তৃতীয় রাতে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ে আল-বার্ক। একজন শাসকের শান নিয়ে বের হত সে। কিন্তু আজ বের হল চোরের ন্যায়। এদিক-ওদিক তাকিয়ে হাঁটা দেয় একদিকে। গভীর নিদ্রায় নিমগ্ন কায়রো শহর। নীরবতা বিরাজ করছে সর্বত্র। সামরিক মহড়া শেষ হয়ে গেছে দুদিন হল। চলে গেছে বহিরাগত দর্শনার্থীরা। অস্থায়ীভাবে নির্মিত পতিতালয়গুলো তুলে দেওয়া হয়েছে সরকারী নির্দেশে। আলী বিন সুফিয়ানের গোয়েন্দা বিভাগ তদন্ত চালাচ্ছে বহিরাগত কোন মেয়ে বা সন্দেহভাজন শহর কিংবা শহরতলীর কোথাও রয়ে গেল কিনা। মেলার উদ্দেশ্য পূরণ হয়েছে। মাত্র দুদিনে সেনাবাহিনীতে ভর্তি হয়েছে চার হাজার যুবক। আরও ভর্তি হবে বলে আশা করছেন সুলতান সালাহুদ্দীন।
শহরের বাইরে চলে যায় আল-বার্ক। সে নির্ধারিত ভবনটির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। কোথাও কোন সাড়া-শব্দ নেই। নীরব-নিস্তব্ধ রজনী। মেয়েটি বলেছিল, ‘সে বৃদ্ধের কয়েদী। সারাক্ষণ তার চোখে চোখে থাকতে হয়। তবু আল-বার্কের আশা, মেয়েটি আসবে অবশ্যই। সম্ভাব্য বিপদের মোকাবেলা করার জন্য তার হাতে আছে খঞ্জর। নারী এমনি এক যাদু, যা একবার কারও উপর সওয়ার হয়ে বসলে আর রক্ষা নেই। নারীর প্রেমেপড়া পুরুষটি পরোয়া করে না কিছুরই। তার হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে যায়।
আল-বার্ক একজন পরিণত বয়সের পুরুষ। কিন্তু এখন সে একটি নির্বোধ আনাড়ী যুবক।
ভবনটির নিকটে চলে আসে আল-বার্ক। সম্মুখে অন্ধকারে আপাদমস্তক কালো চাদরে আবৃত একটি ছায়ামূর্তি চোখে পড়ে তার। চোখের পলকে অন্ধকারে মিলিয়ে যায় ছায়াটি।
হাঁটার গতি বাড়িয়ে দেয় আল-বার্ক। প্রেমের নেশা তার সবকিছু ছিনিয়ে নিয়েছে— ডর-ভয়, আত্মমর্যাদাবোধ সব। সে পুরনো পরিত্যক্ত জীর্ণ ভবনটির সামনে এসে দাঁড়ায়। এদিক-ওদিক ইতিউতি তাকিয়ে ভাঙ্গা দেয়ালের ফাঁক দিয়েই ভিতরে প্রবেশ করে। কবরের অন্ধকার বিরাজ করছে ভবনটিতে। সম্মুখে একটি কক্ষ। মাথার উপর দিয়ে ফড় ফড় করে দ্রুতগতিতে উড়ে গেছে কি একটা পাখি। ঠাণ্ডা বাতাসের ঝাঁপটা লাগে তার গায়ে। পরক্ষণেই চিঁ চিঁ শব্দ শুনতে পায় সে। বুঝা গেল এগুলো চামচিকা।— এখান থেকে বেরিয়ে সামনে এগিয়ে যায় আল-বার্ক। ঢুকে পড়ে আরেকটি কক্ষে। কারও ক্ষীণ পদশব্দ তার কানে আসে। এখানে কেউ আছে বলে অনুমান করে। কোমর থেকে খঞ্জর বের করে হাতে নেয়। মাথার উপর তার ভীতিকর ফড়্ ফড়্ শব্দে চামচিকা উড়ছে। আল-বার্ক ক্ষীণ কণ্ঠে ডাক দেয়— ‘আসেফা?’
‘আরে, আপনি এসেছেন?’ খানিকটা বিস্ময়ভরা কণ্ঠে জিজেস করে মেয়েটি। কিন্তু কোন জবাবের অপেক্ষা না করেই ছুটে এসে গা ঘেষে দাঁড়ায় আল-বার্কের। লোকটাকে জড়িয়ে ধরে আবেগাপ্লুত চাপা কণ্ঠে বলতে শুরু করে— ‘শুধু আপনার খাতিরে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এখানে এসেছি। আমাকে তাড়াতাড়ি ফিরে যেতে হবে। বুড়োকে মদের সঙ্গে বড়ি খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে রেখে এসেছি। জেগে ওঠলে বিপদ হবে।’
‘কেন, মদের সঙ্গে বিষ খাওয়াতে পারলে না?’ জিজ্ঞেস করে আল-বার্ক।
‘আমি কখনও কাউকে খুন করিনি। আমি মানুষ হত্যা করতে পারি না। একজন পর পুরুষের সঙ্গে প্রেম-নিবেদন করার জন্য এমন এক ভয়ঙ্কর স্থানে আসতে হবে, এমনটি ভাবিনি আমি কখনও।’ জবাব দেয় মেয়েটি।
মেয়েটিকে বাহুবন্ধনে জড়িয়ে ধরে আল-বার্ক। ভোগের নেশায় উন্মাতাল তার হৃদয়। হঠাৎ আলো জ্বলে উঠে পিছনের কক্ষে। যে কক্ষটি অতিক্রম করে আল-বার্ক এখানে এসে পৌঁছেছে, তার মধ্য থেকে বেরিয়ে আসে দুটি লণ্ঠন। লাঠির মাথায় তেলভেজা কাপড়ে আগুন জ্বালিয়ে বানানো প্রদীপ। আসেফাকে নিজের পিছনে নিয়ে লুকিয়ে ফেলে আল-বার্ক। হাতে তার খঞ্জর। এরা কি এই পরিত্যক্ত ভবনে বসবাসকারী কাল-ভূত, নাকি মেয়েটিকে ধাওয়া করতে তার স্বামী এসে পড়ল? উৎকণ্ঠিত ভাবনার জগত থেকে এখনও ফিরে আসেনি আল-বার্ক। হঠাৎ গর্জে উঠে একটি কণ্ঠ, ‘দুটাকেই খুন করে ফেল।’
একেবারে নিকটে চলে আসে লণ্ঠন দুটো। তার কম্পমান আলোয় চারজন লোক দেখতে পায় আল-বার্ক ও আসেফা। একজনের হাতে বর্শা, তিনজনের যতে তরবারী। এক মাথা মাটিতে গেড়ে লণ্ঠন দুটোকে দাঁড় করিয়ে রাখে তারা। আলোকিত হয়ে উঠে ভবনটির আঙ্গিনা। আল-বার্কের চারপার্শ্বে ক্ষুধার্ত ব্যাঘ্রের ন্যায় ধীরে ধীরে চক্কর দিতে শুরু করে চারজন লোক। আসেফা তার পিছনে জড়সড় দণ্ডায়মান। পার্শ্বের কক্ষ থেকে আবার গর্জে উঠে— ‘একজন পেয়েছিস? জ্যান্ত ছাড়বি না কিন্তু।’ এটি মেয়েটির বৃদ্ধ স্বামীর কণ্ঠ।
আল-বার্কের পিছন থেকে সরে সামনে এগিয়ে আসে আসেফা। ক্ষোভ ও ঘৃণা মিশ্রিত কণ্ঠে বৃদ্ধকে উদ্দেশ করে বলে— ‘সামনে এস, আগে আমাকে খুন কর। আমি তোমাকে ঘৃণা করি, অভিসম্পাত দেই। কারও প্ররোচনায় নয়। আমি নিজের ইচ্ছায় এখানে এসেছি।’
সশস্ত্র চার ব্যক্তি আল-বার্ক ও আসেফার চারদিকে দণ্ডায়মান। বর্শাধারী লোকটি ধীরে ধীরে আসেফার প্রতি বর্শা এগিয়ে ধরে এবং আগাটা মেয়েটির পাঁজরে ঠেকিয়ে বলে— ‘মরণের আগে বর্শার আগা কেমন দেখে নাও; কিন্তু এই বেটা তোমার আগে ছটফট করে তোমার সামনে মৃত্যুবরণ করবে, যার টানে তুমি এখানে ছুটে এসেছে।’
আসেফা মুখে কোন জবাব না দিয়ে ঝট্ করে বর্শাটা ধরে ফেলে এবং ঝটকা এক টান দিয়ে বর্শাটা হাত থেকে ছিনিয়ে নেয়। আল-বার্ক থেকে একটু দূরে সরে গিয়ে ঝাঁঝাল কণ্ঠে বলে— ‘এস, সাহস থাকলে আমার সামনে এস। আমার আগে একে তোমরা কিভাবে হত্যা করবে, আমি দেখে ছাড়ব!’
খঞ্জর উঁচিয়ে মেয়েটির সামনে চলে আসে আল-বার্ক। আসেফা যার হাত থেকে বর্শা ছিনিয়ে নিয়েছিল, খঞ্জরের আঘাত হানে তার উপর। পিছন দিকে পালিয়ে যায় লোকটি। পার্শ্ব পরিবর্তন করে তার সঙ্গীরা। তরবারী উদ্যত করলেও তারা আল-বার্কের উপর আক্রমণ করে না। অথচ, এ-স্থানে একটা লোককে হত্যা করা ব্যাপারই নয়। গর্জন করে চলেছে আস। বারবার এগিয়ে গিয়ে হামলা করে ঠিক, কিন্তু তার প্রতিটি আঘাতই ব্যর্থ হচ্ছে। আল-বার্ক খঞ্জর দ্বারা আঘাত হানে একজনের উপর। সঙ্গে সঙ্গে হাঁক ছেড়ে দুজন চলে আসে তার পিছনে। আসেফাও এক লাফে তার পিছনে চলে আসে। সে হাতের বর্শাটি দিয়ে তরবারীর মোকাবেলা করতে পারে। কিন্তু লাফ-ফাল আর তর্জন-গর্জন ছাড়া কিছুই করছে না সে।
একধারে দাঁড়িয়ে নিজের লোকদের উত্তেজিত করছে বৃদ্ধ। আল-বার্ক ও আসেফার উপর তারা বারবার আক্রমণ চালাচ্ছে। তাদের উপর বারবার ঝাঁপিয়ে পড়ছে আসেফা। আক্রমণ প্রতিহত করে পাল্টা আক্রমণের চেষ্টা করছে আল-বার্ক। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার, মেয়েটির উপর্যুপরি আক্রমণ সত্ত্বেও আহত হল না একজনও। বৃদ্ধের লোকেরা তরবারী চালনায় পরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করা সত্ত্বেও আসেফা ও আল-বার্ক অক্ষতই রয়ে গেল। একটি আঁচড় লাগল তাদের গায়ে। হঠাৎ বৃদ্ধ উচ্চকণ্ঠে বলে উঠে— ‘আক্রমণ থামাও।’ সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ হয়ে যায় যুদ্ধ।
এমন বে-ওফা, অসভ্য মেয়েকে আমি আর ঘরে রাখতে চাই না। ছুঁড়িটা যে এত দুঃসাহসী, নির্ভীক, তা আগে আমি জানতাম না। এখন জোর করে ঘরে নিয়ে গেলেও সমস্যা; সুযোগ পেলে বেশ্যাটা আমাকে নির্ঘাত মেরেই ফেলবে।’ ঝাঁঝাল কণ্ঠে বলল বৃদ্ধ।
‘আমি তোমাকে এর উপযুক্ত মূল্য দিয়ে দেব; বল কত দিয়ে কিনেছিলে।’ উদ্দীপ্ত কণ্ঠে বলল আল-বার্ক।
ডান হাতটা প্রসারিত করে এগিয়ে আসে বৃদ্ধ। আল-বার্কের হাতে হাত মিলিয়ে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বলে, ‘মূল্য দিতে হবে না। আমার সম্পদের অভাব নেই। মেয়েটিকে তুমি এমনিতেই নিয়ে যাও। তোমার সঙ্গে ওর এতই যখন ভালবাসা, তো ওকে আমি তোমার হাতে তুলে দিলাম। তাছাড়া ও যোদ্ধা বংশের সন্তান, আমি হলাম গিয়ে ব্যবসায়ী, সওদাগর মানুষ। তোমার ঘরেই ওকে ভাল মানাবে। তুমি সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর সরকারের কর্মকর্তা। আমি সুলতানের অনুগত ও ভক্ত। তোমাকে আমি নারাজ করতে পারি না। আমি মেয়েটিকে তালাক দিয়ে দিলাম এবং তোমার জন্য হালাল করে দিলাম ….। চল দোস্ত! আমরা যাই।’ বলেই তারা লণ্ঠন দুটো হাতে তুলে নিয়ে চলে যায়।
বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে পড়ে আল-বার্ক। তার পায়ের তলার মাটি কাঁপতে শুরু করে যেন। এমন একটি অভাবিত ঘটনা ঘটে গেল, তা যেন তার বিশ্বাসই হচ্ছে না। একে বৃদ্ধের প্রতারণা বলে সংশয় জাগে তার মনে। আশংকা জাগে, পথে ওঁৎ পেতে বসে থেকে তারা দুজনকেই কতল করে ফেলে কিনা।
একটি বর্শা ছিল আসেফার হাতে। আল-বার্ক সেটি নিজের হাতে নিয়ে খানিক অপেক্ষা করে মেয়েটিকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে ভবন থেকে। ডানে-বাঁয়ে-পিছনে সতর্ক দৃষ্টি রেখে দ্রুত হাঁটতে শুরু করে দুজন। কিছু একটা শব্দ কানে এলেই চকিত নয়নে থমকে দাঁড়ায়। অন্ধকারে চারদিক ইতিউতি দেখে নিয়ে আবার শুরু করে পথ চলা। শহরে প্রবেশ করার পর তারা দেহে জীবন ফিরে আসে। আসেফা আল-বার্কের গলা জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞেস করে, ‘আপনি সত্যিই কি আমাকে বিশ্বাস করেন?’ জবাবে মুখে কিছু না বলে আল-বার্ক বুকের সঙ্গে চেপে ধরে মেয়েটিকে। আবেগের আতিশয্যে কোন শব্দ বের হচ্ছে না তার মুখ থেকে। একটি অচেনা মেয়ের প্রেম অতীত জীবনের সকল অর্জন ছিনিয়ে নিয়েছে আল-বার্কের। আল-বার্কের স্ত্রী বয়সে তার সমান। এতকাল মন উজাড় করে ভালবাসা দিয়ে এসেছে সে তাকে। কিন্তু আসেফাকে পেয়ে এখন তার মনে হচ্ছে, স্ত্রীর কোন মূল্যই নেই তার কাছে।
সে যুগে নারী বেচাকেনা হত। একত্রে চারটি বউ রাখাকে ন্যায্য অধিকার মনে করত পুরুষরা। বিত্তশালীরা তো বিবাহ ছাড়াই দুচারটি সুন্দরী মেয়ে ঘরে তুলত। এই নারীই ধ্বংস করেছিল মুসলিম আমীর-শাসকদের। স্বামীর মনোরঞ্জনের জন্য খুঁজে খুঁজে, সুন্দরী মেয়েদের সংগ্রহ করে স্বামীকে উপহার দিত স্ত্রীরা।
আসেফাকে নিয়ে আল-বার্ক যখন ঘরে প্রবেশ করে, তখন ঘরের সকলে গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন। সকালে জাগ্রত হয়ে স্ত্রী যখন স্বামীর খাটে অপরিচিতা এক সুন্দরী তরুণীকে শুয়ে থাকতে দেখে, তখন সে এতটুকু অনুভবও করেনি যে, স্বামী-সোহাগ তার শেষ হয়ে গেছে। উল্টো বরং সে এই ভেবে আনন্দিত হয় যে, যা হোক আমার স্বামী এমন একটি রূপসী মেয়ে পেয়ে গেছেন! নতুন শয্যা-সঙ্গীনী জুটে যাওয়ায় আমার কর্তব্য অনেকখানি লাঘব হয়ে যাবে।
সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী মুসলমানদেরকে নারী থেকে এবং নারীকে মুসলমানদের কবল থেকে মুক্ত করতে চান। পুরুষদের নারী-লোলুপতা দেখে তিনি এক স্বামী এক স্ত্রীর বিধান চালু করতে চাইছেন। কিন্তু বাঁধ সেঁধেছে তারই আমীর-উজীরগণ। ঘরে তাদের একাধিক নারী। তারাই নারীর প্রধান খরিদ্দার। খোলা বাজারে নারী বেচা-কেনা, সুন্দরী মেয়েদের অপহরণ ঘটনা ঘটছে তাদেরই কারণে। আমীর-শাসকদের নারী-পূজার ফলেই ইহুদী-খৃষ্টানরা নারীর মাধ্যমে সালতানাতে ইসলামিয়ার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চালাবার সুযোগ পাচ্ছে।
সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী ভাবছেন এই নারীরাই একদিন পুরুষদের পাশাপাশি কাফেরদের বিরুদ্ধে লড়াই করত; জিহাদের ময়দানে ছিল তারা মিল্লাতের আধা শক্তি। এখন কিনা সেই নারীরাই পুরুষদের বিনোদন ও বিলাস উপকরণে পরিণত। এতে একটি জাতির অর্ধেক সামরিক শক্তিই যে নিঃশেষ হয়েছে, তাই নয়— নারী এখন এমন একটি নেশায় পরিণত হয়েছে, যা জাতির বীর পুরুষদেরকে কাপুরুষে পরিণত করেছে। এসব ভাবনা অস্থির করে তুলেছে সুলতান সালাহুদ্দীনকে।
নারীর ইজ্জত পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে চাইছেন সুলতান সালাহুদ্দীন। এ লক্ষ্যে তিনি একটি পরিকল্পনা ঠিক করে রেখেছিলেন। তাহল অবিবাহিতা মেয়েদের নিয়মতান্ত্রিকভাবে সেনাবাহিনীতে ভর্তি করে নেওয়া। তাঁর আশা, এ পন্থা অবলম্বন করলে বিলাসপ্রিয় আমীর-উজীরদের হেরেম শূন্য হয়ে যাবে। কিন্তু পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করার জন্য তাঁর সালতানাতের খেলাফত ও ইমারত হাতে নেওয়া একান্ত প্রয়োজন। এ এক কঠিন পদক্ষেপ। সুলতান সালাহুদ্দীনের দুশমনদের মধ্যে আপনদের সংখ্যাই বেশী। তিনি জানতেন, তাঁর জাতির মধ্যে ঈমান-বিক্রেতাদের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। কিন্তু তার একান্ত নির্ভরযোগ্য ও প্রশাসনের পদস্থ এক কর্মকর্তা খাদেমুদ্দীন আল-বার্কও যে একটি রূপসী রক্ষিতাকে ঘরে তুলেছে এবং মেয়েটির প্রেম-নেশায় নিজের পদমর্যাদা ও ব্যক্তিত্বের কথা ভুলে বসেছে, তা এখনও তিনি জানেন না।
○ ○ ○
মহড়ায় সুলতান সালাহুদ্দীনের সামরিক শক্তি ও বাহিনীর বীরত্ব দেখে মিসরের মানুষ অতিশয় আনন্দিত। তারা এতে দারুণ প্রভাবিত হয়েছে। সুলতান সালাহুদ্দীন ভাষণ-বক্তৃতায় তেমন অভ্যস্ত ছিলেন না। কিন্তু তিনি সেদিনকার এই সমাবেশে বক্তৃতা দেওয়া আবশ্যক মনে করলেন। তিনি বললেন, আমার এই বাহিনী জাতির মর্যাদার মোহাফেজ, ইসলামের অতন্দ্র প্রহরী। খৃষ্টানদের সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার বিশ্লেষণ দিয়ে তিনি মিসরবাসীদের উদ্দেশে বলেন, আরব বিশ্বের মুসলিম আমীর ও শাসকদের বিলাসপ্রিয়তার কারণে খৃষ্টানরা সেখানকার মুসলমানদের অস্তিত্বের জন্য হুমকি সৃষ্টি করে রেখেছে। পথে পথে মুসলিম কাফেলা লুট করছে। তারা অপহরণ করে সম্ভ্রমহানী করছে মুসলিম মেয়েদের। ভাষণে জনগণকে জাতীয় চেতনার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে সুলতান সালাহুদ্দীন বললেন, আপনারা সেনাবাহিনীতে ভর্তি হয়ে আপনাদের মা-বোন-কন্যাদের ইজ্জত ও ইসলামের মর্যাদা সংরক্ষণ করুন।
সুলতান সালাহুদ্দীনের সেই বক্তব্য এতই জ্বালাময়ী ছিল যে, তা শ্রোতাদেরকে দারুণ উদ্দীপ্ত করে তোলে। সেদিন থেকেই যুবকরা সেনাবাহিনীতে ভর্তি হতে শুরু করে।
দশদিনে ভর্তি হওয়া যুবকের সংখ্যা দাঁড়ায় ছয় হাজারে। এদের অন্তত দেড় হাজার যুবক নিজ নিজ উট সঙ্গে করে নিয়ে আসে। ঘোড়া ও খচ্চর নিয়ে আসে প্রায় এক হাজার। সুলতান সালাহুদ্দীন সঙ্গে সঙ্গে তাদেরকে বাহনের উপযুক্ত মূল্য দিয়ে দেন এবং সেনা কর্মকর্তারা তাদের প্রশিক্ষণ শুরু করে দেন।
মহড়ার তিনদিন পর।
সুলতান সালাহুদ্দীনের সেনাবাহিনীতে তিনটি অপরাধ বেড়ে চলেছে। চৌর্যবৃত্তি, জুয়াবাজী ও রাতে অনুপস্থিতি। অপরাধগুলো এর আগেও ছিল; কিন্তু ছিল অনুল্লেখযোগ্য। সেনা মহড়ার পর এগুলো মহামারীর আকার ধারণ করতে শুরু করেছে।
এ তিনটি অপরাধের মূলে ছিল জুয়াবাজী। চুরির ব্যাপকতা এত বেশী ছিল যে, এক সিপাহী অপর সিপাহীর ব্যক্তিগত জিনিস চুরি করে বাজারে নিয়ে বিক্রি করে ফেলত। কিন্তু এক রাতে ঘটে যায় একটি চাঞ্চল্যকর ঘটনা। হঠাৎ উধাও হয়ে যায় ফৌজের তিনটি ঘোড়া। অথচ সিপাহীদের সকলেই উপস্থিত। উচ্চ পর্যায়ে রিপোর্ট পৌঁছে। কর্মকর্তারা সিপাহীদের সতর্ক করেন, শাস্তির ভয় দেখান ও আল্লাহকে ভয় করে চলার উপদেশ দেন। কিন্তু তবু অপরাধ তিনটির প্রবণতা উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে।
এক রাতে ধৃত হয় একজন সিপাহী। সে কোথাও থেকে ক্যাম্পে ফিরছিল। এর আগে রাতে, অনুপস্থিত থাকা সিপাহীরা প্রহরীদের চোখ ফাঁকি দিয়ে বেরিয়ে যেত এবং তেমনিভাবেই ফিরে আসত। কিন্তু আজ ধরা পড়ে গেল একজন। কাঁপতে কাঁপতে এগিয়ে আসছিল লোকটি। তাকে দেখে হাঁক দেয় প্রহরী। সিপাহী থেমে যায় এবং সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে।
কাছে গিয়ে প্রহরী দেখে, লোকটির সারা গায়ে রক্ত, যেন রক্ত দিয়ে গোসল করে এসেছে। তুলে তাকে কমাণ্ডারের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়, ক্ষতস্থানে ব্যাণ্ডেজ করা হয়। কিন্তু রক্ষা করা গেল না তাকে। মৃত্যুর পূর্বে সে বলেছিল, নিজের এক সিপাহী সঙ্গীকে সে হত্যা করে এসেছে। ক্যাম্প থেকে আধা ক্রোশ দূরে একটি তাঁবুতে পড়ে আছে তার লাশ। তার বর্ণনা মতে সেখানে তিনটি তাঁবু আছে। অধিবাসীরা যাযাবর। তাদের কাছে আছে অনেক রূপসী তরুণী। অনেক সিপাহী সেখানে রাতে যাওয়া-আসা করে।
তাঁবুর যাযাবর অধিবাসী মেয়েরা শুধু দেহ ব্যবসায়ীই নয়— তাদের প্রতিটি মেয়ে আপন আপন খদ্দেরের মনে এই প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করত যে, আমার জীবন তোমার জন্য উৎসর্গিত। বিয়ে করে আমি তোমার স্ত্রী হয়ে জীবন কাটাতে চাই। পরে তদন্ত করে জানা গেছে, তারা তাদের খদ্দের সিপাহীদের মধ্যে পরস্পর বিরোধ সৃষ্টি করার কাজে লিপ্ত ছিল। তারই ফলে এই দু সিপাহী যাযাবরদের তাঁবুতে পরস্পর হানাহানিতে লিপ্ত হয়ে একজন ঘটনাস্থলেই মারা যায় এবং অপরজন আহত হয়ে ক্যাম্পে ফিরে এসে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়ে প্রাণ হারায়।
যাযাবরের তাঁবুতে নিহত সিপাহীর লাশ আনার জন্য কয়েকজন লোক প্রেরণ করা হয়। একজন কমাণ্ডারও আছে তাদের সাথে। ক্যাম্পে মৃত সিপাহীর দেওয়া নির্দেশনা মোতাবেক তারা এক স্থানে গিয়ে পৌঁছে। কিন্তু তাঁবু নেই। পড়ে আছে শুধু একটি লাশ। আলামতে বুঝা যাচ্ছে, এখানে তাঁবু ছিল; তুলে নেওয়া হয়েছে। রাতের বেলা পালিয়ে যাওয়া যাযাবরদের খুঁজে বের করা সম্ভব ছিল না। তারা সিপাহীর লাশ তুলে নিয়ে ফিরে আসে।
সুলতান সালাহুদ্দীনকে এ দুর্ঘটনার রিপোর্ট দেওয়া হয়। রিপোর্টে এও বলা হয় যে, সেনাবাহিনীর মধ্যে অপরাধ প্রবণতা বেড়ে গেছে। চুরি হয়েছে তিনটি ঘোড়া। সুলতান সালাহুদ্দীন আলী বিন সুফিয়ানকে ডেকে বললেন, সিপাহী বেশে ব্যারাকে গুপ্তচর ঢুকিয়ে তথ্য নাও, এসব অপরাধ বাড়ল কেন। আল-বার্কের বাহিনীকেও সুলতান সালাহুদ্দীন এ ব্যাপারে নির্দেশ প্রদান করেন।
এই ‘কেন’র জবাব নগরীতেই বিদ্যমান। কিন্তু সে পর্যন্ত পৌঁছার সাধ্য নেই আলী বিন সুফিয়ানের গুপ্তচরদের। এটি দুর্গম একটি ভবন। একটি মিসরী পরিবার বাস করে এখানে। এই ভবন ও ভবনের অধিবাসীরা নগরীতে বেশ খ্যাতিমান। বিপুল পরিমাণ দান-খয়রাত বণ্টন হয় এখানে। গরীব-অসহায় মানুষ এখান থেকে আর্থিক সাহায্য পায়। মহড়ার সময় এরা সৈন্যদের জন্য দু থলে স্বর্ণমুদ্রা দান করেছিল সুলতান সালাহুদ্দীনকে। এটি একটি ব্যবসায়ী পরিবার। সুলতান সালাহুদ্দীনের আগমনের আগে এ ভবনটি ছিল সুদানী বাহিনীর পদস্থ কর্মকর্তাদের মেহমানখানা। সুলতান সালাহুদ্দীন এসে সুদানীদের নির্মূল করে দেওয়ার পর এরা সুলতানের অফাদারী মেনে নেয়।
সুলতান সালাহুদ্দীন যেদিন আল-বার্ক ও আলী বিন সুফিয়ানকে সেনাবাহিনীর অপরাধ প্রবণতার রহস্য উদ্ঘাটনের নির্দেশ দেন, সেদিন এই ভবনটির একটি কক্ষে বসা ছিল দশ-বারোজন লোক। কক্ষে মদের আসর চলছিল। এমন সময়ে কক্ষে প্রবেশ করে এক বৃদ্ধ। বৃদ্ধকে দেখে আসন ছেড়ে দাঁড়িয়ে যায় সকলে। সঙ্গে ছিল তার অতিশয় সুন্দরী একটি মেয়ে, যার মুখমণ্ডলের অর্ধেকটা নেকাবে টাকা। তারা কক্ষে প্রবেশ করামাত্র দরজা বন্ধ হয়ে যায়। মেয়েটি তার মুখের নেকাব সরিয়ে ফেলে। সে বৃদ্ধের সঙ্গে এক পাশে বসে পড়ে।
‘সেনাবাহিনীতে জুয়াবাজী ও অপকর্ম বেড়ে যাওয়ার সংবাদ এই গতকালই সুলতান সালাহুদ্দীনের নিকট পৌঁছেছে। আমাদের আজকের এই বৈঠক অতীব গুরুত্বপূর্ণ। সুলতান সালাহুদ্দীন সিপাহীদের বেশে সেনাবাহিনীতে গুপ্তচর ঢুকিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। আমাদের এই গুপ্তচরবৃত্তিকে ব্যর্থ করতে হবে। আমি যে তাজা সংবাদটি নিয়ে এসেছি, তা বড়ই আশাব্যঞ্জক। এক মেয়েকে কেন্দ্র করে লড়াইয়ে লিপ্ত হয়ে দুজন সিপাহী একে অপরকে হত্যা করেছে। এটি আমাদের সাফল্যের সূচনা।’ বলল বৃদ্ধ।
‘তিন মাসে মাত্র দুজন মুসলমান সিপাহী খুন হয়েছে। সাফল্যের এই গতি বড়ই ধীর। প্রকৃত সফল তো তখন হব, যখন সুলতান সালাহুদ্দীনের কোন নায়েব সালার তার সালারকে হত্যা করবে।’ বৃদ্ধের কথা কেটে বলল আরেকজন।
‘আমি তো বরং কামিয়াবী তাকে বলব, যখন কোন সালার কিংবা নায়েব সালার সালাহুদ্দীন আইউবীকে হত্যা করবে। আমি জানি, কোন বাহিনীর এক হাজার সিপাহী খুন হলেও তেমন কিছু যায় আসে না। আমাদের টার্গেট সালাহুদ্দীন। সালাহুদ্দীনকে হত্যা করা আমাদের প্রধান লক্ষ্য। গত বছরের ঘটনা দুটোর কথা আপনাদের নিশ্চয় মনে আছে। সমুদ্রতীরে সালাহুদ্দীনকে লক্ষ্য করে ছোঁড়া তীরটি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে গেল। রোম থেকে আমাদের বাহিনী এল, কিন্তু তারা সকলেই ধরা পড়ল। এতে বুঝা যায়, আপনারা সুলতান সালাহুদ্দীনকে হত্যা করা যত সহজ মনে করছেন, বিষয়টা তত সহজ নয়। তাছাড়া এমনও তো হতে পারে যে, সালাহুদ্দীন নিহত হলে তার স্থলে যিনি আসবেন, তিনি আরও কঠোর ও কট্টর মুসলমান হবেন। তাই আমার প্রস্তাব, তার বাহিনীকে সেই লোভনীয় ধ্বংসের পথে নিক্ষেপ কর, যে পথে ক্রুশের পূজারীরা নিক্ষেপ করেছে বাগদাদ ও দামেশকের আমীর-শাসকদের।’ বলল বৃদ্ধ।
‘ক্রুশের অনুসারী ও সুদানী বাহিনী পরাজিত হল এক বছর কেটে গেছে। এই এক বছরে আপনি কী কী কাজ করেছেন? আপনি বড় দীর্ঘ সময় ব্যয় করেছেন। দুজন লোককে যে করে হোক হত্যা করতেই হবে। সালাহুদ্দীন আইউবী ও আলী বিন সুফিয়ান।’ বলল একজন।
‘আলী বিন সুফিয়ানকে যদি হত্যা করা যায়, তাহলে সালাহুদ্দীন এমনিতেই অন্ধ ও বধির হয়ে যাবে।’ বলল আরেকজন।
‘আমি সেই চোখগুলোকে হাত করে ফেলেছি, যারা সুলতান সালাহুদ্দীনের বুকের প্রতিটি গোপন রহস্য স্পষ্ট দেখতে পায়।’ বলে বৃদ্ধ তার সঙ্গে আসা মেয়েটির পিঠে হাত রেখে বলল— ‘এই সেই চোখ। দেখে নিন, এই চোখ দুটোতে কেমন যাদু! তোমরা সালাহুদ্দীন আইউবীর পদস্থ এক কর্মকর্তা খাদেমুদ্দীন আল-বার্কের নাম অবশ্যই শুনেছেন। কেউ হয়ত তাকে দেখেছেনও। সালাহুদ্দীন আইউবীর একান্ত ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি দুজন। আলী ও আল-বার্ক। আলী বিন সুফিয়ানকে হত্যা করা বোকামী হবে। আমি আল-বার্ককে যেভাবে কব্জা করেছি, আলীকেও সেভাবে হাত করতে হবে।’
‘কী বললেন, আল-বার্ক আপনার কব্জায় এসে গেছে?’ উদ্দীপ্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে একজন।
‘হ্যাঁ’ — মেয়েটির রেশমী চুলে আঙ্গুল বুলিয়ে বৃদ্ধ বলল— ‘আমি তাকে এই শিকলে আটক করেছি। আজ বিশেষ করে এ সুসংবাদটি শুনানোর জন্যই আপনাদের এখানে তলব করেছি। আমাদের দ্রুত এ বৈঠক মুলতবী করতে হবে। কারণ, এভাবে একত্রে এক স্থানে দীর্ঘ সময় অবস্থান করা ঠিক নয়। এ মেয়েটিকে বোধ হয় আপনারা সকলেই চিনবেন। এ যে এত বিচক্ষণতার সাথে নাটক মঞ্চস্থ করতে পারবে, আমি তা কল্পনাও করিনি। বয়সে কচি হলে কি হবে, মেয়েটা কাজে বড় পাকা। গত একটি বছর আমি এমন একটি সুযোগের সন্ধান। করে ফিরছিলাম, যাতে আলী ও আল-বার্ককে অন্তত একজনকে ফাঁদে ফেলতে পারি। তাদের সঙ্গে আমরা কখনও সাক্ষাৎ করিনি। তার কারণ, আমি তাদের কাছে পরিচিত হতে চাইনি। সুলতান সালাহুদ্দীন সামরিক কর্মকর্তাদের শহর থেকে দূরে রাখেন। অবশেষে তিনি সামরিক মহড়া ও মেলার ঘোষণা দেন। আমি জানতে পারলাম, তিনি সেনা কমাণ্ডার ও সালারদের নির্দেশ দিয়েছেন, যেন মেলায় এসে তারা আম-জনতার সঙ্গে বসে, তাদের সঙ্গে কথা বলে এবং ভীতি ছড়ানোর পরিবর্তে জনমনে আস্থা সৃষ্টি করার চেষ্টা করে। আমি তন্ন তন্ন করে খুঁজেও আলী বিন সুফিয়ানকে কোথাও পেলাম না। এই মেয়েটিকে সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিলাম। খুঁজে পেলাম আল-বার্ককে। তার এক পাশে দুটি শূন্য চেয়ার পেলাম। কাছেরটিতে মেয়েটিকে বসিয়ে অপরটিতে আমি বসে পড়লাম। একে আট মাস ধরে আমি ওস্তাদী কায়দা শিখিয়ে আসছি। আমাকে নিজের বৃদ্ধ স্বামী এবং নিজেকে খরিদকৃত মজলুম নারী পরিচয় দিয়ে আল-বার্কের ন্যায় ঈমানদার লোকটাকে নিজের রূপের ফাঁদে বন্দি করে মেয়েটি। অন্যত্র সাক্ষাতের সময় ও স্থান ঠিক করে নেয় দুজনে। পতিত জীর্ণ ভবনটিতে নিয়ে এসে তার সঙ্গে কি ড্রামা খেলতে হবে, তা শিখিয়ে দিলাম। মেয়েটি যথাসময়ে ভবনটিতে চলে যায়। আল-বার্কও চলে আসে। চারজন লোক নিয়ে আমি পূর্ব থেকেই সেখানে লুকিয়ে ছিলাম। সেই চারজনের দুজন এখানে উপস্থিত আছে। আপনারা সকলে হয়ত তাদেরকে চিনেন না। তারা আমাদের দলের লোক। মেয়েটি আল-বার্কের কাছে প্রমাণ করে যে, তার খাতিরে সে নিজের জীবন দিতেও প্রস্তুত। আমাদের চার সঙ্গী আর-বার্ক ও মেয়েটির উপর তরবারী দ্বারা আক্রমণ করে বসে। মেয়েটি বর্শা দ্বারা আক্রমণের মোকাবেলা করে। নাটকটিকে এমন সুনিপুণভাবে মঞ্চস্থ করা হল যে, আল-বার্কের মনে বিন্দুমাত্র সন্দেহ জাগল না। অভাগার মাথায় এ বুঝটুকুও এল না যে, তরবারী ও বর্শার এমন ঘোরতর লড়াই হল, অথচ একটা লোকের গায়েও সামান্য আঁচড় লাগল না; এমনকি তার নিজের গায়েও একটি খোঁচা লাগল না। আমি এই বলে নাটকটির ইতি টানলাম যে, মেয়েটি এত দুঃসাহসী আমি আগে জানতাম না। এমন সাহসী মেয়ে কোন বীর পুরুষের পাশেই মানাবে ভাল। এই বলে সন্তুষ্টচিত্তে মেয়েটিকে আল-বার্কের হাতে তুলে দিলাম।’
‘এমন পরিণত বয়সের একজন অভিজ্ঞ শাসক এত সহজে আমার ফাঁদে আটকে গেল, আমি ভেবে বিস্মিত হই। আমি তাকে সুরায় অভ্যস্ত করে তুলেছি, যা পূর্বে কখনও সে পান করেনি। তার প্রথমা স্ত্রী আমার সঙ্গে একই ঘরে বাস করে। তার ছেলে-মেয়েও আছে। কিন্তু আমাকে পেয়ে লোকটা সবাইকে ভুলে গেছে।’ বলল মেয়েটি।
মেয়েটি কী কী পদ্ধতিতে সুলতান সালাহুদ্দীনের এমন একজন নির্ভরযোগ্য ও ঘনিষ্ঠতম ব্যক্তিত্বের বিবেক-বুদ্ধিকে নিজের মুঠিতে নিয়ে রেখেছে, সে সভাসদদের সামনে তার বিবরণ তুলে ধরে।
‘এই তিন মাসে মেয়েটি আমাকে সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর কয়েকটি মূল্যবান তথ্য প্রদান করেছে। সুলতান সালাহুদ্দীন বিশাল সেনাবাহিনী গঠনের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন। এই বাহিনীর অর্ধেক থাকবে মিসরে। বাকি অর্ধেককে তিনি নিজের কমাণ্ডে খৃষ্টান রাজাদের বিরুদ্ধে লড়াবার জন্য নিয়ে যাবেন। দৃষ্টি তার জেরুজালেমের উপর। কিন্তু আমার মেয়েটি আল-বার্ক থেকে যে তথ্য সংগ্রহ করেছে, তাহল, সুলতান সর্বপ্রথম নিজের মুসলিম প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও আপনজনদের ঐক্যবদ্ধ করবেন। কিন্তু ক্রুশের অনুসারীরা তাদের ঐক্যকে সেই পদ্ধতিতে বিনষ্ট করে দিয়েছে, যে পদ্ধতিতে আমরা আল-বার্ককে নিজেদের কজায় এনেছি।’ বলল বৃদ্ধ।
‘তাহলে কি আমরা ধরে নিতে পারি, আল-বার্ক এখন আমাদেরই লোক?’ জানতে চাইল একজন।
‘না। আল-বার্ক এখনও একনিষ্ঠভাবেই সালাহুদ্দীনের ওফাদার। পাশাপাশি ততটুকু ওফাদার আমাদের এই মেয়েটির। মেয়েটি বড় বিচক্ষণতা ও আবেগের সাথে নিজেকে এমনভাবে সুলতান সালাহুদ্দীন, জাতি ও ইসলামের জন্য উৎসর্গিত বলে প্রকাশ করে যে, আল-বার্ক একে স্বজাতির একটি জানবাজ কন্যা মনে করে। এর রূপ-যৌবন ও প্রেম-ভালবাসার ক্রিয়াই আলাদা। আল-বার্ককে আমরা আমাদের দলে ভেড়াতে পারব না। তার প্রয়োজনই বা কি। সে আমাদের হাতের পুতুল হয়েই তো কাজ করছে।’ জবাব দেয় বৃদ্ধ।
‘সুলতান সালাহুদ্দীন আর কী করতে চান?’ জিজ্ঞেস করে দলের এক সদস্য।
‘সুলতান সালাহুদ্দীন সালতানাতে ইসলামিয়ার স্বপ্ন দেখছেন। তিনি ক্রুশের সাম্রাজ্যে ইসলামের পতাকা উড্ডীন করার পরিকল্পনা তৈরী করেছেন। আমাদের যেসব গুপ্তচর সমুদ্রের ওপার থেকে এসেছিল, তাদেরকে গ্রেফতার ও ব্যর্থ করে দেওয়ার জন্য সালাহুদ্দীন আলী বিন সুফিয়ানের তত্ত্বাবধানে বিশাল এক গ্রুপ তৈরি করেছেন। আল-বার্ক থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী তিনি জানবাজদের একটি আলাদা বাহিনী গঠন করেছেন। তার পরিকল্পনা, তাদেরকে বিভিন্ন খৃষ্টরাজ্যে প্রেরণ করে গুপ্তচরবৃত্তি ও নাশকতা চালাবেন। এই বাহিনীর প্রশিক্ষণ শুরু হয়ে গেছে। সালাহুদ্দীন আইউবীর পরিকল্পনা বড় ভয়াবহ। ক্রুসেড বিরোধী সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবেই তিনি সামরিক মহড়ার আয়োজন করেছিলেন এবং সেনাবাহিনীতে সাত হাজার যুবক ভর্তি করেছেন। এখনও ভর্তি হচ্ছে। যারা ভর্তি হচ্ছে, তাদের মধ্যে সুদানীও রয়েছে। আমি উপর থেকে যে নির্দেশনা, পেয়েছি, তাহল, সালাহুদ্দীনের বাহিনীতে পাপের বীজ বপণ করতে হবে। সৈন্যদের মনে নারী ও জুয়ার আসক্তি ঢুকিয়ে দিতে হবে।’ জবাব দেয় বৃদ্ধ।
বৃদ্ধ আরও জানায়, ‘সুলতান সালাহুদ্দীনের সামরিক মহড়া সমাপ্ত হওয়ার পর পর সে সেনাদের মধ্যে নিজের লোক ঢুকিয়ে রেখেছে। তারা বড় বিচক্ষণতার সাথে সৈন্যদের মধ্যে জুয়া খেলা শুরু করিয়ে দিয়েছে। জুয়া আর নারী এমন এক বস্তু, যা মানুষকে চুরি ও খুন-খারাবিতে লিপ্ত করে।’
বৃদ্ধ আরও জানায়, ‘বেশ্যা মেয়েদেরকে প্রশিক্ষণ দিয়ে আমি সালাহুদ্দীনের সেনা ক্যাম্পগুলোর আশপাশে ছড়িয়ে দিয়েছি। তারা এতই বিচক্ষণতার সাথে কাজ করে যে, তারা যে পেশাদার পতিতা, তা কাউকে বুঝতেই দেয় না। সুলতান সালাহুদ্দীনের সৈন্যদেরকে পাপের পথে নিক্ষিপ্ত করার পাশাপাশি তাদের মধ্যে দ্বন্দ্বও সৃষ্টি করছে।’
বৃদ্ধ জানায়, ‘ইতিমধ্যে আমার এই অভিযানের ফলও ফলতে শুরু করেছে। এই একেবারে তাজা খবর, দুজন সিপাহী রাতের আঁধারে ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে এসে একই সময়ে এক মেয়ের তাঁবুতে ঢুকে। মেয়েটির দখল নিয়ে তারা বিবাদে লিপ্ত হয়। সৈনিক মানুষ তো! এক কথা দু কথার পর যুদ্ধ বেঁধে যায় দুজনের মধ্যে। একজন খুন হয়ে যায় ঘটনাস্থলেই। অপরজনের ব্যাপারে শুনেছি, সে রক্তাক্ত অবস্থায় ক্যাম্পে ফিরে গিয়ে মারা গেছে। এ রিপোর্ট চলে যায় সুলতান সালাহুদ্দীনের কাছে। তিনি আলী বিন সুফিয়ান ও আল-বার্ককে ডেকে ক্যাম্পে ক্যাম্পে গুপ্তচর ঢুকিয়ে এই চুরি, জুয়াবাজি ও অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধির কারণ উদ্ঘাটনের নির্দেশ দেন। তাই আমাদের যে মেয়েগুলো এ কাজে নিয়োজিত আছে, আপনারা তাদের বলে দেবেন, যেন তারা ক্যাম্পের নিকটে না যায়।’
বৈঠকে বৃদ্ধ আরও জানায়, ‘আসেফা পাঁচ-ছয়দিন পর পর নতুন তথ্য জানাবার জন্য তার নিকট আসে। যে রাতে তার বাইরে বেরুবার প্রয়োজন পড়ে, সে রাতে আল-বার্ককে মদের সঙ্গে এক প্রকার নেশাকর পাউডার মিশিয়ে খাইয়ে দেয়। তার ক্রিয়ায় লোকটা ভোর পর্যন্ত অচেতন হয়ে পড়ে থাকে।’
বৈঠকে এ তথ্যও প্রকাশ করা হয় যে, মিশরের শহর-নগর ও গ্রাম-গঞ্জে গোপন বেশ্যালয় ও জুয়ার আডড়া প্রতিষ্ঠা করে দেওয়া হয়েছে। তার ফলাফল বেশ আশাব্যঞ্জক। প্রশিক্ষিত সুন্দরী মেয়েরা সুশীল-সম্ভ্রান্ত পরিবারের যুবকদেরকে পাপের পথে নিক্ষেপ করে চলেছে। এখন থেকে চেষ্টা করতে হবে, মুসলিম মেয়েদের মধ্যেও কিভাবে এই অশ্লীলতা ছড়ানো যায়।
খৃষ্টান গুপ্তচরদের গোপন এই অধিবেশন সমাপ্ত হয়। তারা সকলে এক সঙ্গে বেরোয়নি। একজন বের হওয়ার দশ-পনের মিনিট পর বের হয় দ্বিতীয়জন। এভাবে একে একে সকলে চলে যায় আপন আপন ঠিকানায়। চলে যায় বৃদ্ধও। থেকে যায় শুধু আসেফা ও আরেকজন! অবশেষে আসেফাও মুখটা নেকাবে ঢেকে বেরিয়ে পড়ে লোকটার সঙ্গে।
○ ○ ○