☼ অজেয় রায় ☼
বাস্তেন দ্বীপে অভিযান
ছয়
পরদিন সকালে মামাবাবু মোটেই বেরুলেন না নিজের তবু ছেড়ে। সকালে টিফিন খেয়ে আমাদের বললেন, আমার কিছু কাছ আছে। বেরুব না। তোমরা দুজন মিকিকে নিয়ে ঘুরে এসো দ্বীপে। ফকির থাক এখানে। রান্নাবান্না করবে। মাঝে মাঝে আমার চা করে দেবে। দপরে খাবার আগে আমায় একদম ডিসটার্ব করবে না।
মামাবাবুর এই ধরনের আচরণের কারণ জানি। গভীর কোনো চিন্তায় ডুবে থাকলে তিনি একা থাকতে চান। তখন অন্য কারও সঙ্গে কথাবার্তা পছন্দ করেন না।
আমি ও সুনন্দ খুশি হয়েই মিকিকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। যাবার আগে দেখি মামাবাবু তার সেই বাক্সটা ঝাড়পোঁছ করছেন।
মামাবাবু একটা হালকা অথচ মজবুত মাঝারি আকারের বাক্স এনেছিলেন। তাতে ছিল বৈজ্ঞানিক গবেষণার প্রয়োজনীয় কিছু যন্ত্রপাতি, মালমশলা।
দ্বীপটা বেরিয়ে দেখতে দেখতে আমাদের বিস্ময় বাড়ে। কত রকম যে গাছ সেখানে। কত রকম ফল ফুলের গাছ। দেশি বুনো ঝোঁপঝাড় তো রয়েছেই। তার মধ্যে মিশে আছে নানান দেশের ভালো ভালো গাছ। বোঝা যায় ওসব গাছপালা এখানে আপনা আপনি জন্মায়নি। কেউ এনে লাগিয়েছে। কে আর হবে ফন বাস্তেন ছাড়া?
একটা গাছ দেখে থমকে যাই। কাঁঠাল। কচি কচি এঁচোড় ঝুলছে ডালে। মস্ত গাছ।
মিকি বিজ্ঞের মতন বলে, জ্যাক ফ্রুত। আন্দালাসে আমরা বলি নাংকো।
—আন্দালাস মানে সুমাত্রায় কাঁঠাল গাছ আছে বুঝি? আমি জানতে চাই।
—আছে। তবে বেশি নেই। ডুরিয়ানই বেশি হয়।
—ডুরিয়ান কী রকম ফল?
—এই তোমাদের জ্যাক ফ্রুতের জাত। তবে একটু অন্য রকম। ফুটবলের মতো গোল। গায়ে বড় বড় খোঁচা খোঁচা কাটা। স্বাদ ইন্দিয়ান কঁঠালের মতো ভালো নয়। বেশি মিষ্টি। আমি ইন্ডিয়ান জ্যাকফ্রুত খেতে বেশি ভালোবাসি।
সুনন্দ বলল, ফাসক্লাস। গাছপাঁঠার কালিয়া রাঁধব। মিকি পাড়োত ভাই ওই তিনটে এঁচোড়। এই গাছের তলায় রেখে যাই। বোঁটা থেকে আঠা ঝরে যাক। ফেরার পথে তুলে নেব।
ঘুরতে ঘুরতে সহসা তীব্র মিষ্ট সুগন্ধ পাই। এদিক—সেদিক তাকাতে তাকাতে চোখে পড়ে কিছুটা ফাঁকায় বিরাট এক মুচকুন্দ ফুলের গাছ। ফুলে ফুলে ভরা। গাছের নীচে পড়ে আছে অজস্র আধশুকনা বা শুকনো ফুল। কিছু টাটকা ফুল পেড়ে পকেটে পুরলাম। তাঁবুতে জল ছিটিয়ে পাত্রে রাখলে চমৎকার গন্ধ ছড়াবে।
গাছতলায় বসে এক রাউন্ড চা খাওয়া হল ফ্লাস্ক থেকে ঢেলে। ঝরনার জলে আরাম করে স্নান করলাম। একটু বাদে তাঁবুতে ফিরি।
তাঁবুতে পৌঁছে উঁকি দিয়ে দেখলাম মামাবাবু তার তাঁবুর ভিতরে একটা ফোল্ডিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। টেবিল ভর্তি টেস্টটিউব, বার্নার, নানান সাইজের বাটি প্লেট ইত্যাদি সরঞ্জাম। নিবিষ্ট চিত্তে মামাবাবু একটা টেস্ট—টিউবের মধ্যে তরল পদার্থ দেখছেন। আমাদের আগমন বুঝি টেরই পেলেন না। আমরাও ডাকি না তাঁকে।
মাঝিরা যখন আমাদের দুপুরের খাওয়া পরিবেশনের উদ্যোগ শুরু করেছে মামাবাব। তখন তার তাঁবু থেকে নিজেই বেরিয়ে এলেন, বেশ প্রফুল্ল বদনে। আমরা যা যা দেখেছি রিপোর্ট করলাম মামাবাবুকে।
খাওয়ার পর মামাবাবু আবার ঢুকে গেলেন নিজের তাঁবুতে। বিকেল অবধি ব্যস্ত থাকলেন কী সব গবেষণায়। আমি ও সুনন্দ থাকতাম অন্য একটা তাঁবুতে। তোফা ঘুম দিলাম দুপুরে। বিকেলে সমুদ্রের ধারে বসে আড্ডা মারলাম দুজনে। ফকির লোকটির নজর খুব। না চাইতেই দুবার আমাদের সামনে গরম চা ধরে দিল।
পরদিন মামাবাবুও আমাদের সঙ্গে দ্বীপটা ঘুরতে বেরোলেন। মিকিও চলল সঙ্গে। মাঝিরা ইতিমধ্যে পৌঁছে গেছে বাস্তেন আইল্যান্ডে। ফকির গল্প জুড়েছে ওদের সঙ্গে।
আমরা বেরোবার আধঘণ্টার মধ্যেই আকাশে কালো মেঘ ঘনিয়ে এল। বৃষ্টি নামতে পারে যে কোনো সময়। সুনন্দ বলল আমায়, চ, তাঁবু থেকে আমাদের বর্ষাতি আর ছাতাগুলো নিয়ে আসি। বেশি জোরে বৃষ্টি নামলে কোনো আড়ালে দাঁড়িয়ে যাব। সাধারণত সকালের দিকে বৃষ্টি বেশিক্ষণ থাকে না। গোটা সকাল তাঁবুতে কাটানো ভারি একঘেয়ে ব্যাপার। মামাবাবু এবং মিকিরও তাই মত। দুজনে জোরে পা চালিয়ে তাঁবুর দিকে হন্টন দিলাম।
মামাবাবুর তাঁবুতে যাই প্রথমে। পর্দা সরিয়ে ভিতরে উঁকি মেরেই আমরা থ। কে একটা লোক মাটিতে বসে। তার সামনে মামাবাবুর ব্যাগ থেকে বের করা কাগজপত্র ছড়ানো। আমাদের আসার শব্দে লোকটা মুখ ফেরায়। লোকটা বেঁটে। মোঙ্গোলিয়ান বা চিনা জাতীয়। ফুলপ্যান্ট ও হলুদ স্পোর্টস গেঞ্জি পরনে। সে তড়াক করে উঠে দাঁড়িয়ে তাঁবুর অন্য ধার দিয়ে বেরিয়ে যাবার চেষ্টা করে। কিন্তু পারে না—সুনন্দ বডি থ্রো দিয়ে ওর কোমর ধরে ওকে সুষ্ঠু নিয়ে মাটিতে পড়ল। লোকটা অতি তৎপর। সে গা মুচড়ে পাকাল মাছের মতো সুনন্দর হাত ছাড়িয়ে উঠে বসে, তারপর তার পোশাকের আড়ালে লুকানো লম্বা একটা ছুরি ঝট করে বের করে উঁচিয়ে ধরে সুনন্দকে তাক করে। হয়তো মেরেই বসত ছুরি কিংবা ভয় দেখিয়ে পালাত। আমি আর রিস্ক নিই না। একটা টিনের ভারী পাত্র ছুঁড়লাম লোকটার হাত লক্ষ্য করে। ঘা খেয়ে ছুরি ছিটকে গেল লোকটার হাত থেকে। সে ঝাঁকিয়ে ওঠে ব্যথায়। এই সুযোগে আমি ডাইভ দিয়ে পাকড়ে লোকটাকে পেড়ে ফেলি মাটিতে। সুনন্দও তাকে চেপে ধরে।
দড়ি দিয়ে লোকটার হাত পা শক্ত করে বেঁধে মাটিতে ফেলে রাখি। সুনন্দ ছুটল মামাবাবুকে খবর দিতে।
মামাবাবু ও মিকি এসে লোকটাকে দেখে অবাক। কে এ? কী উদ্দেশ্যে আমাদের জিনিস হাতড়াচ্ছিল? এই নির্জন দ্বীপে চোর! এখানে যে আর কেউ বাস করে তার কোনো চিহ্ন তো চোখে পড়েনি!
মামাবাবু মাঝিদের ডাকলেন। ফকিরও আসে। হামিদ লোকটাকে দেখেই বলে ওঠে, আরে এতো খ্যাপা চিয়াং! ও ইন্দোনেশিয়ার দ্বীপগুলোয় গুপ্তধন খুঁজে বেড়ায়। কুখ্যাত জলদস্যু তাই—চুংয়ের গুপ্তধনরত্নের ভাণ্ডার, বহু বছর খুঁজছে চিয়াং। এই ওর নেশা মানে পাগলামি বলতে পারেন।
হামিদের মুখে শুনি তাই—চুং বৃত্তান্ত—
প্রায় দেড়শো বছর আগের জলদস্যু তাই—চুং। দাপিয়ে বেড়াত ইন্দোনেশিয়ার সমুদ্রগুলিতে। সে সময় দক্ষিণ—পূর্ব এশিয়ায় জলদস্যুদের ভীষণ উপদ্রব ছিল। চিনা পর্তুগিজ মালয়ি—বর্মি ইত্যাদি নানা দেশের বোম্বেটের উৎপাত। দামি মশলার লোভে এবং ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য করতে এখানের সাগরগুলি দিয়ে যাতায়াত করত কত দেশের বাণিজ্যপোত। ধনী সওদাগরদের বড় বড় নৌকো বা জাহাজ। জলদস্যুরা ওঁৎ পেতে থাকত সেই সব বাণিজ্যপোত লুঠ করতে। বণিকদের সঙ্গে যদিও আত্মরক্ষার জন্য সশস্ত্র সৈনিকরা থাকত তবু অনেক সময় তারা বাঁচাতে পারত না নিজেদের মাল ও প্রাণ।
প্রবাদ আছে তাই—চুং ইন্দোনেশিয়ার কোনো এক জনহীন ছোট্ট সাগর দ্বীপে তার লুণ্ঠন করা ধনরত্ন লুকিয়ে রাখত। চুং নিজে এবং তার ঘনিষ্ঠ কয়েকজন সাগরেদ ছাড়া কেউ জানত না সেই দ্বীপের হদিস বা কোথায় কীভাবে লুকনো আছে চুংয়ের গুপ্তধন। একবার আচমকা এক ডাচ যুদ্ধজাহাদের সামনে পড়ে যায় চুংয়ের জাহাজ। ডাচ সামরিক জাহাজের গোলার আঘাতে ডুবে যায় চুংয়ের জাহাজ। বোম্বেটে জাহাজের কেউ প্রাণে বাঁচেনি। চুং এবং তার যে ক—জন সহচর জানত ওই গুপ্তধনের ঠিকানা তারা সবাই মারা পড়ে সেবার। ফলে চুংয়ের গুপ্তধনের হদিস লুপ্ত হয়ে যায়। তব খোঁজ চলে। প্রবাদ আছে চুংয়ের গুপ্তধন নাকি বিপুল। কেউ খুঁজে পায়নি আজও। সামান্য দু—চারটে ক্ল বা কিংবদন্তি নির্ভর করে খোঁজা। সবাই এখন প্রায় হাল ছেড়ে দিয়েছে শুধু এই চিয়াং ছাড়া।
চিয়াং দক্ষ মাল্লা। বছরে কয়েক মাস কাজ করে। আর বাকি সময় খুঁজে বেড়ায় চুংয়ের গুপ্তধন। এ তার এক উদ্ভট নেশা। পাগলামি। লোকে এই নিয়ে খ্যাপায় তাকে, হাসিঠাভা করে। ভুলভাল খবর দিয়ে হয়রানি করিয়ে মজা দেখে। তবু চিয়াংয়ের চৈতন্য হয় না। মাঝিমাল্লা মহলে এখানে তাই ওর নাম হয়ে গেছে খ্যাপাটে চিয়াং।
—হ্যাঁ, মাঝিরা অনেকে দেখেছে যে মিকি যখন জাকার্তায় নৌকো ভাড়ার খোঁজখবর করছিল তখন এই চিয়াং ঘুরঘুর করছিল মিকির কাছাকাছি। মিকি ওকে চিনত না। ব্যাপারটা যে এতদূর গড়াবে ভাবেনি বন্দরের মাঝিরা। চিয়াংয়ের নিশ্চয় ধারণা হয়েছিল যে এই বিদেশি চুংয়ের গুপ্তধনের খোঁজ পেয়েছে। নইলে ওই সব অখাদ্য দ্বীপে কেউ ঘোরে। বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান ভান মাত্র। হয়তো কেউ মজা করে চিয়াংয়ের মাথায় ঢুকিয়ে দিয়েছিল। ধারণাটা।
চিয়াং ছুরি বের করেছিল শুনে মাঝিরা বেজায় চটে গেল। প্রচণ্ড বকাবকি করল চিয়াংকে। সবচেয়ে বেশি তড়পাল ফকির। সে চিয়াংকে কয়েক ঘা উত্তমমধ্যম না দিয়েই। ছাড়বে না। মামাবাবু অনেক কষ্টে ঠেকালেন ফকিরকে।
চিয়াং আধবোজা চোখে জুলজুল করে তাকিয়ে সব বকুনি—গালাগালি হজম করল। তারপর সহসা ফেটে পড়ল রাগে। চিনা ভাষায় উত্তেজিত স্বরে কী সব বলতে লাগল। মিকির সঙ্গে ওর এক প্রস্থ কথাবার্তা হয়। মাঝিরাও ওকে কিছু বলে।
—কী বলছে চিয়াং? মামাবাবু জানতে চাইলেন।
মিকি মুচকি হেসে যা বলে তার সারমর্ম এই—ও বলছে ওর ম্যাপটা চাই। জলদস্যু চুং নাকি ওর পূর্বপুরুষ। অতএব ওই ম্যাপে শুধু তারই অধিকার।
—কীসের ম্যাপ? মামাবাবু অবাক।
—গুপ্তধনের ম্যাপ। যে ম্যাপ দেখে আপনি হদিস পেয়েছেন কোন্ দ্বীপে, কীভাবে চুংয়ের গুপ্তধন লুকানো আছে।
—মানে বাস্তেন আইল্যান্ড?
—না। বাস্তেন আইল্যান্ডের ইতিহাস ও জানে। ও বলছে আগের দ্বীপটার কথা। যেখানে পাথরে খোদাই শিলালিপি পাওয়া গেছে। ওর ধারণা শিলালিপিটা আসলে সাংকেতিক ভাষা। যা উদ্ধার করলেই বোঝা যাবে গুপ্তধন ওই দ্বীপে কীভাবে লকানো আছে। ম্যাপে আর কী কী আছে ও জানতে চায়। তাই আপনার ব্যাগ ঘাঁটছিল মাম পেতে।
—যাচ্চলে। আচ্ছা পাগল! মামাবাবু বলেন, ওকে বুঝিয়ে দাও মিকি আমরা কোন গুপ্তধনের ম্যাপটাপ পাইনি। ওই শিলালিপি সংস্কৃত ভাষায় লেখা। সংস্কৃত প্রাচীন ভারতীয় ভাষা। গুপ্তধনের হদিস নিশ্চয় চিনা ভাষায় থাকবে।
মিকি চিয়াংয়ের সঙ্গে ফের কথাবার্তা চালায়। চিয়াংয়ের মুখে বাক্যের তুবড়ি ছোটে।
মিকি মামাবাবুকে বলে, আপনার কথা ও বিশ্বাস করছে না।
হতাশ মামাবাবু বলেন, তা আর কী করা যাবে? ও পাথরে খোদাই সংকেত উদ্ধার করুক। গুপ্তধন পাক। আমার বিন্দুমাত্র আপত্তি নেই। তবে অমন কোনো ম্যাপ আমার কাছে নেই।
সুনন্দ ও আমি হাসছি শুনে। মাঝিরা ভ্যাবাচাকা। হামিদ কী জানি নির্দেশ দিতে অন্য দুই মাঝি বেরিয়ে গেল। মামাবাবু ভুরু কুচকে বলেন, আচ্ছা ও শিলালিপির ব্যাপারটা জানল কীভাবে?
মিকি ও হামিদ বলল, বোঝাই যাচ্ছে যে চিয়াং জাকার্তা থেকে আমাদের ফলো করে এসেছে। সব দ্বীপে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখেছে আপনার কার্যকলাপ। আপনি বৈজ্ঞানিক। গাছপালা খুঁজছেন। এসব ওর মাথায় ঢোকেনি। এখানে অজানা দ্বীপে কেউ গেলেই চিয়াং ভাবে সে গুপ্তধন খুঁজছে। চুংয়ের গুপ্তধন।
—ও একা একা নৌকো বেয়ে এসেছে সাগরে? আমরা স্তম্ভিত।
—না একা নয়। ওর নিশ্চয় সঙ্গী মাঝি আছে। ওর নৌকো লুকানো আছে দ্বীপে কোথাও। সেই নৌকো খুঁজতে লোক পাঠিয়েছি।
বন্দিকে তাঁবুতে রেখে আমরা বাইরে আলোচনা করি, যে এখন এই লোকটাকে নিয়ে কী করা যায়? মামাবাবু বিব্রত।
মিকি ও হামিদ নিজেদের মধ্যে কী সব পরামর্শ করে। সুনন্দ ফকিরকে বলে, এক রাউন্ড চা খাওয়াও ভাই। বেড়ানো তো ভেস্তে গেল।
ফকির একটু অনিচ্ছায় চা বানাতে যায়। বোধহয় এমন জমাটি কাটার কোনো কিছুই বাদ দিতে চায় না।
খানিক পরে হামিদের সহচর দুই মাঝি ফিরে এসে জানায় যে চিয়াংয়ের নৌকো খুঁজে পেয়েছে তারা। এক সঙ্গী নিয়ে এসেছে চিয়াং। একটা খাঁড়ির মধ্যে নৌকোটা লুকানো ছিল। সঙ্গীটি সেখানে ছিল চিয়াংয়ের অপেক্ষায়। গুপ্তধনের ভাগ দেবে আশা দেখিয়ে তাকে জটিয়েছে চিয়াং। তবে সাগরে দুজনে নৌকো চালিয়ে আসা খুবই বিপজ্জনক। অবশ্য গুপ্তধনের লোভে ওদের প্রাণের মায়াও তুচ্ছ। চিয়াংয়ের সঙ্গীকে শক্ত করে বেঁধে রেখে এসেছে। হামিদের মাঝিরা।
মামাবাবু মিকিকে বলেন, এই খ্যাপাটে লোকটাকে রেখে কী লাভ? ওদের বরং ছেড়ে দাও। জাভায় ফিরে যাক।
মিকি বলল, ও ব্যাটা এখন ফিরবে না মোটেই। আমাদের জ্বালাবে শুধু।
হামিদ জানায়, আমরা রাতে আর দিনের অনেকটা সময় ওই পাথরে খোদাই লেখা দ্বীপে মানে চিয়াংয়ের গুপ্তধনের দ্বীপে থাকায় ও এখনো তেমন গুপ্তধন খোঁজাখুঁজি করতে পারেনি। আমরা গেলেই পুরো দমে লাগবে।
—তা খুঁজুক। সুনন্দ মিচকে হেসে বলে, সারা জীবন খুঁজুক ওখানে।
হামিদ বলল, ভাবছি, আমরা শিলালিপি দ্বীপে ফেরার সময় চিয়াংদের নৌকোসুদ্ধ সঙ্গে নিয়ে যাব। অন্য কোনো দ্বীপে চলে যেতে বলব ওদের। কড়কে দেব যে ফের আমাদের চোখের সামনে এলে স্রেফ খুন করে ফেলব ওদের। তাহলে হয়তো ভয়ে এখন আর জ্বলাবে না আমাদের।
হামিদের প্রস্তাব মেনে নিলাম আমরা।
হামিদ বলল, আপাতত চিয়াংকে শাসিয়ে রাখি, তোমার ব্যবস্থা হচ্ছে। হাত পা বেধে সমদ্রে ফেলে দেব? না কোনো নির্জন দ্বীপে নির্বাসন দেব? দেখি ভেবে। ছুরি মারতে গিয়েছিলে এত বড় আস্পর্ধা! থাকুক ভয়ে ভয়ে।
আমি সুনন্দ কাছাকাছি একটু ঘোরাঘুরি করি। রোদ বাড়তে নিজেদের তাঁবুতে ঢুকলাম। মামাবাবু নিজের তাঁবুতে কী সব করছেন। বন্দি চিয়াংকে রাখা হয়েছে মিকিদের তাঁবুতে। ফকিরকে বলা হয়েছে যে বন্দি লোক্টা চাইলে জল খেতে দিতে।
মিকি গিয়ে মাঝিদের সঙ্গে গল্প জুড়ল। মাঝিরা একটা গুহার ভিতর রান্না করছে। মাঝিরা খেয়েদেয়ে ফিরে যাবে শিলালিপি দ্বীপে। তখন নিয়ে যাবে বন্দি চিয়াং আর তার সঙ্গীকে।
দুপুরের খাওয়া হল। আমার ও সুনন্দর তাঁবুতে ফোল্ডিং টেবিল ও টুল পেতে খাই সাধারণত। মামাবাবুও আসেন খেতে।
ফকির আমাদের খাবার সাজিয়ে দিয়ে বলল যে সে মাঝিদের কাছে যাচ্ছে খেতে। যাবার আগে ফকির ইতস্তত করে বলে, বন্দি চিয়াংকে কিছু খেতে দেব কি?
—হ্যাঁ দিও। মামাবাবু উদার, তবে সাবধান। ওর কোমরে দড়ি বেঁধে দড়ির অন্য প্রান্ত বেঁধে তবে ওর হাত—পায়ের বাঁধন খুলবে। হাতে একটা লাঠি নিয়ে তুমি পাহারায় থাকবে খাবার সময়। ওর খাওয়া শেষ হলে ফের হাত—পা বেঁধে দেবে।
ফকির চলে গেল ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানিয়ে।
আমরা খাওয়া শেষ করার পর খাবার জল আনতে মাঝিদের কাছে গিয়ে দেখি তিন মাঝি ও মিকি খাচ্ছে। কিন্তু ফকির সেখানে নেই। সে নাকি আসেনি খেতে। লোকটা গেল কোথায়?
মিকির তাঁবুতে গিয়ে দেখি যে বন্দি চিয়াং উধাও। তবু ফাঁকা। ডাকাডাকি করেও ফকিরের কোনো সাড়া পাওয়া গেল না। লক্ষ করলাম যে তাঁবুতে ফকিরের ব্যাগ দুটোও নেই।
একটা ঘোর সন্দেহ জাগে সবার মনে।
মাঝিরা ছটল চিয়াংয়ের নৌকোর খোঁজে। তারা ফিরে এসে বলল যে নৌকো নেই। চিয়াংয়ের সঙ্গীটিও নেই। অর্থাৎ ওরা পালিয়েছে। ওরা দুজন বাঁধন খুলল কী করে? তবে কি?
মামাবাবু মৃদু হেসে বললেন, এতো দিব্যি বোঝা যাচ্ছে। শ্রীমান ফকির আসনে চিয়াংয়ের লোক। কৌশল করে ওকে আমাদের দলে ঢুকিয়ে দিয়েছিল চিয়াং। বাঃ চিয়াংয়ের বুদ্ধি আছে। আর ফকির লোকটার অ্যাকটিং দারুণ। কিসসুটি বুঝতে দেয়নি ওর মতলব। হয়তো ওর নাম ঠিকানা সবই ভুয়ো। আগের দ্বীপে ফকির বা চিয়াংই আমার ব্যাগ হাতড়েছিল। ম্যাপ খুঁজেছে। আমরা যে যে দ্বীপে গিয়েছি চিয়াং ফলো করে সেখানে গিয়ে লুকিয়ে থেকেছে। আমাদের গতিবিধির রিপোর্ট পেয়েছে ফকির মারফত। হয়তো আমাদের খাবারের ভাগও পেয়েছে। সুনন্দর গাছপাঁঠার কালিয়াও হয়তো চেখে দেখেছে চিয়াং। ওই জন্যেই ফকির মিকির ভক্ত সেজে পারতপক্ষে আমাদের চোখে আড়াল করত না। ভুতুড়ে বাস্তেন দ্বীপে অবধি থেকে গেছে। ফকিরই চিয়াংদের বাঁধন খুলে দিয়েছে, তারপর ওদের সঙ্গে পালিয়েছে দ্বীপ ছেড়ে।
আমি প্রশ্ন করি, চিয়াং এই দ্বীপে এল কখন? দিনের বেলা এলে নিশ্চয় আমাদের কারও চোখে পড়ত।
—এসেছে রাতে বা সন্ধের পর। মাঝিরা চলে যাবার পর। যারা গুপ্তধন খোঁজে তাদের ভূতের ভয় থাকলে চলে না। ফকির হয়তো আকাশে হাউই ছুঁড়ে সংকেত জানিয়েছে আসার জন্য। চিয়াং এখানে রাতে কোথাও লুকিয়ে থাকত আর দিনের বেলা আমাদের নজরে রাখত লুকিয়ে। আগের দ্বীপগুলোতেও তাই করেছে। হামিদ ওকে যা ভয়। দেখিয়েছে, আর থাকতে সাহস পায়নি। পাছে ফকিরের কীর্তি জেনে ফেলি তাই সেও আর রিস্ক নেয়নি।
যাগগে ভালোই হয়েছে। আপদ বিদায় হয়েছে। থাকলেই আমাদের বিপদ বাড়ত।
কিন্তু ওরা না থাকলেও আমাদের বিপদ যে কতদূর গড়িয়েছে তা টের পাওয়া যায়। খানিক বাদে।
হামিদের এক মাঝি এসে উদ্বিগ্ন স্বরে জানাল যে তাদের নৌকোর দাঁড়গুলো নেই। একটাও নেই। চুরি গেছে। আর পালের দড়িগুলো অনেক জায়গায় কাটা। তবে পালের কাপড় কাটেনি। চিয়াংদের কীর্তি সন্দেহ নেই।
শুনে মাঝিদের মাথায় হাত। এই দ্বীপ ছেড়ে এখন যাবে কেমন করে? হামিদ গর্জে ওঠে, এবার ও ব্যাটাদের হাতে পেলে সত্যি খুন করব।
বোঝা গেল যে পাছে হামিদরা ওদের পিছু নিয়ে ধরে ফ্যালে সেই ভয়ে চিয়াং—হামিদের নৌকোটা অকেজো করে গেছে।
ব্যাপার শুনেই মামাবাবু দূরবিন নিয়ে উঠলেন একটা উঁচু জায়গায়। সমুদ্রের নানা দিকে দেখতে দেখতে বললেন, হু একটা নৌকো দেখছি অনেক দূরে। তিনটে মাথা দেখছি নৌকোয়। সাঁতরে বোধহয় ধরা যাবে না আর।
আমি ফুট কাটি, সুনন্দ ঠিক পারবে। ও কলেজ লাইফে সুইমিং চ্যাম্পিয়ান ছিল। সুনন্দ ট্রাই কর।
সুনন্দ অগ্নিদৃষ্টি হেনে জবাব দেয়, সরি এটা সমুদ্র। সুইমিংপুল নয়।
মামাবাবু দেখতে দেখতে বলেন, ওরা কিন্তু শিলালিপি দ্বীপ মানে যেখানে গুপ্তধন আছে মনে করছে সেদিকে যাচ্ছে না। হয়তো ভয় পেয়েছে, হামিদ মাঝিরা কোনোরকমে যদি ওই দ্বীপে হাজির হয় তাহলে রক্ষে নেই ওদের। তবে আমরা সবাই জাভায় ফিরে গেলে চিয়াং ঠিক ওই দ্বীপে ফের আসবে গুপ্তধন খুঁজতে।
মামাবাবু তার তাঁবুতে ঢুকে একটা ব্যাগ খুলেই চমকে বললেন, দ্যাখো কাণ্ড। আমার এই ব্যাগ কেউ হাতড়েছে। কাগজপত্র সরিয়েছে। নির্ঘাৎ চিয়াং বা ফকিরের কীর্তি। আমরা যখন খাচ্ছিলাম তোমাদের টেন্টে তখন নিশ্চয় সরিয়েছে। টাকাকড়ি কিন্তু খোয়া যায়নি।
ব্যাগের কাগজপত্রর হিসেব মেলাতে মেলাতে মামাবাবু বললেন, গ্যাছে একটা এই বছরের বাংলা পাঁজি। শিলালিপি দ্বীপের একটা স্কেচ করেছিলাম সেটা। একটা মিনি সাইজের সংস্কৃত এবং পাশে বাংলায় লেখা শ্ৰীভাগবত গীতা। একটা জুলজির পেপার আধখানা লিখেছিলাম, তাতে কিছু হাতে আঁকা ছবি ছিল, সেটাও নেই। বুঝে ব্যাপার? ম্যাপ ভেবে নিয়ে গেছে। যদি কোনোটা কাজে লাগে? ইস পাঁজিটা রেঙ্গুনের এক বাঙালি ভদ্রলোকের মায়ের জন্যে এনেছিলাম। অনুরোধ করেছিলেন আনতে। ফেরার পথে দিতাম। গেল। দেশে ফিরে বাইপোস্ট পাঠাতে হবে আর একখানা পাঁজি কিনে।
মাঝিদের সঙ্গে হাতুড়ি—করাত—কাটারি জাতীয় কিছু যন্ত্রপাতি আছে। তাই দিয়ে মোটামুটি কাজ চালানোর মতো দাঁড় তারা তৈরি করে নিতে পারত। কিন্তু সেই সব হাতিয়ার তো রয়েছে শিলালিপি দ্বীপে। আমাদের কাছেও হাতুডি—পেরেক—কাটারি ইত্যাদি কিছু যন্ত্রপাতি আছে বটে। তবে সেগুলো ছোট মাপের। নিরুপায় মাঝিরা তাই দিয়েই লেগে গেল কাঠ জোগাড় করে দাঁড় বানাতে। অন্তত কাজ চালানোর মতো। কিছুটা পথ যাবার মতো। পালের কাটা দড়ি জোড়া দেবার কাজও চলে। কিন্তু দেরি হয়ে গেল। অন্ধকার নামার আগে তাদের কাজ শেষ হয় না। এমন আধাখেঁচড়া পাল ও দাঁড় নিয়ে রাতে সমুদ্রে পাড়ি দেওয়া রীতিমতো বিপজ্জনক। সুতরাং সে রাতটা মাঝিরা বাস্তেন দ্বীপে কাটাতে বাধ্য হল।
হামিদ আর তার দুই সঙ্গী মাঝির যে কী ভীষণ ভূতের ভয় টের পেলাম সেদিন। গোটা রাত তারা গুহার মধ্যে আগুন জ্বেলে জেগে কাটাল। চিৎকার করে কী জানি বলছিল দেশি ভাষায়। মিকি জানাল, ওগুলো ভূত তাড়াবার মন্ত্র।
ভোরবেলা দেখি একটা পুরোনো দাঁড় পড়ে আছে বেলাভূমিতে। অর্থাৎ দাঁড়গুলো চিয়াং সমুদ্রে ফেলে দিয়েছিল। তারই একটা ভেসে ফিরে এসেছে। কিছুটা সুবিধা হল দাঁড়টা পেয়ে।
হেডমাঝি হামিদ চিন্তিতভাবে জানাল মামাবাবুকে, আপনাদের নিয়ে জাকার্তায় ফেরা সমস্যা হবে। মানে এই অবস্থায়। আপনাদের প্রচুর লটবহর। লোকও বাড়বে। এমনি জোড়াতালি দেওয়া দাঁড় আর পাল নিয়ে টাল সামলানো মুশকিল হবে। জোর বাতাস বইলে নৌকো ডুববে। আমরা নিজেরা যাহোক করে জাকার্তায় ফিরে যাব। সামলে নেব নৌকো। জলে ছিটকে পড়লেও উঠে পড়ব নৌকোয়। আপনারা পারবেন না।
—কী ভাবছ তুমি? মামাবাবু জানতে চান।
—আমি ভাবছি। হামিদ ইতস্তত করে।
মামাবাবু বলেন, একটা কাজ করতে পারো। তোমরা আপাতত চলে যাও জাকার্তায়। ওখানে গিয়ে পাল আর দাঁড় ঠিকঠাক করে আবার চলে আসবে এই দ্বীপে। আমরা এখানে থেকে যাব ততদিন। তাড়াতাড়ি যেতে—আসতে কতদিন লাগবে তোমাদের?
—অন্তত চার—পাঁচ দিন।
—ভেরিগুড। আমার এই দ্বীপে আরও কদিন থাকা দরকার। আমাদের নিয়ে ভেবো না। রসদ দরকার মতো সবই মজুত আছে। চার—পাঁচ দিন দিব্যি চলে যাবে।
মদ যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচে। বুঝি এই প্রস্তাবটাই সে দিতে যাচ্ছিল।
—মিকির কী ইচ্ছে? মামাবাবুর প্রশ্ন।
মিকি বলল, আপনারা থাকলে আমিও থাকব।
—বেশ বেশ। মামাবাবু খুশি।
ঘণ্টাখানেকের মধ্যে হামিদ তার দুই সহচর নিয়ে নৌকো ভাসাল সাগরে।
হামদরা চলে যেতে মামাবাবুর মেজাজ যেন ভারি শরিফ হয়ে গেল। আমাদের বললেন, চলো হে সবাই আজ সকালে একবার দ্বীপটা চক্কর দিয়ে আসি। দেখি ফন বাস্তেন কেমন বোটানিকাল গার্ডেন বানিয়েছিল।
সত্যি কতরকম অভিনব গাছগাছালি যে ছড়িয়ে আছে দ্বীপটায় যা এমন দ্বীপে একসম থাকা অসম্ভব। যদি না কেউ বাইরে থেকে এনে লাগায়। কিছু উদ্ভিদের উল্লেখ আগে করেছি আরও কিছু উল্লেখযোগ্য গাছের কথা জানাচ্ছি। সব এখন মনে নেই। কিছু উল্লেখযোগ্য উদ্ভিদ হয়তো আমাদের চোখ এড়িয়ে গেছে। দেখেছি যে স্থানীয় দেশি জংলা অতি সাধারণ গাছগাছড়া ঝোঁপঝাড়ের সঙ্গে মিশে আছে অনেক বিশিষ্ট গাছপালা। যেগুলি অবশ্যই বাস্তেনের আমদানি নানা দেশ থেকে।
গোটা দুই বাস্কেটবল কোর্টের আয়তন সমান মোটামুটি সমতল একখণ্ড জমিতে অনেকগুলো বড় গাছ মাথা তুলে রয়েছে এক জায়গায়। শন শন শব্দ হচ্ছে পাতার ফাঁক দিয়ে হাওয়া বইতে। মামাবাবু গাছগুলো দেখিয়ে বললেন, দেখেচ ঝাউগাছ। মিকি তোমরা কী বলো ঝাউকে?
—আরু। জবাব দেয় মিকি।
—আর ঝাউয়ের ফাঁকে ফাঁকে ছোট গাছগুলো কী?
আমি ও সুনন্দ মাথা চুলকোই। মিকি মিটিমিটি হাসে।
—মিকি তুমি চেনো? প্রশ্ন মামাবাবুর।
—হাঁ স্যার রবার গাছ।
ইস রবার গাছ দেখেছি আগে। মনে পড়ল না এখন। ভারি আপশোস হয় আমার।
দুদিন ধরে ঘুরে ঘুরে চোখে পড়েছে—ডুমুর গাছ, সয়াবিন লতা, সুপারি গাছ, তামাক পাতার গাছ, নয়নতারার ঝোঁপ। বাঁশ ঝাড়। জল জমা নিচু জায়গায় লম্বা লম্বা বেত গাছ। যত্রতত্র আনারস গাছ। দিব্যি বড় বড় আনারস ফলে রয়েছে। আম কাঁঠাল তেঁতুল গাছ দেখেছি প্রচুর। ছোট ছোট জুই ফুলের ঝাড়। সুগন্ধে ম ম করছে চারপাশ। সমুদ্র তীরে লম্বা লম্বা নারকেল গাছ অবশ্য এখানকার দ্বীপগুলিতে অতি পরিচিত দৃশ্য। প্রবল সমুদ্রের হাওয়ায় নারকেলের পাতাগুলি সদাই দুলছে।
বড়গাছের নিচে ছায়ায় একটা ফুল দেখে আমরা থ। মাটি থেকে একটু উঁচুতে গোড়ার ওপর পাঁচটি প্রকাণ্ড মোটামোটা পাপড়ি গোল হয়ে মাটির প্রায় সমান্তরালভাবে ছড়িয়ে আছে। পাপড়িগুলো মিলেছে যেখানে সেখানটা মস্ত গোল ডাব্বার মতো। সেটা বোঁটা বা কাণ্ড হবে। ফুলটার ব্যাস অন্তত আড়াই—তিনফুট। পাপড়িগুলো মেটে রঙের। বাক অংশের রংও প্রায় তাই। বাপরে এ কী ফুল! শুধুই ফুল। উদ্ভিদের আর কোনো ডালপালা যে দেখছি না।
মামাবাবু খুঁটিয়ে দেখে বললেন, জানো এটা কী ফুল?
আমরা মাথা নাড়ি—না।
আমি বুঝেছি। ছবি দেখেছি এই ফুলের। র্যাফলসিয়া আরনলদি। বিশ্বের বৃহত্তম ফুল। এর পাতা নেই। পাতার মতো দেখতে অংশগুলো আসলে শিকড় বা কাণ্ড। শুধুমাত্র সুমাত্রার জঙ্গলে এই ফুল পাওয়া যায়। মিকি তুমি এই ফুল দেখেছ আগে?
—না। মিকি ঘাড় নাড়ে। বলে, তবে শুনেছি এর কথা।
মামাবাবু বললেন, এই ফুলের গাছ আসলে প্যারাসাইট। অর্থাৎ পরজীবী। এর কাণ্ড থেকে সরু সুতোর মতন শিকড় বেরোয়। ওই শিকড়গুলি অন্য গাছের গায়ে ঢুকিয়ে দিয়ে সেই গাছের রস নিজের খাদ্য হিসেবে টেনে নিয়ে এরা বাঁচে। সত্যি বাস্তেন আশ্চর্য উদ্ভিদপ্রেমী ছিল। এ ফুলের গাছ জোগাড় করা সহজ ব্যাপার নয়।
দ্বীপটায় নানান ফল—ফুলের গাছ জন্মানোয় প্রচুর পাখি এসে জুটেছে। প্রজাপতি উড়ছে রং—বেরঙের। কাঠবেড়ালিও চোখে পড়ল। ঝোঁপঝাড়ের ভিতর সড়সড় আওয়াজ জানান দেয় আরও কিছু ছোট জীবের চলাফেরা। তবে বিষাক্ত সাপের ভয়ে আমরা সতর্ক থাকি। লাঠি বাগিয়ে। ঘন ঝোঁপের মধ্যে যাই না। কানে আসে পাখির কলকাকলি ও মধুর শিস।
মামাবাবু যেতে যেতে মন্তব্য করেন, বাস্তেন আইল্যান্ড ভুতুড়ে থাকাই মঙ্গল।
—কেন? আমি অবাক।
—কারণ তা নইলে মানুষ এখানে এসে বসতি করবে। ঘরবাড়ি বানাবে। গাছ কাটবে। এখানকার জীবজন্তুদের মারবে বা তাড়িয়ে ছাড়বে। বাস্তেনের গড়া সাধের দ্বীপ ধ্বংস করবে। দুঃখের কথা কী জানো, মানুষ ভাবে যে এই পৃথিবীটা বুঝি শুধু তাদেরই জন্যে। অন্য জীবজন্তুর অধিকার নেই এখানে। মানুষ নিজের স্বার্থে কত যে গাছপালা ধ্বংস করেছে, কত জীবজন্তুকে নিঃশেষ করে দিয়েছে পৃথিবী থেকে।
—মিকি তুমি ফিরে গিয়ে লোককে বলবে, বাস্তেন দ্বীপটায় সত্যি সত্যি ভুতুড়ে। দিনের বেলা তবু কাটানো যায় কিন্তু রাতে ভয়ংকর। বিকট সব আওয়াজ হয়। অশরীরী ছায়ামূর্তি ঘুর বেড়ায়। রাতে তাঁবুর বাইরে দুমদাম্ ঢিল পাথর পড়ত। বাস্তেন সাহেবের প্রেতাত্মার ক্রুদ্ধ গর্জন শোনা যেত। শাসাত, দ্বীপ ছেড়ে চেলে যাও নইলে বিপদে পড়বে ভীষণ। মাঝে মাঝে রাতে ঝোড়ো দীর্ঘশ্বাসের মতো গা—হিম করা আওয়াজ করে হাওয়া বয় দ্বীপে। বৃষ্টিঝরা রাতে কান্নার আওয়াজ গুমরে গুমরে ওঠে। ভয়াবহ অভিজ্ঞতা। হামিদরা তো বাস্তেন দ্বীপে কিছুতেই থাকেনি রাতে। নেহাতই ইন্ডিয়ান প্রফেসর ভূত ঠেকাবার মন্ত্র জানত তাই রক্ষে পেয়েছি এ—যাত্রা।
—হ্যাঁ আর একটা ভয় যোগ করতে পারো। বলবে, দ্বীপটায় কিং—কোবরা আছে। তমি। দেখেছ সচক্ষে। তাতেই অর্ধেক কাজ হাসিল হবে। কেউ এই দ্বীপে থাকতে চাইবে না। পা দিতেই চাইবে না অনেকে শঙ্খচূড়ের ভয়ে। নিশ্চিন্তে শ্রীবৃদ্ধি পাবে বাস্তেনের বোটানিকাল গার্ডেন। এই দ্বীপে কী কী গাছ আছে বলবে না কাউকে।
মিকি ঘাড় হেলিয়ে সম্মতি জানায় মামাবাবুর কথায়।
ফেরার পথে আমরা বাস্তেনের পোড় ভিটে হয়ে আসি। ছড়িয়ে থাকা ভাঙাচোরা নিসগুলো মামাবাবুরা ঘুরে ঘুরে দেখেন। কিছু জিনিস হাতে নিয়ে পরীক্ষা করেন।
সেদিন দুপুরে তিনি একা বেরিয়ে গেলেন ছাতা মাথায়। বুঝলাম কোনো কারণে আমাদের সঙ্গে নেবার ইচ্ছে নেই। আমি সুনন্দ ঘুম মারলাম দুপুরে। পরদিন সকালেও মামাবাবু একা বেরুলেন। আমাদের ডাকলেন না। বললেন, আমি ঝরনাটার ধারে কাছে ঘুরব। তোমরা অন্য দিকে যাও।
আমি ও সুনন্দ শুধু দুজনে ঘুরলে জমে বেশি। বেড়ানো আড্ডা দুই হয়। মামাবাবু সঙ্গে থাকলে কিঞ্চিৎ আড়ষ্ট থাকি। যদিও শিখতে পারি অনেক কিছু।
ঘুরতে ঘুরতে সুনন্দ আশঙ্কা প্রকাশ করে, হামিদরা ঠিকঠাক ফিরবে তো?
—জরুর ফিরবে। পাওনা বাকি। আমি নিশ্চিত।
—না। মানে যদি জাকার্তায় পৌঁছতে না পারে ঠিকমতো? নৌকোর যা অবস্থা ছিল।
—তা বটে। আমি সায় দিই।
—আমাদের খাবারের স্টকে আরও চার—পাঁচ দিন চলে যাবে। তারপর?
—কী আর হবে? ডুমুর সিদ্ধ, কাঁঠাল, এঁচোড় সিদ্ধ। সিদ্ধ মাছ। ডিম সিদ্ধ।—এই সব খেয়ে কাটাব। আমি নির্বিকার।
—আটকে গেলে এ দ্বীপ থেকে কবে যে উদ্ধার পাব? এ দিকে নৌকো জাহাজ চলে খুব কম। চিন্তিত সুনন্দ বিড়বিড় করে।
সেদিন দুপুরে খাওয়ার পর মামাবাবু নিজের তাঁবুতে কাটালেন কী সব করে। আমি ও সুনন্দ সমুদ্রের বেলাভূমিতে আড্ডা মেরে কাটালাম বিকেলটা।
মিকি একটা বন্য ছাগল শিকার করেছিল। রাতের খাবার সুনন্দ রাঁধল মাংসের পোলাও। দারুণ। মামাবাবু অবধি চেটেপুটে খেলেন। খাবার পর মামাবাবু আমাকে ও সুনন্দকে বললেন, কাল সকালে টিফিনের পর আমার তাঁবুতে চলে এসো। দরকারি কথা আছে।
কী কথা? প্রচণ্ড কৌতূহল হয়। মামাবাবু যে শুধুমাত্র বাস্তেন দ্বীপে গাছপালার সংগ্রহ দেখতে এত দূরে, এত খরচ করে আসেননি তা আন্দাজ করেছিলাম প্রথম থেকে। অন্য কোনো গূঢ় কারণ। এবার কি তার হদিস পাব?
সে রাতে টানা বৃষ্টি হল ঘণ্টা দুই। শনশন হাওয়া বয়। উথালপাথাল ঢেউয়ের শব্দ। এমন রাতে এমনি নিরালা দ্বীপে কেমন গা ছমছম করে।
পরদিন সকালে আকাশ দিব্যি পরিষ্কার। আমি ও সুনন্দ মামাবাবুর তাঁবুতে গিয়ে জটলাম। মিকি চা দিয়ে গেল। মামাবাবুর সামনে বসি। গরম চায়ে চুমুক দিয়ে মামাবাবু ধীর কণ্ঠে শুরু করলেন বলতে, আচ্ছা এই যে আমি এত দূরে দ্বীপটায়, এত সময় কাটাচ্ছি কেন, তাই নিয়ে তোমাদের মনে কি কোনো প্রশ্ন জেগেছে?
আমি চুপ। সুনন্দ ফস্ করে বলে বসে, আমি বুঝেচি।
—কী বুঝেচ? মামাবাবু যেন রীতিমতো বিস্মিত।
—ফন বাস্তেন বোটানিকাল গার্ডেন তৈরির ভান করে আসলে আফিম তৈরি করত কিনা, তাই জানতে। কলকাতায় আপনার বাগানে পোস্ত গাছ দেখে মিকি যেই বলল এই দ্বীপে ওই গাছ সে দেখেছে অমনি তারপর থেকে আপনি খুব তো ইন্টারেস্টেড হয়ে পড়লেন কেসটা নিয়ে।
—ঘোড়ার ডিম বুঝেচ। মামাবাবু তর্জন করেন, বাস্তেন আফিম বিক্রি করলে লোকে ঠিক জেনে ফেলত। তার সে বদনাম নেই। প্রমাণ পেয়েছি যে সে জাভায় এসে বিক্রি করত তার শিল্পকর্ম এবং খুব সম্ভবত আরও একটি জিনিস।
যাকগে আমি তাই নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছি না। আমার এখানে আসা ও দেখার উদ্দেশ্য ছিল অন্য। বাস্তেনের লাগানো পোস্ত গাছের ঝাড় কেন অত বড় বড়? কেনই বা এখানে ক্যালিফোর্নিয়ান পপির পাতা এত বড় বড় আর মোটা হয়েছে? যে কারণ আমি কলকাতায় বসে সন্দেহ করেছিলাম তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ সংগ্রহই আমার এখানে আসার আসল উদ্দেশ্য। বাস্তেনের বিচিত্র বোটানিকাল গার্ডেন দেখাটা বাড়তি লাভ।
আমরা উভয়েই বাক্যহারা।
একটু দম নিয়ে মামাবাবু বলেন, কলকাতায় আমি যে ইদানীং বাগান করা নিয়ে মেতেছি তা কিন্তু স্রেফ ফুল ফোঁটানো নয়। পাতাবাহার বা ক্যাকটাসের একজিবিশন করা নয়। পাড়ার ঘোষবাবুদের মতো চন্দ্রমল্লিকা গোলাপ ইত্যাদি ফুটিয়ে পাড়ার লোককে দেখিয়ে ক্রেডিট নেওয়া নয়। আমার বাগান করা শৌখিন উদ্যানচর্চা নয়। এর উদ্দেশ্য আলাদা।
আমরা উদগ্রীব হয়ে শুনি।
মামাবাবু বলেন, জিওবোটানি বিষয়টা কী জানো? মানে জিওলজি এবং বোটানির মিশ্রণ। বাংলায় বললে, ভূ—উদ্ভিদ বিদ্যা।
—নামটা শুনেছি। সুনন্দ ইতস্তত করে বলে।—উদ্ভিদ আর ভূ—বিদ্যা মানে জিওলজির সম্পর্ক নিয়ে রিসার্চ।
—কী ধরনের রিসার্চ? মামাবাবুর প্রশ্ন।
—তা ঠিক জানি না। সুনন্দ তোতলায়।—নামটা পড়েছি একটা জার্নালে। আর্টিকেলটা পড়ার সময় পাইনি।
—পড়া উচিত ছিল। নতুন বিষয় দেখলেই পড়বে। যাকগে, বুঝছি তোমরা কিসু জানো না এ বিষয়ে। দু—চার কথায় সহজ করে ব্যাখ্যা করি ব্যাপারটা। এই নিয়ে গবেষণার কারণেই আমার এখানে আসা।
—তোমরা হয়তো জানো যে পরজীবী বাদে অন্য গাছগাছড়া—বড় গাছ, ছোট গাছ, ঘাস ঝোঁপঝাড় সবাই মাটিতে শিকড় ঢুকিয়ে তার বাঁচার প্রয়োজনে জমি থেকে খাদ্য আর জল টেনে নেয়। মাটি বা জমিতে অনেক কিছু মিশে থাকে। ধাতু বা খনিজপদার্থও থাকে নানারকম। কোনোটা বেশি,কোনোটা কম। গাছের শিকড় মাটি থেকে সব কিছু নেয় তার দেহে। তার কাণ্ডে ও শাখা—প্রশাখায়। এই ভাবে নানা ধাতু ঢোকে উদ্ভিদ দেহে। এর ফলাফল হয় নানারকম। হয়তো কোনো ধাতু কোনো উদ্ভিদের পক্ষে উপকারী। গাছের খাদ্যে সেই ধাতু বেশি থাকলে ওই উদ্ভিদের বাড় বেশি হয়, ফল ফুল বেশি হয়। আবার একই উদ্ভিদের পক্ষে অন্য। কোনো ধাতু হয়তো ক্ষতিকর। সেই ধাতু খাদ্যের সঙ্গে বেশি পরিমাণে ওই উদ্ভিদের শরীরে ঢুকলে গাছের বাড় কম হয়। পাতা বা ফুলও কম হয়। পাতা ও ফুলের রং ও আকার বদলে যায়। বদলে যায় উদ্ভিদটির গড়ন। কখনো কখনো জমিতে ওই খনিজ দ্রব্য বেশি পরিমাণে থাকলে সেখানে ওই গাছের বীজ থেকে অঙ্কুরই জন্মাতে চায় না। আবার একই ধাতু অন্য এক উদ্ভিদ দেহে কোনো প্রভাবই ফেলতে পারে না। কয়েকটা উদাহরণ দিচ্ছি—
বেসিয়াম অবোভেটাম—এর একটি প্রজাতির সাহায্যে আফ্রিকা মহাদেশে জিম্বাবোয়ে রাজ্যে খনিজ তামা আবিষ্কার করা গেছে। এ একরকম জংলা ছোট গাছ। সূর্যমুখী ধরনের ফুল পাতা। এক গ্রাম মাটিতে অন্তত পঁচিশ মিলিগ্রাম তামা না থাকলে সেই মাটিতে এই গাছের বীজ থেকে অঙ্কুরোদগম হয় না। তাই এই প্রজাতির গাছ বা ঝোঁপ যেখানে বেশি ঘন দেখা যায়, জিওলজিস্টরা সেখানকার মাটি খুঁড়ে স্যাম্পল নিয়ে, সেখানকার পাথর নিয়ে পরীক্ষা করে দেখেন তামা আছে কি না এবং থাকলে পরিমাণে কেমন? বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তাদের ধারণা সঠিক প্রমাণিত হয়েছে। অর্থাৎ সেখানে মাটিতে যথেষ্ট পরিমাণে তামা মিলেছে।
আবার বেসিয়াম অবোভেটামের আর এক প্রজাতি আফ্রিকায় কঙ্গো রাজ্যে এবং কাছাকাছি অঞ্চলের জমিতে যথেষ্ট পরিমাণে তামা থাকার লক্ষণ জানান দেয়।
—হিউমেনিয়া কাঙ্গানিস এবং হিউমেনিয়া রবার্টি প্রজাতির উদ্ভিদ আফ্রিকার জাইরে রাজ্যে তামা আবিষ্কারের এক প্রধান সূত্র বলা যায়। এরা স্থানীয় জংলা ছোট গাছ। জাইরেতে বহু আগে অনেক তামার খনি ছিল। কিন্তু নানা কারণে খনিগুলিতে তামা তোলা বন্ধ হয়ে যায়। খনিগুলি পরিত্যক্ত হয়। খনি ঘিরে ঘরবাড়ি বসতির চিহ্ন লোপ পায় কালে কালে। কিন্তু ওইসব খনি এলাকার জমিতে প্রচুর পরিমাণে তামা থাকার ফলে পরিত্যক্ত বুজে যাওয়া খনিগুলির ওপর এবং কাছাকাছি জায়গায় ওই দুরকম উদ্ভিদের ঘন ঝোঁপ গজিয়ে ওঠে। পরে এখন ভূ—উদ্ভিদ বিজ্ঞানীরা জাইরেতে ওই দুরকম গাছের ঘন ঝোঁপ দেখলেই মাটি খুঁড়ে দেখেছেন সেখানে খনিজ তামা আছে কি না? পেয়েও গেছেন এইভাবে কয়েকটি পরিত্যক্ত তামাসমৃদ্ধ খনির হদিস। যে খনিগুলিতে এখনো যথেষ্ট পরিমাণে তামার আকর রয়েছে।
চায়ে চুমুক দিয়ে একটু থেমে মামাবাবু বললেন, আমি গাছপালা উদ্ভিদগুলোর— বৈজ্ঞানিক নাম করছি। এদের স্থানীয় নাম জানি না। কিছু জেনেছিলাম, ভুলে গেছি। শুধু ভারতব কিছু মিনারেল ইন্ডিকেটর প্ল্যান্টের দেশি নাম মনে আছে। তোমাদের আগ্রহ থাকলে দেশি বিদেশি মিনারেল—ইন্ডিকেটর প্ল্যান্টের স্থানীয় নাম খুঁজে পেতে জেনে নিও।
—হ্যাঁ, আরও কয়েকটা উদাহরণ দিচ্ছি। যেমন আরমেরিয়া ভালগারিস। প্রধানত শীতের দেশের গাছ+ছোট ঝোঁপ। জংলি বলা যায়। জমিতে যথেষ্ট পরিমাণ খনিজ তামা থাকলে এই উদ্ভিদের বাড় বেশি হয়, প্রচুর জন্মায় ঘন হয়ে। ওয়েলস—এ এই উদ্ভিদের বাড় ও ঘন ঝোঁপ লক্ষ করে বিজ্ঞানীরা কয়েক জায়গায় খনিজ তামাসমৃদ্ধ জলাভূমি আবিষ্কার করেছেন। মজার কথা কী জানো। হাইড্রানজিয়া ম্যাক্রোফাইল্লা নামে এক উদ্ভিদ—প্রজাতি যেখানে জন্মায় সেই জমিতে প্রচুর পরিমাণে খনিজ অ্যালুমিনিয়াম থাকলে এই গাছের ফলের রং হয় নীলচে। কিন্তু জমিতে অ্যালুমিনিয়াম না থাকলে কিংবা খুব সামান্য পরিমাণে থাকলে এর ফুলের রং হয় গোলাপি। সুতরাং ফুলের রং দেখে ধরা যায়, ওই গাছ যেখানে জন্মেছে সেই জমিতে খনিজ অ্যালুমিনিয়াম বেশি আছে কি না?
মামাবাবু ঝপ করে চুপ মেরে গেলেন। তারপর বললেন, নাঃ বড় বকছি। তোমাদের বোর করছি।
—না না বলুন। দারুণ ইন্টারেস্টিং লাগছে। আমি ও সুনন্দ সরবে জানাই।
মামাবাবু খুশি মুখে বললেন, বেশ, তবে আরও কয়েকটা উদাহরণ দিই। এই ধরো যে মাটিতে বেশি পরিমাণে জিংক অর্থাৎ দস্তা আছে সেখানে ভায়োলেট ফুলের গাছ খুব তেজি হয়, প্রচর হয়। জমিতে বেশি পরিমাণে দস্তা থাকলে ভায়োলেট ফুলের গাছের পাতা সবজের বদলে হলদে হয়ে যায়। ইউরোপে বেলজিয়াম এবং আরও কয়েকটি দেশে। ভায়োলেট গাছের পাতার রং লক্ষ করে সেখানে দস্তার খনি আবিষ্কার হয়েছে।
—জিপসাম—এরও ইন্ডিকেটর প্ল্যান্ট আছে। রাজস্থানে দেখা গেছে ক্যালোট্রোপস প্রোসেরা, আর পারসিকা এবং আর সিউডো—টোমেন্টোসা—এই তিন প্রজাতির গাছ এক জায়গায় প্রচুর জন্মালে সেখানকার মাটিতে যথেষ্ট পরিমাণ জিপসাম আছে ধরা যায়। এই গাছগুলি জংলা টাইপের। সরু চার—পাঁচ ফুট লম্বা, গাঁটে গাঁটে দুটি একটি পাতা থাকে।
—জানো কি, তামিলনাড়ুর সমুদ্রতটের বালিতে কোথাও কোথাও তেজস্ক্রিয় ধাতুর সন্ধান পাওয়া গেছে। প্রধানত সেরিয়াম এবং থোরিয়াম। ওই বালুময় জমিতে ক্যাথারেস রোসেয়াস, যার আর এক নাম মাগাস্কার পেরিউইংকিল জন্মালে গাছের গঠনে বিশেষ কিছু বিকৃতি লক্ষ করা গেছে। বৈজ্ঞানিক নামগুলো শুনে ঘাবড়িও না হে, এই গাছটির ফুলকে আমরা সাদা বাংলায় বলি নয়নতারা।
—জমিতে বা জমির নিচে শিলাস্তরে বেশি পরিমাণ তেজস্ক্রিয় ধাতু থাকলে ওই জমিতে জন্মানো অনেক উদ্ভিদের গড়ন বিকৃত হয়। উদ্ভিদের বাড় নষ্ট হয়, ফুল পাতার স্বাভাবিক রং বদলে যায়। এই যেমন কানাডায় গ্রেট বিয়ার হ্রদের কাছে জলাভূমিতে মাটির নিচে ইউরেনিয়াম আবিষ্কার হয়েছে যথেষ্ট পরিমাণে। ওই জলাভূমিতে পানিফলের মতো একরকম ফল জন্মায়। যে গাছের বৈজ্ঞানিক নাম এপিলোবিয়াম অগাস্টিফোলিয়াম। জলার মাটির তলায় প্রচুর ইউরেনিয়াম থাকার ফলে পানিফল জাতীয় ওই জলার গাছের ফুলের রং সবজের বদলে হয় সাদাটে।
মাটিতে বা মাটির তলায় শিলাস্তরে বেশি ইউরেনিয়াম থাকলে সেই জমিতে জন্মানো ছোট ঝোঁপঝাড়ের বাড় খুব কম হয়। এই সব জংলা ঝোঁপ সাধারণত মাটি থেকে খাদ্যের সঙ্গে যথেষ্ট পরিমাণ তেজস্ক্রিয় পদার্থ সেলেনিয়াম শোষণ করে। ফলে তাদের ডালপালা পাতা বিষাক্ত হয়ে যায়। গোরু ছাগল ইত্যাদি গবাদি পশু ওই সব গাছের ডাল—পাতা খেলে। অসুস্থ হয়ে পড়ে। যেহেতু সেলেনিয়াম ইউরেনিয়ামের সঙ্গে প্রায়ই, এক জায়গায় মিশে থাকে, এমনি বিষাক্ত ঝোঁপঝাড় নজরে এলে ভূ—উদ্ভিদ—বিদ্যা বিশেষজ্ঞ ব্যক্তি সেখানের মাটিতে বা মাটির তলায় সেলেনিয়াম এবং তার সঙ্গে ইউরেনিয়াম থাকতে পারে বলে। আন্দাজ করে। মাটি খুঁড়ে খোঁজে। উত্তর আমেরিকায় এই লক্ষণ বিচার করে কয়েকটা ইউরেনিয়ামের খনি আবিষ্কারও হয়েছে।
—কখনো কখনো দেখা গেছে, ঘন জঙ্গলে বা প্রচুর গাছপালার মধ্যে হঠাৎ একখণ্ড অনুর্বর প্রায় ন্যাড়া উদ্ভিদহীন ভূখণ্ড। এই দৃশ্য দেখলে ভূ—উদ্ভিদ বিজ্ঞানী তখুনি সেখানের জমিতে এবং জমির নিচে যথেষ্ট পরিমাণ তেজস্ক্রিয় পদার্থ থাকার সম্ভাবনা আশা করেন। ইউ. এস. এ. তে এই লক্ষণ বিচার করে আবিষ্কার হয়েছে কয়েকটি থোরিয়ামের আকর। আরও কিছু কিছু ইন্টারেস্টিং কেসের কথা মনে পড়ছে। কিন্তু গলাটা যে ধরে গেছে বকে বকে। বাবা সুনন্দ এক রাউন্ড চা খাওয়াও তো। মিকিকে ডাকার দরকার নেই। আমার তাঁবুতে স্টোভ, চা পাতা, চিনি কাপ—সব মজুদ আছে।
গরম চায়ে চমক দিতে দিতে মামাবাবু ফের শুরু করেন—জানো, কোথাও মাটিতে বা মাটির নিচে শিলাস্তরে যথেষ্ট পরিমাণ সোনা রূপা এমনকি হিরের ভাণ্ডার আছে কি না সেখানে জন্মানো কিছু গাছগাছড়ার বিশেষ বিশেষ লক্ষণ দেখে জিওবটানিস্টরা এখন আন্দাজ করতে পারেন মোটামূটি। যেমন ডেলোজিয়া ক্যানডিডা নামে এক জাতের উদ্ভিদ ব্রাজিলে হিরের ভাণ্ডারের সন্ধান দিয়েছে।
—বিরাট দেশ, যার অনেকটাই অজানা কিংবা মাহাসাগরে অজানা দ্বীপ যেমন এই বাস্তেন আইল্যান্ড, এইসব জায়গায় কিছু উদ্ভিদের রূপ ও লক্ষণ বিচার করে হঠাৎ কোনো খনিজ ভাণ্ডারের ক্লু পাওয়া যায়। অন্য উপায়ে প্রসপেকটিং—এর চেয়ে জিওবোটানি পদ্ধতির খরচ খুবই কম। কোন কোন উদ্ভিদের কী কী লক্ষণ সেখানে কোন কোন ধাতুর সম্ভাবনা প্রকাশ করছে তা জানা থাকলে সায়ান্টিস্টের মনে চট করে সন্দেহ জাগাবে। পরে অবশ্য যথারীতি মেনে খোঁজ ও খোঁড়াখুঁড়ি চালাতে হবে ডিপোজিট নানে আকরের পরিমাণ বুঝতে জানতে। তবে বৈজ্ঞানিকের মনে এনে সম্ভাবনা বা সন্দেহের উদয় হওয়াটাই একটা মস্ত লাভ।
—শুধু খনিজ ধাতু আবিষ্কার নয় জলহীন, প্রায় উদ্ভিদবিহীন রুক্ষ প্রান্তরে অ্যাকাসিয়া গ্ল্যালিফেরা নামে বাবলা জাতীয় গাছ হঠাৎ হঠাৎ কোথাও থাকলে ওই বিশেষ গাছ দেখে বোঝা যায় যে ওই গাছের কাছে মাটির তলায় জল আছে। সেখানে কুয়ো খুঁড়ে বা টিউবয়েল বসিয়ে জল পেতে পারো।
আফ্রিকা মহাদেশের আদিবাসীরা প্রাচীনকাল থেকে জলহীন শুষ্ক প্রান্তরে কোথাও এই বাবলা গাছ অ্যাকাসিয়া, গ্ল্যান্ডুলিফেরা জন্মেছে দেখলে বোঝে যে সেখানে মাটির নিচে জলের ভাণ্ডার আছে। সুনন্দ বলে ওঠে, কিন্তু আপনি মিকির মুখের পোস্ত গাছের বর্ণনা শুনে এখানে ছুটে এলেন কেন, তা তো বললেন না?
—বলছি এবার। আগে ভূমিকাটা করে নিলাম। প্যাপাভেরাসিয়া সংক্ষেপে প্যাপাভের ফ্যামিলির কিছু উদ্ভিদ জমি থেকে তাদের খাদ্যের সঙ্গে যথেষ্ট পরিমাণ তামা শোষণ করলে তাদের বৃদ্ধি বেশি হয়। প্যাপাভের হচ্ছে পপি জাতীয় গাছ। পোস্ত আর ক্যালিফোর্নিয়ান পপি প্যাপাভের গোত্রের উদ্ভিদ। মিকির মুখে যেই শুনলাম যে বাস্তেন দ্বীপে পোস্ত গাছের ঝাড় মস্ত বড়, ক্যালিফোর্নিয়ান পপি গাছগুলো আমার বাগানের চেয়ে অনেক বড় আর পুষ্ট, তখুনি সন্দেহ হয় যে ওই দ্বীপের মাটিতে বেশি পরিমাণ তামা থাকতে পারে। আমার বাগানের পপি গাছগুলোয় অন্য সার এবং অন্য খনিজ ধাতু দিয়েছিলাম কিন্তু তামা দিয়ে কখনো এক্সপেরিমেন্ট করিনি। তবে এটা যে ঘটে তা জানতাম। আর একটা কিন্তু ছিল। বাস্তেন দ্বীপের মাটিতে বা জলে কি ফসফেট বেশি? ফসফেট বেশি পরিমাণে গ্রহণ করলেও পপি গাছের বাড় বেশি হতে পারে। তাই নিজের চোখে ব্যাপারটা যাচাই করতে এতদুর এসেছি এবং এখনকার মাটিতে আর পাথরে খনিজ তামা যে প্রচুর পরিমাণে আছে তার প্রমাণও পেয়েছি।
—প্রমাণ কীভাবে পেলে? চোখে দেখে বুঝলে? সুনন্দর কণ্ঠে দ্বিধা।
—দূর বোকা, মামাবাবু হাসেন, চোখে দেখে কি তা বোঝা যায়? রীতিমতো কেমিকাল টেস্ট করে বলছি। রাসায়নিক পরীক্ষা। কালরিমেট্রিক টেস্ট।
—সেটা কী? আমি প্রশ্ন করি।
—খুব সোজা ব্যাপার। সামান্য জিনিসপত্র লাগে। আমার ওই বাক্সটাতেই সব আছে।
—কী রকম ভাবে করেন টেস্ট?
—অলরাইট। দু—চার কথায় বুঝিয়ে দিচ্ছি। ধরো, কোনো জমিতে বিশেষ কোনো খনিজ ধাতু আছে কি না জানতে প্রথমে সেখানকার অল্প একটু মাটি নাও অথবা সেখান থেকে ছোট পাথরের টুকরো নিয়ে মিহি গুঁড়ো করো। এরপর ওই মাটি বা গুঁড়ো পাথর টেস্ট—টিউবে বিশেষ রাসায়নিক দ্রব্য মেশানো তরলে ফেলো। এবার টেস্ট—টিউবটা ঝকাও। টেস্ট—টিউবের তরলের কী রং হয় লক্ষ করো। ওই রং দেখেই বুঝতে পারবে যে ওখানকার মাটিতে বা পাথরে যে ধাতু আছে ভাবছ তা সত্যি সত্যি আছে কি না? যদি থাকে, তরলের রং—এর ঘনত্ব বুঝিয়ে দেবে ওই ধাতু কী পরিমাণে আছে। বেশি না কম?
—ব্লো—পাইপ টেস্ট করেও অবশ্য এটা বোঝা যায়।
—সেটা কী?
—অতি সোজা পদ্ধতি। টেস্ট—টিউবে স্যাম্পল নিয়ে তাতে বিশেষ কেমিকাল মিশিয়ে বার্নারের ওপরে ধরে ব্লো—পাইপ দিয়ে ফুঁ দিলে ওই মিশ্র স্যাম্পলের যে রং হয় তাই দেখে। রং দেখে বুঝতে পারা যায় স্যাম্পেলে প্রধানত কী ধাতু আছে এবং কেমন পরিমাণে। যাগে আর সময় নষ্ট করব না আপাতত। তোমাদের আগ্রহ থাকলে দেশে ফিরে হাতে—কলমে পরীক্ষা করে দেখো।
সুনন্দ খুশি হয়ে বলে, যাক কপার তাহলে পেয়েছ। আমাদের এখানে আসা সার্থক হয়েছে।
—পেয়েছি বইকি। মামাবাবু সায় দেন দীপ্ত কণ্ঠে, শুধু কি তামা আরও দামি ধাতুও—বলতে বলতে তিনি যেন কথা গিলে ফেলেন। বুঝলাম যে কিছু চেপে গেলেন।
সুনন্দ বলে, ইন্দোনেশিয়ায় কি আর কোথাও তামা পাওয়া গেছে?
—গেছে বইকি। বোর্নিও সেলেবিস টাইমর—এর কয়েক জায়গায় কম বেশি তামার আকর আবিষ্কৃত হয়েছে। তাই এখানে পাওয়াটা মেটেই দৈবাৎ ব্যাপার নয়। জানো, বহু কোটি বছর আগে ভারতবর্ষ থেকে অস্ট্রেলিয়া অবধি ডাঙার যোগাযোগ ছিল। টানা ভখৎ। পরে ভূমিকম্প ইত্যাদি ভূ—প্রকৃতির আলোড়নে কিছু জায়গা জলের নিচে তলিয়ে যায়। সৃষ্টি হয় এখনকার দ্বীপময় ইন্দোনেশিয়া। ফের ভূকম্পে কিছু ডাঙা জলের ওপর মাথা তোলে। প্রচুর ছোট ছোট দ্বীপ সৃষ্টি হয়। তাই এখানে কাছাকাছি অঞ্চলের ভূ—প্রকৃতি এবং শিলাস্তরের গঠনে খুব মিল আছে। হয়তো কখনো জাভা, সুমাত্রা, নিউগিনিতেও তামা আবিষ্কার হবে। নাঃ অনেক বকেছি, আর নয়।
মামাবাবু ঢক ঢক করে এক গ্লাস জল খেয়ে একেবারে মৌনব্রত অবলম্বন করলেন।
আমি ও সুনন্দ তাঁর তাঁবু থেকে বেরিয়ে আসি অগত্যা।