» » বাস্তেন দ্বীপে অভিযান

বর্ণাকার

অজেয় রায়

বাস্তেন দ্বীপে অভিযান

তিন

জাকার্তা। জাকার্তা জাভা দ্বীপে। ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী। বিশাল শহর।

পালেমবাং থেকে মিকি সহ আমরা তিনজনে এয়ারোপ্লেনে চেপে গেলাম জাকার্তা। বাসে করেও যাওয়া যায়। বাসে চড়ে শহরতলি ও ঘন জঙ্গলের ভিতর দিয়ে লামপুং বন্দর। সেখান থেকে গোটা বাস যাত্রীসমেত উঠে যায় একটা জাহাজে। জাহাজ পার হয় মুন্ডা প্রণালী ঘণ্টা তিনেকে। পৌঁছয় জাভার মোরোক জেটিতে। বাস ডাঙায় নেমে ফের চলে। মোরোক থেকে জাকার্তা শহর প্রায় দশ ঘণ্টার জার্নি। এই সুন্ডা প্রণালীতেই মাথা তুলে আছে বিখ্যাত ক্রাকাউ আগ্নেয়গিরি। ১৮৮৩ সালে ভয়াবহ অগ্ন্যুৎপাত ঘটেছিল এই আগ্নেয়গিরিতে।

বাসে জাকার্তা গেলে বেশ একটা অ্যাডভেঞ্চার হত বটে কিন্তু মামাবাবু অত সময় নষ্ট করতে চাইলেন না।

জাকার্তায় একটা হোটেলে উঠলাম চারজন।

মিকি যে নৌকাটা ঠিক করেছে তার সর্দার মাঝিকে নিয়ে এল দেখা করাতে। বেশ লম্বা পোক্ত চেহারা লোকটির। মাঝবয়সি। নাম—হামিদ আলি।

হামিদ একটু গম্ভীর প্রকৃতির। অল্প কথায় আমাদের ঘোরার ব্যাপারটা ঝালিয়ে নিল। তাদের পাওনাগণ্ডা সম্বন্ধে কথা বলল। কী কী সঙ্গে নিতে হবে তার একটা ফিরিস্তি দিল। ঘাটে গিয়ে আমরা একবার দেখে এলাম নৌকোটা।

বেশ বড় পালতোলা নৌকো। ছই আছে। হাদিম ছাড়াও আরও দুজন মাঝি নৌকো বাইবে। আর একটি লোককে জুটিয়েছিল মিকি। তার নাম ফকির। বছর চল্লিশ বয়স হবে। খুব হাসিখুশি স্বভাব। সে নৌকো বাইতে জানে। আবার আমাদের টুকিটাকি কাজে সাহায্যও করবে। ফকিরের আর একটা গুণ, সে ইংরেজি কিছু বলতে পারে ও বোঝে। অল্প বয়সে সে নাকি সিঙ্গাপুরে এক ভারতীয় ব্যবসায়ীর কাছে কাজ করেছিল, তখনই ইংরেজি শেখে।

রাতে মামাবাবু আপশোস করেন, ইস জাভায় এলাম অথচ বরোবুদর দেখা হবে না।

বরোবুদরের কথা আমি তো জানিই, সুনন্দও জানে। সে সুযোগটা ছাড়ল না। পণ্ডিতি ঢঙে বলল, জানি বরোবুদর বিখ্যাত এক বৌদ্ধ স্তূপ। সেটা কি কাছাকাছি?

—না খুব কাছে নয়, বলেন মামাবাবু, যোগজাকার্তায়। যেতে আসতে দেখতে অন্তত তিন দিন লাগবে। এযাত্রা সময় নেই। দেশ বিদেশ থেকে কত লোক যায় বরোবুদর দেখতে। ছবিতে যা দেখেছি, বৰ্ণনা যা পড়েছি, অবাক হয়ে গেছি।

সুনন্দ বেঁফাস বলে ফ্যালে, সাঁচির চেয়েও বড়?

মামাবাবু হাসেন নিঃশব্দে। সুনন্দর অল্পবিদ্যার বহর ধরে ফেলেছেন। ক্লাস লেকচারের ঢঙে বলেন, ঢের ঢের বড়। পৃথিবীর সব চাইতে বড় বৌদ্ধ স্তূপ। প্রায় হাজার বছরের পুরনো। গোটাটা পাথরে তৈরি। গোল গম্বুজ আকৃতির। নয়টি ধাপ। একটু একটু উপরে সরু হয়ে উঠেছে। স্তূপের নিচের দিকে পাথরের দেয়ালে গৌতম বুদ্ধের জীবনকাহিনি নিয়ে অজস্র ঘটনা খোদাই করা আছে। চারপাশে বিরাট পাথরে বাঁধানো চত্বর। সেখানে প্রচুর পাথরের মূর্তি। জাভানিস এবং ভারতীয় শিল্প কর্মের মিলন ঘটেছে। অপূর্ব। ইস্ স্বচক্ষে দেখা হবে না এবার। যাগে।

সকালে কিছু কেনাকাটা করলাম আর জাকার্তা শহরটা একটু ঘুরে দেখে নিলাম। জাকার্তা অনেকটা কলকাতার মতো। একধারে প্রচুর বহুতল, আধুনিক অট্টালিকা। আবার কিছু জায়গায় বহু পুরনো ঘরবাড়ি, বস্তি। নোংরা সরু রাস্তা।

শুনলাম যে দশম থেকে ষোড়শ শতাব্দীর গোড়া অবধি এই শহর ছিল হিন্দু রাজাদের অধীনে। তখন নাম ছিল শুন্ডা কেলাপা। এরপর প্রায় একশো বছর ছিল মুসলমানদের অধীনে। তারা শহরের নাম দেয় জায়াকার্তা বা জাকার্তা। এরপর জাকার্তা অধিকার করে ডাচরা। তারা নাম দেয় বাটাভিয়া। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় এই শহর কিছুকাল জাপানিরা দখল করে। তারা ফের জাকার্তা নামটা চালু করে।

জাকার্তায় দেখলাম মারডেকা স্কোয়ার, জাদুঘর, ন্যাশনাল মনুমেন্ট ইত্যাদি কিছু দ্রষ্টব্য স্থান। জাদুঘরে সব চেয়ে মনে ধরে ইন্দোনেশিয়ার নানা দ্বীপের পুতুল, মখোশ, কাপড় ইত্যাদি শিল্পদ্রব্য।

আমাদের নৌকো ছাড়ল সকালবেলা।

জাভা সাগর দিয়ে চললাম পুবমুখো। তটভূমি থেকে ক্রমে সরে গভীর সাগরে চলে গেলাম। বার দুই আচমকা বৃষ্টি নামল। তখন ছইয়ের মধ্যে ঢুকে পড়ি। মাঝিদের মাথায় তাল বা খেজুর জাতীয় পাতার চওড়া কানাওলা টোকা। পরনে লঙ্গি সার্ট বা ফলপাল্ট হাফসাট। রোদ খুব চড়ে। তখন গরমে ছইয়ের বাইরে থাকা কষ্টকর। হেড মানি চাঁদ ধরেছে হাল।

সাগরের অথই জলে নৌকো যেন মোচার খোলা। ডাঙার প্রাণী আমি, বেশ অসহায় লাগে। তবে মামাবাবু ও সুনন্দর সঙ্গে এমন নৌকোয় দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রার অভিজ্ঞতা আছে। আমার। ডাঙা থেকে জলের রাজ্যে এসে দৃশ্যপট একেবারে বদলে যায়। মাথার ওপর জ্বলন্ত সূর্য। চারপাশে গাঢ় নীল অতল জলরাশি। বাতাসের বেগ বাড়ালে ঢেউ ওঠে বেশি, নৌকোর ওঠানামা বাড়ে। মাঝিদের অবশ্য তাতে হেলদোল নেই।

নৌকোর পাশে পাশে হঠাৎ হঠাৎ উড়ুক্কু মাছের ঝাঁক  জল ছেড়ে লাফিয়ে উঠে খানিকক্ষণ বাতাসে ভেসে ফের ডুব মারে জলে। ধারে কাছে কখনো দেখি হাঙরের লেজের তিনকোনা ডগা জলের ওপর। সচল। দুটো বড় বড় পালতোলা নৌকো পেরিয়ে যায় অনেক দূর দিয়ে। আমাদের মাঝিদের সঙ্গে ওই নৌকোগুলোর মাঝিদের ইশারায় বার্তা বিনিময় হয় হাত ও কাপড় নেড়ে। একটা স্টিমার চলে যায় দুর দিয়ে।

নৌকোর ছইয়ে দুটো ভাগ। এক অংশে আমরা থাকি তিনজন—আমি, সুনন্দ, মামাবাবু। অন্য অংশে বিশ্রাম নেয় বাকিরা। সেখানেই রান্নার ব্যবস্থা কেরোসিন বা উনুন জ্বালিয়ে। স্তয়ের ওই অংশ জিনিসপত্রর স্টোররুমও বটে।

মামাবাবু দেখছি মিকির সঙ্গে নিচু গলায় কী সব কথা বলেন। ফকির লোকটি খাসা। চা পানের ইচ্ছে প্রকাশ করলেই সে ঝটপট চা বানিয়ে সামনে ধরে। অন্য মাঝিদেরও চা বানিয়ে খাওয়ায়। যে কারও হুকুম তালিম করতে সে সদাই হাসিমুখে প্রস্তুত।

দপরে আমরা তিনজনে শুকনো খাবার খেয়ে নিলাম। বাকিরা রান্না করে ভাত ও মাছের তরকারি খেল। সুনন্দ রন্ধনবিদ্যায় ওস্তাদ। সে মাঝিদের রান্না চেখে জানাল যে ভাতটা চলতে পারে কিন্তু মাছটা অখাদ্য। ওটা নিজেদের জন্যে আমাকেই রাঁধতে হবে। বিকেলে আমাদের নৌকো একটা ছোট দ্বীপের কূলে নোঙর ফেলল।

এ দ্বীপে মানুষের বসতি আছে। তবে মাত্র তিরিশ—চল্লিশ ঘর। দু—তিনটে কামরা নিয়ে থাকে একটা পরিবার। আমরা দ্বীপটা ঘুরে দেখি। মামাবাবু গাছপালা এবং সমুদ্রতীরে পড়ে থাকা প্রাণী নজর করেন। কিছু স্যাম্পল নেন। দ্বীপের বাসিন্দারা কিন্তু আমাদের সঙ্গে মিশতে আগ্রহ দেখায় না। তাদের ভাষাও আমরা তিনজন বুঝি না। মাঝিরা একটা ফাঁকা ঘর চেয়ে নিয়ে সেখানে বিশ্রাম করে, রান্নার জোগাড় করে।

দ্বীপের বাড়িগুলি সুমাত্রা জাভার গ্রামের বাড়ির মতনই। বাঁশের কঞ্চির চাটাই দিয়ে তৈরি দেয়াল। মাথায় পাতার ছাউনি। মোটা কাঠের তক্তা বা বাঁশের ফ্রেমের ওপর ঘর, মাটি থেকে দু—তিন হাত উঁচুতে। এখানে প্রবল বৃষ্টি হয় সারা বছর। বৃষ্টির জল যাতে ঘর বাড়ির নিচ দিয়ে গড়িয়ে যেতে পারে তাই এইরকম ব্যবস্থা।

লক্ষ করি দ্বীপে সমর্থ জোয়ান পুরুষের সংখ্যা খুব কম। কারণটা জানায় মিকি। সে। ইতিমধ্যে ওদের সঙ্গে দিব্যি জমিয়ে নিয়েছে। এই দ্বীপে নাকি চাষবাস হয় সামান্য। কিছ ফলের গাছ আছে মাত্র। ফলে লোকের পেট ভরে না। তাই দ্বীপের সমর্থ পুরুষরা বেশির ভাগই বাইরে চলে যায় রোজগারের আশায়। দ্বীপে ফেরে কয়েক মাস বাদে বাদে, কিছু  ঢাকা জমিয়ে কেনাকাটি করে। কিছু দিন দ্বীপে কাটিয়ে ফের বেরোয় দ্বীপ ছেড়ে পেটের ধান্দায়।

মামাবাবু আমাদের বললেন, মিকিকে লাগিয়েছি দ্বীপের লোকের কাছ থেকে বাস্তেন আইল্যান্ডের ডিরেকশন জানতে। মামাবাবু, সুনন্দ ও আমি রাতে থাকব তাঁবু ফেলে।

মিকি রাতে এসে বলল, প্রফেসর ভেরি সরি। এ দ্বীপের লোক মাত্র একজন বাদে বাস্তেন দ্বীপের নামই কেউ শোনেনি। শুধু এক বৃদ্ধ বলল যে হু অমন একটা দ্বীপের কথা শুনেছি বটে বহু বছর আগে। তখন আমি জোয়ান পুরুষ। এখান থেকে উত্তর—পবে। অনেকটা গেলে কয়েকটা খুব ছোট ছোট জনহীন দ্বীপ আছে। তেমনি একটা জংলা দ্বীপে এক সাহেব বাস করত। একা। শুধু একজন এদেশি সঙ্গী নিয়ে। সেই সময় আমাদের দ্বীপের দুজন জেলে ওই দ্বীপে একবার নৌকো ভিড়িয়েছিল। ঘুরেছিল দ্বীপটায় কয়েকঘণ্টা। দেখেছিল সেই সাহেবকে। সাহেব তাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলেনি মোটে। ওদের ধারণা হয়েছিল যে সাহেবের মাথায় ছিট আছে। নইলে অমন দ্বীপে কেউ বাস করে?

পরে শুনেছিলাম সেই সাহেব মারা গেছে। ওই দ্বীপে এখন কেউ থাকে কিনা জানি না। পরের দিন ফের আমাদের নৌকো জলে ভাসল।