আল-বার্কের ঘরে আসেফা এখনও এক রহস্যময়ী নারী। অন্যায় না হলেও আল-বার্ক কাউকে জানতে দেয়নি যে, সে আরেকটি মেয়েকে বৌ বানিয়ে ঘরে তুলেছে। এতকাল এক স্ত্রী নিয়ে ঘর করে চল্লিশ বছর বয়সে একটি সুন্দরী যুবতীকে বিয়ে করার কথা শুনলে বন্ধুরা ঠাট্টা করবে, এই তার ভয়। কিন্তু সে এ রহস্য বেশীদিন গোপন রাখতে পারেনি। শহর এবং সেনা ক্যাম্পগুলোর আশপাশে আলী বিন সুফিয়ান যে গুপ্তচরদের ছড়িয়ে রেখেছিলেন, তাদের মাধ্যমে তিনি রিপোর্ট পান, সামরিক মহড়ার পর থেকে শহরে জুয়া ও অপকর্ম বেড়ে চলেছে। একদিন এক গুপ্তচর আলী বিন সুফিয়ানকে রিপোর্ট দেয়, গত তিন মাসে সে চারবার দেখেছে, রাতে যখন সব মানুষ ঘুমিয়ে পড়ে, তখন খাদেমুদ্দীন আল-বার্কের ঘর থেকে কালো চাদরে আবৃতা এক মহিলা বের হয়। ঘর থেকে বের হয়ে খানিক দূরে গেলে একজন পুরুষ তার সঙ্গ নেয়। গুপ্তচর জানায়, প্রথম দুবার সে এতটুকুই দেখেছে। তৃতীয়বার সে মহিলার পিছু নেয়। দেখে, মহিলাটি লোকটির সঙ্গে একটি ঘরে ঢুকে পড়েছে। কিছুক্ষণ পর সেখান থেকে বের হয়ে লোকটির সঙ্গে ফিরে যায়।
গুপ্তচর জানায়, গতরাতেও সে মহিলাটিকে আল-বার্কের ঘর থেকে বের হয়ে উক্ত লোকটির সঙ্গে যেতে দেখে তাদের পিছু নেয়। কিছুদূর গিয়ে তারা আগের ঘরটিতে প্রবেশ করে। কিছুক্ষণ পর বেরিয়ে আসে অন্য একজনের সাথে। সেখান থেকে বেরিয়ে তারা প্রবেশ করে শহরের অপর একটি বিশাল ভবনে। গুপ্তচর ভবনটির বেশ দূরে একস্থানে অবস্থান নেয়। দীর্ঘসময় পর পনের-বিশ মিনিট অন্তর অন্তর ভবন থেকে একে একে বের হয় এগারজন লোক। সবশেষে সঙ্গী পুরুষটির সঙ্গে মহিলাটিও বের হয়। গুপ্তচর অন্ধকারে তাদের পিছু নেয়। আল-বার্কের ঘরের সামান্য দূর থেকে লোকটি চলে যায় অন্যদিকে। মহিলা ঢুকে পড়ে আল-বার্কের ঘরে।
আল-বারকের ন্যায় উচ্চপদস্থ একজন কর্মকর্তার বাসগৃহ সম্পর্কে রিপোর্ট করার সাহস একজন সাধারণ গুপ্তচরের থাকার কথা নয়। কিন্তু আলী বিন সুফিয়ানের নীতি অত্যন্ত কঠোর। তাঁর গুপ্তচর ও সংবাদদাতাদের বলে রাখা ছিল, স্বয়ং সুলতান সালাহুদ্দীনের কোন আচরণ-গতিবিধিতেও যদি সন্দেহ দেখা দেয়, তারও রিপোর্ট করতে হবে। এ ব্যাপারে কারও পদমর্যাদার তোয়াক্কা করা যাবে না। যখনই যার ব্যাপারে সন্দেহ দেখা দেবে— হোক তা তুচ্ছ— সঙ্গে সঙ্গে, তা আলী বিন সুফিয়ানকে অবহিত করতে হবে।
এই গুপ্তচর চার চারটিবার যা দেখেছে, আলী বিন সুফিয়ানের জন্য তা অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তিনি আল-বার্কের স্ত্রীকে ভাল করেই জানেন। মহিলা এমন নন যে, রাতের বেলা পরপুরুষের সঙ্গে ঘর থেকে বের হবেন। আল-বার্কের কোন যুবতী মেয়েও তো নেই। তাছাড়া আর-বার্ক নতুন কোন যুবতীকে বিয়ে করে ঘরে তুললে সে খবর তো তারা জানতেন!
বিষয়টি নিয়ে গভীর ভাবনায় পড়ে যান আলী বিন সুফিয়ান। তিনি ভাবেন, আল-বার্ক আমার বন্ধু মানুষ। তার ঘরে নতুন করে কিছু একটা ঘটে থাকলে তা আমার জানবার কথা। তবে কি আল-বার্ক কোন একটা নারীর খপ্পরে পড়ে গেল? রহস্যটা উদ্ঘাটন করা যায় কিভাবে?
মাথায় একটা বুদ্ধি আসে আলী বিন সুফিয়ানের। গোয়েন্দা বিভাগের একটি মেয়েকে নির্যাতিতা নারীর বেশে আল-বার্কের ঘরে প্রেরণ করেন। তাকে বলে দেন, তুমি গিয়ে বলবে, আমার স্বামী মারা গেছেন। ছেলে-সন্তান কেউ নেই। আমাকে সাহায্য করুন।
আলী বিন সুফিয়ানের নির্দেশনা মোতাবেক মেয়েটি আল-বার্কের ঘরে যায়। আল-বার্ক তখন ঘরে ছিল না। মেয়েটি কৌশল করে ঘরের সর্বত্র ঘুরে-ফিরে দেখে। সে এক নবাগতা সুন্দরী তরুণীকে দেখতে পায়। মেয়েটি আল-বার্ককের প্রথমা স্ত্রীর কাছে যায়। তার কাছে নিজের ফরিয়াদ পেশ করে। বলে, আপনি দয়া করে আল-বার্কের কাছে আমার জন্য সুপারিশ করুন। কথায় কথায় সে জিজ্ঞেস করে বসে, আপনার মেয়ের কি বিয়ে হয়ে গেছে? আল-বার্কের স্ত্রী জবাব দেয়— ‘ও আমার মেয়ে নয়। আমার স্বামীর নতুন বউ। তিন মাস হল, তিনি একে বিয়ে করেছেন।’
আলী বিন সুফিয়ানের জন্য এ তথ্য ছিল বিস্ময়কর। তার মনে এ সন্দেহই জাগ্রত হয়েছিল যে, রাতের অন্ধকারে বের হওয়া মেয়েটি আল-বার্কের স্ত্রী হতে পারে না। গুপ্তচর মেয়েটির দেওয়া তথ্যের পর অপর এক মহিলার মাধ্যমে আলী বিন সুফিয়ান আল-বার্কের প্রথমা স্ত্রীর নিকট বার্তা প্রেরণ করেন যে, আমি বাইরে কোথাও আপনার সঙ্গে সাক্ষাত করতে চাই। তবে আল-বার্ক যেন জানতে না পারে। বার্তায় তিনি একথাও বলেন, আপনার পরিবার সম্পর্কে আমার অনেক জরুরী কথা আছে। আলী বিন সুফিয়ান সাক্ষাতের স্থান এবং সময়ও নির্ধারণ করে দেন।
আল-বার্ক অফিসের কাজে ব্যস্ত। তার প্রথমা স্ত্রী নির্ধারিত সময়ে নির্ধারিত স্থানে এসে উপস্থিত হন। মহিলাকে বেশ শ্রদ্ধা করতেন আলী বিন সুফিয়ান। তিনি বললেন— ‘আমি জানতে পারলাম, আপনার স্বামী নাকি আরেকটি বিয়ে করেছে?’
মহিলা বললেন— ‘আল্লাহর শোকর, আমার স্বামী মাত্র দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন— তৃতীয় বা চতুর্থ বিয়ে করেননি।’
কথা প্রসঙ্গে আলী বিন সুফিয়ান জিজ্ঞেস করলেন— ‘তা নতুন বউটা কেমন হল?’
‘অত্যন্ত সুন্দরী।’ জবাব দেন মহিলা।
‘ভদ্রও তো, না? তার প্রতি আপনার কোন ধরনের সন্দেহ নেই তো?’ জিজ্ঞেস করেন আলী বিন সুফিয়ান।
জবাবে মহিলা কিছুই বললেন না। নীরবে কিছুক্ষণ ভাবনায় পড়ে থাকেন আলী বিন সুফিয়ান জবাবের অপেক্ষা না করে বললেন— ‘আচ্ছা, আমি যদি বলি, মেয়েটি মাঝে-মধ্যে রাতের আঁধারে বাইরে কোথাও চলে যায়, তাহলে রাগ করবেন না তো?’
মহিলা স্মিত হেসে বললেন আমি নিজেই অস্থিরচিত্তে ভাবছিলাম, ‘কথাটা কাকে বলব। আমার স্বামী মেয়েটির গোলাম হয়ে গেছেন। আমার সঙ্গে তো তিনি এখন কথাও বলেন না। অতি আদরের এই বউটির বিরুদ্ধে যদি কিছু বলতে যাই, তাহলে নির্ঘাত আমাকে তিনি ঘর থেকে বের করে দেবেন। তিনি ভাববেন, হিংসাবশত আমি তার বদনাম করছি। মেয়েটি আসলেই ভাল নয়। আমার ঘরে ইতিপূর্বে কখনও মদের ঘ্রাণও আসেনি। আর এখন পিপার পর পিপা শূন্য হয়ে যায়।’
‘মদ? আল-বার্ক মদও পান করতে শুরু করেছে?’ হঠাৎ শিউরে উঠে জিজ্ঞেস করেন আলী বিন সুফিয়ান।
‘শুধু পানই করেন না— মাতাল-অচেতনও হয়ে যান। আমি ছয়বার মেয়েটিকে রাতের বেলা বাইরে যেতে দেখেছি। ফিরেছে অনেক বিলম্বে। আমি এ-ও দেখেছি যে, যে রাতে মেয়েটির বাইরে যেতে হয়, সে রাতে আল-বার্ক অজ্ঞানের মত পড়ে থাকেন। সকালে জাগ্রত হন অনেক বিলম্বে। মেয়েটি বড় বদমাশ, লোকটার সঙ্গে ও প্রতারণা করছে।’ বললেন মহিলা।
‘না, মেয়েটি বদমাশ নয়— গুপ্তচর। আর সে ধোঁকা দিচ্ছে আল-বার্ককে নয়— গোটা জাতিকে।’ বললেন আলী বিন সুফিয়ান।
‘কী বললেন? গুপ্তচর? আমার ঘরে শত্রুর গোয়েন্দা?’ অকস্মাৎ চমকে উঠেন মহিলা। বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে দাঁত কড়মড় কর বললেন— ‘আপনি জানেন, আমি শহীদ পিতার কন্যা। আমার স্বামী আল-বার্ক ছিলেন একজন খাঁটি মুসলমান। নিজের জীবনটা উৎসর্গ করে রেখেছিলেন ইসলামের জন্য। সন্তানদেরকে আমি গঠন করছি জিহাদের জন্য। আর এখন আপনি কিনা বলছেন, আমার সন্তানদের পিতা একজন শত্ৰু গোয়েন্দা মেয়ের কব্জায় বন্দী! আমি আমার সন্তানদের পিতাকে ত্যাগ করতে পারি— জাতি ও ইসলামকে কোরবান হতে দিতে পারি না। যে করে হোক, দুজনকেই আমি খুন করে ফেলব।’
আলী বিন সুফিয়ান মহিলাকে বড় কণ্ঠে শান্ত করেন। বললেন, ‘মেয়েটি যে গুপ্তচর, তা আমাদের নিশ্চিত করতে হবে। দেখতে হবে, আল-বার্ক গুপ্তচরদের দলে ভিড়েই গেল, নাকি তাকে মদপান করিয়ে ব্যবহার করা হচ্ছে।’ আলী বিন সুফিয়ান আল-বার্কের স্ত্রীকে এও জানান যে, ‘আমরা গুপ্তচরদের হত্যা করি না গ্রেফতার করে তাদের গ্যাং সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করি।’
আলী বিন সুফিয়ানের পরামর্শে শান্ত হয়ে আল-বার্কের স্ত্রী চলে যান। কিন্তু তার ভাব-গতিতে মনে হচ্ছিল, ঈমানী চেতনাসমৃদ্ধ মহিলা ফুঁসে উঠতে পারেন যে কোন মুহূর্তে। আত্মনিয়ন্ত্রণ হারিয়ে একটা অঘটন ঘটিয়ে ফেলতে পারেন তিনি।
○ ○ ○
খাদেমুদ্দীন আল-বার্ক আলী বিন সুফিয়ানের কেবল সহকর্মীই নয় অন্তরঙ্গ বন্ধুও বটে। বয়সেও দুজন সমান। রণাঙ্গনে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াইও করেছেন দুজনে। সে সুলতান সালাহুদ্দীনের প্রবীণ সহচর। তথাপি সে তার দ্বিতীয় বিয়ের কথা আলী বিন সুফিয়ান থেকে গোপন রেখেছে। বিষয়টি অবহিত হওয়ার পর আলী বিন সুফিয়ান এ প্রসঙ্গে তার সঙ্গে কোন আলাপ করেননি। আল-বার্কের মাধ্যমে বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার জন্য সুকৌশলে তৎপরতা চালান। তিনি আল-বাকের ঘর এবং মেয়েটি রাতের অন্ধকারে যে বাড়িতে যাওয়া-আসা করে, দুয়ের মাঝে গুপ্তচর বসিয়ে দেন।
আল-বার্কের প্রথমা স্ত্রীর সঙ্গে আলী বিন সুফিয়ানের কথা হল দুদিন হয়ে গেছে। এ সময়ে আসেফা ঘর থেকে বের হয়নি। রাত জেগে পাহারা দিচ্ছে আলীর গোয়েন্দারা।
তৃতীয় রাতের দ্বি-প্রহরের পূর্ব মুহূর্ত। ঘুমিয়ে আছেন আলী বিন সুফিয়ান। হঠাৎ এস্ত-ব্যস্ত হয়ে তার কক্ষে প্রবেশ করে এক চাকর। ঘুম থেকে ডেকে তোলে তাঁকে। বলে— ‘ওমর এসেছে! তাকে বড় ভয়ার্ত দেখাচ্ছে!’
ধনুক থেকে বের হওয়া তীরের ন্যায় দ্রুত কক্ষ থেকে বেরিয়ে আসেন আলী বিন সুফিয়ান। দু-তিন লাফে বারান্দা অতিক্রম করে দেউড়ী পার হয়ে বাইরে চলে আসেন। বাইরে দণ্ডায়মান ওমর বলল— ‘দ্রুত দশ-বারজন অশ্বারোহী প্রস্তুত করুন! নিজের ঘোড়াও হাজির করুন। তারপর বলছি, কী ঘটেছে।’
চৌদ্দজন সশস্ত্র আরোহী, নিজের ঘোড়া ও তরবারী প্রস্তুত করার আদেশ দিয়ে আলী ওমরকে জিজ্ঞেস করেন— ‘বল, ব্যাপার কী?’
আসেফার গতিবিধি অনুসরণ করার জন্য নিয়োজিত ছিল ওমর ও আজর নামের দুই গোয়েন্দা। আলী বিন সুফিয়ান তাদেরকে আদেশ দিয়ে রেখেছিলেন, ঘর থেকে বেরিয়ে মেয়েটি কোথাও যেতে শুরু করলে সঙ্গে সঙ্গে আমাকে সংবাদ দেবে।
বড় ভয়ানক সংবাদ নিয়ে এসেছে ওমর। সে জানায়, এই সামান্য আগে আল-বার্কের ঘর থেকে আপাদমস্তক কালো চাদরে ঢাকা একটি মেয়ে বের হয়েছে। পঞ্চাশ-ষাট গজ পথ অতিক্রম করার পর সেই ঘর থেকে বের হয় একই রকম পোশাকে আরেকজন নারী। দ্রুত অগ্রসর হয়ে দ্বিতীয় মহিলা প্রথম মহিলার পিছনে চলে যায়। খানিকটা দূরে থাকতেই প্রথম মহিলা দাঁড়িয়ে যায়। গুপ্তচর দুজন লুকানো ছিল আড়ালে। তাদের দেখতে পায়নি কেউ। মহিলাদের অনুসরণও করছিল অতি সন্তর্পণে। মুখোমুখি হল মহিলাদ্বয়। কি যেন কথা হল দুজনের মধ্যে। হঠাৎ হাতে তালি বাজায় তাদের একজন। কাছাকাছি একস্থান থেকে বেরিয়ে আসে এক ব্যক্তি। সে দ্বিতীয় মহিলাকে আটক করার চেষ্টা করে। মহিলা কি একটি অস্ত্র দিয়ে আঘাত করল তার উপর। মহিলার উপরও পাল্টা আঘাত হানে লোকটি।
কণ্ঠস্বর শোনা গেল প্রথম মহিলার— ‘একে তুলে নিয়ে চল।’ দ্বিতীয় মহিলা আঘাত হানে তার উপর। তার চিৎকারের শব্দ ভেসে আসে। পুরুষ লোকটির আঘাত প্রতিহত করে দ্বিতীয় মহিলা। আরও একটি আঘাত হানে প্রথম মহিলার উপর। আহত হয়ে পড়ে মহিলাদের দুজনই। আলী বিন সুফিয়ানকে সংবাদ দেওয়ার জন্য দৌড়ে যায় ওমর। আজর লুকিয়ে থাকে সেখানেই। এরা যায় কোথায়, দেখবার অপেক্ষায় লুকিয়ে থাকে সে।
এরূপ বিশেষ সময়ের জন্য অতি দ্রুতগামী ও অভিজ্ঞ আরোহীদের একটি বাহিনী গঠন করে রেখেছিলেন আলী বিন সুফিয়ান। রাতে ঘুমায় তারা আস্তাবলে— ঘোড়ার কাছে। যিন-হাতিয়ার প্রস্তুত থাকে সব সময়। প্রয়োজন হলে রাতেও যেন তারা কয়েক মিনিটে প্রস্তুত হয়ে যথাস্থানে পৌঁছে যেতে পারে, তার প্রশিক্ষণ দিয়ে রাখা হয়েছে তাদের। বাহিনীটি এতই তৎপর যে, সংবাদ পেয়ে আলী বিন সুফিয়ান পোশাক পরিবর্তন ও ঘোড়া প্রস্তুত করতে না করতেই তারা এসে উপস্থিত।
আলী বিন সুফিয়ানের নেতৃত্ব ও ওমরের রাহ্বারীতে ঘটনাস্থলে গিয়ে পৌঁছে বাহিনীটি। দুজন আরোহীর হাতে লাঠির মাথায় বাঁধা তেল-ভেজা কাপড়ের মশাল। ঘটনাস্থলে পড়ে আছে দুটি মানব-দেহ। ঘোড়া থেকে অবতরণ করে দেখলেন আলী বিন সুফিয়ান। একজন আল-বার্কের প্রথমা স্ত্রী, অপরজন ওমরের সহকর্মী আজর। দুজনই জীবিত এবং রক্তরঞ্জিত।
আজর জানায়, অপর দুজন এই মহিলাকে ফেলে চলে গেলে আমি এগিয়ে আসি। কিন্তু হঠাৎ পেছন থেকে কে যেন পরপর তিনটি আঘাত হানে আমার উপর। আমি নিজেকে সামলাতে পারিনি। আক্রমণকারী পালিয়ে যায়। অপর মহিলা আল-বার্কের ঘরের দিকে যায়নি, গেছে বরাবরের মত ঐ ভবনটির দিকে। সেই ভবনটি জানা আছে ওমরের।
আলী বিন সুফিয়ান দুজন আরোহীকে বললেন, ‘তোমরা জখমীদেরকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাও এবং রক্তক্ষরণ বন্ধ করার চেষ্টা কর।’ অবশিষ্টদেরকে ওমরের দিক-নির্দেশনায় সেই ভবনটির দিকে নিয়ে যান, আসেফা যেখানে যাওয়া-আসা করত।
পুরনো আমলের বিশাল এক বাড়ি। সঙ্গে সংযুক্ত আরও কয়েকটি ভবন। পিছনের দিক থেকে ঘোড়ার হ্রেষাধ্বনি শোনা গেল। আলী বিন সুফিয়ান তার সৈন্যদেরকে ভবনটির দুদিক থেকে পিছনে পাঠিয়ে দেন। দুজনকে দাঁড় করিয়ে রাখেন সম্মুখের ফটকে। বলে দেন, ভেতর থেকে কেউ বেরুবার চেষ্টা করলে তাকে ধরে ফেলবে। পালাবার চেষ্টা করলে পেছন থেকে তীর ছুঁড়ে শেষ করে দেবে।
চক্কর কেটে আলী বিন সুফিয়ানের সৈন্যরা ভবনের পিছনে এগিয়ে যাচ্ছে। এমন সময়ে তারা একাধিক ধাবমান ঘোড়ার পদধ্বনি শুনতে পায়। আলী বিন সুফিয়ান এক আরোহীকে বললেন— ‘জল্দি যাও, কমাণ্ডারকে বল, দ্রুত ভবনটিকে ঘিরে ফেলে যেন ভিতরে ঢুকে পড়ে এবং ভিতরের সবাইকে গ্রেফতার করে।’
আরোহী ক্যাম্পের দিকে ছুটে যায়।
আলী বিন সুফিয়ান উচ্চকণ্ঠে তাঁর বাহিনীকে আদেশ করেন— ‘ঘোড়া ছুটাও—ধাওয়া কর।’ নিজেও ঘোড়া হাঁকান আলী বিন সুফিয়ান। উন্নত জাতের বাছাই করা ঘোড়া তাঁর। বাতাসের গতিতে ছুটে চলেন তিনি। নগর এলাকা পেরিয়েই সামনে খোলা ময়দান।
অন্ধকারে ঘোড়া দেখা যায় না। ধাবমান অশ্বের শব্দের অনুসরণ করা হচ্ছে শুধু। নগর ছেড়ে খোলা মাঠে এসে পড়ে পলায়নকারীরা। এবার আত্মগোপন করা কঠিন হয়ে পড়ে তাদের জন্য। বিস্তৃত দিগন্তের দৃশ্যপটে এবার ছায়ার মত দেখা যাচ্ছে তাদের।
তারা চারজন। দু পক্ষের মাঝে এখনও অন্তত একশত গজের ব্যবধান। আলী বিন সুফিয়ানের নির্দেশে ধাবমান ঘোড়ার পিঠ থেকেই তীর ছুঁড়ে দু আরোহী। লক্ষ্যভ্রষ্ট হয় আক্রমণ। বড় চতুর মনে হল ওদের। যাচ্ছিল একত্রিতভাবে পাশাপাশি। এবার পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে তাদের ঘোড়া। ধেয়ে চলেছে অবিরাম। আলী বিন সুফিয়ানের বাহিনীও এগিয়ে চলছে তীব্রগতিতে। ধীরে ধীরে দু পক্ষের মাঝের দূরত্ব কমে আসতে থাকে। পলায়নকারীদের ঘোড়াও পরস্পর আরও বিচ্ছিন্ন হতে থাকে। সামনে ঘন সন্নিবিষ্ট একটি খেজুর বাগান। এখানে উপনীত হয়ে তাদের ঘোড়াগুলো একের থেকে অপরটি আরও দূরে সরে যায়। দুটি ডানে আর দুটি বায়ে কেটে পড়ে। স্থানটি বেশ উঁচু। উপরে অদৃশ্য হয়ে যায় ঘোড়াগুলো।
আলী বিন সুফিয়ানের বাহিনীও উঁচুতে আরোহণ করে। কিন্তু পলায়নরত ছায়ামূর্তিগুলো এবার অনেক ব্যবধানে চলে যায় তাদের থেকে। চারজন ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। আলী বিন সুফিয়ান বুঝে ফেললেন, ওরা তার বাহিনীকে বিক্ষিপ্ত করতে চায়। উচ্চকণ্ঠে হাঁক দেন তিনি। বলেন— ‘বিভক্ত হয়ে তোমরা ওদের ধাওয়া কর। আরও দ্রুত ঘোড়া ছুটাও। ব্যবধান কমিয়ে ফেল। ধনুকে তীর সংযোজন কর।’
চার ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে আলী বিন সুফিয়ানের বাহিনী। কাঁধ থেকে ধনুক নামিয়ে তাতে তীর সংযোজন করে। পিছু নেয় পলায়নকারী চারটি ঘোড়ার। পলায়নকারীদের ঘোড়ার গতি বেড়ে যায় আরও। বেড়ে যায় আলী বিন সুফিয়ানের বাহিনীর ঘোড়ার গতিও। হঠাৎ উনিশটি ঘোড়ার সোজা ক্ষুরধ্বনির ভেদ করে কানে ভেসে এল ধনুক থেকে ছুটে যাওয়া একটি তীরের শাঁ শাঁ শব্দ। সঙ্গে একজনের চীৎকার ধ্বনি— ‘একটা শেষ করেছি— ঘোড়া কাবু হয়ে গেছে।’
এদিকে আলী বিন সুফিয়ানের সঙ্গে যে দুজন আরোহী আছে, তারাও তীর ছুঁড়ে। অন্ধকারে তীর লক্ষ্যভ্রষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা আছে, হচ্ছেও। তবু তারা একটি ঘোড়াকে ঘায়েল করতে সক্ষম হয়। নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ঘোড়াটি চক্কর কেটে চলে আসে পিছনে। একজন বর্শার আঘাত হানে ঘোড়াটির ঘাড়ে। পেটে বর্শা ঢুকিয়ে দেয় আরেকজন। অত্যন্ত শক্ত সমর্থ ঘোড়া। দুটি আঘাত খাওয়ার পরও দাঁড়িয়ে আছে। আরোহীদের জীবিত ধরতে হবে। আলীর এক সৈনিক হাত বাড়িয়ে এক আরোহীর ঘাড় ধরে ফেলে। তার ঘোড়া আহত। ঘোড়া থেমে যায়। ঘোড়ার আরোহী দুজন একজন পুরুষ, একটি মেয়ে। মেয়েটি বসেছে পুরুষের সামনে। তাকে অচেতন বলে মনে হল।
অন্ধকার রাত। এখন আর কোন ধাবমান ঘোড়ার পায়ের শব্দ শোনা যায় না। এখন কানে আসছে শুধু কতিপয় মানুষের কথা বলার শব্দ আর দুলকি চালে চলন্ত কয়েকটি ঘোড়ার আওয়াজ। আরোহীরা একে অপরকে ডাকাডাকি করছে। তাদের আওয়াজে বুঝা যাচ্ছে, তারা পলায়নপর লোকগুলোকে ধরে ফেলেছে।
আলী বিন সুফিয়ান সবাইকে একত্রিত করেন। পলায়নপর লোকগুলো এখন তার হাতে বন্দী। তাদের দুটি ঘোড়া আহত। সেগুলোকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে যমের হাতে।
পলায়নপর লোকের সংখ্যা পাঁচজন। চারজন পুরুষ, একটি মেয়ে। মেয়েটি মাটিতে লুটিয়ে পড়ে আছে। পুরুষদের একজন বলল, ‘আমাদের সঙ্গে তোমরা যেমন ইচ্ছা আচরণ করতে পার। কিন্তু এই মেয়েটি আহত। আমরা আশা করি। তোমরা একে বিরক্ত করবে না।’
একটি ঘোড়ার যিনের সঙ্গে মশাল বাঁধা আছে। সেটি খুলে নিয়ে জ্বালানো হল। মশালের আলোকে মেয়েটিকে নিরীক্ষা করে দেখা হল। অতিশয় রূপসী এক যুবতী। গায়ের পোশাক রক্তে রঞ্জিত। কাঁধেও ঘাড়ের পার্শ্বে গভীর ক্ষত। সীমাহীন রক্তক্ষরণে মুখমণ্ডল লাশের ন্যায় সাদা। চক্ষুদ্বয় মুদিত। আলী বিন সুফিয়ান জখমের গর্তে এক খণ্ড কাপড় ঢুকিয়ে আরেকটি কাপড় দ্বারা বেঁধে দেন। তারপর তাকে ঘোড়ার পিঠে চড়িয়ে এক সৈনিককে বললেন, ‘একে জলদি ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাও।’ কিন্তু জলদি যাওয়া কিভাবে। শহর এখান থেকে কয়েক মাইল দূরে। একজন বৃদ্ধও আছে কয়েদীদের মধ্যে।
○ ○ ○