“গুড়ুম্ গুড়ুম্ গুম্।” ইংরেজের কামান ডাকিল। সেই শব্দ বিশাল কানন কম্পিত করিয়া প্রতিধ্বনিত হইল, “গুড়ুম্ গুড়ুম গুম্।” নদীর বাঁকে বাঁকে ফিরিয়া সেই ধ্বনি দূরস্থ আকাশপ্রান্ত হইতে প্রতিক্ষিপ্ত হইল, “গুড়ুম্ গুড়ুম্ গুম্।” নদীপারে দূরস্থ কাননান্তরের মধ্যে প্রবেশ করিয়া সেই ধ্বনি আবার ডাকিতে লাগিল, “গুড়ুম্ গুড়ুম্ গুম্!” সত্যানন্দ আদেশ করিলেন, “তোমরা দেখ, কিসের তোপ।” কয়েক জন সন্তান তৎক্ষণাৎ অশ্বারোহণ করিয়া দেখিতে ছুটিল, কিন্তু তাহারা কানন হইতে বাহির হইয়া কিছু দূর গেলেই শ্রাবণের ধারার ন্যায় গোলা তাহাদের উপর বৃষ্টি হইল, তাহারা অশ্বসহিত আহত হইয়া সকলেই প্রাণত্যাগ করিল। দূর হইতে সত্যানন্দ তাহা দেখিলেন। বলিলেন, “উচ্চ বৃক্ষে উঠ, দেখ কি।” তিনি বলিবার অগ্রেই জীবানন্দ বৃক্ষে আরোহণ করিয়া প্রভাতকিরণে দেখিতেছিলেন, তিনি বৃক্ষের উপরিস্থ শাখা হইতে ডাকিয়া বলিলেন, “তোপ ইংরেজের।” সত্যানন্দ জিজ্ঞাসা করিলেন, “অশ্বারোহী, না পদাতি?”
জী। দুই আছে।
স। কত?
জী। আন্দাজ করিতে পারিতেছি না, এখনও বনের আড়াল হইতে বাহির হইতেছে।
স। গোরা আছে? না কেবল সিপাহী?
জী। গোরা আছে।
তখন সত্যানন্দ জীবানন্দকে বলিলেন, “তুমি গাছ হইতে নাম।”
জীবানন্দ গাছ হইতে নামিলেন।
সত্যানন্দ বলিলেন, “দশ হাজার সন্তান উপস্থিত আছে ; কি করিতে পার দেখ। তুমি আজ সেনাপতি।” জীবানন্দ সশস্ত্রে সজ্জিত হইয়া উল্লম্ফনে অশ্বে আরোহণ করিলেন। একবার নবীনানন্দ গোস্বামীর প্রতি দৃষ্টি করিয়া নয়নেঙ্গিতে কি বলিলেন, কেহ তাহা বুঝিতে পারিল না। নবীনানন্দ নয়নেঙ্গিতে কি উত্তর করিল, তাহাও কেহ বুঝিল না, কেবল তাহা দুই জনেই মনে মনে বুঝিল যে, হয়ত এ জন্মের মত এই বিদায়। তখন নবীনানন্দ দক্ষিণ বাহু উত্তোলন করিয়া সকলকে বলিলেন, “ভাই! এই সময় গাও “জয় জগদীশ হরে’!” তখন সেই দশ সহস্র সন্তান এককণ্ঠে নদী কানন আকাশ প্রতিধ্বনিত করিয়া, তোপের শব্দ ডুবাইয়া দিয়া, সহস্র সহস্র বাহু উত্তোলন করিয়া গায়িল,-
“জয় জগদীশ হরে
ম্লেচ্ছনিবহনিধনে কলয়সি করবালম্।”
এমন সময়ে সেই ইংরেজের গোলাবৃষ্টি আসিয়া কাননমধ্যে সন্তানসম্প্রদায়ের উপর পড়িতে লাগিল। কেহ গায়িতে গায়িতে ছিন্নমস্তক ছিন্নবাহু ছিন্নহৃদপিণ্ড হইয়া মাটিতে পড়িল, তথাপি কেহ গীত বন্ধ করিল না, সকলে গায়িতে লাগিল, “জয় জগদীশ হরে!” গীত সমাপ্ত হইলে সকলেই একেবারে নিস্তব্ধ হইল। সেই নিবিড় কানন, সেই নদীসৈকত, সেই অনন্ত বিজন একেবারে গম্ভীর নীরবে নিবিষ্ট হইল ; কেবল সেই অতি ভয়ানক কামানের ধ্বনি আর দূরশ্রুত গোরার সমবেত অস্ত্রের ঝঞ্ঝনা ও পদধ্বনি।
তখন সত্যানন্দ সেই গভীর নিস্তব্ধতামধ্যে অতি উচ্চৈ:স্বরে বলিলেন, “জগদীশ হরি তোমাদিগকে কৃপা করিবেন – তোপ কত দূর?”
উপর হইতে এক জন বলিল, “এই কাননের অতি নিকট, একখানা ছোট মাঠ পার মাত্র!”
সত্যানন্দ বলিলেন, “কে তুমি?”
উপর হইতে উত্তর হইল, “আমি নবীনানন্দ।”
তখন সত্যানন্দ বলিলেন, “তোমরা দশ সহস্র সন্তান, আজ তোমাদেরই জয় হইবে, তোপ কাড়িয়া লও”। তখন অগ্রবর্তী অশ্বারোহী জীবানন্দ বলিলেন, “আইস।”
সেই দশ সহস্র সন্তান – অশ্ব ও পদাতি, অতিবেগে জীবানন্দের অনুবর্তী হইল। পদাতির স্কন্ধে বন্দুক, কটীতে তরবারি, হস্তে বল্লম। কানন হইতে নিষ্ক্রান্ত হইবামাত্র, সেই অজস্র গোলাবৃষ্টি পড়িয়া তাহাদিগকে ছিন্ন ভিন্ন করিতে লাগিল। বহুতর সন্তান বিনা যুদ্ধে প্রাণত্যাগ করিয়া ভূমিশায়ী হইল। একজন জীবানন্দকে বলিল, “জীবানন্দ, অনর্থক প্রাণিহত্যায় কাজ কি?”
জীবানন্দ ফিরিয়া চাহিয়া দেখিলেন ভবানন্দ – জীবানন্দ উত্তর করিলেন, “কি করিতে বল |”
ভ। বনের ভিতর থাকিয়া বৃক্ষের আশ্রয় হইতে আপনাদিগের প্রাণরক্ষা করি – তোপের মুখে, পরিষ্কার মাঠে, বিনা তোপে এ সন্তানসৈন্য এক দণ্ড টিকিবে না ; কিন্তু ঝোপের ভিতর থাকিয়া অনেক্ষণ যুদ্ধ করা যাইতে পারিবে।
জী। তুমি সত্য কথা বলিয়াছ, কিন্তু প্রভু আজ্ঞা করিয়াছেন, তোপ কাড়িয়া লইতে হইবে, অতএব আমরা তোপ কাড়িয়া লইতে যাইব।
ভ। কার সাধ্য তোপ কাড়ে? কিন্তু যদি যেতেই হবে, তুমি নিরস্ত হও, আমি যাইতেছি।
জী। তা হবে না – ভবানন্দ! আজ আমার মরিবার দিন।
ভ। আজ আমার মরিবার দিন।
জী। আমার প্রায়শ্চিত্ত করিতে হইবে।
ভ। তুমি নিষ্পাপশরীর – তোমার প্রায়শ্চিত্ত নাই। আমার চিত্ত কলুষিত – আমাকেই মরিতে হইবে – তুমি থাক, আমি যাই।
জী। ভবানন্দ! তোমার কি পাপ, তাহা আমি জানি না। কিন্তু তুমি থাকিলে সন্তানের কার্যোদ্ধার হইবে। আমি যাই।
ভবানন্দ নীরব হইয়া শেষে বলিলেন, “মরিবার প্রয়োজন হয় আজই মরিব, যে দিন মরিবার প্রয়োজন হইবে, সেই দিন মরিব, মৃত্যুর পক্ষে আবার কালাকাল কি?”
জী। তবে এস।
এই কথার পর ভবানন্দ সকলের অগ্রবর্তী হইলেন। তখন দলে দলে, ঝাঁকে ঝাঁকে গোলা পড়িয়া সন্তানসৈন্য খণ্ড বিখণ্ড করিতেছে, ছিঁড়িয়া চিরিতেছে, উল্টাইয়া ফেলিয়া দিতেছে, তাহার উপর শত্রুর বন্দুকওয়ালা সিপাহী সৈন্য অব্যর্থ লক্ষ্যে সারি সারি সন্তানদলকে ভূমে পাড়িয়া ফেলিতেছে। এমন সময়ে ভবানন্দ বলিলেন, “এই তরঙ্গে আজ সন্তানকে ঝাঁপ দিতে হইবে – কে পার ভাই? এই সময় গাও “বন্দে মাতরম্!” তখন উচ্চ নিনাদে মেঘমল্লার রাগে সেই সহস্রকণ্ঠ সন্তানসেনা তোপের তালে গায়িল, “বন্দে মাতরম্।”

Leave a Reply