☼ মলয় রায় চৌধুরী ☼
ঔরস
স্মৃতির জার : নয়
দিয়ারার আসেপাশের জলে মাছ ধরতে হলে, নৌকো বাইতে হলে, সুশান্তকে, মানে জামাইবাবার নামে তাঁর শশুরকে, রংদারি ট্যাক্স দিতে হয়। এই মহার্ঘ বালিয়াড়িতে সরকার বলতে বোঝায় তারিণী মণ্ডলের জামাই, যাকে গ্রামের লোক আর প্রশাসনের লোকেরা যে-যার আতঙ্কের মাধ্যমে চেনে-জানে। অঞ্চলের অন্য গুণ্ডারা, যেমন দীনা যাদব, দমদমি যাদব, রাসবিহারি মণ্ডল, দারা মিয়াঁ, সৎইয়া মণ্ডল প্রতিমাসে জামাইখোরাকি দিয়ে যায় ওনার শশুর বা শাশুড়িকে। ওনার দলের সবায়ের কাছে কাট্টা,তমঞ্চা, একনল্লা, দুনল্লা আছে, কয়েকজনের কাছে একে-সানতালিস আর একে-ছপ্পন।
যে দিয়ারাগুলোর পলি প্রায় পাকা জমির চেহারা নিয়েছে, সেখানে সরকারি স্কুল আছে বটে কিন্তু বর্ষায় তারা ডুববে না ভাসবে তা কেউ আগাম বলতে পারে না বলে সারা বছর ক্লাস হয় না। ছেলে অপুকে তাই ভাগলপুর শহরে রেখে সেইন্ট জোসেফ কনভেন্টে ভর্তি করে দিয়েছিলেন জামাইবাবা। তারিণী মণ্ডলও চেয়েছিলেন নাতি আজকালকার খ্যাতনামা অপরাধীদের মতন স্যুটটাই পরে দেশে-বিদেশে নাম করুক। স্কুলে যে চারটে গ্রুপ ছিল লাল, হলুদ, সবুজ আর নীল, তাতে লাল গ্রুপে ছিল অপু, বাদশাহি লাল। ওর, অপুর, নামটা তারিণী মণ্ডলের দেয়া, আদর করে, আপ্রাধি ঘোষ, তারিণীর মতে জগতসংসারে অপরাধীর চেয়ে বড়ো আর কেউ হতে পারে না, তা মহারাজ বাল্মিকীর জীবন থেকে জানা যায়। এককালের ডাকাত সর্দার, পরে রামায়ণের লেখক, তাঁর নাম যদি উইয়ের ঢিবি হতে পারে তাহলে তারিণী মণ্ডলের একমাত্র নাতির নাম কেন রামায়ণ রচয়িতার অনুকরণে হবে না। তাই আপ্রাধি; সুশান্ত নিজের মতো করে তাকে বাঙালিয়ানা দিয়ে অপু করলেও, কেউই ওকে অপু বলে ডাকে না, এমনকি সুশান্তর বিড়িসেবিকা মেঠোগন্ধা নিরক্ষর ডাগরচোখ শ্যামলিমা বউও নয়। বেবি ডাকে আপ্পু বলে।
ওর ডাকনাম হয়ে গেছে আপ্পু। আড়ালে, আপ্পু দোগলা। স্কুলেতে সহপাঠীরা ‘আবে আপ্পু’ ডাকটাকে ‘এবি আপ্পু’তে, মানে ‘এ বাস্টার্ড আপ্পুতে’, পালটে তাতাতে চেষ্টা করলে, অপুর সরাসরি উত্তর, হ্যাঁ, তো কি হয়েছে?
অশ্বমেধ হোষ নামে ডাকে না কেউ, টিচাররাও বলেন আপ্পু।
বুক চিতিয়ে অপু জানায়, আমি বাঙালি, বুঝলি বাঙালি।
—বাংগালি? সে তো আরও কমজোর, দল বেঁধে চেঁচায়। দুজন এক সঙ্গে না হলে লড়তে ভয় পায়। আর কায়স্থ মানে তো মুনশিগিরি, যমরাজের কেরানি চিত্রগুপ্ত জাতে কায়স্থ। দেখিস না কায়স্থগুলো চিত্রগুপ্ত পুজো করে।
—বাড়ি গিয়ে পুরাণ-শাস্ত্র পড়গে যা। চিত্রগুপ্ত হল বিহারি কেরানি, আর যমরাজ হল বাঙালি।
—আচ্ছা?
—হ্যাঁ। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বোসের নাম শুনিসনি তোরা। ইংরেজদের এমন বাঁশ দিয়েছিল যে সে বাঁশ কাংরেসিরা ধামাচাপা দিয়ে পুঁতে রেখেছে। একদিন ওই বাঁশের চারা বেরোবে চারপাশ থেকে, তখন দেখিস কী হয়।
সুভাষচন্দ্র বসুর নামটা তারিণী মণ্ডল মুখস্থ করে রেখেছেন। নাতিকে যখনই উৎসাহিত করার দরকার হয়, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বোসের গল্প আরম্ভ করেন, সবই গাঁজাখুরি, কেননা উনি কেবল নামটুকুই জানেন আর ফোটো দেখেছেন। বলেন, আরে ওনার ফোটুর দিকে দ্যাখ, লম্বা-চওড়া গাবরু জওয়ান, প্যান্ট-শার্ট পরে স্যালুট নিচ্ছে। আর আজকালকার নেতাদের দিকে তাকিয়ে দ্যাখ, ভয়ে সবায়ের ল্যাজ পোঁদে এমন ঢুকে থাকে যে দশটা বন্দুকধারি নিয়ে ঘুরে বেড়ায়; আমি তো শুধু দুটো পহলওয়ানকে রেখেছি, আমার ওপর রামধারি ধানুক একবার হামলা চালিয়েছিল বলে, রামধারীর জন্যই আমার বাঁচোখটা নষ্ট হয়ে গেল।
—জানি দাদু, রামধারিকে তুমি লোক পাঠিয়ে কলকাতায় মারিয়েছিলে; দুই রাজ্যের ঝগড়ায় সে ব্যাটার লাশ পনেরোদিন কলকাতার মর্গে পড়ে পচে পোকা ধরে গিয়েছিল।
—আরে, এই দিয়ারার জমিজমা সবই গংগোতা আর মাল্লাহদের ছিল।
—জানি, বাবা সেকথা বলেছিল তোমায়। এচ এচ রিজালে নামে একজন সায়েব ১৮৯১ সালে লোকগণনা করে লিখে গেছে সেসব। কিন্তু উঁচু জাতের আফসাররা টাকা খেয়ে ভূমিহার, রাজপুত, যাদব, কোয়েরি, কুর্মিদের হাতে দিয়ারার জমি তুলে দিত। গংগোতারা ফেরত নেবার চেষ্টা করতে গেলে তাদের চোখে ছুঁচ ফুটিয়ে অ্যাসিড ঢেলে দেয়া হয়েছিল, ক্রিমিনাল দেগে দেয়া হয়েছিল।
—ক্রিমিনাল খারাপ হতে যাবে কেন? রামায়ণ লিখেছিলেন মহারাজ বাল্মিকী, উনি কি ক্রিমিনাল ছিলেন? উনি ছিলেন মহাআপ্রাধি। তুই বড়ো হয়ে মহাআপ্রাধি হয়ে দেখা দিকিনি।
গঙ্গার তো মতিগতির ঠিকঠিকানা নেই; এই বর্ষায় এক দিয়ারা ডোবায় তো আরেক বর্ষায় আরেক। যে খেতি করে তার জমি ডুবলে যে নতুন জমি ভেসে উঠল সেটা তার পাওনা, কিন্তু ইংরেজরা যাবার পর উঁচু জাতের লোকেরা নতুন ভেসে-ওঠা দিয়ারা নিজেদের নামে লিখিয়ে নিত। কী আর করা যাবে, বল। তাই আমরা হাথিয়ার তুলে নিতে বাধ্য হয়েছি। বন্দুক যার, জল-জমিন তার। কৈলাশ মণ্ডল নামে একজন গংগোতা নকসল্লি কামকাজ করে চেষ্টা করেছিল সব ঘোটালা বন্ধ করতে, সেই ১৯৬৭ সালে; কিন্তু সেও তো কোথায় গায়েব হয়ে গেল।
—গায়েব হয়নি, আমাদের ইউনিভারসিটির একজন টিচার বলেছে যে তাকে গায়েব করে দেয়া হয়েছিল। তখন নকসল্লি ধরে-ধরে গায়েব করার সরকারি কারিয়াকরম চলছিল।
—আরে সব বেকার। লুকিয়ে-লুকিয়ে যদি কিছু করতেই হয় তো সুভাষচন্দ্র বোসের মতন করো। আংরেজরা অব্দি পালিয়ে গেল ভয়ে। কথা কটা বলে উরুতে কুস্তিগিরের চাপড় দাদুর।
—দাদু, আমাদের মতন ছিল না সুভাষচন্দ্র বোস। ওর জন্যে জান দেবার অনেক সঙ্গীসাথী ছিল। আমরা তো নিজেরাই লড়ে মরি।
বাবা সুশান্ত ঘোষ মনে করেন ওনার কোনো প্রত্যক্ষ অবদান নেই অপুর চরিত্র গঠনে। পরোক্ষ অবদান আছে। অপু নিজেও তাই মনে করে। বাবা বাংলা বলতে আর ভাগলপুর শহর থেকে বই এনে বাংলা পড়তে শিখিয়েছেন, সাধারণ জ্ঞানের বই কিনে দিতেন ছোটোবেলা থেকে। বাংলা শেখানোর সময়েই চটে যেতেন বাবা, কান মুলে দিতেন, চড় মারতেন। বাংলা শেখার দরুণ আলটপকা কথা বলে বিব্রত হতে হয়েছে অনেক সময়ে। জে এন ইউয়ের বন্ধুরা তো আর জানে না যে ওর মা দিয়ারার গংগোতা বিহারিন। পদবি দেখে অনুমান করে নেয় যে এ. ঘোষ মানে শহুরে বাঙালি।
সনাতন সরকার নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষকের সঙ্গে প্রায় ঝগড়া আরম্ভ হয়ে গিয়েছিল অপুর। গায়ের রং বেশ ময়লা, কোঁকড়া উস্কো-খুস্কো চুল, রোগা, সাড়ে পাঁচ ফিটের, কালো ফ্রেমের চশমা-চোখ সনাতন দিল্লিতেও ধুতি-পাঞ্জাবি পরা বজায় রেখেছে, পায়ে কোলহাপুরি, বাংলা কথায় ওড়িয়া টান। বিড়ি ফোঁকে। প্রথম পরিচয়ের পর প্রায়ই সনাতনের সঙ্গে আড্ডা মারে অপু।
—হাই সনাতন, আপনিও কি সোকলড প্রবাসী? প্রথমবার পরিচয় করার জন্য শুরু করেছিল অপু।
—পশ্চিমবাংলার বর্ণহিন্দু হাফগাণ্ডুরা আমাদের অমনভাবে গালাগাল দেয়, ইসকি মাকা সালে……; তুইও কেন সেকথা পাড়ছিস। তুই তো ভাগলপুরি খোটুয়া বলে জানি। কথায় বিড়ির ধোঁয়া মিশিয়ে বলল সনাতন সরকার।
—না, পুজোপাণ্ডালে, দিল্লি হাটে বা কোনো ফাংশানে দিল্লির বাঙালিদের সঙ্গে আলাপ হলে, যখন ওনারা জানতে পারেন যে আমি ভাগলপুরের তখন অমন প্রশ্ন তোলেন। আপনি তো উড়িষ্যা থেকে?
—না, টু বি স্পেসিফিক, আমি দণ্ডকারণ্য থেকে। শুনেছিস কি দণ্ডকারণ্য?
—বাবার কাছে গল্প শুনেছিলুম, রামায়ণ না মহাভারতের গল্প ঠিক জানি না, নর্মদা আর গোদাবরী নদীর তীরে দণ্ডক রাজার রাজ্য ছিল। কোনো ঋষির অভিশাপে জঙ্গলে পরিণত হয়েছিল।
—আবে সালে হাফউইট, আমি সেই আদ্যিকালের গাঁজাখুরি এরিয়ান গল্পের কথা বলছি না।
—দেন হোয়াট?
—দণ্ডকারন্য জায়গাটা হল ভারতের কয়েকটা রাজ্যের আদিবাসী অধ্যুষিত নয়টা জেলা, মাটির তলায় প্রচুর মিনারালস আছে; গড়চিরোলি, ভাণ্ডারা, বালাঘাট, রাজনন্দগাঁও, কাউকের, বস্তার, নারায়ণপুর, দাঁতেওয়াড়া আর মালকানগিরি। আমি মালকানগিরি প্রডাক্ট, সুভাষপল্লিতে থাকতাম, এখনও আছে সুভাষপল্লী, জঙ্গল পরিষ্কার করে আমরাই বসত গড়েছিলাম, আর এখন চুতিয়াগুলো আমাদেরই ঘরছাড়া করে দিতে চাইছে, ইসকি মাকা…। কিন্তু এখন চলে গেছি ছত্তিসগড়ের নারাণপুরে।
—মালকানগিরি? অমন অড, গড ফরসেকন জায়গায়?
—দেশভাগের পর কী হয়েছিল জানিস না, চামগাদড় কঁহিকা?
—হ্যাঁ, জানি-জানি, বাস্তুহারাদের দণ্ডকারণ্যে সেটল করানো হয়েছিল।
—কোন ভোঁসড়িকে-জনা তোকে বুঝিয়েছে, ইসকি মাকা…? কিছুই জানিস না তুই। আমাদের, নমঃশূদ্র বাঙালিদের, আনসেটল করা হয়েছিল, ডেসট্রয় করা হয়েছিল, ইসকি মাকা….। বাঙালির প্রত্নতাত্ত্বিক রুইনস যদি দেখতে চাস তো ঘুরে আয় একবার, ইসকি মাকা…। স্বাধীনতার লাৎ খেয়ে আমরা সেই সব মানুষ হয়ে গড়ে উঠেছি যাদের অতীত লোপাট, বর্তমান গায়েব আর ভবিষ্যৎ নেই। আইডেনটিটিলেস। আমাদের ইতিহাস প্রতিদিন রিপিট হয়, কেননা আমরা ইতিহাসহীন, বিমূর্ত। বিমূর্ত বুঝিস? অ্যাবসট্র্যাক্ট!
…চুপ করে যায় অপু। টের পায় যে সারেনি এমন আঘাতের রক্তপূঁজের খোসা ছাড়িয়ে ফেলেছে।
—আমরা ১৯৪৭-এ, ১৯৬৪-৬৫-তে, ১৯৭১-এ, ১৯৭৫-এ মার খেয়েছি, যখনই ওপার বাঙালির কসাইদের প্রবৃত্তি সালভাদর দালির পেইনটিঙের মতন হয়, তখনই ওরা আমাদের পোঁদে জ্বলন্ত জিরাফ ঢোকায়। অপর জানিস তো, দি আদার, পড়ছিস বোধহয়, তোদের কোর্সে আছে তো, দি আদার, ইসকি মাকা…। সম্প্রতি নাস্তিক আর আস্তিকদের খুনিখুনি হল ঢাকায়-চট্টগ্রামে, তাতেও ঘরছাড়া করা হল আমাদের, আমাদের ইয়ানেকি নিম্নবর্ণের লোকেদের। ওদেশের রাজনীতির বনেদ হয়ে গেছে খেদাও, খেদাও, খেদাও, মেইনলি রিমেইনিং নিম্নবর্ণদের খেদাও।
…চুপ করেই থাকে অপু।
—মরিচঝাঁপি শুনেছিস, মরিচঝাঁপি?
—হ্যাঁ, জানি ঘটনাটা, বাবা বলেছিলেন, দণ্ডকারণ্য থেকে কয়েক হাজার পরিবার গিয়েছিল সুন্দরবনের ওই দ্বীপে বসতি গড়তে।
—ওই দ্বীপেই, ১৯৭৯ এর ৩১ জানুয়ারি আমার বাবা-মাকে খুন করেছিল ইসকি…। মরিচঝাঁপি দ্বীপটাকে চারিদিক থেকে তিরিশটা পুলিশ-লঞ্চ ঘিরে রেখেছিল যাতে খাবার আর পানীয় জল না পোঁছোয়; তারপর যুদ্ধক্ষেত্রের ঢঙে ব্রাশফায়ার করেছিল, ইসকি…। দণ্ডকারণ্যের অনেকের বাড়িতে ৩১ জানুয়ারির দিনটা তাদের কোনো-না-কোনো আত্মীয়ের মৃত্যু দিন হিসাবে পালিত হয়। আমাদের বাড়িতে পালিত হয় আমার বাবা-মায়ের মৃত্যুদিন হিসাবে। যারা বেঁচে ফিরতে পেরেছিল তাদের কেউ-কেউ কলকাতার বারাসাতের কাছে মরিচঝাঁপি কলোনি গড়ে থেকে গেল, কেউ-কেউ থেকে গেল ক্যানিঙের হিঙ্গলগঞ্জে কলোনি গড়ে, কেউ রেললাইনের ধারে, কেউ খালপাড়ে। আমাকে মরিচঝাঁপি থেকে দণ্ডকারণ্যে নিয়ে এসেছিলেন আমার পিসেমশায়, নিজের পিসেমশায় নন, তবু আপন। নয় বছর বয়সে ক্লাস ওয়ানে ভর্তি হয়েছিলাম, ইসকি…। তোরা হয়তো ভাবিস তোদের চেয়ে আমার বয়স এত বেশি, ইউনিয়ানবাজি করার জন্য গাণ্ডুগর্দি চালিয়ে ইউনিভার্সিটিতে টাইম পাস করছি, হয়তো মনে করিস পি এইচ ডি করতে এত বছর লাগছে কেন, ইসকি…।
…আবার চুপ করে যায় অপু।
—আমাকে আবার দণ্ডকারণ্যে এনে লালন-পালন বলতে যা বোঝায় তা করেছেন, স্কুল-কলেজে পড়িয়েছেন, এখনও পড়ার খরচ যোগাচ্ছেন, আমার পিসতুতো বোন যাকে ১৯৭১ সালে রেপ করেছিল পাকিস্তানি রাজাকারগুলো, ইসকি…। সেও আমার নিজের পিসতুতো বোন নয়, কিন্তু আপন। ও দণ্ডকারণ্য থেকে মরিচঝাঁপি যায়নি। ওর বর, আমার অভিভাবক জামাইবাবু গণেশচন্দ্র সরকার যেতে চাননি; উনি তখনই বলেছিলেন ওই টেঁটিয়া গিরগিটিমার্কা বর্ণহিন্দু বাঙালিগুলোকে বিশ্বাস করা যায় না, ইসকি…। আন্দামানে যাবার জেটিতে গিয়ে ওদের ছাতুবাবুরা কালাপানি-দ্বীপান্তরের আতঙ্ক ছড়িয়ে ভাষণবাজি করে হাজার-হাজার মানুষের আন্দামানে যাওয়া ভণ্ডুল করে দিয়েছিল। নেহেরু আমাদের ঠুঁসে দিল আদিবাসীদের জংলি এলাকাগুলোয়, আর বর্ণহিন্দু বাঙালিরা পেলো চিত্তরঞ্জন পার্ক, তুই তো এসব সাপসিঁড়ির পলিটিক্স জানিস না। বাড়ি থেকে কাঁচা টাকা আনিস, আর নাইটক্লাব-ডিসকোবাজি করে বেড়াস।
…অপু চুপ করে রইল। বুঝতে পারছিল যে সনাতন সরকার সম্ভবত মন খুলে ঝাল ঝাড়ার অবসর তৈরি করে ফেলতে পেরেছে ওর প্রশ্নগুলোর চোট খেয়ে। অপু আরও ভয়ঙ্কর হিন্দি গালাগাল জানে, ব্যবহার করে না কখনও, ছোটোবেলা থেকে বাবার চড়-খাওয়া নির্দেশ।
—ওই নেতাগুলোর বেশ কয়েকজন বেঙ্গলের ডিভিজান করে পাকিস্তান সৃষ্টি সমর্থন করেছিল। যেই পাকিস্তান হল অমনি বর্ণহিন্দু লোকগুলো আগেভাগে পালিয়ে এলো; এসে, এ আজাদি ঝুটা হ্যায় জিগির তুলে ট্রাম-বাস পোড়াতে ব্যস্ত হয়ে গেল। আর আমরা? আমরা তো নমঃশূদ্র, নিম্নবর্ণ, আনটাচেবল, ইসকি…। বর্ণহিন্দু পরিবারগুলো পশ্চিমবাংলায় বাড়িঘর তৈরি করে থেকে গেল, পার্টিগুলোকে দখল করে নিল। নিম্নবর্ণের জন্যে দণ্ডকারণ্য, হিমালয়ের তরাই, আন্দামান, ইসকি…। বর্ণহিন্দু ভাড়ুয়াগুলোই আমাদের আন্দামানে যেতে দেয়নি। এখন আন্দামানে গিয়ে দ্যাখ, সাউথ ইনডিয়ান আর পাঞ্জাবিরা গুছিয়ে নিয়েছে। বাংলা তো পড়তে পারিস। তোর ডিপার্টমেন্টের লাইব্রেরিতে মনোরঞ্জন ব্যাপারির লেখা চণ্ডালের চোখে চণ্ডাল বইটা আছে, পড়িস। জঁ জেনে সম্পর্কে জাঁ পল সার্ত্রে বিস্তারিত আলোচনা করে সেইন্ট জেনে নামে একটা বই-ই লিখে ফেলেছেন। কোনো বাঙালি কি মনোরঞ্জন ব্যাপারিকে নিয়ে বই লিখেছে? শালা বর্ণহিন্দু চুতিয়া ইনটেলেকচুয়ালদের দল, ইসকি…।
ক্যান্টিনের অন্য টেবল থেকে একজন সহপাঠির মন্তব্য শোনা গেল, আবে সানি, হিন্দি মেঁ গালি কিঁউ? তু বংলা গালি নহিঁ জানতা হ্যায় ক্যা? সুনা, সুনা, দো-চার, ইয়াদ করকে রখুঁ।
সনাতন জবাব দিল, যাদের দিচ্ছি তাদের জন্য এই গালাগালগুলোই উপযুক্ত মনে হল। বাংলা গালাগাল কয়েকটা জানি, কিন্তু সেগুলোয় তেমন তেজ নেই। মালকানগিরিতে বাংলা বলার চল শেষ হয়ে গেছে, ইসকি…। উড়িষ্যা সরকার বাংলা শেখানো তুলে দিয়ে ওড়িয়া শেখাচ্ছে। মহারাষ্ট্রের চন্দ্রপুর আর গড়চিরোলি জঙ্গলের উদ্বাস্তু গ্রামে বাঙালিরা আছে, তাদের বাচ্চাদের স্কুলে মারাঠি শিখতে বাধ্য করা হয়েছে, সাতচল্লিশটা স্কুলে, বুঝলি, আমরাই এসট্যাবলিশ করেছিলাম ওগুলো। চন্দ্রপুর আর গড়চিরোলিতে বাংলা বলার মতন বাঙালি আর পাবি না, দশ-পনেরো বছর পর, ইসকি…। কোথাও কোথাও ইলেকট্রিসিট পৌঁছেচে বটে, কিন্তু চাষের জল, সেচের ব্যবস্থা নেই, সরকারি চিকিৎসাকেন্দ্র নেই। গালাগাল দেবো না তো কী দেবো, ভ্যালেন্টাইনের খামে পুরে আমাশার মিক্সড ফ্রুট জ্যাম?
অপু বলল, আরে আপনি ওদের ছাড়ুন, শালারা সারাদিন লন্দিফন্দি করে আর চকরলস কাটে; ছোলে-ভাটুরে খাতে, অওর লিডারকে দুম চাটতে।
—এখন দণ্ডকারণ্যে পোলাভরম ড্যাম তৈরি হবে নয় হাজার কোটি টাকা খরচ করে, চুতিয়া শালা ইসকি…। উপজাতি আর উদ্বাস্তু অধ্যুষিত দুশো ছিয়াত্তরটা গ্রামের দু লাখ মানুষ ভেসে যাবে, উৎখাত করা হবে তাদের, দাঁতেওয়াডায় সাবরি নদীর ধারে চাষের সব জমি ভেসে যাবে, ইসকি…। কারোর দুশ্চিন্তা নেই, তার কারণ যারা ভেসে যাবে তারা হয় শিডুল্ড ট্রাইব বা বাঙালি শিডুল্ড কাস্ট। এই যে সেনসাস হল, তাতে আমরা যে শিডুলড কাস্ট তা চাপা দিয়ে দেখানো হল আমরা বাঙালি, ইসকি…। কেন? যাতে আমরা শিডুলড কাস্টের সুবিধাগুলো না পাই। ভোঁসড়িকে, পোলাভরমের জল যাবে ভিশাখাপটনমের কারখানাগুলোয়, স্টিল প্ল্যান্টে, হাইড্রোপাওয়ারে,শহরে। ক্যান ইউ ইম্যাজিন? লক্ষ-লক্ষ মানুষ পানীয় জল পাবে না, ইসকি…। আর কলকাতায় গিয়ে দ্যাখ; বর্ণহিন্দু লৌণ্ডাগুলো আমরা বাঙালি আমরা বাঙালি করে ধুতি খুলে লুঙ্গি ড্যান্স নেচে চলেছে। দেশভাগের দরুণ আমরা শুধু তাদের সাংস্কৃতিক গর্বের বাল ওপড়াবার জন্য নিশ্চিহ্ণ হয়ে চলেছি, ইসকি…। দণ্ডকারণ্যের দলিতরাও তাদের দলে আমাদের নিতে চায় না। আমরা ইতিহাসের গার্বেজ ডাম্প, ইসকি…।
সনাতন সরকার নিজের রোষকে সামাল দিয়েছে আঁচ করে অপু বলল, বাংলাদেশ কিন্তু দাঙ্গাবাজদের বিরুদ্ধে অ্যাকশান নিচ্ছে, এতকাল পরে হলেও নিচ্ছে। সেখানের জনসাধারণের মধ্যে থেকেই সরকারকে নাড়া দেয়া হচ্ছে, মৌলবাদী প্রতিষ্ঠানকে আক্রমণ করা হচ্ছে।
—কী রকম শুনি?
—শাহবাগে এককাট্টা হয়ে মেয়েরা পর্যন্ত প্রতিবাদে অংশ নিয়েছে, বোরখা পরে নয়, ওপনলি। আমাদের এখানে চুরাশির শিখ নিধন, নেলি গণহত্যা, গোধরার পর আহমেদাবাদের দাঙ্গা, কয়েকমাস আগে মুজফফরনগরে আর শ্যামলিতে যে দাঙ্গা হল, কই এখানে তো শাহবাগের মতন রাস্তার মোড়ে নামতে দেখা গেল না ছেলে-মেয়েদের।
—ওদের দেশে বিয়াল্লিশ বছর লেগেছে কাদের মোল্লাকে কাঠগড়ায় তুলতে, যে লোকটা শুধু মীরপুরেই সাড়ে তিনশ মানুষকে খুন করিয়েছিল। আসল শয়তান বাচ্চু রাজাকরটা আগেই পাকিস্তানে পালিয়েছিল, ইসকি…। তুই আমার তর্কটাকে অন্য দিকে নিয়ে যাচ্ছিস। আমাদের এখানে যতই দাঙ্গা হোক না কেন, আমরা কাউকে পাকিস্তানে বা বাংলাদেশে তাড়া করে নিয়ে যাই না। আমাদের কোনো রাজাকরের ইকুইভ্যালেন্ট নেই। রাজাকর কাদের বলে জানিস?
—ধার্মিক স্বেচ্ছাসেবকদের। যতদূর জানি হায়দ্রাবাদের নিজামের টাকায় তৈরি মিলিশিয়া।
—আবে ঘড়িয়ালকে চামড়া, তর্ক চলছে পূর্ব পাকিস্তান আর নিম্নবর্ণের বাঙালি নিয়ে, তুই তার মধ্যে নিয়ে এলি হায়দ্রাবাদ। রাজাকার হল খুনি মিলিশিয়া, যাদের অর্ডিনান্সের মাধ্যমে জন্ম দিয়েছিল টিক্কা খান, ইসকি…। পূর্ব পাকিস্তানে, আই মিন বাংলাদেশে, তুই ঘরে-ঘরে রাজাকার পাবি। পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, হিমালয়ের তরাই, আন্দামান এমনকি দণ্ডকারণ্যেও বাঙালিদের মধ্যে তুই অমন জাতকসাই পাবি না। আমাদের এখানে সরকার কোনো দিনই ধর্মান্ধ মিলিশিয়া তৈরি করবে না, আমরা দেবো না তৈরি করতে, গৃহযুদ্ধ বেধে যাবে, ব্লাডি সিভিল ওয়র। হুমায়ুন আজাদের নাম শুনেছিস?
—হ্যাঁ, আমার বাবা হুমায়ুন আহমেদের অনেক বড়ো ফ্যান। যে গংগোতা বাংলাদেশ-ইনডিয়া সীমার ব্যবসা দেখভাল করে আর থার্মোকোল আইসবক্সে বাবার জন্যে ইলিশ আনে, শুঁটকি-মাছ আনে, সে বাবাকে বইপত্র এনে দ্যায়। ইলিশ-টিলিশ বাবা নিজেই রাঁধেন।
সনাতন সরকার, স্তম্ভিত, অপুর মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, আবে, তেলচাট্টা ঘাসলেট, আমি একজন ভাবুকের কথা বলছি, পাল্প ফিকশান রাইটারের কথা বলছি না। হুমায়ুন আজাদকে পাক সার জমিন সাদ বাদ নামে একটা বই লেখার জন্য রাজাকাররা খচাখচ-খচাখচ ছুরি-ছোরা-চপার মারার কিছুদিন পর উনি মারা যান। যাকগে, তোর মতন অ্যায়রা-গ্যায়রা নাৎথু-খায়রাকে এসব বলে কোনো লাভ নেই; কী জানতে চাইছিলিস যেন?
—এমন লেকচার দিলেন যে যা বলতে চাইছিলুম, তা-ই ভুলে গেলুম। গালাগালের তোড়ে ভেসে গেলুম।