» » বাস্তেন দ্বীপে অভিযান

বর্ণাকার

অজেয় রায়

বাস্তেন দ্বীপে অভিযান

পাঁচ

ঘণ্টাখানেক নৌকো যাত্রার পরেই একটা দ্বীপের রেখা দেখা দিল সমুদ্রের বুকে। কাছে। এগোতেই দ্বীপটা মাথা উঁচু করে, স্পষ্ট হয়। দ্বীপটা নেড়া নয়। ঘন গাছগাছালির দেখা পাওয়া যায়।

এ দ্বীপে থামা হবে, না পাশ কাটিয়ে যাব মামাবাবু ঠিক করবেন। মিকি একদৃষ্টে দেখছিল দ্বীপটা। সে হঠাৎ মামাবাবুকে ফিসফিসিয়ে বলল, প্রফেসর আমার সন্দেহ হচ্ছে যেন চেনা চেনা। হতে পারে বাস্তেন আইল্যান্ড। কতগুলো চিহ্ন মনে পড়ছে।

মামাবাবু তৎক্ষণাৎ মাঝিদের নির্দেশ দিলেন, এই দ্বীপে নৌকো লাগাও। দেখব দ্বীপটা।

দ্বীপে নামলাম। মামাবাবু হামিদকে বললেন, তোমরা বিশ্রাম করো। রান্নার আয়োজন করো। আমরা দ্বীপটা ঘুরে আসছি। দেখি, নতুন কিছু গাছপালা প্রাণী চোখে পড়ে কিনা।

এত তাড়াতাড়ি বিশ্রাম পেয়ে মাঝিরা তো খুশি।

মামাবাবু, সুনন্দ, আমি, মিকি ঢালু পাড় বেয়ে উঠি। ধীরে ধীরে দ্বীপের ভিতরে ঢুকি। ফকিরও সঙ্গে আসতে চাইছিল। কিন্তু মামাবাবু তাকে বারণ করলেন। বললেন, তুমি বরং টেন্ট আর আমাদের ব্যাগগুলো এনে পাড়ে রাখো। কিছু তেমন না পেলেও একটা দিন তো লাগবে ঘুরে দেখতে। একটা রাত অন্তত কাটাতে হবে।

দ্বীপের মাঝখানটা উঁচু। নাতি উচ্চ পাহাড় যেন। ওই উঁচু জায়গা থেকে চারধারে ঢাল নেমেছে। চলতে চলতেই দেখতে পাচ্ছিলাম। মিকি মাঝে মাঝে থামে। দেখে চারপাশে। সে বুঝি কিছু চিহ্ন খুঁজছে। সহসা একটা বাঁক নিয়ে মিকি থমকে যায়। দেখি যে পাহাড়ের গা বেয়ে একটা ঝরনা নামছে। ক্ষীণ স্রোতোধারা। গাছপালার ফাঁকে ফাঁকে ঝরনার কিছু অংশ দেখতে পাই।

মিকি ঝরনাটা দেখতে দেখতে প্রায় চেঁচিয়ে ওঠে, প্রফেসর এটাই বাস্তেন আইল্যান্ড। আমি নিশ্চিত। সেবারও এই ঝরনাটাকে ঠিক এই অ্যাঙ্গেলে প্রথমবার দেখেছিলাম উঠতে উঠতে। চলুন ওপরে, বাস্তেন সাহেবের ঘরবাড়িরর চিহ্ন কী কী আছে দেখতে পাবেন।

মামাবাবুর চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। বলেন, থ্যাংক ইউ মিকি। তোমার আশা পূরণ হোক। যাক বেশি ঘুরতে হল না খুঁজতে।

আঁকা বাঁকা সরু পথ ধরে উঠি। খুব খাড়া নয় পথ। মামাবাবু যেতে যেতে আশেপাশের গাছপালা নজর করতে করতে বললেন, এখানকার গাছপালা দেখছ? অভিনব কিছু চোখে পড়ছে? এ দ্বীপে লোক বাস করত তার প্রমাণ রয়েছে। দেখ, মাঝেমাঝে পাহাড়ের গা। কেটে সমতল করা হয়েছে। আর এখানকার গাছগুলো দেখ।

তা একটু মনে হচ্ছিল আমারও। এবার খুঁটিয়ে নজর করি। সহসা একটা মস্ত ঝাকড়া গাছের দিকে আঙুল দেখিয়ে মামাবাবু বললেন, কী গাছ চিনতে পারো?

আমি দেখেই বলি, তেঁতুল না?

—হুঁ। করেক্ট। মামাবাবু মিকিকে বললেন, তুমি এ গাছটা দেখেছিলে আগেরবার।

—দেখেছিলাম। তবে অনেক ছোট ছিল। এই ছোট দ্বীপগুলোয় তেঁতুলগাছ বড় একটা। দেখা যায় না। এ গাছ প্রচুর আছে সুমাত্রা জাভা মালয়ের জঙ্গলে। তেঁতুল বিচি তো পাখিতে খায় না। ফলে দূরে সাগর দ্বীপে তেঁতুল গাছ পাখিরা বিচি ছড়ায় না। তেঁতুল গাছ সাধারণত মানুষই আনে। এ দ্বীপে বাস্তেন ছাড়া আর কেউ ছিল বলে শুনিনি। বাস্তেনই তেঁতুলের চারা বা বিচি পুঁতেছিল।

দেখা গেল এক জায়গায় পাথর কেটে সিঁড়ি বানানো হয়েছে। ক্ষয়ে গেলেও এখনো ওঠা যায় সিঁড়ি বেয়ে। খানিক সিঁড়ি দিয়ে উঠেই দেখা গেল মস্ত সমতল এক চত্বর। পাথর ও মাটি কেটে বানানো। সেখানে একদা মনুষ্য বসতির ছাপ স্পষ্ট। আমরা থমকে গিয়ে দেখি।

মিকি বলে ওঠে খুশিতে, এইখানেই ছিল বাস্তেন সাহেবের বাড়ি। আগেরবার যা দেখেছি তা নেই। বেশির ভাগই নষ্ট হয়ে গেছে। তবু বোঝা যায়। ওই দেখুন—

চত্বরের মাঝে অনেকগুলো সরু লম্বা হাত দুই উঁচু পাথরের বেদি। চৌকো ইটের মতন পাথর মাটি দিয়ে গেঁথে তৈরি। তবে বেদিগুলো ভেঙে গেছে অনেক জায়গায়। মাটি ও পাথর স্তূপ হয়ে রয়েছে জায়গায় জায়গায়। দেখে মনে হল যে ওই পাথরের বেদিগুলোর ওপর তৈরি হয়েছিল বাস্তেনের বাড়ি। ঘরগুলো হয়তো ছিল বাঁশ ও কাঠের। কয়েকটা ছোট বেদি মনে হল বসার জন্য ব্যবহার হত, যেগুলো কিছু দূরে দূরে।

অবাক কাণ্ড একটা ছোট ঘর তখনো টিকে আছে। চত্বরের এক কোণে ঘরটা। ঘরটার দেয়াল পাথরে তৈরি আর ছাদ টিনের। ছাদে টিনের পাত অবশ্য এখন রংচটা এবং ফুটো ফুটো। হয়তো ওটা গুদামঘর জাতীয় কিছু ছিল। ঘরটার দরজা জানলার পাল্লা নষ্ট হয়ে গেছে। ভিতরে আগাছার জঙ্গল। বাইরে কয়েকটা মুরগি খুঁটে খুঁটে খাচ্ছে।

সুনন্দ ওই ঘরের হাঁ—করা দরজা দিয়ে ভিতরে উঁকি দিতেই মিকি তাকে সাবধান করে, ভিতরে ঢুকো না। বিষাক্ত সাপ থাকতে পারে।

সুনন্দ সভয়ে পিছিয়ে বলে, এখানে সাপ আছে নাকি?

——থাকতেই পারে। আন্দালুস আর মালয় জঙ্গলে বিষাক্ত সাপ প্রচুর। জাভাতেও আছে। সেগুলো জলে ভেসে বা নৌকো আর জাহাজের খোলে ঢুকে লুকিয়ে এই সব ছোট দ্বীপে হাজির হয়। বান্দা সাগরে একটা ছোট দ্বীপে লোকে তো কিং কোবরার ভয়ে মোটে পা দেয় না। আগে ছিল না ওখানে। কী করে যে এসে ওই দ্বীপে আস্তানা গেড়েছে। দ্বীপটায় প্রচর এলাচ হয়। কয়েক ঘর লোক বাস করত দ্বীপটায়। তারা সবাই কিং—কোবরার ভয়ে পালিয়েছে দ্বীপ ছেড়ে। সাপগুলো মারার চেষ্টা হচ্ছে সরকার থেকে।

মামাবাবু বললেন, তা বটে। সুমাত্রা আর মালয় জঙ্গলে কিং—কোবরা মানে শঙ্খচূড় সাপ সাইজে পৃথিবীর সেরা। বারো—চোদ্দ যুট অবধি লম্বা হয়। ওদের সব প্রাণী ভয় পায়। যা সাংঘাতিক বিষ আর তেড়িয়া মেজাজ। তবে এখানে কিং কোবরা নেই। তাহলে কি আর মুরগিগুলো নিশ্চিন্তে মাটিতে চড়ে বেড়ায়।

মিকি বলল, শুধু মুরগি কেন, এখানে ছাগল আর পাতিহাঁস আছে। আমি আগেরবার দেখেছি। নিশ্চয় বাস্তেন সাহেবের আমদানি। এখন বুনো হয়ে গেছে।

নারকেল গাছের কথা ধরছি না। গোটা ইন্দোনেশিয়ায় সর্বত্র নারকেল গাছের ছড়াছড়ি। আপনি জন্মায়। বাড়ে। নারকেলের খোলা ছোবড়া দিয়ে ইন্দোনেশিয়ায় নানান শিল্পবস্তু বা কাজের জিনিস তৈরি হয়। নারকেল তেল হয়। শাঁস খায়। যেমন ভারতের দক্ষিণ অঞ্চলে। এ দ্বীপেও নারকেল গাছ প্রচুর। তবে আমাদের লক্ষ্য অন্য বিশেষ ধরনের গাছপালা কী আছে এ দ্বীপে।

চত্বরের একধারে একটা গাছ দেখে আমরা চমৎকৃত। আমগাছ।

মিকি বলল, ম্যাংগো ট্রি এই দ্বীপে আরও আছে। তবে ইন্ডিয়ান ম্যাংগোর মতন খেতে ভালো নয়। আমি খেয়ে দেখেছি আগের বার। এ গাছও হয়তো বাস্তেন লাগিয়েছিল জাভা সুমাত্রা থেকে এনে।

চত্বরে তখনো কিছু লোহা টিন অ্যালুমিনিয়াম ইত্যাদি ধাতুর ভাঙা রড পাত্র ছড়িয়ে পড়ে ছিল। সব ধাতুই মরচে ধরা। গাছের ডালে তখনো ঝুলছে কিছু ভেঁড়া দড়ি আর ক্যানভাসের টুকরো। তখনো কয়েকটা মোটা কাঠের গুঁড়ি মাটিতে শুয়ে বা বেদির গায়ে হেলান দেওয়া অবস্থায় রয়েছে, তাদের গায়ে পুরু শ্যাওলার আস্তরণ। এসব চিহ্ন সুদূর অতীতের স্মৃতিকে জাগায়, বিষণ্ণ করে মন। এই কারণেই এই দ্বীপে এলে বাইরের লোকের ভীষণ ভাবে বাস্তেনকে মনে পড়ে। এ যে তার অতি প্রিয় বাসভূমি ছিল। ফলে মনে জাগে বাস্তেনের অলৌকিক উপস্থিতির গা ছমছমে অনুভূতি। সাদা বাংলায় বাস্তেনের প্রেতাত্মার ভয়।

চত্বরের একধারে কয়েকটা ফুল গাছ দেখে আমরা অবাক। পাঁচটা পরপর বেলফুলের গাছ আর একটা গন্ধরাজ। বেলফুলের গাছগুলো মস্ত ঝকড়া হয়েছে আর গন্ধরাজটাও বিরাট। প্রচুর  জল পাওয়া ফল। ফুলে ফুলে ভরে গেছে সব গাছ। কাছে যেতেই পাই বাতাসে ভেসে আসে সুবাস। বাঃ ফন বাস্তেন পুষ্পবিলাসীও ছিলেন।

মামাবাবু কিন্তু বাস্তেনের পোডড়া ভিটে দেখতে আধঘণ্টাও কাটাতে চাইলেন না। মিকিকে তাড়া লাগালেন, সেই ওপিয়াম গাছগুলো কোথায় দেখেছিলে? নিয়ে চলো। দেখব।

ঝরনার ধারে ধারে নামলাম কিছুটা। মূল ঝরনা থেকে একটা সরু শাখা ডান ধারে বেরিয়ে গেছে এক জায়গায়। মিকি এবার ওই শাখা স্রোত অনুসরণ করল। পিছু পিছু আমরা। ঝরনা স্রোতে মাটি ধুয়ে পাথর বেরিয়ে পড়েছে। হলদে এবং লালচে কালো রং—এর পাথর। স্রোতোধারার আশেপাশে ছড়িয়ে ছিল অজস্র পাথুরে নুড়ি।

শাখা স্রেতটি খানিক গিয়ে পড়েছে গোল কড়াইয়ের আকারের এক নিচু জায়গায়। সেখানে ছোট এক ডোবা সৃষ্টি হয়েছে। ডোবা থেকে বাড়তি জল উপচিয়ে ফের ক্ষীণ স্রোতোধারায় নেমে গেছে আর এক দিকে গাছপালার ফাঁকে ফাঁকে। ওই ডোবার চারধাবেই দেখলাম পোস্ত গাছের ঘন ঝোঁপ। মানে যা থেকে হয় আফিম বা ওপিয়াম। মামাবারক বাগানে এই জাতীয় গাছই দেখেছি। তবে এখানকার পোস্ত গাছ অনেক বেশি সতেজ, বড় ও ঝাকড়া। গাছগুলোয় কিছু হলুদ ফুল ফুটে আছে।

মামাবাবু অনেকক্ষণ মনোযোগ দিয়ে গাছগুলো নজর করলেন। তারপর ব্যাগ থেকে সরু বেঁটে শাবল বের করে ওখানকার মাটি খুঁড়ে তুলে দুটো ছোট প্লাস্টিকের কৌটোয় ভরলেন। ওখান থেকে কিছু নুড়ি পাথরও নিলেন স্যাম্পল হিসেবে। শিশিতে নিলেন ঝরনার জলের স্যাম্পল। সব স্যাম্পল ব্যাগে ভরলেন। তারপর মিকিকে বললেন ক্যালিফোর্নিয়ান পপি কোথায় দেখেছিলে? এখানে তো দেখছি না?

—ছিল। দেখেছি আমি। এখান থেকে খানিক দূরে যেতে হবে। তবে এতদিনে ৯, আছে কিনা জানি না? জানায় মিকি।

কখনো গাছ পালার ফাঁকে ফাঁকে সরু পথ ধরে, কখনো খোলা আকাশে মাথার ওপর গনগনে সূর্য দেখতে দেখতে, ফের কটা বড় গাছের ঘন ছায়ায় এসে মিকি বলল, এইখানে দেখেছিলাম সেই গাছ। সেখানে ওপরে ঠাস পাতার আচ্ছাদন থাকায় নিচে রোদের তাত খুব কম। দিব্যি ঠাণ্ডা জায়গাটি।

মামাবাবু তীক্ষ্ণ নজরে খুঁজতে থাকেন। মিকিও। মিকিই দেখতে পায় প্রথমে, ওই তো।

তাই বটে। বড় বড় পুরু পাতা ঘাসের মতন এক টুকরো জায়গায় ওই ধরনের পপি গাছ কার্পেটের মতো বিছিয়ে আছে। দু—চারটে গোলাপি ফুল ধরেছে লম্বা বোঁটার ডগায়।

মামাবাবু ভালো ভাবে পরীক্ষা করে বললেন, স্থ। ক্যালিফোর্নিয়ান পপিই বটে। তবে ঠাণ্ডা দেশের উদ্ভিদ তাই ছড়ায়নি তেমন, ফুলও ফোটেনি। তবে গাছগুলো বেশ পুরুষ্ট।

ওই পপি গাছ এবং সেখানকার মাটি স্যাম্পল হিসেবে সংগ্রহ করে ব্যাগে পুরলেন। মামাবাবু। বললেন, আপাতত ফেরা যাক। তোমাদের খিদে পায়নি?

পেয়েছে বইকি। সঙ্গে খাবারও আছে। মামাবাবুর ভয়ে কথাটা তুলতে সাহস পাইনি। এতক্ষণ। এখন উনি এমন ভাব দেখাচ্ছেন যেন আমরাই গা করিনি।

নৌকোর কাছাকাছি গাছের ছায়ায় আমরা খেতে বসলাম। মামাবাবু মিকিকে বললেন, আমরা শুকনো খাবার খাব। তুমি কী খাবে? আমাদেরটা? না মাঝিদের রান্না ভাত মাছ? মিকি সলজ্জভাবে জানায়, ভাত মাছ।

—বেশ। আমরা এখানে খাচ্ছি। তুমি মাঝিদের সঙ্গে খেতে যাও। খেয়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে যাচ্ছি। তারপর তাঁবু খাটাব।

মিকি চলে যায়।

আমরা খাচ্ছি স্যান্ডুইচ, পাকা কলা, সিদ্ধ ডিম। হঠাৎ হন হন করে হাজির হল মিকি। উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলল, মুশকিল হয়ে গেছে।

—কী ব্যাপার?

মিকি বলল, মাঝিরা টের পেয়ে গেছে এটা বাস্তেন আইল্যান্ড। ওরা আর এখানে থাকতে চাইছে না।

—কী করে বুঝল? আমরা জানতে চাই।

—দুজন মাঝি গিয়েছিল দ্বীপের ভিতর খাবার জল আর রান্নার কাঠকুঠো জোগাড় করতে। ওরা ঘুরতে ঘুরতে দেখে ফ্যালে বাস্তেন সাহেবের পোড় ভিটে। ওদের একজন আগে এসেছিল একবার এই দ্বীপে। জানত এটা বাস্তেন আইল্যান্ড। অন্য মাঝিরা চিনত না। তারা আসেনি আগে। তবে এই দ্বীপের দুর্নাম শুনেছে। শুনেছে, এটা নাকি ভুতুড়ে দ্বীপ। যে এসেছিল তার কাছে শুনে অন্য মাঝিরাও ভয় পেয়ে গেছে। থাকবে না বলছে।

মামাবাব বললেন, কিন্তু আমার যে এ দ্বীপে কয়েক দিন থাকতেই হবে। ওরা যাণ আমাদের ফেলে নৌকো নিয়ে পালায় ওদের পাওনা আমি দেব না, বলে দিও।

একটু ভেবে মামাবাবু বললেন, বাস্তেন দ্বীপে রাতে থাকতেই তো ভয় এদের?

—হাঁ তাই।

—তবে একটা প্রস্তাব দাও মাঝিদের। দিনের বেলা ওরা কাটাক এখানে। অন্ধকার হবার আগেই চলে যেতে পারে কাছে কোনো দ্বীপে রাত কাটাতে। পরদিন সূর্য উঠলে আসুক এখানে। বাস্তেনের ভিটের কাছে যাবার দরকার নেই ওদের। সমুদ্র তীরেই কাটাক। আমাদের যতটুকু পারে সাহায্য করবে এখানে। আবহাওয়া খারাপের জন্য কোনো কোনো দিন এখানে না এলেও আমার আপত্তি নেই। মোট কথা আমাদের ফেলে রেখে দেশে পালানো চলবে না। এই দ্বীপের গাছপালা এবং আরও কিছু কিছু জিনিস আমি খুটিয়ে দেখব। এতদূর কষ্ট করে আসা কি বৃথা যাবে? আচ্ছা তুমি কী করবে?

মিকি বলল, আমি এখানেই থাকব। বলেছি তো আমার ভূতের ভয় নেই।

—ভেরি গুড। যাও। চটপট জানাও মাঝিরা কী ঠিক করল। বলো যে তাদের এই বাড়তি খাটুনি আমি পুষিয়ে দেব বেশি টাকা দিয়ে।

মিকি চলে যায় চিন্তিত মুখে। আমি ও সুনন্দও চিন্তিত। আমাদের এখানে ফেলে রেখে মাঝিরা নৌকো নিয়ে চম্পট দিলেই গেছি। কীভাবে উদ্ধার পাব তাহলে? প্রাণের চেয়ে কি টাকার লোভ বেশি? অথচ মামাবাবু যা জেদি নিজের ইচ্ছে থেকে এক চুলও সরবেন না। তাতে যা বিপদই ঘটুক। মাঝিরা পালাতে চাইলে মিকি কি আর থাকবে আমাদের সঙ্গে? সেও পালাবে ঠিক। দুশ্চিন্তায় চুমুক দিতে ভুলে গিয়ে কফি ঠাণ্ডা করে ফেলি।

মিকি ফিরে আসে ঘণ্টাখানেক বাদে। মুখে খুশি।—হ্যাঁ মাঝিরা রাজি হয়েছে মামাবাবুর শর্তে। কাছে যে দ্বীপ থেকে আমরা এখানে এসেছি সেখানে তারা ফিরে যাবে সন্ধের আগে। আমাদের সাহায্য করবে দিনের বেলা।

শুনে আমরা উৎফুল্ল। হাঁপ ছাড়ি। মামাবাবু বললেন, ওদের এ দ্বীপে বেশি ঘোরাঘুরির দরকার নেই। আমাদের রান্না করে দিলেই চলবে। আচ্ছা ফকির কী করতে চায়?

মিকি জানাল, ফকির আমাদের সঙ্গে বাস্তেন দ্বীপেই থাকবে বলেছে। মানে রাতেও।

—ওর বুঝি ভূতের ভয় নেই?

একেবারে নেই তা নয়। তবে ও আমার সঙ্গে থাকতে চায়। আসলে আমায় খুশি করতে চায়।

—কেন?

মাইনে দিচ্ছি আমি।

মামাবাবু অবাক।

—হাঁ আপনি ওর বস্ ঠিক কথা। কিন্তু আমি যে ওকে চাকরিটা পাইয়ে দিয়েছি। সেই কৃতজ্ঞতায়—

—একটু খোলসা করে বলো। মামাবাবু ভুরু কোঁচকান।

বারকয়েক চোখ পিটপিট করে ইতস্তত ভাবে মিকি জানায় রহস্যটা।

জাকার্তায় কয়েকটা নৌকোর মাঝিদের সঙ্গে কথা বলার পর মিকি হামিদের সঙ্গে কথা পাকা করে। কোথায় কোথায় যেতে হবে, কী কী করতে হবে ইত্যাদি জানানোর পর দরাদরি করে ভাড়া পাওনাগণ্ডা ঠিক হয়। হামিদের কাছ থেকে চলে আসছে মিকি তখন হঠাৎ ফকির মিকিকে পাকড়াও করে। মিকি আগে চিনত না ফকিরকে। ফকির মিকিকে করুণ কণ্ঠে জানায় যে তার একটা চাকরির খুব দরকার। যে নৌকোয় ফকির কাজ পেয়েছিল, গ্রাম থেকে ফিরতে দেরি হওয়ায় সেই নৌকো ফকিরের জন্য অপেক্ষা না করে ছেড়ে গেছে। অতএব ফকির এখন বেকার। বাড়িতে তার সংসার আছে। গরিব মানুষ সে। বেশি দিন কাজ না করে কি তার চলে? মিকি যদি তাকে একটা কাজ জুটিয়ে দেয় এই নৌকো যাত্রায় সে বড় কৃতজ্ঞ হবে। মিকিরা বেরুচ্ছে শিগগিরি সে জেনেছে। ফকিরের পুরোনো চেনা নৌকোয় ফিরতে অন্তর মাসখানেক লাগবে। এখনো সে কোনো কাজ জোটা পারেনি। মাইনে সে বেশি চাইবে না। সবরকম কাজই সে জানে—

মিকির দয়া হয়। সে হামিদকে অনুরোধ করে ফকিরকে ওর নৌকোয় কাজ দিতে। হামিদ প্রথমে মোটেই রাজি ছিল না ফকিরকে নিতে। মিকি ধরাধরি করতে বলে যে বেশ চলুক সঙ্গে তবে ওর মাইনে আমি দিতে পারব না, শুধু খাওয়া দেব। মিকি তখন চালাকি করে ফকিরের মাইনের টাকাটা হামিদের নৌকো ভাড়ার সঙ্গে জুড়ে দিয়ে মোট ভাড়া কত লাগবে জানায় মামাবাবুকে। পুরো ব্যাপারটা আর ভাঙেনি মামাবাবুর কাছে। এই জন্যেই আমায় একটু স্পেশাল খাতির করে। এই আর কি—মিকি সলজ্জ ভাবে জানায়।

—হুম। ফকিরের আসল বস্ তাহলে তুমি। আমি নয়। মামাবাবু টিপ্পনি কাটেন। মিকি অপ্রতিভ। বলে, তা লোকটা সত্যি কাজের। তাই না?

মামাবাবু বললেন, বেশ চাইলে থাকুক ফকির। তোমার সঙ্গে থাকবে ছোট তাঁবুটায়। আমরা থাকব বড় দুটো তাঁবুতে। আমাদের শোবার ক্যাম্প খাট আছে। তোমরা বাঁশের মাচা করে তার ওপর বিছানা পেত। এখানে তো মাটিতে শোয়া যাবে না। যা বৃষ্টি।

মিকি মহা খুশি হয়ে দৌড়াল ফকিরকে খবর দিতে।

তাঁবু খাটাতে, জিনিসপত্র গোছগাছ করতে করতে সেই দিনটা কেটে গেল। সূর্য ডোবার ঢের আগেই হামিদ তার দুই সঙ্গীসহ নৌকো নিয়ে চলে গেল কাছের দ্বীপে —যেখানে শিলালিপি পাওয়া গেছে, সেই দ্বীপটায়।