপর তিন পার্শ্বে, আম্র, কাঁটাল, জাম, লেবু, লিচু নারিকেল, কুল, বেল প্রভৃতি ফলবান ফলের গাছ, ঘনশ্রেণীবদ্ধ হইয়া অন্ধকারে অসমশীর্ষ প্রাচীরবৎ দৃষ্ট হইতেছিল। কদাচিৎ তাহার শাখায় বসিয়া মাচাড় পাখী বিকট রব করিয়া নিঃশব্দ সরোবরকে শব্দিত করিতেছিল। শীতল বায়ু, সরোবর পার হইয়া ইন্দীবরকোরককে ঈষন্মাত্র বিধূত করিয়া, আকাশচিত্রকে স্বল্পমাত্র কম্পিত করিয়া কুন্দনন্দিনীর শিরঃস্থ বকুলপত্রমালায় মর্মর শব্দ করিতেছিল এবং নিদাঘপ্রস্ফুটিত বকুল পুষ্পের গন্ধ চারি দিকে বিকীর্ণ করিতেছিল। বকুল পুষ্প সকল নিঃশব্দে কুন্দনন্দিনীর অঙ্গে এবং চারি দিকে ঝরিয়া পড়িতেছিল। পশ্চাৎ হইতে অসংখ্য মল্লিকা, যূথিকা এবং কামিনীর সুগন্ধ আসিতেছিল। চারিদিকে, অন্ধকারে, খদ্যোতমালা স্বচ্ছ বারির উপর উঠিতেছিল, পড়িতেছিল, ফুটিতেছিল, নিবিতেছিল। দুই একটা বাদুড় ডাকিতেছে–দুই একটা শৃগাল অন্য পশু তাড়াইবার তাহাদিগের যে শব্দ, সেই শব্দ করিতেছে– দুই একখানা মেঘ আকাশে পথ হারাইয়া বেড়াইতেছে– দুই একটা তারা মনের দুঃখে খসিয়া পড়িতেছে। কুন্দনন্দিনী মনের দুঃখে ভাবিতেছেন। কি ভাবনা ভাবিতেছেন? এইরূপ;-“ভাল, সবাই আগে মলো–মা মলো, দাদা মলো, বাবা মলো, আমি মলেম না কেন? যদি না মলেম ত এখানে এলাম কেন? ভাল, মানুষ কি মরিয়া নক্ষত্র হয়?” পিতার পরলোকযাত্রার রাত্রে কুন্দ যে স্বপ্ন দেখিয়াছিল, কুন্দের আর তাহা কিছুই মনে ছিল না; কখনও মনে হইত না; এখনও তাহা মনে হইল না। কেবল আভাসমাত্র মনে আসিল। এইমাত্র মনে হইল, যেন সে কবে মতাকে স্বপ্ন দেখিয়াছিল, তাহার মা যেন, তাহাকে নক্ষত্র হইতে বলিয়াছেন। কুন্দ ভাবিতে লাগিল, “ভাল, মানুষ মরিলে কি নক্ষত্র হয়? তা হলে ত বাবা, মা, সবাই নক্ষত্র হইয়াছেন? তবে তাঁরা কোন্ নক্ষত্রগুলি? ঐটি? না ঐটি? কোন‍্‍টি কে? কেমন করিয়া জানিব? তা যেটিই যিনি হউন, আমায় ত দেখতে পেতেছেন? আমি যে এত কাঁদি–তা দূরে হউক, ও আর ভাবি না–বড় কান্না পায়। কেঁদে কি হবে? আমার ত কপালে কান্নাই আছে–নহিলে মা–আবার ঐ কথা! দূর হউক–ভাল, মরিলে হয় না? কেমন করিয়া? জলে ডুবিয়া? বেশ ত! মরিলে নক্ষত্র হব–তা হলে হব ত? দেখিতে পাব–রোজ রোজ দেখিতে পাব–কাকে? কাকে, মুখে বলিতে পারি নে কি? আচ্ছা, নাম মুখে আনিতে পারি নে কেন? এখন ত কেহ নাই–কেহ শুনিতে পাবে না। একবার মুখে আনিব? কেহ নাই–মনের সাধে নাম করি।ন–নগ–নগেন্দ্র! নগেন্দ্র, নগেন্দ্র,নগেন্দ্র, নগেন্দ্র, নগেন্দ্র। নগেন্দ্র আমার নগেন্দ্র! আলো! আমার নগেন্দ্র? আমি কে? সূর্যমুখীর নগেন্দ্র। কতই নাম করিতেছি–হলেম কি? আচ্ছা সূর্যমুখীর সঙ্গে বিয়ে না হয়ে যদি আমার–সঙ্গে হতো–দূর হউক–ডুবেই মরি। আচ্ছা, যেন এখন ডুবিলাম–কাল ভেসে উঠবো–তবে সবাই শুনবে, শুনে নগেন্দ্র–নগেন্দ্র! –নগেন্দ্র! –নগেন্দ্র! আবার বলি–নগেন্দ্র নগেন্দ্র নগেন্দ্র! -নগেন্দ্র শুনে কি বলিবেন? ডুবে মরা হবে না–ফুলে পড়িয়া থাকিব–দেখিতে রাক্ষসীর মত হব। যদি তিনি দেখেন? বিষ খেয়ে ত মরিতে পারি? কি বিষ খাব? বিষ কোথা পাব–কে আমায় এনে দিবে? দিলে যেন–মরিতে পারিব কি? পারি–কিন্তু আজি না– একবার আকাঙ্ক্ষা ভরিয়া মনে করি–তিনি আমায় ভালবাসেন। কমল কি কথাটি বলতে বলতে বলিল না? সে ঐ কথাই। আচ্ছা, সে কথা সত্য?–কিন্তু কমল জানিবে কিসে? আমি পোড়ারমুখী জিজ্ঞাসা করিতে পারিলাম না। ভালবাসেন? কিসে ভালবাসেন? কি দেখে ভালবাসেন, রূপ না গুণ? রূপ–দেখি?” (এই কহিয়া কালামুখী স্বচ্ছ সরোবরে আপনার প্রতিবিম্ব দেখিতে গেল, কিন্তু কিছুতেই দেখিতে না পাইয়া আবার পূর্বস্থানে আসিয়া বলিল) “দূর হউক, যা নয় তা ভাবি কেন? আমার চেয়ে সূর্যমুখী সুন্দর; আমার চেয়ে হরমণি সুন্দর; বিশু সুন্দর; মুক্ত সুন্দর; ‘চন্দ্র’ সুন্দর; প্রসন্ন সুন্দর; বামা সুন্দর; প্রমদা সুন্দর; আমার চেয়ে হীরা দাসীও সুন্দরী। হীরাও আমার চেয়ে সুন্দর? হাঁ; শ্যামবর্ণ হলে কি হয়–মুখ আমার চেয়ে সুন্দর। তা রূপ ত গোল্লাই গেল–গুণ কি? আচ্ছা দেখি দেখি ভেবে।-কই, মনে ত হয় না। কে জানে! কিন্তু মরা হবে না, ঐ কথা ভাবি। মিছে কথা! তা মিছে কথাই ভাবি। মিছে কথাকে সত্য বলিয়া ভাবিব। কিন্তু কলিকাতায় যেতে হবে যে, তা ত যেতে পারিব না; দেখিতে পাব না যে। আমি যেতে পারব না–পারব না–পারব না। তা না গিয়াই বা কি করি? যদি কমলের কথা সত্য হয়, তবে ত যারা আমার জন্য এত করেছে, তাহাদের ত সর্বনাশ করিতেছি। সূর্যমুখীর মনে কিছু হয়েছে বুঝিতে পারি। সত্যই হউক, মিথ্যাই হউক, কাজে কাজেই আমাকে যেতে হবে। তা পারিব না। তাই ডুবে মরি। মরিবই মরিব। বাবা গো! তুমি কি আমাকে ডুবিয়া মরিবার জন্য রাখিয়া গিয়াছিলে__”

কুন্দ তখন দুই চক্ষে হাত দিয়া কাঁদিতে লাগিল। সহসা অন্ধকার গৃহে প্রদীপ জ্বালার ন্যায়, কুন্দের সেই স্বপ্ন-বৃত্তান্ত সুস্পষ্ট মনে পড়িল। কুন্দ তখন বিদ্যুৎস্পৃষ্টার ন্যায় গাত্রোত্থান করিল। “আমি সকল ভুলিয়া গিয়াছি–আমি কেন ভুলিলাম? মা আমাকে দেখা দিয়াছিলেন–মা আমার কপালের লিখন জানিতে পারিয়া আমায় ঐ নক্ষত্রলোকে যাইতে বলিয়াছিলেন–আমি কেন তাঁর কথা শুনলেম না–আমি কেন গেলাম না! –আমি কেন মলেম না! আমি এখনও বিলম্ব করিতেছি কেন? আমি এখনও মরিতেছি না কেন? আমি এখনই মরিব।” এই ভাবিয়া কুন্দ ধীরে ধীরে সেই সরোবরসোপান অবতরণ আরম্ভ করিল। কুন্দ নিতান্ত অবলা–নিতান্ত ভীরুস্বভাবসম্পন্না–প্রতি পদার্পণে ভয় পাইতেছিল–প্রতি পদার্পণে তাহার অঙ্গ শিহরিতেছিল। তথাপি অস্খলিতসঙ্কল্পে সে মাতার আজ্ঞাপালনার্থে ধীরে ধীরে যাইতেছিল। এমত সময় পশ্চাৎ হইতে কে অতি ধীরে ধীরে তাহার পৃষ্ঠে অঙ্গুলিস্পর্শ করিল। বলিল, “কুন্দ!” কুন্দ দেখিল–সে অন্ধকারে দেখিবামাত্র চিনিল–নগেন্দ্র। কুন্দের সে দিন আর মরা হলো না।

আর নগেন্দ্র! এই কি তোমার এত কালের সুচরিত্র? এই কি তোমার এত কালের শিক্ষা? এই কি সূর্যমুখীর প্রাণপণ প্রণয়ের প্রতিফল! ছি ছি! দেখ, তুমি চোর! চোরের অপেক্ষাও হীন। চোর সূর্যমুখীর কি করিত? তাহার গহনা চুরি করিত, অর্থহানি করিত, কিন্তু তুমি তাহার প্রাণহানি করিতে আসিয়াছ। চোরকে সূর্যমুখী কখন কিছু দেয় নাই ; তবু সে চুরি করিলে চোর হয়। আর সূর্যমুখী তোমাকে সর্বস্ব দিয়াছে–তবু তুমি চোরের অধিক চুরি করিতে আসিয়াছ! নগেন্দ্র, তুমি মরিলেই ভাল হয়। যদি সাহস থাকে, তবে তুমি গিয়া ডুবিয়া মর।

আর ছি! ছি! কুন্দনন্দিনি! তুমি চোরের স্পর্শে কাঁপিলে কেন? ছি! ছি! কুন্দনন্দিনী!–চোরের কথা শুনিয়া তোমার গায়ে কাঁটা দিল কেন? কুন্দনন্দিনী!–দেখ, পুষ্করিণীর জল পরিষ্কার, সুশীতল, সুবাসিত–বায়ূ তাহার নীচে তারা কাঁপিতেছে। ডুবিবে? ডুবিয়া মর না? কুন্দনন্দিনী মরিতে চাহে না।

চোর বলিল, “কুন্দ। কলিকাতায় যাইবে?”

কুন্দ কথা কহিল না–চক্ষু মুছিল–কথা কহিল না।

চোর বলিল, “কুন্দ! ইচ্ছাপূর্বক যাইতেছ?”

ইচ্ছাপূর্বক! হরি! হরি‌‌! কুন্দ আবার চক্ষু মুছিল–কথা কহিল না।

“কুন্দ–কাঁদিতেছ কেন?” কুন্দ এবার কাঁদিয়া ফেলিল। তখন নগেন্দ্র বলিতে লাগিলেন, “শুন কুন্দ! আমি বহু কষ্টে এত দিন সহ্য করিয়াছিলাম. কিন্তু আর পারিলাম না। কি কষ্টে যে বাঁচিয়া আছি, তাহা বলিতে পারি না। আপনার সঙ্গে যুদ্ধ করিয়া আপনি ক্ষত বিক্ষত হইয়াছি। ইতর হইয়াছি, মদ খাই। আর পারি না। তোমাকে ছাড়িয়া দিতে পারি না। শুন, কুন্দ! এখন বিধবাবিবাহ চলিত হইতেছে– আমি তোমাকে বিবাহ করিব। তুমি বলিলেই বিবাহ করি।”

কুন্দ এবার কথা কহিল। বলিল, “না।”

আবার নগেন্দ্র বলিলেন, “কেন কুন্দ! বিধবার বিবাহ কি অশাস্ত্র?” কুন্দ আবার বলিল, “না।”

নগেন্দ্র বলিল, “তবে না কেন? বল বল-বল–আমার গৃহিণী হইবে কি না? আমায় ভালবাসিবে কি না?”

কুন্দ বলিল, “না।”

তখন নগেন্দ্র যেন সহস্রমুখে অপরিমিত প্রেমপরিপূর্ণ মর্মভেদী কত কথা বলিলেন। কুন্দ বলিল “না।”

তখন নগেন্দ্র চাহিয়া দেখিলেন, পুষ্করিণী নির্মল, সুশীতল–কুসুম-বাস-সুবাসিত–পবনহিল্লোলে তন্মধ্যে তারা কাঁপিতেছে,-ভাবিলেন, “উহার মধ্যে শয়ন কেমন?”

অন্তরীক্ষে যেন কুন্দ বলিতে লাগিল, “না।” বিধবার বিবাহ শাস্ত্র আছে। তাহার জন্য নয়। তবে কুন্দ ডুবিয়া মরিল না কেন? স্বচ্ছ বারি–শীতল জল–নীচে নক্ষত্র নাচিতেছে–কুন্দ ডুবিয়া মরিল না কেন?

Leave a Reply