সায়াহ্নকৃত্য সমাপনান্তে মহেন্দ্রকে ডাকিয়া সত্যানন্দ আদেশ করিলেন, “তোমার কন্যা জীবিত আছে |”
ম। কোথায় মহারাজ?
স। তুমি আমাকে মহারাজ বলিতেছ কেন?
ম। সকলেই বলে, তাই। মঠের অধিকারীদিগকে রাজা সম্বোধন করিতে হয়। আমার কন্যা কোথায় মহারাজ?
স। শুনিবার আগে, একটা কথার স্বরূপ উত্তর দাও। তুমি সন্তানধর্ম গ্রহণ করিবে?
ম। তাহা নিশ্চিত মনে মনে স্থির করিয়াছি।
স। তবে কন্যা কোথায় শুনিতে চাহিও না।
ম। কেন মহারাজ?
স। যে এ ব্রত গ্রহণ করে, তাহার স্ত্রী, পুত্র, কন্যা, স্বজনবর্গ, কাহারও সঙ্গে সম্বন্ধ রাখিতে নাই। স্ত্রী, পুত্র, কন্যার মুখ দেখিলেও প্রায়শ্চিত্ত আছে। যতদিন না সন্তানের মানস সিদ্ধ হয়, ততদিন তুমি কন্যার মুখ দেখিতে পাইবে না। অতএব যদি সন্তানধর্ম গ্রহণ স্থির হইয়া থাকে, তবে কন্যার সন্ধান জানিয়া কি করিবে? দেখিতে ত পাইবে না।
ম। এ কঠিন নিয়ম কেন প্রভু?
স। আমি সে পদ্ধতি বলিয়া দিতেছি।
ম। নূতন মন্ত্র লইতে হইবে কেন?
স। সন্তানেরা বৈষ্ণব।
ম। ইহা বুঝিতে পারি না। সন্তানেরা বৈষ্ণব কেন? বৈষ্ণবের অহিংসাই পরম ধর্ম।
স। সে চৈতন্যদেবের বৈষ্ণব। নাস্তিক বৌদ্ধধর্মের অনুকরণে যে অপ্রকৃত বৈষ্ণবতা উৎপন্ন হইয়াছিল, এ তাহারই লক্ষণ। প্রকৃত বৈষ্ণবধর্মের লক্ষণ দুষ্টের দমন, ধরিত্রীর উদ্ধার। কেন না, বিষ্ণুই সংসারের পালনকর্তা। দশ বার শরীর ধারণ করিয়া পৃথিবী উদ্ধার করিয়াছেন। কেশী, হিরণ্যকশিপু, মধুকৈটভ, মুর, নরক প্রভৃতি দৈত্যগণকে, রাবণাদি রাক্ষসগণকে, কংস, শিশুপাল প্রভৃতি রাজগণকে তিনিই যুদ্ধে ধ্বংস করিয়াছিলেন। তিনিই জেতা, জয়দাতা, পৃথিবীর উদ্ধারকর্তা, আর সন্তানের ইষ্টদেবতা। চৈতন্যদেবের বৈষ্ণবধর্ম প্রকৃত বৈষ্ণবধর্ম নহে – উহা অর্ধেক ধর্ম মাত্র। চৈতন্যদেবের বিষ্ণু প্রেমময় – কিন্তু ভগবান কেবল প্রেমময় নহেন – তিনি অনন্তশক্তিময়। চৈতন্যদেবের বিষ্ণু শুধু প্রেমময় – সন্তানের বিষ্ণু শুধু শক্তিময়। আমরা উভয়েই বৈষ্ণব – কিন্তু উভয়েই অর্ধেক বৈষ্ণব। কথাটা বুঝিলে?
ম। না। এ যে কেমন নূতন নূতন কথা শুনিতেছি। কাশিমবাজারে একটা পাদরির সঙ্গে আমার দেখা হইয়াছিল – সে ঐরকম কথাসকল বলিল – অর্থাৎ ঈশ্বর প্রেমময় – তোমরা যীশুকে প্রেম কর – এ যে সেইরকম কথা।
স। যেরকম কথা আমাদিগের চতুর্দশ পুরুষ বুঝিয়া আসিতেছেন, সেইরকম কথায় আমি তোমায় বুঝাইতেছি। ঈশ্বর ত্রিগুণাত্মক, তাহা শুনিয়াছ?
ম। হাঁ। সত্ত্ব, রজ:, তম: – এই তিন গুণ।
স। ভাল। এই তিনটি গুণের পৃথক পৃথক উপাসনা। সত্ত্বগুণ হইতে তাঁহার দয়াদাক্ষিণ্যাদির উৎপত্তি, তাঁহার উপাসনা ভক্তির দ্বারা করিবে। চৈতন্যের সম্প্রদায় তাহা করে। আর রজোগুণ হইতে তাঁহার শক্তির উৎপত্তি ; ইহার উপাসনা যুদ্ধের দ্বারা – দেবদ্বেষীদিগের নিধন দ্বারা – আমরা তাহা করি। আর তমোগুণ হইতে ভগবান শরীরী – চতুর্ভূজাদি রূপ ইচ্ছাক্রমে ধারণ করিয়াছেন। স্রক্ চন্দনাদি উপহারের দ্বারা সে গুণের পূজা করিতে হয় – সর্বসাধারণে তাহা করে। এখন বুঝিলে?
ম। বুঝিলাম। সন্তানেরা তবে উপাসকসম্প্রদায় মাত্র?
স। তাই। আমরা রাজ্য চাহি না – কেবল মুসলমানেরা ভগবানের বিদ্বেষী বলিয়া তাহাদের সবংশে নিপাত করিতে চাই।
স। সন্তানের কাজ অতি কঠিন কাজ। যে সর্বত্যাগী, সে ভিন্ন অপর কেহ এ কাজের উপযুক্ত নহে। মায়ারজ্জুতে যাহার চিত্ত বদ্ধ থাকে, লকে বাঁধা ঘুড়ির মত সে কখন মাটি ছাড়িয়া স্বর্গে উঠিতে পারে না।
ম। মহারাজ, কথা ভাল বুঝিতে পারিলাম না। যে স্ত্রী-পুত্রের মুখ দর্শন করে, সে কি কোন গুরুতর কার্যের অধিকারী নহে?
স। পুত্র-কলত্রের মুখ দেখিলেই আমরা দেবতার কাজ ভুলিয়া যাই। সন্তানধর্মের নিয়ম এই যে, যে-দিন প্রয়োজন হইবে, সেই দিন সন্তানকে প্রাণত্যাগ করিতে হইবে। তোমার কন্যার মুখ মনে পড়িলে তুমি কি তাহাকে রাখিয়া মরিতে পারিবে?
ম। তাহা না দেখিলেই কি কন্যাকে ভুলিব?
স। না ভুলিতে পার, এ ব্রত গ্রহণ করিও না।
ম। সন্তানমাত্রেই কি এইরূপ পুত্র-কলত্রকে বিস্মৃত হইয়া ব্রত গ্রহণ করিয়াছে? তাহা হইলে সন্তানেরা সংখ্যায় অতি অল্প।
স। সন্তান দ্বিবিধ, দীক্ষিত আর অদীক্ষিত। যাহারা অদীক্ষিত, তাহারা সংসারী বা ভিখারী। তাহারা কেবল যুদ্ধের সময় আসিয়া উপস্থিত হয়, লুঠের ভাগ বা অন্য পুরস্কার পাইয়া চলিয়া যায়। যাহারা দীক্ষিত, তাহারা সর্বত্যাগী। তাহারাই সম্প্রদায়ের কর্তা। তোমাকে অদীক্ষিত সন্তান হইতে অনুরোধ করি না, যুদ্ধের জন্য লাঠি- সড়কিওয়লা অনেক আছে। দীক্ষিত না হইলে তুমি সম্প্রদায়ের কোন গুরুতর কার্যে অধিকারী হইবে না।
ম। দীক্ষা কি? দীক্ষিত হইতে হইবে কেন? আমি ত ইতিপূর্বেই মন্ত্র গ্রহণ করিয়াছি।
স। সে মন্ত্র ত্যাগ করিতে হইবে। আমার নিকট পুনর্বার মন্ত্র লইতে হইবে।
ম। মন্ত্র ত্যাগ করিব কি প্রকারে?
জী। কি প্রকারে তাহার সংগ্রহ করিব, আজ্ঞা করুন।
স। সংগ্রহের জন্য আমি আজ রাত্রে তীর্থযাত্রা করিব। যত দিন না ফিরিয়া আসি, তত দিন তোমরা কোন গুরুতর ব্যাপারে হস্তক্ষেপণ করিও না। কিন্তু সন্তানদিগের একতা রক্ষা করিও। তাহাদিগের গ্রাসাচ্ছাদন যোগাইও, এবং মার রণজয়ের জন্য অর্থভাণ্ডার পূর্ণ করিও। এই ভার তোমাদিগের দুই জনের উপর রহিল।
ভবানন্দ বলিলেন, “তীর্থযাত্রা করিয়া এসকল সংগ্রহ করিবেন কি প্রকারে? গোলাগুলি বন্দুক কামান কিনিয়া পাঠাইতে বড় গোলমাল হইবে। আর এত পাইবেন বা কোথা, বেচিবে বা কে, আনিবে বা কে?”
স। কিনিয়া আনিয়া আমরা কর্ম নির্বাহ করিতে পারিব না। আমি কারিগর পাঠাইয়া দিব, এইখানে প্রস্তুত করিতে হইবে।
জী। সে কি? এই আনন্দমঠে?
স। তাও কি হয়? ইহার উপায় আমি বহু দিন হইতে চিন্তা করিতেছি। ঈশ্বর অদ্য তাহার সুযোগ করিয়া দিয়াছেন। তোমরা বলিতেছিলে, ভগবান প্রতিকূল। আমি দেখিতেছি, তিনি অনুকূল।
ভ। কোথায় কারখানা হইবে?
স। পদচিহ্নে।
জী। সে কি? সেখানে কি প্রকারে হইবে?
স। নহিলে কি জন্য আমি মহেন্দ্র সিংহকে এ মহাব্রত গ্রহণ করাইবার জন্য এত আকিঞ্চন করিয়াছি?
ভ। মহেন্দ্র কি ব্রত গ্রহণ করিয়াছেন?
স। ব্রত গ্রহণ করে নাই, করিবে। আজ রাত্রে তাহাকে দীক্ষিত করিব।
জী। কই, মহেন্দ্র সিংহকে ব্রত গ্রহণ করাইবার জন্য কি আকিঞ্চন হইয়াছে, তাহা আমরা দেখি নাই। তাহার স্ত্রী কন্যার কি অবস্থা হইয়াছে, কোথায় তাহাদিগকে রাখিল? আমি আজ একটি কন্যা নদীতীরে পাইয়া আমার ভগিনীর নিকট রাখিয়া আসিয়াছি। সেই কন্যার নিকট একটি সুন্দরী স্ত্রীলোক মরিয়া পড়িয়া ছিল। সে ত ক মহেন্দ্রের স্ত্রী-কন্যা নয়? আমার তাই বোধ হইয়াছিল।
শান্তি কিছুই উত্তর করিল না। চুপ করিয়া রহিল। নিমাই দেখিল, শান্তি মনের কথা কিছু বলিবে না। শান্তি মনের কথা বলিতে ভালবাসে না, তাহা নিমাই জানিত। সুতরাং নিমাই চেষ্টা করিয়া অন্য কথা পাড়িল–বলিল, “দেখ দেখি বউ, কেমন মেয়েটি |”
শান্তি বলিল, “মেয়ে কোথা পেলি – তোর মেয়ে হলো কবে লো?”
নি। মরণ আর কি – তুমি যমের বাড়ী যাও – এ যে দাদার মেয়ে।
নিমাই শান্তিকে জ্বালাইবার জন্য এ কথাটা বলে নাই। “দাদার মেয়ে” অর্থাৎ দাদার কাছে যে মেয়েটি পাইয়াছি। শান্তি তাহা বুঝিল না ; মনে করিল, নিমাই বুঝি সূচ ফুটাইবার চেষ্টা করিতেছে। অতএব শান্তি উত্তর করিল, “আমি মেয়ের বাপের কথা জিজ্ঞাসা করি নাই – মার কথাই জিজ্ঞাসা করিয়াছি |”
নিমাই উচিত শাস্তি পাইয়া অপ্রতিভ হইয়া বলিল, “কার মেয়ে কি জানি ভাই, দাদা কোথা থেকে কুড়িয়ে মুড়িয়ে এনেছে, তা জিজ্ঞাসা করবার ত অবসর হলো না! তা এখন মন্বন্তরের দিন, কত লোক ছেলেপিলে পথেঘাটে ফেলিয়া দিয়া যাইতেছে ; আমাদের কাছেই কত মেয়ে-ছেলে বেচিতে আনিয়াছিল, তা পরের মেয়ে-ছেলে কে আবার নেয়?” (আবার সেই চক্ষে সেইরূপ জল আসিল – নিমি চক্ষের জল মুছিয়া আবার বলিতে লাগিল) “মেয়েটি দিব্য সুন্দর, নাদুসনুদুস চাঁদপানা দেখে দাদার কাছে চেয়ে নিয়েছি |”
তার পর শান্তি অনেক্ষণ ধরিয়া নিমাইয়ের সঙ্গে নানাবিধ কথোপকথন করিল। পরে নিমাইয়ের স্বামী বাড়ী ফিরিয়া আসিল দেখিয়া শান্তি উঠিয়া আপনার কুটীরে গেল। কুটীরে গিয়া দ্বার রুদ্ধ করিয়া উননের ভিতর হইতে কতকগুলি ছাই বাহির করিয়া তুলিয়া রাখিল। অবশিষ্ট ছাইয়ের উপর নিজের জন্য যে ভাত রান্না ছিল, তাহা ফেলিয়া দিল। তার পরে দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া অনেক্ষণ চিন্তা করিয়া আপনা আপনি বলিল, “এত দিন যাহা মনে করিয়াছিলাম, আজি তাহা করিব। যে আশায় এত দিন করি নাই, তাহা সফল হইয়াছে। সফল কি নিষ্ফল – নিষ্ফল! এ জীবনই নিষ্ফল! যাহা সঙ্কল্প করিয়াছি, তাহা করিব। একবারেও যে প্রায়শ্চিত্ত, শতবারেও তাই |”
এই ভাবিয়া শান্তি ভাতগুলি উননে ফেলিয়া দিল। বন হইতে গাছের ফল পাড়িয়া আনিল। অন্নের পরিবর্তে তাহাই ভোজন করিল। তার পর তাহার যে ঢাকাই শাড়ির উপর নিমাইমণির চোট, তাহা বাহির করিয়া তাহার পাড় ছিঁড়িয়া ফেলিল। বস্ত্রের যেটুকু অবশিষ্ট রহিল, গেরিমাটিতে তাহা বেশ করিয়া রঙ করিল। বস্ত্র রঙ করিতে, শুকাইতে সন্ধ্যা হইল। সন্ধ্যা হইলে দ্বার রুদ্ধ করিয়া অতি চমৎকার ব্যাপারে শান্তি ব্যাপৃত হইল। মাথার রুক্ষ আগুল‍্ফলম্বিত কেশদামের কিয়দংশ কাঁচি দিয়া কাটিয়া পৃথক করিয়া রাখিল। অবশিষ্ট যাহা মাথায় রহিল, তাহা বিনাইয়া জটা তৈয়ারি করিল। রুক্ষ কেশ অপূর্ববিন্যাসবিশিষ্ট জটাভারে পরিণত হইল। তার পর সেই গৈরিক বসনখানি অর্ধেক ছিঁড়িয়া ধড়া করিয়া চারু অঙ্গে শান্তি পরিধান করিল। অবশিষ্ট অর্ধেকে হৃদয় আচ্ছাদিত করিল। ঘরে একখানি ক্ষুদ্র দর্পণ ছিল, বহুকালের পর শান্তি সেখানি বাহির করিল ; বাহির করিয়া দর্পণে আপনার বেশ আপনি দেখিল। দেখিয়া বলিল, “হায়! কি করিয়া কি করি! তখন দর্পণ ফেলিয়া দিয়া, যে চুলগুলি কাটা পড়িয়া ছিল, তাহা লইয়া শ্মশ্রুগুম্ফ রচিত করিল। কিন্তু পরিতে পারিল না। ভাবিল, “ছি! ছি! ছি! তাও কি হয়! সে দিনকাল কি আছে! তবে বুড়ো বেটাকে জব্দ করিবার জন্য, এ তুলিয়া রাখা ভাল |” এই ভাবিয়া শান্তি সেগুলি কাপড়ে বাঁধিয়া রাখিল। তার পর ঘরের ভিতর হইতে এক বৃহৎ হরিণচর্ম বাহির করিয়া, কণ্ঠের উপর গ্রন্থি দিয়া, কণ্ঠ হইতে জানু পর্যন্ত শরীর আবৃত করিল। এইরূপে সজ্জিত হইয়া সেই নূতন সন্ন্যাসী গৃহমধ্যে ধীরে ধীরে চারি দিক নিরীক্ষণ করিল। রাত্রি দ্বিতীয় প্রহর হইলে শান্তি সেই সন্ন্যাসীবেশে দ্বারোদ্ঘাটন পূর্বক অন্ধকারে একাকিনী গভীর বনমধ্যে প্রবেশ করিলেন। বনদেবীগণ সেই নিশীথে কাননমধ্যে অপূর্ব গীতধ্বনি শ্রবণ করিল।

Leave a Reply