সেই জ্যোৎস্নাময়ী রজনীতে দুই জনে নীরবে প্রান্তর পার হইয়া চলিল। মহেন্দ্র নীরব, শোককাতর, গর্বিত, কিছু কৌতূহলী।

ভবানন্দ সহসা ভিন্নমূর্তি ধারণ করিলেন। সে স্থিরমূর্তি ধীরপ্রকৃতি সন্ন্যাসী আর নাই; সেই রণনিপুণ বীরমূর্তি – সৈন্যাধ্যক্ষের মুণ্ডঘাতীর মূর্তি আর নাই। এখনই যে গর্বিতভাবে সেই মহেন্দ্রকে তিরস্কার করিতেছিলেন, সে মূর্তি আর নাই। যেন জ্যোৎস্নাময়ী, শান্তিশালিনী, পৃথিবীর প্রান্তর-কানন-নদ-নদীময় শোভা দেখিয়া তাঁহার চিত্তের বিশেষ স্ফূর্তি হইল – সমুদ্র যেন চন্দ্রোদয়ে হাসিল। ভবানন্দ হাস্যমুখ, বাঙ্ময়, প্রিয়সম্ভাষী হইলেন। কথাবার্তার জন্য বড় ব্যগ্র। ভবানন্দ কথোপকথনের অনেক উদ্যম করিলেন, কিন্তু মহেন্দ্র কথা কহিল না। তখন ভবানন্দ নিরুপায় হইয়া আপন মনে গীত আরম্ভ করিলেন,-

“বন্দে মাতরম্।
সুজলাং সুফলাং
মলয়জশীতলাম্
শস্যশ্যামলাং
মাতরম্।”1

মহেন্দ্র গীত শুনিয়া কিছু বিস্মিত হইল, কিছু বুঝিতে পারিল না – সুজলা সুফলা মলয়জশীতলা শস্যশ্যামলা মাতা কে,-জিজ্ঞাসা করিল, “মাতা কে?”
উত্তর না করিয়া ভবানন্দ গায়িতে লাগিলেন,-

“শুভ্র-জ্যোৎস্না-পুলকিত-যামিনীম্–
ফুল্ল-কুসুমিতদ্রুমদলশোভিনীম্
সুহাসিনীং সুমধুরভাষিণীম্
সুখদাং বরদাং মাতরম্।”

মহেন্দ্র বলিল, “এ ত দেশ, এ ত মা নয়–”

ভবানন্দ বলিলেন, “আমরা অন্য মা মানি না–জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরীয়সী। আমরা বলি, জন্মভূমিই জননী, আমাদের মা নাই, বাপ নাই, ভাই নাই, বন্ধু নাই,–স্ত্রী নাই, পুত্র নাই, ঘর নাই, বাড়ী নাই, আমাদের কাছে কেবল সেই সুজলা, সুফলা, মলয়জসমীরণশীতলা শস্যশ্যামলা,—”

তখন বুঝিয়া মহেন্দ্র বলিলেন, “তবে আবার গাও।”

ভবানন্দ আবার গায়িলেন,-

“বন্দে মাতরম্।
সুজলাং সুফলাং
মলয়জশীতলাং
শস্যশ্যামলাং
মাতরম্।
শুভ্র-জ্যোৎস্না-পুলকিত-যামিনীম্
ফুল্লকুসুমিত-দ্রুমদলশোভিনীম্,
সুহাসিনীং সুমধুরভাষিণীম্
সুখদাং বরদাং মাতরম্।।
সপ্তকোটীকণ্ঠকলকলনিনাদকরালে
দ্বিসপ্তকোটীভুজৈর্ধৃতখর-করবালে,
অবলা কেন মা এত বলে।
বহুবলধারিণীং
নমামি তারিণীং
রিপুদলবারিণীং
মাতরম্।
তুমি বিদ্যা তুমি ধর্ম
তুমি হৃদি তুমি মর্ম
ত্বং হি প্রাণা: শরীরে।
বাহুতে তুমি মা শক্তি
হৃদয়ে তুমি মা ভক্তি
তোমারই প্রতিমা গড়ি
মন্দিরে মন্দিরে।
ত্বং হি দুর্গা দশপ্রহরণধারিণী
কমলা কমল-দলবিহারিণী
বাণী বিদ্যাদায়িনী
নমামি ত্বাং
নমামি কমলাম্
অমলাং অতুলাম্
সুজলাং সুফলাম্
মাতরম্
বন্দে মাতরম্
শ্যামালাং সরলাং
সুস্মিতাং ভূষিতাম্
ধরনীং ভরণীম্
মাতরম্।”

মহেন্দ্র দেখিল, দস্যু গায়িতে গায়িতে কাঁদিতে লাগিল। মহেন্দ্র তখন সবিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করিল, “তোমরা কারা?” ভবানন্দ বলিল, “আমরা সন্তান |”
ম। সন্তান কি? কার সন্তান?
ভ। মায়ের সন্তান।
ম। ভাল – সন্তানে কি চুরি-ডাকাতি করিয়া মায়ের পূজা করে? সে কেমন মাতৃভক্তি?
ভ। আমরা চুরি-ডাকাতি করি না।
ম। এই ত গাড়ি লুঠিলে।
ভ। সে কি চুরি-ডাকাতি? কার টাকা লুঠিলাম?
ম। কেন? রাজার।
ভ। রাজার? এই যে টাকাগুলি সে লইবে, এ টাকায় তার কি অধিকার?
ম। রাজার রাজভাগ।
ভ। যে রাজা রাজ্য পালন করে না, সে আবার রাজা কি?
ম। তোমরা সিপাহীর তোপের মুখে কোন্ দিন উড়িয়া যাইবে দেখিতেছি।
ভ। অনেক শালা সিপাহী দেখিয়াছি – আজিও দেখিলাম।
ম। ভাল করে দেখনি, একদিন দেখিবে।
ভ। না হয় দেখ‍লাম, একবার বই ত আর দুবার মর‍‍ব না।
ম। তা ইচ্ছা করিয়া মরিয়া কাজ কি?
ভ। মহেন্দ্র সিংহ, তোমাকে মানুষের মত মানুষ বলিয়া আমার কিছু বোধ ছিল, কিন্তু এখন দেখিলাম, সবাই যা, তুমিও তা। কেবল দুধ ঘির যম। দেখ, সাপ মাটিতে বুক দিয়া হাঁটে, তাহা অপেক্ষা নীচ জীব আমি ত আর দেখিব না; সাপের ঘাড়ে পা দিলে সেও ফণা ধরিয়া উঠে। তোমার কি কিছুতেই ধৈর্য নষ্ট হয় না? দেখ, যত দেশ আছে, — মগধ, মিথিলা, কাশী, কাঞ্চী, দিল্লী, কাশ্মীর, কোন্ দেশের এমন দুর্দশা, কোন্ দেশে মানুষ খেতে না পেয়ে ঘাস খায়? কাঁটা খায়? উইমাটি খায়? বনের লতা খায়? কোন্ দেশে মানুষ শিয়াল-কুক্কুর খায়, মড়া খায়? কোন্ দেশের মানুষের সিন্দুকে টাকা রাখিয়া সোয়াস্তি নাই, সিংহাসনে শালগ্রাম রাখিয়া সোয়াস্তি নাই, ঘরে ঝি-বউ রাখিয়া সোয়াস্তি নাই, ঝি-বউয়ের পেটে ছেলে রেখে সোয়াস্তি নাই? পেট চিরে ছেলে বার করে। সকল দেশের রাজার সঙ্গে রক্ষণাবেক্ষণের সম্বন্ধ; আমাদের মুসলমান রাজা রক্ষা করে কই? ধর্ম গেল, জাতি গেল, মান গেল, কুল গেল, এখন ত প্রাণ পর্যন্তও যায়। এ নেশাখোর দেড়েদের না তাড়াইলে আর কি হিন্দুর হিন্দুয়ানী থাকে?
ম। তাড়াবে কেমন করে?
ভ। মেরে।
ম। তুমি একা তাড়াবে? এক চড়ে নাকি?
দস্যু গায়িল:-
“সপ্তকোটীকণ্ঠ-কলকল-নিনাদকরালে!
দ্বিসপ্তকোটীভুজৈর্ধৃতখরকরবালে
অবলা কেন মা এত বলে।”
মহে। কিন্তু দেখিতেছি তুমি একা।
ভ। কেন, এখনি ত দুশ লোক দেখিয়াছ।
ম। তাহারা কি সকলে সন্তান?
ভ। সকলেই সন্তান।
ম। আর কত আছে?
ভ। এমন হাজার হাজার, ক্রমে আরও হবে।
ম। না হয় দশ বিশ হাজার হল, তাতে কি মুসলমানকে রাজ্যচ্যুত করিতে পারিবে?
ভ। পলাশীতে ইংরেজের কজন ফৌজ ছিল?
ম। ইংরেজ আর বাঙালিতে?
ভ। নয় কিসে? গায়ের জোরে কত হয় – গায়ে জিয়াদা জোর থাকিলে গোলা কি জিয়াদা ছোটে?
ম। তবে ইংরেজ মুসলমানে এত তফাৎ কেন?
ভ। ধর, এক ইংরেজ প্রাণ গেলেও পলায় না, মুসলমান গা ঘামিলে পলায় – শরবৎ খুঁজিয়া বেড়ায় – ধর, তার পর, ইংরেজদের জিদ আছে–যা ধরে, তা করে, মুসলমানের এলাকাড়ি। টাকার জন্য প্রাণ দেওয়া, তাও সিপাহীরা মাহিয়ানা পায় না। তার পর শেষ কথা সাহস – কামানের গোলা এক জায়গায় বই দশ জায়গায় পড়বে না – সুতরাং একটা গোলা দেখে দুই শ জন পলাইবার দরকার নাই। কিন্তু একটা গোলা দেখিলে মুসলমানের গোষ্ঠীশুদ্ধ পলায় – আর গোষ্ঠীশুদ্ধ গোলা দেখিলে ত একটা ইংরেজ পলায় না।
ম। তোমাদের এসব গুণ আছে?
ভ। না। কিন্তু গুণ গাছ থেকে পড়ে না। অভ্যাস করিতে হয়।
ম। তোমরা কি অভ্যাস কর?
ভ। দেখিতেছ না আমরা সন্ন্যাসী? আমাদের সন্ন্যাস এই অভ্যাসের জন্য। কার্য উদ্ধার হইলে – অভ্যাস সম্পূর্ণ হইলে – আমরা আবার গৃহী হইব। আমাদেরও স্ত্রী কন্যা আছে।
ম। তোমরা সে সকল ত্যাগ করিয়াছ – মায়া কাটাইতে পারিয়াছ?
ভ। সন্তানকে মিথ্যা কথা কহিতে নাই – তোমার কাছে মিথ্যা বড়াই করিব না। মায়া কাটাইতে পারে কে? যে বলে, আমি মায়া কাটাইয়াছি, হয় তার মায়া কখন ছিল না বা সে মিছা বড়াই করে। আমরা মায়া কাটাই না – আমরা ব্রত রক্ষা করি। তুমি সন্তান হইবে?
ম। আমার স্ত্রী-কন্যার সংবাদ না পাইলে আমি কিছু বলিতে পারি না।
ভ। চল, তবে তোমার স্ত্রীকন্যাকে দেখিবে চল।
এই বলিয়া দুই জনে চলিল; ভবানন্দ আবার “বন্দে মাতরম্” গায়িতে লাগিল। মহেন্দ্রের গলা ভাল ছিল, সঙ্গীতে একটু বিদ্যা ও অনুরাগ ছিল – সুতরাং সঙ্গে গায়িল – দেখিল যে, গায়িতে গায়িতে চক্ষে জল আইসে। তখন মহেন্দ্র বলিল, “যদি স্ত্রী-কন্যা ত্যাগ না করিতে হয়, তবে এ ব্রত আমাকে গ্রহণ করাও”।
ভ। এ ব্রত যে গ্রহণ করে, সে স্ত্রী-কন্যা পরিত্যাগ করে। তুমি যদি এ ব্রত গ্রহণ কর, তবে স্ত্রী-কন্যার সঙ্গে সাক্ষাৎ করা হইবে না। তাহাদিগের রক্ষা হেতু উপযুক্ত বন্দোবস্ত করা যাইবে, কিন্তু ব্রতের সফলতা পর্যন্ত তাহাদিগের মুখদর্শন নিষেধ।
ম। আমি এ ব্রত গ্রহণ করিব না।

Leave a Reply