» » বাস্তেন দ্বীপে অভিযান

বর্ণাকার

অজেয় রায়

বাস্তেন দ্বীপে অভিযান

সাত

আমাদের ভাগ্য ভালো। হামিদ মাঝি নৌকো সমেত ফিরতে দেরি করেনি।

এবার ফেরার পালা। আমরা গোছগাছ শুরু করি। হামিদ আর তার দুই মাঝি অবশ্যই সেই রাতে বাস্তেন দ্বীপে কাটাল না। রাত কাটাতে চলে গেল তাদের পুরোনো আস্তানায় শিলালিপি দ্বীপে।

সে রাতে বৃষ্টি হল খুব। অঝোর ধারায় ঘণ্টা তিনেক।

পরদিন সকালে অবশ্য আকাশ দিব্যি মেঘমুক্ত। হামিদরা বাস্তেন দ্বীপে ফিরে এল সকাল সকাল। খানিক বাদেই আমরা রওনা হলাম নৌকোয়। জাকার্তায় কয়েক দিন কাটিয়ে ফিরে যাব দেশে।

আমাদের ফেরার আগে থেকেই মিকি সুনন্দকে পাকড়েছিল—কয়েকটা মাছের রান্না আর সেই মাংসের পোলাও আপনি যেমন বেঁধেছিলেন ফর্মুলাটা আমায় ভালো করে শিখিয়ে দিন। বাড়ি ফিরে স্ত্রীকে শেখাব রান্নাগুলো। ওঃ দারুণ খেতে।

মুশকিল। সুনন্দর রান্না খেয়ে মিকির স্বাদবোধ পালটে গেছে। ঘরের রান্না আর বুঝি পছন্দ হচ্ছে না।

সুনন্দর অবশ্য আপত্তি নেই শেখাতে। তার মশলার স্টক এখনো কিছু বাকি। নৌকোয় যেতে যেতে সে মিকিকে হাতে কলমে রান্না শেখায়।

জাকার্তা হোটেলে বসে কথা বলছি আমি, সুনন্দ, মামাবাবু। মামাবাবু হঠাৎ বললেন, সেদিন ভাঙিনি ব্যাপারটা, আজ বলছি। জানো, বাস্তেন আইল্যান্ডে আমি সোনার খোঁজ পেয়েছি।

—অ্যাঁ সোনা! আমি ও সুনন্দ চমকাই। কোথায়?

—ঠিক কোথায় আছে ডিপোজিট বলতে পারব না, তবে নির্ঘাৎ আছে কোথাও ঝরনার কাছাকাছি মাটির তলায়। ঝরনার দুধারে মাটিতে বালিতে আর ঝরনাটা যেখানে সমুদ্রতটে পড়েছে সেখানের বালিতে সোনা পেয়েছি।

——সোনা চিনলেন কীভাবে? সুনন্দর প্রশ্নে যেন অবিশ্বাস।

——বালি মাটি প্যানিং করে। ঝরনার ধারে ধারে ছড়ানো নুড়ি পাথরের গুঁড়ো প্যানিং করে। সোনা খুঁজতে প্যানিং পদ্ধতিটা জানো?

—না। ঠিক জানি না। তবে নাম শুনেছি। আমরা উভয়ে আমতা আমতা করি।

—সোজা ব্যাপার। একটা বড় কানা উঁচু সপ্যানের মতো গোল পাত্র চাই। যার নিচটা সমান আর ওপরের ফাঁক প্যানের তলার চেয়ে বড়। ময়লা মেশানো বালিমাটি বা পাথরের গুড়ো প্যানে ফেলে অনেকখানি জল মেশাও। আস্তে আস্তে ঝাঁকাও, নাডো, ঘরিয়ে ঘুরিয়ে। স্যাম্পল—এ মেশা ভারীধাতু যেমন, সোনা লোহা নিচে প্যানের তলায় থিতিয়ে জড়ো হবে। বাজে ময়লা জলে গুলে যাবে বা ভাসবে। আস্তে আস্তে ওপরের ঘোলা ময়লা জল ফেলে দাও। নিচে জমা সোনা থাকলে তার হলুদ রং দিব্যি চোখে পড়বে। সেই অতি ক্ষুদ্র কণার মতো সোনার গুঁড়ো বা টুকরো আরও ছেঁকে ছেঁকে বের করতে হয়। ডিটেলস—এ যাচ্ছি না এখন। জেনো, এই কায়দাতেই সুবর্ণরেখা নদীর দুধারের বালি ছেঁকে স্থানীয় লোক সোনার গুঁড়ো বা টুকরো জোগাড় করে।

—এরপরেও আছে অ্যামালগামেশন পদ্ধতি। প্যানের তলায় থিতিয়ে—পড়া সোনার রেণু অন্য খাত থেকে আলাদা করতে। সোনার এমন কিছু গুণ আছে যাতে মাটি, বালি বা পাথরের গুঁড়ো থেকে সোনাকে আলাদা করা যায় সহজেই। মানে ক্যাম্পে বসে আমার এ সরঞ্জামের সাহায্যেই। যুগে যুগে স্বর্ণসন্ধানীরা পৃথিবীর নানান জায়গায় নদী বা অজীরে এমনি সহজ উপায়েই সোনা খুঁজেছে। আজও খোঁজে।

—সোনার আকরের ওপর দিয়ে ঝরনা বা নদীর জল আসার সময় অতি ক্ষুদ্র সোনার টুকরো কণা বয়ে নিয়ে আসে আরও সব খনিজ পদার্থ ধুলো ময়লার সঙ্গে। সেই সোনা। ন বা নদীর গতিপথের দু পাশে মাটিতে বালিতে মেশে। এছাড়া জলের স্রোত বয়ে আনে সোনা মেশানো পাথরের নুড়ি।

—তুমি বুঝলে কীভাবে ঝরনার ধারে সোনা আছে? আগে জানতে? প্রশ্ন করে সুনন্দ।

—মোটই নয়। সন্দেহটা জাগে বাস্তেনের পোড়ো ভিটে দেখতে গিয়ে। সেখানে কয়েকটা ভাঙা মরচেধরা প্যান দেখি। সোনা খুঁজতে প্রসপেকটররা ঠিক এমনি প্যান ব্যবহার করে। তাতেই হয় সন্দেহ। কী কাজে লাগত প্যানগুলো? যে পাত্রগুলো আমরা সঙ্গে এনেছি তাই থেকে একটা কানা উঁচু পাত্র জোগাড় করি গোল্ড প্যানিং—এর কাজ চালাতে।

—তামা সোনা সব রয়েছে একই জায়গায়? সুনন্দ খুঁতখুঁত করে।

—থাকতেই পারে। অস্বাভাবিক কিছু নয়, বলেন মামাবাবু, ইন্দোনেশিয়ার অনেক জায়গাতেই তামা সোনা একই সঙ্গে পাওয়া গেছে।

এমনকি কোথাও কোথাও এদের সঙ্গে রুপোও মিলেছে। সব মিলেমিশে আছে। তবে সব ধাতুই বেশি পরিমাণে নাও থাকতে পারে।

—সোনা বের করে বাস্তেন করত কী? নিশ্চয় বিক্রি করত? আমি মুখ খুলি।

মামাবাবু বলেন, আমারও তাই সন্দেহ। জাকার্তায় তো যেত মাঝে মাঝেই। শিল্পকর্ম বিক্রি এবং তার সঙ্গে গোপনে সোনা বিক্রি দুটোই হয়তো তার রোজগারের উপায় ছিল। তবে মনে হয় ওর অ্যাসিস্ট্যান্ট পো সোনার ব্যাপারটা জানত না। তাহলে সে কি আর ওই দ্বীপ ছেড়ে চলে যায় বাস্তেন মারা যাবার পর?

সুনন্দ বলল, সোনার খোঁজটা মিকিকে জানাবে না? বেচারা একদিন দুঃখ করছিল, বয়স হয়েছে, ঘর—সংসার ফেলে বছরে সাত—আট মাস সমুদ্রে ঘুরতে আর ভালো লাগে না। বাস্তেন দ্বীপের সোনা পেলে ওর খানিক সুবিধা হয়।

—জানি মিকির এই সমস্যা। কিন্তু সরি ওকে এই সোনার খোঁজ দেওয়া যাবে না।

—কেন?

—কারণ তাহলে খবরটা ঠিক ফাঁস হয়ে যাবে। তখন গাদা গাদা লোক ওখানে ছুটবে সোনার লোভে। মিকির ভাগ্যে আর কতটুকু সোনা জুটবে। মাঝ থেকে বাস্তেন দ্বীপ ছারখার হয়ে যাবে লোভী মানুষের ভিড়ে। পুরো দ্বীপটা ইজারা নিয়ে নিজের দখলে রাখা মিকির সাধ্যি নয়।

আমাদের দুঃখী মুখ দেখে মামাবাবু সান্ত্বনা দেন, মিকি আমাদের জন্যে অনেক করেছে সত্যি। ওকে আমি পুরস্কার হিসেবে মোটা টাকা দিয়ে যাব। তাই দিয়ে করুক ব্যবসা। জমি জায়গাও কিনতে পারে। তবে আমার মনে হয় ইচ্ছে থাকলেও ও বেশি দিন ঘরে টিকতে পারবে না।

—কেন? কেন? প্রশ্ন আমাদের।

—এটা জাহাজি নাবিকদের স্বভাব। জলে ঘুরে ঘুরে এমন অভ্যেস হয়ে যায় যে বেশি দিন স্থির ভাবে ডাঙায় কাটালে তাদের হাঁপ ধরে। এমন কেস আমি অনেক শুনেছি। রিটায়ার না করা পর্যন্ত অর্থাৎ ক্ষমতায় যদ্দিন কুলোয় তারা জলে জলে ঘোরে। মিকি দেখুক চেষ্টা করে—

সেই রাতেই আমাদের প্লেন ছাড়বে। ফিরব কলকাতায়। বাস্তেন দ্বীপে অভিযান সাঙ্গ হল। রোমাঞ্চকর স্মৃতি নিয়ে ফিরছি। এক আশ্চর্য অভিজ্ঞতা।

মিকিকে ছেড়ে যেতে আমাদের ভারি কষ্ট হচ্ছিল। মিকিরও তাই। মিকি আমাদের চমৎকার নকশাওলা বাতিকের কাজ করা লম্বা এক খণ্ড কাপড় উপহার দিল। ঘরে সাজিয়ে রাখব কলকাতায়।

মিকি বলল, ক্যালকাটা পোর্টে গেলে নিশ্চয় যাব তোমাদের বাড়ি। ব্রাদার সুনন্দর হাতের রান্না খাব। রাইসে মিত মিশিয়ে কি জানি নাম বেঁধেছিলে? হাঁ পোলাও। ওঃ দারুণ খেতে। ওইটে খাওয়াতে হবে। যাবার আগে মামাবাবু ফের সাবধান করে দিলেন মিকিকে—মনে রেখো, অন্য লোককে বলবে বাস্তেন দ্বীপ সাংঘাতিক ভূতুড়ে। খুব বেঁচে গেছ প্রাণে। ইন্ডিয়ান মন্ত্র না খাটলে ঠিক মরতে। হ্যাঁ, এখানকার আর্কিওলজি ডিপার্টমেন্টে শিলালিপিটার খবর জানিয়েছি। ওরা বলেছে, কয়েক দিনের মধ্যেই শিলালিপিটা নিয়ে আসবে। পাঠোদ্ধারের চেষ্টা করবে। খ্যাপাটে চিয়াং যদি ওই দ্বীপে গুপ্তধন খুঁজে বেড়ায়—খুঁজুক। যদি চিয়াং তোমায় পাকড়াও করে বলবে যে ওই ইন্ডিয়ানগুলো ফিরে গেছে দেশে। আমায় গুপ্তধনের হদিস কিছু দেয়নি। কত ধরাধরি করলাম বলল না কিছুতেই। লোকগুলো অতি বাজে স্বার্থপর। তবে ওরাও গুপ্তধন পায়নি এযাত্রা। তাহলে আমি ঠিক টের পেতাম।

শুনে মিকি ঘাড় নেড়ে একগাল হেসে বলল—অলরাইত।