» » একবিংশ পরিচ্ছেদ : হীরার কলহ–বিষবৃক্ষের মুকুল

তা ত হলো। কুন্দ বশ হবে! কিন্তু সূর্যমুখী নগেন্দ্রের দুই চক্ষের বিষ না হলে ত কিছুতেই কিছু হবে না। গোড়ার কাজ সেই। হীরা এক্ষণে তাহাদের অভিন্ন হৃদয় ভিন্ন করিবার চেষ্টায় রহিল।

এক দিন প্রভাত হইলে পাপ হীরা মুনিব-বাড়ী আসিয়া গৃহকার্যে প্রবৃত্তা হইল। কৌশল্যানাম্নী আর এক জন পরিচারিকা দত্তগৃহে কাজ করিত, এবং হীরা প্রধানা বলিয়া ও প্রভুপত্নীর প্রসাদপুরস্কারভাগিনী বলিয়া তাহার হিংসা করিত। হীরা তাহাকে বলিল, “কুশি দিদি! আজ আমার গা কেমন কেমন করতেছে, তুই আমার কাজগুলি কর না?” কৌশল্যা হীরাকে ভয় করিত, অগত্যা স্বীকৃত হইয়া বলিল, “তা করিব বৈ কি। সকলেরই ভাই শরীরের ভাল মন্দ আছে–তা এক মুনিবের চাকর–করিব না?” হীরার ইচ্ছা ছিল যে, কৌশল্যা যে উত্তরই দিউক না, তাহাতেই ছল ধরিয়া কলহ করিবে। অতএব তখন মস্তক হেলাইয়া, তর্জন গর্জন করিয়া কহিল, “কি লা কুশি–তোর যে বড় আস্পর্ধা দেখতে পাই? তুই গালি দিস।” কৌশল্যা চমৎকৃত হইয়া বলিল, “আ মরি! আমি কখন গালি দিলাম?”

হী। আ মলো! আবার বলে কখন গাল দিলাম? কেন শরীরের ভাল মন্দ কি লা? আমি মরতে বসেছি না কি? আমাকে শরীরের ভাল মন্দ দেখাবেন, লোকে বোলবে, উনি আশীর্বাদ করলেন! তোর শরীরের ভাল মন্দ হউক।

কৌ। হয় হউক। তা কেন রাগ করিস কেন? মরিতে ত হবেই একদিন–যম ত আর তোকেও ভুলবে না, আমাকেও ভুলবে না।

হী। তোমাকে যেন প্রাতর্বাক্যে কখনও না ভোলে। তুমি যেন হিংসাতেই মর! শীগ‍্‍গির অল্পাই যাও, নিপাত যাও, নিপাত যাও, নিপাত যাও! তুমি যেন দুটি চক্ষের মাথা খাও!

কৌশল্যা আর সহ্য করিতে পারিল না। তখন কৌশল্যাও আরম্ভ করিল, “তুমি দুটি চক্ষের মাথা খাও! তুমি নিপাত যাও! তোমায় যেন যম না ভোলে! পোড়ারমুখি! আবাগি! শতেক খোয়ারি!” কোন্দল-বিদ্যায় হীরার অপেক্ষা কৌশল্যা পটুতরা। সুতরাং হীরা পাটকেলটি খাইল।

হীরা তখন প্রভুপত্নীর নিকট নালিশ করিতে চলিল। যাইবার সময়ে যদি হীরার মুখ কেহ নিরীক্ষণ করিয়া দেখিত, তবে দেখিতে পাইত যে, হীরার ক্রোধলক্ষণ কিছুই নাই, বরং অধরপ্রান্তে একটু হাসি আছে। হীরা সূর্যমুখীর নিকট যখন গিয়া উপস্থিত হইল, তখন বিলক্ষণ ক্রোধলক্ষণ–এবং সে প্রথমেই স্ত্রীলোকের ঈশ্বরদত্ত অস্ত্র ছাড়িল অর্থাৎ কাঁদিয়া দেশ ভাসাইল।

সূর্যমুখী নালিশী আরজি মোলাহেজা করিয়া, বিহিত বিচার করিলেন। দেখিলেন, হীরারই দোষ। তথাপি হীরার অনুরোধে কৌশল্যাকে যৎকিঞ্চিৎ অনুযোগ করিলেন। হীরা তাহাতে সন্তুষ্ট না হইয়া বলিল, “ও মাগীকে ছাড়াইয়া দাও, নহিলে আমি থাকিব না।” তখন সূর্যমুখী হীরার উপর বিরক্ত হইলেন। বলিলেন, “হীরে তোর বড় আদর বাড়িয়াছে। তুই আগে দিলি গাল–দোষ সব তোর–আবার তোর কথায় ওকে ছাড়াইব? আমি এমন অন্যায় করিতে পারিব না–তোর যাইতে ইচ্ছা হয় যা, আমি থাকিতে বলি না।”

হীরা ইহাই চায়। তখন “আচ্ছা, চল্লেম” বলিয়া হীরা চক্ষের জলে মুখ ভাসাইতে ভাসাইতে বহির্বাটীতে বাবুর নিকট গিয়া উপস্থিত হইল।

বাবু বৈঠকখানায় একা ছিলেন–এখন একাই থাকিতেন। হীরা কাঁদিতেছে দেখিয়া নগেন্দ্র বলিলেন, “হীরে, কাঁদিতেছিস কেন?”

হী। আমার মাহিনা পত্র হিসাব করিয়া দিতে হুকুম করুন।

ন। (সবিস্ময়ে) সে কি? কি হয়েছে?

হী। আমার জবাব হয়েছে। মা ঠাকুরাণী আমাকে জবাব দিয়াছেন।

ন। কি করেছিস তুই?

হী। কুশি আমাকে গালি দিয়াছিল–আমি নালিশ করিয়াছিলাম। তিনি তার কথায় বিশ্বাস করিয়া আমাকে জবাব দিলেন।

নগেন্দ্র মাথা নাড়িয়া হাসিতে হাসিতে বলিলেন, “সে কাজের কথা নয়, হীরে, আসল কথা কি বল।”

হীরা তখন ঋজু হইয়া বলিল, “আসল কথা, আমি থাকিব না।”

ন। কেন?

হী। মা ঠাকুরাণীর মুখ বড় এলোমেলো হয়েছে–কারে কখন কি বলেন, ঠিক নাই।

নগেন্দ্র ভ্রূ কুঞ্চিত করিয়া তীব্রস্বরে বলিলেন, “সে কি?”

হীরা যাহা বলিতে আসিয়াছিল, তাহা এইবার বলিল, “সেদিন কুন্দঠাকুরাণীকে কি না বলিয়াছিলেন। শুনিয়া কুন্দঠাকুরাণী দেশত্যাগী হইয়াছেন। আমাদের ভয়, পাছে আমাদের সেইরূপ কোন্ দিন কি বলেন,-আমরা তা হলে বাঁচিব না। তাই আগে হইতে সরিতেছি।”

ন। সে কি কথা?

সূ। তখন সে কথা ভাবি নাই। এখন ভাবিতেছি।

ন। ভাবিলে না কেন?

সূ। আমার মনের ভ্রান্তি জন্মিয়াছিল। বলিতে বলিতে সূর্যমুখী–পতিপ্রাণা–সাধ্বী–নগেন্দ্রের চরণপ্রান্তে ভূতলে উপবেশন করিলেন, এবং নগেন্দ্রের উভয় চরণ দুই হস্তে গ্রহণ করিয়া নয়নজলে সিক্ত করিলেন। তখন মুখ তুলিয়া বলিলেন, “প্রাণাধিক তুমি। কোন কথা এ পাপ মনের ভিতর থাকিতে তোমার কাছে লুকাইব না। আমার অপরাধ লইবে না?”

নগেন্দ্র বলিলেন, “তোমায় বলিতে হইবে না। আমি জানি, তুমি সন্দেহ করিয়াছিলে যে, আমি কুন্দনন্দিনীতে অনুরক্ত।”

সূর্যমুখী নগেন্দ্রের যুগল চরণে মুখ লুকাইয়া কাঁদিতে লাগিলেন। আবার সেই শিশিরসিক্ত-কমলতুল্য ক্লিষ্ট মুখমণ্ডল উন্নত করিয়া, সর্বদুঃখাপহারী স্বামিমুখপ্রতি চাহিয়া বলিলেন, “কি বলিব তোমায়? আমি যে দুঃখ পাইয়াছি, তাহা কি তোমায় বলিতে পারি? মরিলে পাছে তোমার দুঃখ বাড়ে, এই জন্য মরি নাই। নহিলে যখন জানিয়াছিলাম, অন্যা তোমার হৃদয়ভাগিনী–আমি তখন মরিতে চাহিয়াছিলাম। মুখের মরা নহে–যেমন সকলে মরিতে চাহে, তেমন মরা নহে; আমি যথার্থ আন্তরিক অকপটে মরিতে চাহিয়াছিলাম। আমার অপরাধ লইও না।”

নগেন্দ্র অনেকক্ষণ স্থিরভাবে থাকিয়া, শেষ দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করিয়া বলিলেন, “সূর্যমুখী! অপরাধ সকলই আমার। তোমার অপরাধ কিছুই নাই। আমি যথার্থ তোমার নিকট বিশ্বাসহন্তা। যথার্থই আমি তোমাকে ভুলিয়া কুন্দনন্দিনীতে–কি বলিব? আমি যে যন্ত্রণা পাইয়াছি, যে যন্ত্রণা পাইতেছি, তাহা তোমাকে কি বলিব? তুমি মনে করিয়াছ, আমি চিত্ত দমনের চেষ্টা করি নাই; এমত ভাবিও না। আমি যত আমাকে তিরস্কার করিয়াছি, তুমি কখনও তত তিরস্কার করিবে না। আমি পাপাত্মা–আমার চিত্ত বশ হইল না।”

সূর্যমুখী আর সহ্য করিতে পারিলেন না, জোড়হাত করিয়া কাতরস্বরে বলিলেন, “যাহা তোমার মনে থাকে, থাক্–আমার কাছে আর বলিও না। তোমার প্রতি কথায় আমার বুকে শেল বিঁধিতেছে।–আমার অদৃষ্টে যাহা ছিল, তাহা ঘটিয়াছে–আর শুনিতে চাহি না। এ সকল আমার অশ্রাব্য।”

“না। তা নয়, সূর্যমুখী! আরও শুনিতে হইবে। যদি কথা পাড়িলে, তবে মনের কথা ব্যক্ত করিয়া বলি–কেন না, অনেক দিন হইতে বলি বলি করিতেছি। আমি এ সংসার ত্যাগ করিব। মরিব না–কিন্তু দেশান্তরে যাইব। বাড়ী ঘর সংসারে আর সুখ নাই। তোমাতে আমার আর সুখ নাই। আমি তোমার অযোগ্য স্বামী। আমি আর কাছে থাকিয়া তোমাকে ক্লেশ দিব না। কুন্দনন্দিনীকে সন্ধান করিয়া আমি দেশ-দেশান্তরে ফিরিব। তুমি এ গৃহে গৃহিণী থাক। মনে মনে ভাবিও তুমি বিধবা–যাহার স্বামী এরূপ পামর, সে বিধবা নয় ত কি? কিন্তু আমি পামর হই আর যাই হই, তোমাকে প্রবঞ্চনা করিব না। আমি অন্যাগতপ্রাণ হইয়াছি–সে কথা তোমাকে স্পষ্ট বলিব; এখন আমি দেশত্যাগ করিয়া চলিলাম। যদি কুন্দনন্দিনীকে ভুলিতে পারি, তবে আবার আসিব! নচেৎ তোমার সঙ্গে এই সাক্ষাৎ!”

এই শেলসম কথা শুনিয়া সূর্যমুখী কি বলিবেন? কয়েক মুহূর্ত প্রস্তরময়ী মূর্তিবৎ পৃথিবীপানে চাহিয়া রহিলেন। পরে সেই ভূতলে অধোমুখে শুইয়া পড়িলেন। মাটিতে মুখ লুকাইয়া সূর্যমুখী–কাঁদিলেন কি? হত্যাকারী ব্যাঘ্র যেরূপ হত জীবের যন্ত্রণা দেখে, নগেন্দ্র, সেইরূপ স্থিরভাবে দাঁড়াইয়া দেখিতেছিলেন। মনে মনে বলিতেছিলেন, “সেই ত মরিতে হইবে–তার আজ কাল কি? জগদীশ্বরের ইচ্ছা,-আমি কি করিব? আমি কি মনে করিলে ইহার প্রতীকার করিতে পারি? আমি মরিতে পারি, কিন্তু তাহাতে সূর্যমুখী বাঁচিবে?”

না ; নগেন্দ্র! তুমি মরিলে সূর্যমুখী বাঁচিবে না, কিন্তু তোমার মরাই ভাল ছিল।

দণ্ডেক পরে সূর্যমুখী উঠিয়া বসিলেন। আবার স্বামীর পায়ে ধরিয়া বলিলেন, “এক ভিক্ষা।”

ন। কি?

সূ। আর এক মাস মাত্র গৃহে থাক। ইতিমধ্যে যদি কুন্দনন্দিনীকে না পাওয়া যায়, তবে তুমি দেশত্যাগ করিও। আমি মানা করিব না।

নগেন্দ্র মৌনভাবে বাহির হইয়া গেলেন। মনে মনে আর এক মাস থাকিতে স্বীকার করিলেন। সূর্যমুখীও তাহা বুঝিলেন। তিনি গমনশীল নগেন্দ্রের মূর্তিপ্রতি চাহিয়াছিলেন। সূর্যমুখী মনে মনে বলিতেছিলেন, “আমার সর্বস্ব ধন! তোমার পায়ের কাঁটাটি তুলিবার জন্য প্রাণ দিতে পারি। তুমি পাপ সূর্যমুখীর জন্য দেশত্যাগী হইবে? তুমি বড়, না আমি বড়?”

Leave a Reply