☼ অজেয় রায় ☼
বাস্তেন দ্বীপে অভিযান
চার
একটা দ্বীপকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গেল আমাদের নৌকো। দ্বীপে যে মানুষের বসতি আছে বোঝা গেল তীরে কয়েকজন লোকের ঘোরাফেরা দেখে। মামাবাবু ওই দ্বীপে না থানার নির্দেশ দিলেন।
মামাবাবু চোখে দূরবিন লাগিয়ে লক্ষ করছিলেন। একবার বললেন, পিছনে একটা নৌকো আসছে আমাদের পথে।
হামিদ বলল, এদিকের কোনো দ্বীপে আসছে। অনেক দ্বীপেই লোক বাস করে।
দুপুরে হঠাৎ মেঘ করল। বাতাসের জোরও বাড়ছে। হামিদ বলল, কোথাও নোলে ভেড়ানো উচিত। বেশিক্ষণ বৃষ্টি চললে চারপাশ ভালো দেখা যায় না। নৌকো কোন্ দিকে কত দূর ভেসে যাবে কে জানে?
সত্যিই একটু বাদে তুমুল বৃষ্টি শুরু হল। তবে ঝড় ওঠেনি রক্ষে। সৌভাগ্যের বিষয় একটা দ্বীপের তটরেখা দেখা গেল কাছেই। পাল নামিয়ে ফেলে প্রাণপণে দাঁড় টেনে মাঝিরা কোনোরকমে ওই দ্বীপের কূলে নোঙর ফেলল।
দুজন মাঝি বারিধারার মাঝেই ডাঙায় উঠে গেল আশ্রয়ের সন্ধানে। ছইয়ের ঝাপের ফাঁক দিয়ে দেখি চারপাশ লেপেপুঁছে গেছে ছাঁটে। এদেশে এই এক অসুবিধা। যখন তখন বৃষ্টি নামে। কখনো কখনো প্রবল বর্ষণ। নিরক্ষরেখার খুব কাছে বলেই হয়তো এই ব্যাপার। ঘটে। তবে এখানকার লোক এই আবহাওয়ায় অভ্যস্ত।
আধঘণ্টাটাক বাদে মাঝি দুজন ফিরে এসে বলল যে দ্বীপের এধারে কোনো ঘরবাড়ি মানষের দেখা পায়নি। নেহাতই ছোট দ্বীপ। গাছপালা প্রচুর। কয়েকটা পাথরের টিলা আর ছোট ছোট গুহা দেখেছে। তার মধ্যে আশ্রয় নেওয়া যায়।
বষ্টি অবশ্য বেশিক্ষণ চলেনি। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে থেমে গেল। আমরা তখন পাড়ে নামলাম। গুহাগুলোয় আর পাথরের ছাদের মতো আড়ালে আশ্রয় নিলাম। মাঝিরা রান্নার আয়োজনে লাগল। গল্পগুজবে মেতে গেল তারা।
——এক প্রস্থ চা হবে নাকি? ফকির জানতে চাইতেই আমরা মহা খুশি। লোকটি বোঝদার বটে।
সন্ধে নেমে গেল। আকাশে বাঁকা চাঁদ দেখা দেয় দরে দিগন্তবিস্তারী সাগরজলের ওপরে। সেদিন আর বাইরে বেরুনোর চেষ্টা করিনা।
পরদিন দ্বীপটা দেখতে বেরোলাম।
মাঝিরা ঠিকই আন্দাজ করেছিল। নেহাতই ছোট ভূখণ্ড। মানুষের বসতি নেই। দ্বীপের অপর পাশে বেশ উঁচু একটা পাথরের চাতাল। চাতালে বিছানো রয়েছে অজস্র ছোটবড় পাথরের টুকরো। আর নুড়ি। সেখানে গিজগিজ করছে অজস্র সামুদ্রিক পাখি। তাদের কলতানে মুখর জায়গাটা। ছোট ছোট পাখিগুলো সাদা—কালো মেশানো রং। আমাদের আবির্ভাবে পাখিরা কিঞ্চিৎ বিরক্ত হল বটে তবে ভয় পেয়ে পালাল না উঠে। বুঝলাম মানুষের সংস্পর্শে এরা এত কম আসে যে মানুষ সুবিধের প্রাণী নয় এই বোধটাই তাদের নেই।
মামাবাবু মন্তব্য করলেন, এই দ্বীপটা কিন্তু খুব দামি।
—কেন? দামি তো কিছু দেখছি না। কিছু জংলি গাছ আছে শুধু।
—কারণ গুয়ানো। দ্বীপে এত সামুদ্রিক পাখির আস্তানা। এদের শুকনো মল জমে শক্ত হয়ে তৈরি হয় ফসফেট সমৃদ্ধ অতি দামি চাষের সার গুয়ানো। যা চেঁচে তুলে নিয়ে বিক্রি করতে চাইলে খদ্দেরের অভাব হবে না। তবে এখানে বৃষ্টির জলে কেবলই ধুয়ে যাবার ফলে গুয়ানো সার বেশি জমবে বলে মনে হয় না।
দ্বীপটায় একটা আশ্চর্য জিনিস দেখলাম।
দ্বীপের মাঝামাঝি জায়গায় খানিক উঁচুতে অনেকটা সমতলভূমি ছিল। সেখানে দেখি একটা পাথরে বাঁধানো চত্বর। কে বানাল? চত্বরটা বড় নয় বেশি। চত্বরের মাঝে প্রচুর চৌকো ছোট আকারের পাথরের টুকরো পড়ে আছে এলোমেলো ভাবে। মনে হল যে পাথরের দেয়ালে তৈরি একটা ঘর ছিল সেখানে। ভেঙে গেছে। পনেরো—ষোলোফুট লম্বা। এবং দশ ফুট মতন চওড়া ঘরের চিহ্ন বোঝা যায়। তার মাঝখানে পড়ে আছে একটা চারকোনা ইঞ্চি ছয়েক পুরু পাথরের খণ্ড। আয়তাকার। লম্বায় তিনফুট, চওড়ায় দু—ফুট মতন।
আমিই প্রথম নজর করলাম যে ওই পাথরটার মসৃণ গায়ে খোদাই করে কী জানি সব লেখা। কিছু লেখা মুছে গেছে, চটে গেছে। মামাবাবুকে ডেকে দেখালাম। উনি তীক্ষ্ণ চোখে পাথরটা দেখে উলটো দিকে গিয়ে লক্ষ করে বলে উঠলেন, আরে এতো সংস্কৃত অক্ষর। কী লিখেছে ধরতে পারছি না? শিলালিপি জাতীয় কিছু। কয়েকটা সংস্কৃত অক্ষর চিনতে পারছি।
সংস্কৃত ভাষায় শিলালিপি এখানে? আমি ও সুনন্দ তাজ্জব।
মামাবাবু বলেন, অসম্ভব কেন? এক সময়ে এই অঞ্চলে ভারতীয়রা প্রচুর ঘরেছে। রাজত্ব করেছে। তারাই কেউ হয়তো এখানে পাথরের ঘর বানিয়ে শিলালিপিটা রেখেছিল। কী লেখা আছে আমি উদ্ধার করতে পারছি না। সুনন্দ ক্যামেরাটা বের করো। ফোটো তুলে নিই। যারা দক্ষিণ—পূর্ব—এশিয়া আর শিলালিপি নিয়ে রিসার্চ করেন তাদের দেখাব। মনে হচ্ছে চার লাইন লেখা ছিল।
মামাবাবু অনেকগুলো ফোটো তুললেন, পাথরের চত্বর, ভাঙা ঘর, শিলালিপি ইত্যাদির। নোটবই বের করে নোটও লিখলেন কিছু।
লেখাটা কী হতে পারে? আমি ও সুনন্দ উত্তেজিত। হতে পারে দারুণ একটা আবিষ্কার।
সেদিন মাঝিরা পুরোপুরি বিশ্রাম নিল। আগের দিন তাদের ধকল কম হয়নি। ফকির এ মিকি বেশির ভাগ সময় মাঝিদের সঙ্গে কাটাল।
মামাবাবু সুনন্দ ও আমাকে সঙ্গে নিয়ে দ্বীপের গাছপালা পাথর জমি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলেন। স্যাম্পলও নিলেন কিছু।
ফকির একটা মস্ত সামুদ্রিক কাঁকড়া ধরে এনে দিল আমাদের। সুনন্দ খাঁড়ির মধ্যে ছিপ ফেলে ধরল দুটো পেল্লাই সাইজের সামুদ্রিক চিংড়ি। চিংড়ি ধরার কায়দাটা মজার। শক্ত লম্বা সুতোর মাথায় বঁড়শিতে টোপ গেঁথে ও সোজা নামিয়ে দিল জলের ভিতর পাথরের খাঁজে। বাঁশের হাতলটা হাত দুই মাত্র। ফাতনা ডুবতেই সুনন্দ অতি ধীরে সুতো গুটোয়। জল ছেড়ে বঁড়শি বেরিয়ে আসতেই দেখি একটা বিরাট চিংড়ি প্রাণপণে আঁকড়ে আছে বঁড়শি ও সুতো, খাচ্ছে টোপ। যখন সে সুনন্দর খপ্পরে পৌঁছে গেল তখনও হুঁশ নেই, খেয়ে যাচ্ছে টোপ। সুনন্দ বলল, চিংড়ি এমন আঁকড়ে ধরে বঁড়শি সুতো যে চট করে ছাড়াতে পারে না নিজেকে।
সেদিন সুনন্দ রাঁধল কঁকড়ার রোস্ট আর বাগদা চিংড়ির কালিয়া। রান্নার প্রয়োজনীয় মশলা সে সঙ্গে এনেছিল। দক্ষিণ—পূর্ব এশিয়ায় মশলার অভাব নেই। এখানে অনেক দ্বীপকে বলে মশলা দ্বীপ। গরম মশলা, লবঙ্গ, দারচিনি, এলাচ ইত্যাদি নানা মশলার গাছ এখানে প্রচুর।
গরম ভাতের সঙ্গে চিংড়ি কাঁকড়া যা জমল। বেশ গুরুভোজন হয়ে গেল।
ফকিরের এক নতুন বিদ্যের কথা জানালাম। ও নাকি আতসবাজি বানাতে ওস্তাদ। একটা উঁচু জায়গায় নিজে হাতে তৈরি একটা তুবড়ি জ্বালল সন্ধের সময়। আর একটা হাউই ছাড়ল। দুটোই দারুণ। প্রশংসা করতে লজ্জিতভাবে জানাল যে, দেশে কাজকর্ম না জুটলে সে বাজি তৈরি করে দুপয়সা রোজগার করে। নিজের হাতে তৈরি কটা বাজি সে সঙ্গে এনেছে। কোনো দ্বীপে বেকায়দায় আটকে গেলে তুবড়ি জ্বেলে বা হাউই ছুঁড়ে সংকেত পাঠানো যায়। আমরা খুব তারিফ করলাম ওর বুদ্ধির। তখন কি ছাই জানি ওর এই বাজির কারসাজি কেন?
রাতে মামাবাবু একবার জিজ্ঞেস করলেন সুনন্দ ও আমাকে, তোমরা কি কেউ আমার কিট—ব্যাগ ঘেঁটেছিলে?
—না তো। আমরা জবাব দিই।
——টেন্টে ফিরে মনে হল আমার ব্যাগ কেউ ঘেঁটেছে। কাগজপত্রগুলো উলটোপালটা ভাবে রয়েছে। তবে টাকা কিছু খোয়া যায়নি। মানিব্যাগ তো আমার সঙ্গেই ছিল। যাহোক টাকাকড়ি টেন্টে রেখে বেরিও না। মাঝিদের বা মিকি ফকিরের হাতটানের অভ্যেস থাকতে পারে। অভাবী মানুষ এরা। সাবধান হওয়াই উচিত।
পরদিন সকালে ওই দ্বীপ ছেড়ে ফের আমাদের নৌকো ভাসল সাগরে।